#শেষ_থেকে_শুরু_২
#পর্ব_১
#নন্দিনী_চৌধুরী
১.]
“ডিভোর্সের পেপার হাতে নিয়ে কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ। চোখ তার পানিতে টইটই করছে। চোখের সামনেই তার স্বামী অহ স্যরি প্রাক্তন স্বামী তার আপন চাচাতো বোনের সাথে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ! আজ শেষ হয়ে গেছে আরিশ আর তার সম্পর্কের সব বাঁধন। আজ সব বাঁধন থেকে আরিশ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে মুগ্ধকে। ২টা বছরের সম্পর্ক এক নিমিষে পায়ে গুড়িয়ে দিয়েছে আরিশ। বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্ক, যেই সম্পর্কে তারা মহান আল্লাহর পবিত্র কালাম পড়ে সাক্ষী রেখে একে অন্যকে গ্রহণ করেছিলো। আজ সেই সম্পর্ক একটা তিক্ত তিন শব্দ দিয়ে শেষ হয়ে গেলো।
মুগ্ধের ভেতরটা বার বার চিৎকার করে এটাই বলছে, “যেওনা আরিশ, আমাকে ছেড়ে যেওনা। আমি যে থাকতে পারবোনা তোমায় ছাড়া।”
আরিশ মুগ্ধের বিচ্ছেদের কারণ একটাই, মুগ্ধের এক কঠিন অপূর্ণতা। আর সেটা হলো মা না হতে পারার অপূর্ণতা। হ্যাঁ, মুগ্ধ কোনোদিন মা হতে পারবেনা। এই কঠিন সত্যটা যেদিন সে জেনেছিলো সেদিন নিজেকে পৃথিবীর একজন অপূর্ণ নারী মনে হচ্ছিলো তার। মুগ্ধ সেদিন আরিশের বুকে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। আরিশ সেদিন ভরসা দিয়েছিলো তাকে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে সেই ভরসার ফল এটাই ছিলো তাকে একা করে দেওয়া। এই অপূর্ণতার জন্য আরিশ তাকে ছেড়ে দিলো। আজ যে সে আরো ভেংগে গেলো। আজ কার বুকে মাথা রেখে কাঁদবে? যার বুকে কাঁদতো সেইতো আজ তাকে সরিয়ে দিলো! মুগ্ধ কোর্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসলো। আকাশে কালো মেঘের ভিড় জমেছে। আজ আকাশেরও মনে হয় মুগ্ধের মতো কষ্ট তাই আজ বর্ষণ হবে সুখের নয় আকাশের দুঃখের বর্ষণ।
“মেহরুবা ইসলাম মুগ্ধ। নাম মুগ্ধ যেমন মেয়েটাও তেমন মুগ্ধকর। হালকা ফরসা গায়ের রং, গোলগাল চেহারা সব মিলিয়ে মাশাল্লাহ। মুগ্ধ মেহেরাব খানের ছোট মেয়ে। মেহরাব খান ও মেহেজাবিন ইসলামের বড় ছেলে আরিয়ান খান মেহের। মেহেরের ৮ বছর আর মুগ্ধের ৫ বছর বয়সের সময় মেহেরাব আর মেহেজাবীনের একটা দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। যদিও মুগ্ধের নানা বাড়িরা এটা দূর্ঘটনা মানেন না। তাদের মতে এটা একটা মার্ডার! তবে সেরকম প্রমাণ বা ক্লু না পাওয়ায় এটাকে সবাই দূর্ঘটনাই বলে। মুগ্ধ ও মেহেরের মা-বাবা মারা যাওয়ার পর মুগ্ধ ও মেহেরকে তাদের দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি আলাদা করে নেয়। মেহেরকে নিয়ে যায় তার মামারা আর মুগ্ধকে নিয়ে যায় তা চাচা মাহফুজ খান। মেহের মুগ্ধ একে অপরের সাথে দেখা তেমন করতে পারতোনা। দুই ভাইবোনের মাঝে দেয়াল হয়ে যায় মামা-চাচারা। মেহের তাদের সাথে থাকতে চায়নি কিন্তু তারা মেহেরকে জোর করে রেখে দেয়। পরিবারের কারনে ভাই-বোনের সম্পর্ক হয়ে যায় আলাদা। মাহফুজ খানের পরিবার বলতে তার স্ত্রী আর তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সামিয়া ছোট মেয়ে সায়মা। সালমা খান কোনোদিন মুগ্ধকে সয্য করতে পারেনি। যখন থেকে মুগ্ধ তাদের কাছে এসেছে তিনি একদম ওর সাথে ভালো আচরন করেননি। মুগ্ধ যখন তাদের কাছে আসে তখন সায়মা ২বছরের ও সামিয়া ৭বছরের। সামিয়া মুগ্ধকে অনেক ভালোবাসতো। পুরো বাড়িতে মাহফুজ খান আর সামিয়া মুগ্ধকে ভালোবাসতো। মুগ্ধকে সবসময় সালমা খান কাজের মেয়ের মতো ট্রিট করতো। বাড়ির সব কাজ ওকে দিয়ে করাতো। ওতটুকু মেয়ে যার খেলার কথা সে তখন বাসন মাজতো, কাপড় ধুঁতো। সালমা খান মুগ্ধকে অনেক বকতেন একটা সময় মারতেও লাগেন। মুগ্ধ নিরবে অস্রু ফেলতো কাউকে কিছু বলতে পারতো না। মাহফুজ খান অনেকবার আটকাতে গেছেন বিনিময়ে সালমা তাকে এটাই বলেছেন,,,
“তোমার ভাইয়ের আগাছা এখানে রাখতে হলে আমি যা বলবো, যা করাবো তা করেই ওকে থাকতে হবে। আমার কথায় চলতে না পারলে এক লাথি মেরে বের করে দেবো ওকে। ”
এই কথার পর মাহফুজ চেয়েও কিছু বলতে পারেনি। সামিয়া মুগ্ধকে ভালোবাসলেও সায়মা ছিলো তার মায়ের মতো। মুগ্ধকে পদে পদে ওর মায়ের কাছে মার খাওয়ানো ছিলো সায়মার কাজ। মেহের মুগ্ধর সাথে দেখা করতে আসতে পারতো সপ্তাহে একবার। একবারের বেশি অনুমতি দেওয়া হয়নি ওদের। মেহের যখন বোনকে দেখতে আসতো তখন অনেক খেলনা, চকলেট, কাপড় নিয়ে আসতো। মুগ্ধ ভাইকে পেয়ে ভাইয়ের কোলে ঢুকে বসে থাকতো। পুরাটা দিন সেদিন ওর ভাইয়ের কোলটা ওর জন্য থাকতো। মেহের চলে যেতেই সালমা মুগ্ধের থেকে ওকে মেরে ধমকে সব নিয়ে নিতো। এভাবেই বড় হতে থাকে মুগ্ধ। মেহেরের ১০ বছর যখন হলো ওর মামা ওকে নিয়ে চলে গেলেন কানাডা। সেখানেই ওর পড়াশুনা সব কিছু করাবেন তিনি। যেদিন মেহের চলে যাচ্ছিলো সেদিন মুগ্ধ অনেক কেঁদে ছিলো। মেহের বোনকে সেদিন কথা দিয়ে গেছে ফিরে এসে সে বোনকে নিয়ে আসবে নিজের কাছে।
এরপর কেটে গেছে ১৪ বছর,,,,
মুগ্ধ যখন কলেজে উঠে তখন তার পরিচয় হয় আরিশের সাথে। একই এলাকায় দুজনের বাড়ি। আরিশ তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আরিশের মুগ্ধকে ভালো লেগে যায়। সরাসরি সে মুগ্ধকে প্রপোজ না করে সে একদম বিয়ের প্রস্তাব দেয় মুগ্ধের বাসায়। আরিশের আপন বলতে কেউ নেই। এতিম সে। আরিশ জব পাবার পরেই বিয়ের প্রস্তাব দেয় মুগ্ধের বাসায়। সালমা রাজী ছিলোনা এই বিয়েতে। এতো ভালো ঘরে মুগ্ধ যাবে তা তার সয্য হচ্ছিলোনা। সামিয়ার বিয়ে ততদিনে হয়ে গেছে। সালমা খানের মত অমতে পাত্তা না দিয়ে মাহফুজ খান বিয়েতে রাজী হন। মুগ্ধকে জানালে সে না করেনা। যাদের কাছে সে বড় হলো তাদের কথার অমত হবে কি করে। তবে চেয়েছিলো ভাই আসলে বিয়ে করতে। কিন্তু মেহেরের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ হতোনা। প্রথমে যা হতো কিন্তু এখন একদম হয়না। তাই বাধ্য হয়ে ভাইকে ছেড়েই বিয়ে করতে হয় মুগ্ধকে। মুগ্ধের বিয়ের সময় সায়মা ছিলোনা সবাই থাকলেও। সায়মাকে মাহফুজ খান বাড়ি থেকে আলাদা করে দিয়েছিলো। কারন সায়মার নামে অনেক বাজে অভিযোগ আসতো রোজ। একদিন তো সায়মাকে তিনি নেশা করতে হাতে নাতে ধরেন। সেদিন সায়মাকে তিনি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সালমা অনেক অনুরোধ করলেও লাভ হয়না। সায়মার যাওয়ার দায় ও এসে পরে মুগ্ধের ঘাড়ে। সালমার মতে মুগ্ধ সায়মার নামে ওর বাবার কান ভাড়ি করেছে। সালমা খানের অত্যাচার তারপর আরো বেড়ে গেলো। দেখতে দেখতে বিয়ে হয়ে যার আরিশ মুগ্ধের।
২.]
মুগ্ধ ভেবেছিলো এই বিয়ে বুঝি তার জীবনে সুখ নিয়ে আসবে। সব কালো ছায়া সরিয়ে দেবে তার জীবন থেকে। কিন্তু ওইযে একটা কথা আছেনা,,
“ওভাগী যেদিকে যায়,সাগর শুকাইয়া যায়।”
মুগ্ধের ভাগ্যেও তাই ছিলো।
বিয়ের পর আরিশের ভালোবাসায় মুগ্ধ ও ভালোবেসে ফেলে আরিশকে। দুই টুনাটুনির সংসার ভালোই যাচ্ছিলো। আরিশের কেয়ারিং, লাভিং সব মুগ্ধকে অবাক করতো।
কিন্তু সুখ টিকলো না বিয়ের দুই বছর পর যখন মুগ্ধ জানতে পারলো সে মা হতে পারবেনা। সরাসরি ডাক্তার এমন বলেনি। মুগ্ধের প্রায় পেট ব্যাথা থাকায় সে ডাক্তার দেখালে ডাক্তার জানায় তার জরায়ুতে সমস্যা আছে। সে সন্তান গ্রহন করতে সক্ষম ৪০% আর ৬০%অক্ষম। এটা শুনে মুগ্ধ ধরেই নিয়েছে সে মা হতে পারবেনা কোনোদিন। আরিশকে জানানোর পর আরিশ মুগ্ধকে শান্তনা দিয়েছিলো। তবে এরপর পাল্টে যেতে থাকে সব। আরিশের মাঝে সেদিনের পর ২মাস ধরে মুগ্ধ অনেক পরিবর্তন পেয়েছে। আগের আরিশ আর এই আরিশ একদম আলাদা ছিলো। রাত করে বাড়ি ফেরা, মুগ্ধকে অবহেলা করা সব। এরপর চলে আসে সেই কালো রাত,,,,,
আরিশ মুগ্ধকে জানায়,,সে আর মুগ্ধের সাথে থাকতে চায়না। মুগ্ধ সন্তান জন্ম দিতে পারবেনা। সে বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হতে পারবেনা তাই সে মুগ্ধের সাথে থাকবেনা আর। মুগ্ধ সেদিন আরিশকে শুধু এটাই বলেছিলো,,
মুগ্ধ: মেয়েটা কে আরিশ?
আরিশ: কোর্টেই দেখতে পাবে।
এর ১ সপ্তাহ পরেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে কোর্টে যায় মুগ্ধ আরিশ। সেখানে গিয়ে যে এভাবে চমকে যাবে মুগ্ধ আশা করেনি। তারই আপন চাচাতো বোন সায়মাই তার সংসার ভাংগলো! মুগ্ধ কিছু যেনো বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো। এরপর উকিল এসে তাদের ডিভোর্স পেপার দেয়। মুগ্ধকে যখন সাইন করতে দিলে মুগ্ধের হাত কাঁপতে থাকে। চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি পরতে লাগে মুগ্ধের। কে জানে সেই পানি আরিশ দেখেছে কিনা। আর দেখলেও তার মনে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা। মুগ্ধের সাইন শেষ হতেই আরিশ ও জলদি সাইন করে দেয়। যেনো সাইন করলেই সব ঝামেলা শেষ।
হ্যাঁ, হয়ে গেলো ডিভোর্স তাদের। আজ থেকে মুগ্ধ হয়ে গেলো ডিভোর্সি। কিছু সময় আগেও যে ছিলো স্বামী এখন সে হয় গেলো প্রাক্তন স্বামী। সাইন করা শেষে উকিল দুইজনকে দুটো কপি দেয়। আরিশ মুগ্ধের দিকে একটা খাম এগিয়ে দেয় আর বলে,
আরিশ: এই নেও তোমার পাওনা। বিয়েতে যেই দেনমোহর তোমার প্রাপ্য ছিলো সেই টাকা।
মুগ্ধ কেন জানি ফিরিয়ে দিলোনা টাকাটা নিয়ে নিলো। আরিশ সায়মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো একবার ও তাকালোও না আর মুগ্ধের দিকে। সায়মার মুখে ছিলো কোনো কিছু হাসিল করে নেওয়ার হাসি। আরিশের চোখ তা এড়ালেও মুগ্ধের চোখ এড়ায়নি সেটা।
মুগ্ধও বেরিয়ে এলো কোর্ট থেকে।
.
.
.
.
অতীত থেকে ফিরে আসলো মুগ্ধ। অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি নেমে গেছে তা খেয়াল করেনি। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ। আজ কেন জানি মায়ের কথা খুব মনে পরছে। মা থাকলে তার কোলে আজ মাথা রেখে কাঁদতে পারতো মুগ্ধ। মা বাবার কবরটা দেখে আসবে আজকে সে। বাবার চোখের মণি ছিলো মুগ্ধ। আচ্ছা আজ তার বাবা থাকলে তার মণির এতো কষ্ট কি মানতে পারতো সে। না পারতোনা সন্তানের কষ্ট কোনো মা বাবা মানতে পারেনা।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে একদল সাদা মেঘ এসে খেলা করছে। মুগ্ধ গাছ তোলা থেকে বেরিয়ে আসলো এখন তার প্রথম কাজ মা বাবার কবর দেখে আসা। তাই পা চালালো সেই দিকে।
বাবা মায়ের কবর দেখে এসে এখন মুগ্ধ একটা কথাই ভাবছে কোথায় যাবে এখন সে! তার যাওয়ার মতো যে কোনো জায়গা নেই। এতো বড় দুনিয়ায় তার আপন কেউ নেই।
মুগ্ধ এসব ভাবছে আর হাঁটছে। এই মূহূর্তে চাচার কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। তাই মুগ্ধ চাচার বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
__________________
কানাডায় নিজের অফিসে বসে আছে মেহের। পড়াশুনা শেষ করে সব অফিসে বসেছে সে। তার মামার এই বিজনেস সে এখন দেখাশুনা করবে। মামা তার মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। মামিও নেই। মামার কোনো সন্তান না থাকায় মেহেরকেই সব দিয়ে গেছেন তারা। আর তাছাড়া মেহেরের মা বাবার রেখে যাওয়া সব সম্পত্তি মেহের ১৮ বছর হবার পরেই পেয়ে গেছে। মেহেরাব উইল করে রেখেগেছিলো মেহেরের ১৮ হলে সব সম্পত্তি ওর নামে হবে। মেহেরের থেকে মুগ্ধ তার ভাগ নিতে পারবে।
মেহের এখন খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। তার চড়ুইপাখি যে তার অপেক্ষায় আছে। বোনকে এবার নিয়ে আসবে নিজের কাছে। অনেক দূরে রেখেছে বোনকে কিন্তু আর নয়।
মেহের জানেনা যে মুগ্ধের বিয়ে হয়ে গেছে। মেহেরকে কেউ জানায়নি এটা। মেহেরের মামা জানার পরেও এটা জানায়নি তাকে। মেহেরের সাথে মুগ্ধের তেমন যোগাযোগ করতে দিতেন না মেহেরের মামা মেহেরকে। তাই মেহের জানেনা যে মুগ্ধের বিয়ে হয়ে গেছে।
.
.
.
.
.
.
.
মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে ওর চাচার বাসার সামনে। খুব ভয় কাজ করছে ওর ভেতর। তার চাচা চাচি যদি জানে সায়মা আরিশের সাথে তাহলে কি হবে আর তার যে ডিভোর্স হয়ে গেছে তারা কি মেনে নেবে ওকে বাড়িতে। একজন ডিভোর্সি মেয়েকে তো সমাজে সবাই কালো চোখে দেখে।
#চলবে