শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -৩২+৩৩

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩২ (পূর্বাভাস)

তানজিনা বাসায় যেতে যেতে ভাবতে থাকে কে জানাতে পারে তার বিয়ের কথা কিন্তু এত ভেবেও মিহালের পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে দোষী ভাবতে পারল না। বাসায় পৌঁছানোর পর সময় বুঝে ইনায়াকে ফোন করে সবকিছু বলে যা ইনায়ার রাগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
বন্ধুত্বের বন্ধনে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছে ইনায়া যে, কোনটা আংশিক আর কোনটা পুরোপুরি ঠিক সেটার ভেদাভেদ করতে পারছে না। কথায় আছে না,
“আংশিক সত্য একটা মিথ্যার থেকেও ভয়ঙ্কর!”

ঠিক তেমনি ইনায়া মানবিক দিক থেকে বিচার করছে না বিচার করছে একজন স্ত্রী হিসাবে। ইনায়া ভাবছে মিহাল তূরকে বিয়ে করে তানজিনাকে ধোঁকা দিয়েছে কারণ ইনায়া জানে না তানজিনার করা কাজ, যেটাকে তানজিনা সিনিয়রের প্রতি ভক্তি দেখিয়ে আগেপিছে ঘুরতো কাজ থাকলেও আর না থাকলেও! আর বিবাহিতা হয়েও অবিবাহিতা পরিচয় দেয়া, সেটা আসলে তার সিনিয়রের প্রতি থাকা সুপ্ত অনুভূতি যা তানজিনা আগে বুঝতে পারেনি কিন্তু এখন বুঝতে পারছে।
ইনায়ার সবসময় তানজিনা কে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করতো স্কুলে ও কলেজে। মাঝে মাঝে তানজিনার ক্ষতি হবে এমন ভুলগুলো ধরিয়ে দিতো যেমন, কলেজে থাকতে প্রাইভেট টিউটরের বাসায় তানজিনার করা মিহালকে অপমান! সেইদিন ইনায়া তানজিনাকে ভুলটা ঠিক করে দেওয়ার জন্যই তানজিনাকে মিহালের পক্ষে কিছু কথা বলেছিল কারণ ওই দিন সকালেই টিচারের সাথে একটা বড় রকমের হাঙ্গামা হয়ে গিয়েছিল।

মিহালের তানজিনাকে ডিভোর্স দেওয়া ও ডিভোর্সের আগে তূরকে বিয়ে করা এগুলো ইনায়ার কাছে জঘন্য লেগেছে কারন সে এটাতে তানজিনার প্রতি করা অন্যায় ভাবছে আর একজন স্ত্রী হিসেবে অন্য স্ত্রীর কষ্ট যেমন, ভালোবেসে বিয়ে করে সামান্য অবহেলার কারণে ছয় মাসের মাথায় ডিভোর্স দিয়ে দেওয়া, প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় তাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় জনকে বিয়ে করা, দ্বিতীয় জনকে বিয়ে করার পর প্রথম জনের করা অবহেলা গুলো মাথা চারা দিয়ে উঠায় সেটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়া।

এসবই ইনায়ার ভাবনা চিন্তা। সে মুদ্রার শুধু একটা পিঠ দেখছে অপর পিঠ দেখছে না। ইনায়া নিরপেক্ষ হয়ে বিবেচনা করছে না, সে একপাক্ষিক হয়ে বিবেচনা করছে। মোট কথা তানজিনা যা বলছে সেভাবেই কোনো বিবেচনা না করেই চলছে। কিন্তু তূর ও মিহালের বিয়ের দিন রাফির বুঝানো বা প্রেগনেন্সির নিউজ জানার দিন সব গুলোতেই ইনায়া ভালোই ছিলো কিন্তু তানজিনার বলা মিহালের তূরকে এক বছর আগে বিয়ে করা কথা গুলো আর বলার ধরন এসব ইনায়াকে নিরপেক্ষভাবে ভাবতে দিচ্ছে না! বলা যায় সে এখন ‘মেন্টালি কনফিউজড’ স্টেটে আছে।

( আমি ইনায়াকে ইচ্ছা করে খারাপ দেখিয়েছি কিনা সেটা এখন ক্লিয়ার করে দিলাম।)
_________

তানজিনার সাথে কথা বলার পর ইনায়ার মনে হলো তূর ও মিহালকে গিয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা কিন্তু রাফির সেদিনের দেওয়া থাপ্পড় এর কথা মনে পড়ে যায় তাই সে ভাবে, চিল্লাপাল্লা না করে আস্তে করে গিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করবে জবাব চাইবে যাতে আর কেউ টের না পায়।

মিহাল ও তূর নিজেদের রুমের পাশে গার্ডেনের সাথে দরজার কাছে বসে আছে। ইনায়াও বাংলোর সদর দরজা দিয়ে না বের হয়ে তার রুমের গার্ডেনের সাথে দরজা দিয়ে বের হয়েছে গার্ডেনে। ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় ইনায়া। হঠাৎ করে ইনায়াকে দেখে ওরা দুজনেই অবাক হয় পরে তূর ইনায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি ঘৃণা দেখে চোখ নামিয়ে নেয়, ওর আর এসব মানসিক যন্ত্রণা ভালো লাগছে না এই সময়ে। প্রেগন্যান্সির সময়টা হাসিখুশি থাকতে হয় আর সেখানে ও কিনা কারো অহেতুক ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকছে।

ইনায়া ওদের চিন্তা ভাবনার তোয়াক্কা না করে বলে,
ইনায়া: মিহাল, কাজটা কি তুমি ঠিক করলে?

মিহাল কিছুই বুঝে পায়না তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সাথে তূরও।

ইনায়া: ডাক্তার আরিফকে কেন তোমাদের (মিহাল ও তানজিনার) বিয়ে ও ডিভোর্সের কথা টা জানালে? নিজে তো দিব্যি ভালো আছো কাউকে ধোঁকা দিয়ে আর এখন যখন সে একটু সুখের মুখোমুখি হলো তখনই তার সুখ টাকে কেড়ে নিতে চাইছো।

মিহাল ও তূর কথা গুলো শুনে ওদের অবস্থা এমন যে, কে কার সুখ কেড়ে নিতে চাইছে আর কে কাকে দোষারোপ করছে!

ইনায়া: কি হলো চুপ কেন? তুমি কি ভেবেছ, তুমি পার পেয়ে যাবে? কখনোই নয়! তানজিনা আসছে এবং তানজিনা তার পরিবারকে বলে দিয়েছে তোমার দ্বিতীয় বিয়ে করা প্রথম বউ বর্তমান থাকা অবস্থায়।

কথাগুলো বলে আর কথা না বাড়িয়ে ইনায়া সেখান থেকে চলে যায়। তূর মিহালকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে আর বলে,

তূর: কেন এমন হচ্ছে বলতে পারো? আমার জীবনের সুখ হয়তো আমার ভাগ্যেরেই সহ্য হয় না। এই পরিবেশে আমি আমার বাচ্চাকে কিভাবে জন্ম দিবো! যেখানে সে পেটে থাকা অবস্থায় তার মায়ের প্রতি ঘৃণা ভরপুর কারো মনে।

মিহাল তূরকে নিজের সাথে শক্ত করে ধরে রেখে কান্না করতে মানা করছে।

তানজিনার পরিবার এগুলো জেনে মিহালের পরিবারের সাথে ঝামেলা করতে যায়। তখন মিহালের দুলাভাই ওদের ভালোমতো বুঝায় যে, “তানজিনার সাথে ডিভোর্স তানজিনার দোষেই হয়েছে আর্তুর এর সাথে বিয়ের পরেই তূর কোমাতে চলে গিয়েছিল। তানজিনা যে ডিভোর্সের পর অখুশি ছিল এমন তো না। তানজিনা তার নিজের লাইফে মুভ অন করার পরেই মিহালকে ডিভোর্স কনফার্ম করেছে তাই মিহাল আগে কয়টা বিয়ে করলো না করলো সেইটা আপনাদের দেখার বিষয় না কারন তানজিনার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন মিহাল তানজিনাকে কোন রকম কষ্ট দেয়নি আর যদি বলেন ধোঁকা তাহলে সেটা তানজিনা আগে দেওয়া শুরু করেছে এরপর তো ওরা দুজন দুজনের মনোমালিন্যের কারণে একে অপরের মুভ অন করার ব্যাপারে না জেনেই ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। তাই এটাকে আর আগে বাড়াবেন না। আমরা শিওরিটি দিয়ে বলতে পারি মিহাল ডাক্তার আরিফকে ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু জানায়নি আর জানিয়ে বা ওর লাভ কি?”

কথাগুলো শুনে তানজিনার পরিবার দমে যায়, তারা আর কথা আগে বাড়ায় না। কিন্তু তানজিনা মনে মনে এটা ভেবেই নিয়েছে মিহাল এই কথাগুলো লাগিয়েছে নাহলে আর কে লাগাবে! তাই সে পরের সপ্তাহে আমেরিকার যাবে মিহালের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে।
এদিকে আরিফ বিয়েটা আপাতত পেন্ডিং এ রেখেছে। এটাও একটা বড় কারণ তানজিনার রেগে যাওয়া।

মিহালের দুলাভাই মিহালকে তানজিনার পরিবারের সাথে কি কথা হয়েছে সেগুলো জানায় সাথে এটাও জানায় এখন তানজিনার বিয়েটা পেন্ডিং আছে। তানজিনার বিয়েটা পেন্ডিং এ আছে এটা শুনে মিহালের খারাপ লাগে। মিহাল তো চায়নি তানজিনার সাথে এটা হোক।

তূর যখন মিহালকে জিজ্ঞাসা করে কি কথা হয়েছে তখন মিহাল বলে,

মিহাল: দুলাভাই সবাইকে সবকিছু বুঝিয়ে সুজিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে কিন্তু তানজিনার বিয়েটা এখন পেন্ডিং আছে। ডাক্তার আরিফ বিয়েটা পেন্ডিং রেখেছে। আমার তানজিনার জন্য খারাপ লাগছে। আমি চাইনি তানজিনার সাথে এরকম কিছু হোক কারন আমি তাকে ভালোবাসতাম আর সে আমায় ভালোবাসতো না এতে তার দোষ নেই। এটা ঠিক তানজিনা বিয়ের পর আমার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে কিন্তু দেখো ওর করা খারাপ আচরণের জন্যই আমি তোমার ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছি। তানজিনা যেহেতু তার নিজের জীবনের সুখ বেছে নিয়েছিল তাহলে আমি কেন চাইবো তার খারাপ হোক। বরংচ আমার কারনে আজকে তানজিনা যাকে ভালোবাসে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার সাথে তার বিয়ে, ডিভোর্স এগুলোর কারণেই তো এসব হচ্ছে এখন। আমার সত্যি খারাপ লাগছে, নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।

—-মিহালের বলা প্রতিটা কথা স্বাভাবিক থাকলেও তূরের কাছে তা স্বাভাবিক লাগেনি। তূর কষ্ট পেয়েছে এই ভেবে যে, মিহালের মনে আবার তানজিনার জন্য সহানুভূতি জন্ম নিচ্ছে! তাহলে কি আবার ওর কাছ থেকে ওর ভালোবাসার সুখ পাখিটা চলে যাবে!
এসব কথা তূর ভাবছে কারণ এই সময় প্রচুর মুড সুয়িং হয়। কারো কথা স্বাভাবিক থাকলেও মাঝে মাঝে সেটাকে অস্বাভাবিক লাগে।
_________
আজ এই সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা আর তূরেরও তিনমাস পূর্ণ হয়েছে প্রেগনেন্সির।

মিহালের বলা ঐদিন স্বাভাবিক কথাবাত্রা তূরের খারাপ লাগে এরপর থেকে তূরের মন কিছুটা আরো খারাপ হয়ে থাকে।
তূরের মাঝে মাঝে মনে হয়, সে কি কারো জীবনে বোঝা হয়ে আছে? সে কি অনেক খারাপ? যার কারণে সাত বছর ধরে একসাথে পড়াশোনা করার পরেও ইনুর মনে ওর জন্য তিক্ত ধারণা! সে কি আসলেই তানজিনার সংসার ভেঙেছে?
এসব চিন্তা ভাবনা তূরকে ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট দিচ্ছে আরে এসব কষ্ট সে মিহাল কেও বুঝতে দিচ্ছে না।

আজকে শেষ পরিক্ষা আর আজকেই তানজিনা আমেরিকায় এসে ওদের মুখোমুখি হয়েছে। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসেই তাদের কথাবার্তা চলছে।

তানজিনা: তূর, তুই কেমন বান্ধবী রে? বুঝলাম তুই মিহালকে ভালবাসিস কিন্তু যখন তুই মিহালকে বিয়ে করলি তখন কিন্তু আমি মিহালের স্ত্রী ছিলাম। ভালবাসতাম না ঠিক আছে কিন্তু মিহাল তো বাসতো! যদি আমাদের দুজনের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যেত তাহলে কি তুই আমাদের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতি না! তখন তুই বান্ধবী হয়ে নিজের বান্ধবীর ঘর ভাঙতি? এত নিচে নেমে গেছে তোর চিন্তাভাবনা?

কথাগুলো শুনে সবাই রেগে আছে কিন্তু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারণ তারা পুরো কথা শুনতে চায় তারপর প্রতিউত্তর করবে। রণক, জারিন, ফাইজা, শাফকাত, নাদিয়া, আসফি, তাওহিদ, তাইজুল ও ভিনদেশী বন্ধুরা ছাড়া সবাই আছে।

মিহাল তূরের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে দুহাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। আর অর্ক তো ইতিমধ্যে কিছু বলার জন্য তেড়ে যেতে নিয়েছিল কিন্তু রিজভী ওকে ধরে থামিয়েছে। রাফিও সব শুনে প্রতিউত্তর করার অপেক্ষায় আছে।

তূর তানজিনার কথায় অশ্রুসজল চোখে মিহালের দিকে তাকায় কিন্তু মিহাল মাথা নিচু করে রাখায় মিহালের মুখশ্রীর ভাবগতি দেখতে ও বুঝতে পারছেনা। এতে তূরের আরো গভীর অভিমান হয়। তূর আর সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে দ্রুতপদে প্রস্থান করে বাহিরের দিকে। তূরের যাওয়া দেখে মিহাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কারণ সে মনে মনে চাচ্ছিল তূর এখান থেকে সরে যাক! কারণ এখন ওরা তানজিনাকে যা জবাব দিবে তার প্রতিউত্তরে তানজিনা তূরকেই বাজে কথা শুনাবে। তূরের পিছু পিছু আরেকজন সেখান থেকে সটকে পরে।

সেসময় সেখানে ডাক্তার আরিফ উপস্থিত হয়। তানজিনা আরিফকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে ভাবতেও পারেনি আরিফ আমেরিকায় আসবে!
এতক্ষণ তানজিনা মনে মনে যা ভেবে রেখেছিল বলবে সেগুলো এখন তার মুখেই রয়ে যাচ্ছে কারণ আরিফের সামনে সে সেগুলো বলতে চায় না।
সত্যি বলতে তানজিনা এখন আরিফের সাকসেসকে না আরিফকে ভালোবাসে, যতোটা ভালবাসলে হারানোর ভয় থাকে ঠিক ততোটা।

ওদের মাঝে এখন উভয় পক্ষেরই বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। মিহাল তানজিনাকে সব কিছু এতদম পাই টু পাই বলে যাচ্ছে। তানজিনার করা সেই কলেজ থেকে অপমান, নিচু দেখানো, বিয়ে, অবহেলা, রুড ব্যাবহার সব কিছু বলছে।

আরিফ স্বীকার করে মিহাল তাকে বিয়ে ও ডিভোর্সের কথা বলেনি বলেছে একটা মেয়ে যে কিনা ওদের হসপিটালে তানজিনার ব্যাচের। সেই মেয়েটা হচ্ছে তানজিনার ভাবির চাচাতো বোন!

তানজিনার সাথে মিহালের বিয়ের খবর তানজিনার ভাবির পরিবারও জানে না কিন্তু তানজিনার ভাবির চাচাতো বোন মনে মনে আরিফকে পছন্দ করতো। মেয়েটা প্লেগার্ল টাইপের হলেও ডাক্তার আরিফের সাথে তানজিনাকে সহ্য করতে পারেনা। ঐদিন যখন মিহালকে নিয়ে তানজিনা রেস্টুরেন্টে যায় হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তখন ওই মেয়েটাও ওদের পিছু নেয় আর ওদের পাশের টেবিলে বসে এসব জানতে পারে আর সবকিছু রেকর্ড করে রাখে।

আরিফ তানজিনাকে বলে দিয়েছে, যেদিন নিজের করা ভুল বুঝতে পারবে সেদিন যেনো তার কাছে আসে এর আগে তাঁদের বিয়ে হবে না।

তানজিনা এই কথাগুলো শুনে অনেক কষ্ট পায় সে অনেক মিনতি করে আরিফকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভুলেই ওখানে। কিন্তু আরিফ তার কথায় অনড়! সে বলেছে, আগে নিজেকে শুধরাও তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করব কি না ভাববো!

তানজিনা এখন কিছুটা হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারে কিন্তু পুরোপুরি এখনো বুঝতে পারেনি। হয়তো সময় গেলে নিজের ভুল বুঝে নিজেকে শুধরিয়ে ভালো মানুষ হয়ে আরিফের জীবনে যাবে কোন এক সময়!!
ওদের দুজনের সম্পর্কটা এখন সময়ের উপর নির্ভর করছে সময় বলে দেবে ওদের সম্পর্কটা কোন দিকে মোড় নেবে।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩৩

লোকাল বাসে বসে বসে তূর চোখের জল ফেলছে আর একটু আগের কথা ভাবছে,

“ফ্ল্যাশব্যাক———☆
তূর যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসে তখন সাথে সাথে ইনায়াও আসে। ভার্সিটির গেটের বাইরে যাওয়ার আগে ইনায়া তূরের হাত ধরে টান দিয়ে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে যায়। গাছের আড়ালে নিয়ে ইনায়া ঘৃণার স্বরে বলে,

ইনায়া: খুব খুশি তুই এখন তাই না? নষ্ট করে দিলে তানুর জীবনটা! ওর প্রথম হাসবেন্ডকে তো তুই কেড়ে নিয়েছিস এখন ও যখন নিজের জীবনের দ্বিতীয় কাউকে ভালবেসে আনতে চাইছে তখন তুই এভাবে বাধা দিলি!

কথা গুলো শুনে তূরের কান্না আরো বেড়ে গিয়েছে। তাও জড়ানো স্বরে বলে,
তূর: বিশ্বাস কর ইনু, আমি কিছু করিনি। তানজির বিয়ে ভেঙ্গে আমার লাভ কি? আর মিহালকে কেড়ে নেওয়ার কথা বলছিস? আমি ওকে কেড়ে নেই নাই। তানজি যে কখনো মিহালকে মানতো না এটা জানাই ছিলো আর ওদের ডিভোর্সটা কিন্তু আমার কারনে হয়নি। ওরা একে-অপরের সাথে থাকতে চায় না তাই ডিভোর্স দিয়েছে তানজিনা আগে থেকেই রাজি ছিল আর মিহাল এতদিনের চেষ্টা করেও বিফল হয়ে রাজি হয়েছে।

ইনায়া: চুপ থাক! তোর এসব কথাবার্তা বলে তুই আমাকে গলাতে পারবিনা। কত হাসবেন্ড ওয়াইফ আছে বিয়ের পর একে অপরকে মানতে পারেনা তারা কি একসময় না একসময় একে অন্যকে মেনে নেয় না? ঠিকই মেনে নেয়, ওরাও ঠিক মেনে নিতো কিন্তু তুই মাঝখানে মিহালের জীবনে প্রবেশ করে মিহালকে ভাবতে বাধ্য করেছিস ডিভোর্সে দিতে।

তূর: মাফ করে দিস রে, তোকে আমি বোঝাতে পারবো না আর এই অবস্থা তোকে বুঝানোর মতো ক্ষমতাও আমার কাছে নাই।
ইনায়া: তোকে বোঝাতেও হবে না। তুই কি ভেবেছিস তোকে মিহাল ভালোবাসে! এখন তুই মিহালেক বাচ্চার মা হতে চলেছিস বলে তোকে ও মাথায় করে রাখবে? কই রাখল তোকে মাথায় করে? তানজিনা যখন তোকে কিছু বলছিলো কথাগুলো তখনই কি মিহাল একটা টু শব্দও করেছে? করেনি তাই না!

তূর করুন চোখে তাকিয়ে আছে, প্রতিটা কথা ওর হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।

ইনায়া: তোর সাথে মিহালের ভালোবাসার সম্পর্ক এখনো এক বছর হয়নি আর তানজিনাকে সে সাত বছর ধরে ভালোবাসে। তাহলে বল স্বভাববশত তানজিনার প্রতি তার টান তো থাকবেই। আজকে ওই টানের কারণে তানজিনাকে কোনো প্রতি উত্তর করেনি যখন তোকে তানজিনা কথাগুলো বলছিল। তুই আজ প্রেগন্যান্ট বলেই হয়তো মিহাল দুটানায় ভুগছে যে কি করবে? তুই যদি প্রেগনেন্ট না হতিস তাহলে দেখতি মিহাল ঠিক তানজিনাকে এই সময়ে নিজের করে নিতো আবার।

ইনায়া আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই তূর টলমলে পায়ে গেটের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
“ফ্লাশব্যাক এন্ড———☆

এবার তূর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তাই সেই সিদ্ধান্ত পূরন করার জন্য এলেক্সকে ফোন করে। দুইবার রিং হওয়ার পর এলেক্স ফোন রিসিভ করে।

এলেক্স: হ্যালো! কি ব্যাপার নূর, হঠাৎ ফোন দিলে যে? তোমার সব ফ্রেন্ডরা তো ক্যাম্পাসেই আছে তুমি কই?
তূর: আমি বাসে, বাংলাতে ফিরছি।
এলেক্স: তুমি একা একা ফিরছো? কারণ একটু আগে আমি দেখলাম ওরা সবাই মিলে কার সাথে যেন কথা বলছে, অবশ্য কথা বলছে বললে ভুল হবে ওরা ঝামেলা করছে।

তূর: হুম, একা একাই ফিরছি। এখন থেকে আমার একা একাই চলতে হবে।
এলেক্স: কি হয়েছে তোমার? গলাটা কেমন যেনো লাগছে। তুমি কি কান্না করেছো?
তূর: আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?
এলেক্স: বলো কিসের সাহায্যে।

কথাটা বলতেও তূরের ঠিকরে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে তাও নিজেকে সামলিয়ে বলে,
তূর: আমাকে অন্য একটা শহরে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?

এলেক্স অবাক হয়ে গেছে। সে বলে,
এলেক্স: মানে কি? তুমি অন্যের ভার্সিটিতে ভর্তি কেন হবা? এখানেই কি সমস্যা?
তূর: দেখো এলেক্স আমি এখন তোমাকে কি হয়েছে বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আমি খুব করে চাই অন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে এবং সেই ইউনিভার্সিটির কথা তুমি আমার ফ্রেন্ডদের এমনকি মিহালকে কাউকে জানাতে পারবে না।

এলেক্স: কেন ওদের কেন জানাবো না? তুমি কি ওদের না জানিয়ে যাবে?
তূর: হুম!

এলেক্স: কারণটা কি ওদের কেন’না জানিয়ে যাবে? ওরা তোমার ফ্রেন্ড আর মিহাল তোমার হাজব্যান্ড, তুমি প্রেগন্যান্ট এখন!

তূর: যাওয়াটা জরুরি এলেক্স! আমি আজকেই বাংলো থেকে সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে যাব। প্লিজ, তুমি দয়া করে ওদেরকে কথাটা জানাবে না ওরা ফেরার আগেই আমি বেরিয়ে যাব। শুধু এতটুকু বলে দেই আমি একটু মানসিক প্রশান্তি চাই আমার বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার জন্য। এত এত ঘৃণার মাঝখানে আমি পারবোনা নিজেকে ঠিক রাখতে। তোমার বাবা তো আমাদের ইউনিভার্সিটির ভিসির চেনা জানা আছে, উনাকে একটু বলো না আমার ট্রানস্ফার টা করে দিতে একটু গোপনীয়ভাবে। যাতে আমার কোথায় ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে সেটা কেউ জানতে না পারে। শুধু তুমি জানবে কিন্তু তুমিও যেন আমার বন্ধুদের ও মিহালকে না বলো।

এলেক্স: আমি জানিনা তোমার কি হয়েছে, তবে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আজকে ক্যাম্পাসের ঝামেলা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি কিছু না কিছু তো হয়েছে! আমি তোমার ভার্সিটি ট্রান্সফারের বিষয়টার গোপনীয়তা খেয়াল রাখব।

তূর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
তূর: আজকেই একটু কথা বলতে বলো। আর কোন শহরে ভার্সিটিতে ট্রানস্ফার করবে সেটাও একটু বলে দিও আমি সেখানে চলে যাব। আরেকটা হেল্প করতে পারবে প্লিজ?

এলেক্স: বল কি হেল্প।
তূর: একটা গার্লস হোস্টেল খুঁজে দেবে যেখানে আমি থাকতে পারবো। কারণ যেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই না কেন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ওখানে আমাকে রাখবে না ভার্সিটির হোস্টেলে। আমি আজকেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসবো।

এলেক্স: আচ্ছা আমি চেষ্টা করতেছি তুমি সাবধানে বাসায় যাও আর একটা কাজ করো তুমি ব্যাগগুছিয়ে আমার বাসায় এসে থাকতে পারো আজকের রাতটা। তুমি আমার বাসায় আসলে আমি ওলিভাকে আজকে বাসায় আসতে বলব। আর যদি তোমার ইচ্ছে না করে তাহলে তুমি এরিকের ফ্ল্যাটে থাকতে পারো এলিনা সেখানে থাকবে।

তূর: হুম।

ফোনটা কাটার পর তূর বাহিরের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বাংলোতে যাবার পর বাংলোর চাবি যেহেতু কেয়ারটেকারের কাছে ওরা দিয়ে যায় তাই কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। তূরদের রুমের চাবি তূরের কাছেই থাকে যার যার রুমে চাবি যার যার কাছে থাকে। রুমে গিয়ে সবার আগে তূর খাতা-কলম নিয়ে বসে উদ্দেশ্য সবার জন্য কিছু লিখে যাবে। সবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নোট লেখার পর তূর নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাংলো থেকে বেরিয়ে আসে আসার সময় অবশ্য কেয়ারটেকার জিজ্ঞাসা করেছিল, তূর কোন রকম কথা কাটিয়ে চলে আসে।

তূর এখন এলেক্সের বাসায় যাবে। এই সুযোগে এলেক্সের বাবার সাথেও ভার্সিটি ট্রানস্ফার নিয়ে কথা বলা যাবে কিন্তু এরিকের বাসায় গেলে একটা প্রবলেম আছে লিরা জেনে যেতে পারে।
________
মিহাল রাফিরা বাংলোতে ফিরলে দেখে তূর সেখানে নেই। মূলত মিহাল নিজের রুমে খুঁজে না পেয়ে গার্ডেনে খুঁজেছে এরপর আবার নিজের রুমে গিয়ে রুমটা কেমন যেন ওর কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তাই সবকিছু চেক করে দেখে তূরের প্রায় অনেক জামাকাপড় নেই।
মিহাল যে ওদের বিয়ের রাতে তূরকে ওর আগের লম্বা চুলগুলো একটা ওয়ালমেট এর মত বানিয়ে দিয়েছিল সেটা বিছানার কোনায় রাখা তার সাথে চাপা দেওয়া একটা কাগজ।

মিহাল কাগজটা খুলে দেখে সেখানে লেখা,

প্রিয় মিহাল,
প্রথমেই বলি ভালবাসতাম, ভালবাসি, ভালবাসবো।❤
তোমাকে প্রথমবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে বিয়ে করার সময় তোমার চোখে আমি অনুভূতি দেখিনি। তারপর তো আমি কোমাতে চলে গেলাম, তোমার সাথে তানজিনার ডিভোর্স হলো, আমাদের প্রেম হলো, আমরা আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী দিন বিয়ে করলাম, আমি প্রেগনেন্ট হলাম। সবকিছু ঠিকই ছিল কিন্তু সেদিন রাতে তুমি আমাকে বললে,
” তোমার তানজিনার জন্য খারাপ লাগছে! তুমি দায়ী তোমাদের যদি বিয়ে, ডিভোর্স না হতো তাহলে এমনটা হতো না।”
তোমার সাথে তানজিনার বিয়ে তো আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই হয়েছে তাহলে তো আমিই দায়ী হলাম তাই না!
আমি চলে যাচ্ছি এখান থেকে জানিনা কোথায় যাব!
আজকে ইনায়া আমাকে যা বলল তা শোনার পর আমার নিজেকে অনেক নিচু মনে হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, আমি কারো জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ঢুকে গিয়েছি! কারো সম্পর্ক নষ্ট করেছি।
এই পরিবেশে থাকলে আমার পেটের বাচ্চাটার ক্ষতি হবে মিহাল।
সারাখন আমারই চোখের সামনে কেউ আমাকে বদদোয়া দিয়ে যাবে, ঘৃণা করে যাবে এটা আমি মানতে পারব না।
তোমাকে মনে মনে ভালোবেসে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর তো তোমাকে বিয়ে করলাম। তাই তোমার থেকে এখন দূরে চলে যাওয়াটা আমি কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে পারবো। আর আমি তো একা যাচ্ছি না সাথে তোমার আমার ভালবাসার চিহ্ন কে নিয়ে যাচ্ছি! ওকে অনুভব করে আমার দিন কেটে যাবে তবে রাতটা হবে দুর্বিষহ।

তোমার যদি ইচ্ছা হয় তুমি তানজিনার জীবনে ফিরে যেতে পারো বাধা দেবোনা!🙂
আজ আমি ক্লান্ত! দিন শেষে হয়তো এটাই আমার প্রাপ্য ছিল। প্রথমবার তোমাকে বিয়ে করার সময় আমি এটা মেনেই বিয়ে করেছিলাম, “যদি তুমি তানজিনাকে নিয়ে থাকতে চাও তাহলে আমি বাধা দিব না। তোমাদের জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। দূরে সরে থাকবে যদি তুমি কাছে ডাকো তাহলেই কাছে আসব।”
সাথে এটাও বলেছিলাম, ” যতদিন সে তোমার স্ত্রী থাকে ততদিন।”
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেই শর্তটা আমাকে উঠিয়ে নিতে হবে।
ভালো থেকো জানিনা আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে কিনা! কিন্তু মনে রেখ এই তূর তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে।
তোমার তূর💔

চিঠিটা পড়ে মিহাল ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর চিৎকার করে তূরের নাম নিয়ে। মিহালের চিৎকারের শব্দে সবােই ওর রুমে জরো হয়।
লিরা ও ফাইজা দুজনেই চিঠি পেয়েছে কিন্তু খুলে দেখার আগেই হঠাৎ চিৎকারের শব্দে চিঠি হাতে নিয়েই ওরা দুজনে ছুটে যায়।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here