শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -৩০+৩১

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩০ (রিভেল)

যখন ইফতি ও নীরা রেস্টুরেন্টে ঢুকে তখন তানজিনা ও নীরা একে অপরকে দেখে থমকে যায়। ইফতি নীরার ডান হাত ধরে রেস্টুরেন্টের ভিতরে বুক করা টেবিলে নিয়ে যাচ্ছে আর নীরা ভাবছে,
নীরা: তানজিনা আপু এখানে? মানে ডাক্তার আরিফের সাথে তানজিনা আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর এই ডাক্তার আরিফের জন্যই তানজিনা আপু মিহাল ভাইয়াকে বিয়ের পরেও মানতে পারেনি আর ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। যাক যা হয়েছে ভালই হয়েছে আমার আপু তো ভালো থাকতে পারছে এটাই অনেক। যে যার যার জীবনে ভালো আছে।

আর এদিকে তানজিনা ভাবছে,
তানজিনা: নীরা! নীরাই ডাক্তার ইফতির ওয়াইফ! তারমানে ডাক্তার ইফতির প্রথমে তূরের উপর ক্রাশ ছিল তারপর তূর বিবাহিত জেনে নীরাকে ভালো লাগা শুরু হয় এরপর ভালোবেসে বিয়ে করে। তূরের অপারেশন হয়েছে এক বছর আগে আর সে সময় তূর অপারেশনের তিনদিন আগে বিয়ে করেছে কিন্তু কাকে? মিহালের সাথে তো দুই মাস আগে বিয়ে হলো, তাহলে তূরের প্রথম স্বামী কে? ইনু তো আমাকে তূরের যে এর আগে বিয়ে হয়েছে এরকম কিছু বলল না। তূর তো মিহালকে অনেক ভালোবাসে তাহলে অন্য কাউকে বিয়ে করেছিল কেন? তূরের সাথে কি ওর প্রথম স্বামীর ডিভোর্স হয়েছে? ডিভোর্স যদি না হয়ে থাকে তাহলে তূর যে আবার বিয়ে করলো সেটা তে ঝামেলা হওয়ার কথা। উফ! কিছুই বুঝতে পারছি না নীরাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কৌশলে।

ইফতি ও নীরা এসে টেবিলের কাছে দাড়ালো আর তানজিনা ও আরিফ তারাও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। আরিফ ও ইফতি একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে দুজনে দুজনের পিঠ চাঁপড়ে যে যার যার চেয়ারে বসে। ইফতি নীরাকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,

ইফতি: নীরা, ও হচ্ছে আরিফ আমার বন্ধু আর উনি হচ্ছে তানজিনা আমার বন্ধুর ফিয়ন্সে।
নীরা: হ্যালো আপু! হ্যালো ভাইয়া!

আরিফ: হ্যালো।
তানজিনা: হ্যালো, বিয়ে যে করলা জানতেও পারলাম না নীরা।

তানজিনার এইকথা শুনে আরিফ ও ইফতি অবাক হয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয়,
নীরা: শুধু পারিবারিকভাবে ও কিছু আত্মীয় স্বজন নিয়ে আকদ ও কাবিন হয়েছে। তূর আপু দেশে ফিরলে দুই বোনকে একসাথে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হবে।

আরিফ অবাক হয়ে বলে,
আরিফ: মেহেবিন, তুমি ভাবি কে চেনো?
ইফতি: তাই তো! নীরা, তুমি যে ভাবি কে চিনো আগেতো বলোনি!

নীরা মনে মনে ভাবে, ” আগে জানলে এখানে আসতামও না।”

তানজিনা: হ্যাঁ, নীরা আমার ফ্রেন্ড তূরের বোন।
নীরা: তানজিনা আপুকে আমি আগে থেকেই চিনি সে আপু ও ভাইয়ার (মিহাল) ফ্রেন্ড।

ইফতি নীরার কথা শুনে গোল গোল চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবতেও পারছে না এই সেই তানজিনা যাকে তূরের হাসবেন্ড একসময় ভালোবেসে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে বিয়ে করেছিল এরপর ডিভোর্স হয়ে যায় আই ডিভোর্সের আগেই তূরের সাথে মিহালের বিয়ে হয়েছিল। সেই তানজিনা তার বন্ধুর হবু বউ! তার বন্ধু কি জানে যে তার হবু বউয়ের এর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল! হোক সেটা শুধু রেজিস্ট্রি বিয়ে তো হয়েছিল!

আরিফের ডাকে ইফতির ঘোর কাটে।
আরিফ: কিরে কি খাবি অর্ডার দে আর ভাবীকেও বল কি খাবে অর্ডার দিতে। ভুলে যাস না আজকের ট্রিট কিন্তু তুই দিবি তোর বিয়ে উপলক্ষে, আমার ট্রিট আমি পরে দিবো।

ওরা চারজন খাবারের জন্য কিছু অর্ডার করে।
আরিফ: ভালোই হয়েছে বল আমাদের দুজনের বউই পর্ব পরিচিত। তবে নীরা যদি মেহেবিনের বান্ধবী হতো আরো ভালো হতো।

ইফতি: সেটা ঠিক। তাহলে দুই বন্ধু দুই বান্ধবী সুন্দর মিলে যেতো।
কথা গুলো বলে আরিফ ও ইফতি হাসতে থাকে।

তানজিনার মাথায় এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে তূরের এক বছর আগের বিয়েটার কথা! কার সাথে এক বছর আগে তূরের বিয়ে হয়েছিল আর এরপর আবার মিহাল কেই বা কেন বিয়ে করল? এত এত প্রশ্ন চেপে রাখতে না পেরে তানজিনা নীরাকে জিজ্ঞাসা করে,

তানজিনা: আচ্ছা নীরা আরিফের কাছ থেকে শুনলাম তূরের নাকি এক বছর আগে ওর সার্জারির আগে বিয়ে হয়েছিল? এটা কি সত্যি? তাহলে দুই মাস আগে যে মিহালের সাথে বিয়ে হলো সেটা!

প্রশ্নটা শুনেই আরিফ ও ইফতির হাসি থেমে যায়। ইফতি ও নীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে কি জবাব দিবে সেটা ভাবছে। এরই মধ্যে আরিফ বলে ওঠে,

আরিফ: কি বলছ মেহবিন তুমি এসব! নীরার বোনের এক বছর আগে যার সাথে বিয়ে হয়েছিল দুই মাস আগেও প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন তার সাথেই বিয়ে হয়েছে। ওদের দুজনের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর জন্য ইফতি ও নীরার বিয়েটা এতদিন পিছিয়ে ছিল ফাইনালি ওদের বিবাহ বার্ষিকীর এক মাসের বেশি সময় পর ইফতি ও নীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। না হলে তো ইফতি ও নীরার বিয়েটা ছয় মাস ধরে পিছিয়ে যেতো না। নীরার বাবার ইচ্ছা দুই মেয়েকে একসাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে তাই এখনো অনুষ্ঠান করে নি।

তানজিনা এবার বুঝতে পারে কেনো মিহাল ঐদিন তাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে জানতে চেয়েছিল যে সে (তানজিনা) কি চায়? আর কেন এরকম বিহেভিয়ার করছে, সম্পর্কটাকে কি টিকিয়ে রাখতে চায় না? আর কেনইবা মিহাল সব কিছু রেকর্ড করে রেখেছিল! কারণ মিহাল তো আগেই প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছে।
এগুলো ভাবছে আর মনে মনে তার (তানজিনা) রাগ হচ্ছে কারণ মিহাল তাকে ধোঁকা দিয়েছে।

সেদিনের মত সবাই খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা দিয়ে যার যার বাড়ির পথে চলে যায়।
_________

তানজিনা বাড়ি গিয়ে ইনায়াকে ফোন দিয়ে এসব কথা বলে। সবশুনে ইনায়া তূরকে ড্রইংরুমে ডাকে। তূরের সাথে সাথে সবাই এসে জড়ো হয়। ইনায়া রেগে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

ইনায়া: এসব কি তূর? তুই মিহাল কে আরো এক বছর আগে বিয়ে করেছিস তাও তানজিনা ওর স্ত্রী জানা সত্ত্বেও! কিভাবে পারলি নিজের বান্ধবীর স্বামীকে এভাবে বিয়ে করতে? লজ্জা লাগলো না বান্ধবীর ঘর ভাঙতে? এই তোদের মত মেয়ের জন্যই এখনকার স্ত্রীরা স্বামীর দ্বারা অবহেলিত হয় আর স্বামীরা তোদের মেয়ের সাথে পরকীয়ায় জড়ায় যায়। তুই কি বুঝতে পারছিস তুই একটা মেয়ের ঘর ভেঙেছিস! আর সেই মেয়ের ঘর ভেঙ্গে নিজের ঘর জোড়া লাগাইছিস। শুধু নিজের একতরফা ভালোবাসার জন্য এরকমটা করলি তুই? মিহাল কি তখন তোকে ভালোবাসত! না, মিহাল তখন তোকে ভালবাসত না কিন্তু তুই ঠিকই ওকে তোর নিজের জালে ফাঁসিয়ে ফেললি!

তূরের কাছে ইনায়ার কথা গুলো যেনো তীরের মত বুকে বিধেছে। আট সপ্তাহ শেষ হলো ওর প্রেগনেন্সির। প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাস অনেক ক্রিটিকাল। এ সময় গর্ভবতী মায়ের মন ও স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।

মিহাল এগুলো শুনে হাত শক্ত করে মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দিয়ে তার যেনো অগ্নি বের হচ্ছে।
তূরকে নিয়ে বাজে কথা শুনে ওখানে উপস্থিত সকলের রাগে ফেটে পরার মতো অবস্থা। রাগে ফেটে পড়ার মত অবস্থা

রাফি ইনায়ার হাত শক্ত করে ধরে নিজের রুমে টানতে টানতে নিয়ে যায় আর ইনায়া মুখ দিয়ে যা আসছে তূরকে বলেই যাচ্ছে।

রাফি ইনায়াকে নিয়ে চলে যাবার পর তবর কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরে। ফাইজা, লিরা ও জারিন এসে ওর দুই পাশে বসে। তূর ফাইজাকে জড়িয়ে ধরে হিঁচকি তুলে কাদছে। তূরের কাছে এখন সেই প্রথমদিন যেদিন জানতে পারলো মিহালের তানজিনার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে সেই রকম অনুভূতি হচ্ছে। তূর কাঁদতে কাঁদতে ফাইজার জামা ভিজিয়ে ফেলছে লিরা ও জারিন পাশ থেকে ওকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

অর্ক তো রাগে বোম হয়ে আছে। ইনায়ার মত একতরফা দিক বিবেচনা করা মেয়ে ও আর আরেকটা দেখেনি। রনক ও তাইজুল ওকে মাথা ঠান্ডা করতে বলছে।

মিহাল সেই যে রাগে হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মিহালের আজকে ইচ্ছা করছে বলতে, ” কেন আমি সুখে থাকলেই তোমার সহ্য হয়না তানজিনা! তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড যেই মেয়েটাকে আজকে চরিত্রহীন বলে গেল সেই মেয়েটার জন্যই আজকে আমি হাসি খুশি আছি। তূর যদি আমাকে ওইদিন বিয়ে না করতো আমি হয়তো ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম।

রিজভীর ধাক্কায় মিহাল বাস্তবে ফিরে। রিজভী চোখের ইশারায় তূরকে দেখায়। মিহাল সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে, দৌড়ে তূরের সামনে গিয়ে হাঁটু মুরে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে তূরের মাথায় স্পর্শ করে। তূর তখনো ফাইজার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে তূর মাথা তুলে তাকায়। তূরের তাকানো দেখে মিহাল নিজের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে তূরকে ডাকছে। তূর ঝাঁপিয়ে পড়ে মিহালের বুকে। এখন তূরের হেঁচকির শব্দ আরো বেড়ে গেছে।

প্রায় অনেকক্ষণ কাঁদার পর মিহালের কথায় আস্তে আস্তে শান্ত হয় তূর। লিরা পানি নিয়ে আসে আর ফাইজা ও জারিন কিছু ফ্রুট ও খাবার আনতে গেছে। তূর পানিটা খেয়ে শান্ত হয়ে বসে। মিহাল তূরকে এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে।

ফাইজা ও জারিন খাবার আনার পর তূর খেতে চাইছে না, মিহাল অনেক জোর করে কিছু ফ্রুট খাওয়াতে পারল তারপর ওকে নিয়ে রুমে চলে গেল।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩১ ( মুখোমুখি)

রাফি ইনায়াকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর রাফি রেগে বলে,
রাফি: এসব তামাশা করার মানে কি? যা হবার সেটা হয়ে গেছে। তুমি কেন অতীত মানতে পারছ না? তোমার বান্ধবী কি এখন কান্না করে করে মরে যাচ্ছে? তোমার বান্ধবী তো দিব্যি সুখে আছে ওর তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাহলে এখন কেন এত তামাশা করে তুমি নিজেকে আমাদের সামনে ছোট করছো?

রাফির কথা শুনে ইনায়া আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,

ইনায়া: আমি তামাশা করছি তাই না! তামাশা তো তোমরা করেছো। একবারও কি ভেবে দেখেছো এর পরিণাম কি হতে পারতো? আমার তো মনে হচ্ছে তোমরা তানজিনার সাথে ডিভোর্সের অপেক্ষাই করছিলে যাতে তূর মিহালের সাথে ভালো সংসার করতে পারে। আচ্ছা মিহাল কি তূরের জালে ফেঁসে তানজিনাকে ডিভোর্স দিয়েছে? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। যেখানে মিহাল সবসময় জানতো তানজিনা ওকে ভালোবাসে না তাও সে তানজিনাকে বিয়ে করেছে আর বিয়ের পর তানজিনার করা একটু অবহেলা তেই সে একদম তার বিমুখ হয়ে গেল! ব্যাপারটা তো এটাই দাঁড়াচ্ছে তাই না তোমার বান্ধবী মিহাল কে ফাঁসিয়েছে। যদি তানজিনা ঐদিন ডিভোর্সের কথাগুলো না বলতো তাহলেতো মিহাল দুই বউ নিয়ে সংসার করত একদিকে একটা আরেকদিকে আরেকটা! অবশ্য মিহালের সাথে তানজিনার ডিভোর্স কনফার্ম হওয়ার আগেই তো মিহাল তূর এখানে চলে এসেছে তাহলে তো এটাই দাড়াচ্ছে যে ওরা দুজন মিলে তানজিনাকে ধোকা দিত। প্রথম দিনেই মিহালের তূরের দিকে মায়া ও ঘোর লাগা চাহনি দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল আর তুমি আমার সন্দেহ টাকে একদম পাত্তা দাওনি তখন কি জানতাম যে এসবের মধ্যে তোমাদেরও কারসাজি আছে?
তূর ওদের দুজনের মধ্য তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকেছে যার কারণে ওদের বিচ্ছেদ হয়েছে। কেমন খারাপ একটা মেয়ে তূর তুমি ভেবে দেখেছ?

রাফি কথা গুলো শুনছিলো আর দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিল। আর সহ্য করতে না পেরে বলে ওঠে,

রাফি: এই মেয়ে চুপ! যা বলছিস একবার বিবেচনা করে বলছিস তুই? সব দোষ তূরের তাইনা তোর বান্ধবীর কোন দোষ নেই! কোন পরিস্থিতিতে ওদের বিয়ে হয়েছে তা তুই জানিস? মিহাল তানজিনাকে ফোন করেছিল অনুমতি নেওয়ার জন্য কিন্তু তানজিনা যা করল আর এর আগে যা করে এসেছিল এর জন্যই মিহাল ঐদিন বিয়েটা করে আর তূর ছিল মৃত্যুশয্যায়। তানজিনার সাথে যদি মিহালের ডিভোর্স না হতো তাহলে তূর কখনোই মিহালকে নিজের দিকে টানতো না কারণ তূর মিহালকে সেই শর্তেই বিয়ে করেছে। যদি তানজিনার সাথে ডিভোর্সের আগে ওদের (তূর ও মিহাল) মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়ে যেত আর তূর প্রেগনেন্ট হয়ে যেতো তাহলেও তূর তানজিনা বা তার পরিবারকে জানতে দিতো না যে বাচ্চাটা মিহালের যতদিন না মিহাল ও তানজিনা সম্পর্কে আছে।
আরেকটা কথা তূর আগে থেকেই জানতো তানজিনা মিহালের মধ্যে বনিবনা হবে না কারন বিয়ের আগেই অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়েই তূর বিয়ে করতে মিহালকে বলেছে।
ঐদিন যদি ওদের বিয়ে না হতো তাহলে মিহাল তানজিনার সাথে ডিভোর্স এর পর কবে বিয়ে করতো বা আদৌ বিয়ে করতো কিনা তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না।

ইনায়া: যাই বলো না কেন তুমি তোমার বান্ধবীর দোষ ঢাকতে পারবে না এই দিয়ে। তানজিনা তো বেঁচে গেছে মিহালের সাথে ডিভোর্স হওয়ার কারণে না হলে ওর জীবনটা নরকে পূর্ণ হতো কারন ওর স্বামীতো তখন অন্য নারীতে মঝে থাকতো।

রাফি ইনায়ার গায়ে হাত তুলতে নিয়েও নিজেকে সংযত করে চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। ইনায়া যখন দেখল রাফি মারার জন্য হাত তুলেছে তখন ইনায়া আরো রেগে গিয়ে বলে,

ইনায়া: এখন তুমি ঐ মেয়েটার জন্য তোমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবে? ভুলে যেওনা আমি তোমার স্ত্রী আর ওই মেয়েটা জাস্ট তোমার ফ্রেন্ড।

রাফি চোখ বন্ধ অবস্থায় জবাব দেয়,
রাফি: উহুম! তুমি ভুল বললে ও শুধু আমার ফ্রেন্ড না আমার ফ্রেন্ড এর থেকেও বেশি কিছু। ও আমার..

রাফিকে বলতে না দিয়েই ইনায়া বলে,
ইনায়া: কি বলবে তূর তোমার বোন! জাস্ট পাতানো বোন! আপন বোন তো আর না। এরকম কত দেখেছি ভাই বোন বানিয়ে পরে ঠিক অন্য কিছু বের হয়!

এই কথা শুনে রাফির হাত অটোমেটিক ইনায়ার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়! রাফি নিজের রাগ আর কন্ট্রোল করতে না পেরে কাজটা করে ফেলে। ইনায়া গালে হাত দিয়ে হতভম্ব চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে আছে।

ইনায়া: তুমি আমাকে মারলে!
রাফি: হ্যাঁ, মারলাম। এই থাপ্পরটা তোকে আরো আগে দেওয়া দরকার ছিল। আমি ভেবেছিলাম তুই অন্তত তানজিনার মতো না কিন্তু আমি এটা ভুলে গিয়েছিলাম, ” রতনে রতন চেনে!” তুই নিজের বান্ধবীর দোষ ঢাকার জন্য একটা প্রেগনেন্ট মেয়েকে খারাপ অপবাদ দিয়ে দিলি। একবারও চিন্তা করেছিস প্রেগনেন্ট মেয়েটার এই অবস্থায় এগুলো শুনে কি অবস্থা হবে?
আর এখন তুই আমাকেও বলছিস! ওকে নিয়ে খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছিস। মনে রাখিস,
” মুখ থেকে বের হওয়া কথা ও ধনুুক থেকে বের হওয়ার তীর কোনটাই ঠেকানো যায়না।”
এরপর থেকে নিজের মুখ সামলিয়ে কথা বলবি।

কথাগুলো বলে রাফি দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।
_________
মিহাল রুমে এসে তূরকে বিছানায় বসিয়ে নিজে ফ্লোরে বসে। তূরের হাত দুটি মুঠো করে সেখানে আলতো ঠোটের স্পর্শ দেয় এরপর তূরের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দেয় আর এই পুরোটা সময় তূর ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। মিহাল তূরের পেটের উপর থেকে জামার সরিয়ে সেখানে চুমো দিয়ে অনাগত বাচ্চার উদ্দেশ্যে বলে,

মিহাল: সরি বেবি, তোমার বাবার জন্যই তোমার মাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে। তোমার বাবার করা ভুলের জন্য আজ তোমার মাকে এত পীড়াদায়ক কথা শুনতে হয়েছে। তোমার মায়ের সব কষ্টের মূলে আমি। মাফ করে দিও বাবাকে সোনা। তোমার মায়ের জীবনে আমি কষ্ট ছাড়া সুখ চিরস্থায়ী করতে পারেনি।
এগুলো বলে তূরের পেটে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে মিহাল আর চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পরে দুই ফোঁটা পানি।

——
কেটে গেছে আরও তিন সপ্তাহ, আর একমাস পর তানজিনা ও আরিফের বিয়ে হবে তাই তারা আজকে হসপিটালে বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে। বিয়ের দুই সপ্তাহ আগে আনুষ্ঠানিক এনগেজমেন্ট হবে, অবশ্য ওদের মধ্যে আংটি বদল আগেই হয়ে গেছে তাও সেটাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য বিয়ের এক সপ্তাহ আগে এঙ্গেজমেন্ট সিরেমনি করবে।

এই তিন সপ্তাহ ইনায়া রাফির ভয়ে চুপ থাকলেও চোখ দিয়ে ঠিকই তূরকে মানসিক কষ্ট দিয়ে যেতো।
তূর তো এমনিই কিছু খেতে পারে না প্রচুর বমি হয়। টুকটাক ফলমূল খেতে পারে কিন্তু খাওয়ার মাঝে বমি আসার লক্ষণ দেখলে খাওয়া থামিয়ে দিতে হয় আর হুটহাট যেকোনো সময় বমি আসে। কিন্তু আর কিছু খেতে পারুক বা না পারুক আইসক্রিম ও চকলেট জাতীয় খাবার গুলো ঠিক খেতে পারে তাই ওকে ফলের কাস্টার্ড, সালাদ এগুলো বানিয়ে দেওয়ার সময় সাথে আইসক্রিম দিয়ে দেয় যাতে ফ্লেভারে ফ্লেভারে খেয়ে ফেলে।
মাঝে মাঝে তূর নিজের ইচ্ছায় কোন কিছু বানায় তাও সেগুলো হয় নাশতা টাইপ! ভাত, মাছ, মাংস খেলেই বমি হয় তবে চিকেন ফ্রাই একটু একটু খেতে পারে বাকি সব হচ্ছে নুডুলস, কেক, আইসক্রিম, কাস্টার্ড, ফ্রুট সালাদ এগুলো খেয়ে থাকতে হয় তাও মাঝে মাঝে এগুলো খেলেও বমি হয়। বলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টায় চার-পাঁচ বার তো বমি করে।

এই অসুস্থ অবস্থায়ও সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে আর এক সপ্তাহ পর তিন মাস পূর্ণ হবে তখন ডাক্তারের কাছে জানতে চাইবে পেটের বাচ্চার কি অবস্থা।
_________
বিয়ের কার্ড দেয়ার তিনদিন পর হঠাৎ একদিন আরিফ তানজিনাকে একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলে। তানজিনাও খুশিমনে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়েই সম্মুখীন হয় একটা বড় সত্যের যা তানজিনা আরিফের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন।
রেস্টুরেন্টের কোনার দিকের একটা টেবিলে চুপ করে বসে আছে আরিফ মুখে তার কঠোর গাম্ভীর্যতা। তানজিনা পাশের চেয়ারে এসে বসার পর আরিফ বলে,

আরিফ: কেন লুকালে আমার থেকে এত বড় সত্য?

তানজিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তা দেখে আরিফ আবার বলে,
আরিফ: কেন বললে না যখন তোমাকে আমি প্রপোজ করেছিলাম ওই সময় তুমি বিবাহিতা ছিলে!

তানজিনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। তানজিনা ভাবছে,
তানজিনা: এই বিয়ের কথা তো আমার পরিবার ও মিহালের পরিবার ছাড়া আর কেউ জানে না। তাহলে কি মিহাল আরিফকে বলে দিয়েছে? সেদিন ইনু ফোন দিয়ে বলেছিল সে তূরকে অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছে যার দরুন রাফি ইনুকে থাপ্পর দিয়েছে। এই কারণেই কি মিহাল আরিফকে সবকিছু বলে দিলো! এখন যদি আমার আর আরিফের বিয়ের মধ্যে কোন ঝামেলা হয় তাহলে মিহাল তোমাকে আমি ছাড়বো না! আমি তো তোমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা আমার পরিবারকে জানাই নি এবার ঠিকই জানাবো। তুমি আমাকে বর্তমান রেখে আরেকটা বিয়ে করেছিলে তাই না এবার মজা বুঝবে।

আরিফের ডাকে তানজিনার হুঁশ আসে,
আরিফ: কি হলো কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? আমাকে তুমি জানাতে পারতে তুমি বিবাহিতা তাহলে আমি তোমার পথ থেকে চলে যেতাম।

কথাটা শুনে তানজিনার বুক ধক করে ওঠে। তানজিনা বলে,
তানজিনা: দেখো ওই বিয়েটা আমারো মত নিয়ে হয়নি। আমি বিয়েটা করতে চাইনি। আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে আর বিয়েটা শরীয়ত মোতাবেক হয়নি শুধু রেজিস্ট্রি হয়েছিল আর কিছুই না।

আরিফ: বুঝলাম তোমার কথা তাহলে আমাকে তুমি জানাতে পারতে। আর সেদিন হসপিটালে যাকে তুমি তোমার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিলে, সেটাই যে তোমার হাজবেন্ড ছিল সেটা তো তুমি আমাকে বলতে পারতে! তোমাকে আমি যখনই জিজ্ঞাসা করতাম তোমার লাইফে কেউ আছে কিনা? তুমি কারো সাথে সম্পর্কে আছো কিনা? তুমি বলতে না, তুমি সেটাকে কিছুনা কিছু বলে কাটিয়ে দিতে। সত্য কখনো চাপা থাকেনা তানজিনা সেটা একদিন না একদিন বের হয়।

আরিফের মুখ থেকে এই প্রথম “তানজিনা” নামটা শুনলে তানজিনা। সবসময় আরিফ থাকে “মেহবিন” নামে ডাকে। নিজেকে ধারস্থ করে তানজিনা বলে,
তানজিনা: যেই বিয়েটা আমি মানি না সেটা স্বীকৃতি দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি তাকে কখনই মানতে পারেনি এমনকি বিয়ের পর তার সাথে কখনো বউ সুলুভ আচরণ করিনি।

আরিফ: পছন্দ-অপছন্দ ফ্যাক্ট না। তোমার একবার বিয়ে হয়েছিল সেটা তুমি আমাকে জানানোর দরকার ছিল। যেখানে আমি তোমার ধর্ষণ হলেও তোমাকে আমি গ্রহণ করতাম সেখানে কি তুমি এইটুকু বিশ্বাস করে বলতে পারলে না! মানলাম তখন তোমার সাথে তার ডিভোর্সের কথাবাত্রা চলছিল। কিন্তু,,

আরিফকে থামিয়ে দিয়ে তানজিনা বলে,
তানজিনা: জানতে চাও না কার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল?

আরিফ: হ্যাঁ।
তানজিনা: মিহাল! ডাক্তার ইফতির বউয়ের বড় বোনের স্বামী। ওই মিহালের সাথেই আমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের ঠিক দুই মাসের মাথায় মিহাল তূরকে হাসপাতালে বিয়ে করলো আর সেটা আমি এক বছর দুই মাস পর জানতে পারলাম। অবশ্য আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে কিন্তু ভাবো যদি ডিভোর্স না হতো তাহলে?

মিহাল যে তানজিনার হাজবেন্ড ছিল এটা শুনে আরিফ হতভম্ব হয়ে যায়। তাও বলে,
আরিফ: তোমাদের দুজনের ডিভোর্সের আগে একে অপরের সাথে হওয়া প্রতিটা কথা আমি জানি তাই অন্তত এটা বলো না যে ডিভোর্সে মিহালের দোষটা বেশি বরংচ তোমার দোষটা বেশি তোমার খামখেয়ালিপনা, তোমার ওকে ইগনোর করা সবটা আমি জানি আর সেখানে হওয়া তোমার প্রতিটা কথাই স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তুমি এই সম্পর্কটা কোনোভাবেই চাচ্ছো না তাই তোমাদের ডিভোর্সটা শ্রেয় ছিল। তোমার ওকে একটুও ভালো না লাগলে রেজিস্ট্রি করতেও রাজি হওয়াটা তোমার উচিত ছিল না তুমি তোমার বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলতে পারতে। ছেলেটার কথা শুনে মনে হয়েছিল, সে মনের মাঝে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছে।

তানজিনা: কিসের কষ্ট চেপে রেখেছে হ্যাঁ? এতই যখন কষ্ট তাহলে আরেকটা বিয়ে করতে গিয়েছিল কেন?

আরিফ: তোমার কথা মত যদি তূর মিহালের ওয়াইফ হয় তাহলে তূর তখন মৃত্যুশয্যায় ছিল। আর তূরের বিয়েটা হয়েছে ওর সার্জারির তিনদিন আগে তারপর ও কোমাতে চলে যায়। আর ইফতি আমাকে এটা বলেছে, মিহাল পূর্ববর্তী কিছু হিসাব-নিকাশ ও পরিস্থিতি মেনে বিয়েটা করেছিল এবং ওদের বিয়েতে অনেক শর্ত ছিল। এগুলো সবই নীরার থেকে ইফতি জেনেছে।
কিন্তু জানো আমার কি মনে হয়, তোমার করা প্রতিনিয়ত অবহেলা, অসম্মান এসবই ছিল মিহালের পূর্বের হিসাব নিকাশ আর তূর নাকি অনেক আগে থেকেই মিহালকে ভালোবাসে তাই হয়তো মিহাল নিজে ভালোবাসা না পেয়ে একটা মৃত্যুশয্যায় থাকা মেয়ের ভালবাসা পূর্ণ করার জন্যই ওকে বিয়ে করেছিল।

তানজিনা আর কিছু শুনে ও না বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে চলে যায়।

চলবে,
আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার করছি সবার কাছে। তানজিনার শাস্তি হবে তবে অতো না যতটা ইনায়ার হবে।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক করা হয়নি। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। হ্যাপি রিডিং❤
চলবে,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক করা হয়নি। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। হ্যাপি রিডিং❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here