শেষ থেকে শুরু ২ পর্ব -১৬+১৭

#শেষ_থেকে_শুরু_২🌸
#পর্ব_১৬[ধামাকা ২]
#নন্দিনী_চৌধুরী

৩০.
সায়মার সামনে রিপোর্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। সায়মা ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে বার বার। আরিশ সায়মার সামনে রিপোর্ট ছুঁড়ে মেরে চিৎকার দিয়ে বলে,,,
আরিশঃ “আমি কল্পনাও করিনি কোনোদিন যাকে আমি আমার জীবনের ভালোবাসা ভেবে আমার আসল ভালোবাসা ভালোথাকাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার সেই ভালোবাসা আমাকে এভাবে ঠকাবে। আমার বিশ্বাসের এভাবে সুযোগ দেবে। আমার ভালোবাসাকে এভাবে অপমান করবে। আমি ভাবতাম আমি হয়তো আসলেই সুখি কিন্তু না আমার ঘরের সুখকে যেদিন আমি নিজের হাতে বের করে দিয়েছিলাম আমার সুখতো সেদিনই শেষ হয়েগেছিলো। ”
আরিশ একটু থেমে আবার চিৎকার করে বলে,
আরিশঃ এই রিপোর্ট কিসের জানো! জানো কিসের রিপোর্ট। এই রিপোর্ট তোমার ওই পেটের সন্তানের ডিএনে রিপোর্ট যেখানে স্পস্ট ভাবে বলে দিচ্ছে এই বাচ্চা আমার না। এই বাচ্চা অন্য কারো। আর এই বাচ্চা অন্যকারোই হবার কথা কারণ আমি কখনো যেখানে বাবাই হতে পারবোনা। সেখানে তোমার গর্ভে আমার সন্তান কোনোদিনই আসতে পারবেনা। আমি ভাবতে পারছিনা তুমি আমাকে কতটা ধোঁকা দিয়েছো। আমার ঘরের বউ হয়ে পরপুরুষের বিছানায় গেছো। তাও একজন না কতজনের সাথে বিছানায় গেছো। আজ আমি বুঝতে পারছি তোমার ঘাড়ে থাকা সেই লাল দাগ গুলো কোনো ব্যাথার দাগ না। সেগুলা তোমার নষ্টামি করে আসার দাগ। আর সন্তান তোমার সেই বিছানায় যাওয়ার মাঝে কারো একজনের ফল। যাকে গর্ভে ধারণ করে আমার বলে চালিয়ে দিয়েছো। এর থেকে যদি আমি কোনো পতিতাকে বিয়ে করতাম তবে সেও এমন করতোনা। তুমিতো পতিতার থেকেও খারাপ। তোমার মতো মেয়ের উচিত গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া। আরিশের কথায় এবার সায়মা চিৎকার দিয়ে উঠে,,,
সায়মাঃএনাফ! আর একটা কথাও বলবেনা তুমি। হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি নাটক করেছি। তোমার সাথে এতোদিন নাটক করেছি আমি। এই বাচ্চা বিয়ে সংসার ভালোবাসা সব নাটক। শুরু থেকেই সব মিথ্যা ছিলো।
আরিশ এবার সায়মার দুইবাহু চেপে ধরে বলে,
আরিশঃকেনো কেনো! কেনো করলে এমন? বলো কেনো করলে!
সায়মাঃহাহ্। শুনতে চাও কেন করেছি তবে শুনো,,,

মুগ্ধ আর আমি আপন চাচাতো বোন। মুগ্ধ আমার বড় বোন। ছোট থেকেই ওকে আমার বাবা সবার থেকে বেশি আদর ভালোবাসা দিতেন। যেটা আমার একদম পছন্দ ছিলোনা। আমি যখন ক্লাস প্রথম কাউকে মন থেকে ভালোবাসি আমি জানতে পারি সে মুগ্ধকে ভালোবাসে। আমি যাকেই ভালোবাসি সেই মুগ্ধকে ভালোবাসে। আমার বাবা,বোন এমনকি আমার ভালোবাসার মানুষটাও। আমার ভালোবাসার থেকে প্রত্যাখান হয়ে আমি নেশায় আসক্ত হয়ে যাই। রাতবিরাত নেশা করতাম। একদিন মুগ্ধের কাছে ধরা পরে যাই। মুগ্ধকে অনেক অনুরোধ করি বাবাকে না জানাতে। কিন্তু ও বাবাকে জানিয়ে দেয়। বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। একবারো ভাবেনা আমি একটা একা মেয়ে কোথায় যাবো। কিভাবে বাঁচবো। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর মুগ্ধের প্রতি চরম রাগ আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। তারপর আমি জানতে পারি মুগ্ধের বিয়ে হয়েগেছে। তোমার বিয়ের ২বছর পর শুনি তোমরা বাচ্চার জন্য ট্রাই করছো কিন্তু হচ্ছেনা। পরে জানতে পারলাম তোমার বাচ্চা জন্মদেওয়াতে অক্ষম কিন্ত মুগ্ধ সেটা মিথ্যা বলেছে যে সে অক্ষম। ইয়েস আরিশ! আমি আগে থেকেই জানি তুমি অক্ষম বাবা হতে। তখন আমার মাথায় একটা প্ল্যান আসে ম্নুগ্ধের প্রতিশোধ নেওয়ার। আমি আসতে ধীরে তোমার ব্যাপারে খোঁজ লাগাই। তারপর তোমার সাথে দেখা তোমাকে নিজের প্রতি দুর্বল করা সব করলাম। আর ফাইনালি তুমি আমাকে ভালোবাসলা আর মুগ্ধক্কে ডিভোর্স দিলা। কিন্তু এতে কি আমার শান্তি হয় বলো। আমি মুগ্ধ যেই হাসপাতাল থেকে টেস্ট করায় সেই হাসপাতালের আরেক গাইনি ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে তাকে দিয়ে আরেকটা মিথ্যা রিপোর্ট বানাই। যেখানে লেখা থাকে মুগ্ধ মা হতে পুরোপুরি ক্ষমতা নেই। তারপর সেই ডাক্তারকে দিয়ে ওই রিপোর্ট মুগ্ধের কাছে পাঠাই। রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মুগ্ধ জানতে পারে আমাদের কথা। আর তারপর তোমাদের ডিভোর্স হয়। আমি জানতাম মুগ্ধ কাউকে তোমার অক্ষমতার কথা বলবেনা। সবাইকে ওর কথাটাই বলবে। আর তারপর তোমাকে বিয়ে করা। শুধুই তোমার সম্পত্তির জন্য করা সেটা। হ্যাঁ আমার একাধিক ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। আর তুমি একদম ঠিক জেনেছো এই বাচ্চা তোমার না। এটা আমার সো কোল্ড বয়ফ্রেন্ড ফাহাদের বাচ্চা। ওর সাথে তোমার পরেই ইন্টিমেট হয়েই এই বাচ্চা কনসিভ করেছি। তোমার বাচ্চা দরকার ছিলো। কিন্তু তুমিতো অক্ষম তাইতো এই বাচ্চা আমাকে কনসিভ করতে হয়েছে। বাচ্চার আশা তো তোমার মিটেছে।

এবার আসি আমি পতিতার থেকেও খারাপ তাইনা। তাহলে তুমিকি? নিজের দিকে একবারো তাকিয়ে দেখেছো? কেমন স্বামী তুমি যেই জানতে পারলে বউ বাচ্চা দিতে অক্ষম বেশ শেষ সব ভালোবাসা। সব ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো। আর তারপর আরেক নারীকে গিহে ধরলা। তুমিতো জানতেনা আমি মুগ্ধ চাচাতো বোন। আমাকেতো অন্য মেয়েভেবেই কাছে টেনেছো। আজ আমার জায়গায় অন্যকেউও হতে পারতো। তাহলে ভাবো তুমি কি। আমি ভালোনা আমি জানি কিন্তু তুমি! তুমিতো স্বামী নামক বেইমান। আর এতো কিছু করেও আমার কোনো আফসোস নেই।

সায়মার কথা শুনে আরিশ দাঁড়ানো থেকে বসে পরলো। যেনো এক আকাশ সমান ধাক্কা খেয়েছে সে আজ সায়মার কথায়। আরিশ সোফায় বসে বললো,

আরিশঃতোমার চাচাতো বোন ছিলো ম্নুগ্ধ। তুমি সব জেনে শুনে করেছো। ইচ্ছা করে আমাকে আর মুগ্ধকে আলাদা করেছো। আর আমি! আমি বা কি করে পারলাম এটা করতে।
আরিশ সায়মার দিকে তাকিয়ে বলে,
আরিশঃপাপ বাপকেও ছাড়েনা। হ্যাঁ আমি অন্যায় করেছি। আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি তাইতো আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তোমাকে ছেড়ে দেননি। আমার শরীলে যে মরণ রোগ আছে তা তোমার শরীলেও আছে তোমার সো কোল্ড বয়ফ্রেন্ডেরা তোমার পেটে শুধু বাচ্চানা তোমার শরীলে মরণরোগ এডস দিয়ে গেছে। যা তোমাকে তিলে তিলে শেষ করবে। আমি তুমি সর্বোচ্চ ১ বছরের অতিথি এই দুনিয়ায়। যেই ছোট প্রানটা আসছে আল্লাহ না করুক সেও এই রোগ নিয়ে আসে। তবে মরার আগে আমি একবার শেষ দেখা করবো মুগ্ধের সাথে। তার কাছে যে আমার ক্ষমা চাওয়া বাকি। নাহলে যে মরেও আমি শান্তি পাবোনা।

আরিশের কথা শুনে সায়মা অবাক হয়ে যায়। সায়মা চোখে মুখের বিষ্ময়। আরিশ এবার আরেকটা রিপোর্ট বের করে ওর সামনে দিয়ে বলে এটা তোমার এডস এর রিপোর্ট। সায়মা আরিশের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। তবে কি সত্যি সে মারা যাবে আর তার বাচ্চা!

কিছুসময় আগে আরিশ হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। আরিশ রিপোর্টগুলা দেখে অবাক হয়নি। বরং অবাক এখানেই হয়েছে কতটা মিথ্যার মাঝে সে ছিলো এতোদিন। বাসায় এসে সায়মাকে আরিশ প্রথমে কিছু বলেনা কিন্তু সায়মা রিপোর্ট জানার জন্য আগ্রহ দেখালে আরিশ রিপোর্ট দেখানো শুরু করে ওকে।

৩১.
মুগ্ধ সাদাফের বাসায় যায়না আজ ৩দিন। ৩দিন ধরে সাদাফের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে মুগ্ধ। মুগ্ধের এহেন কাজে সাদাফের তো অবস্থা খারাপ। সাদাফ কিছুতেই শান্ত থাকতে পারছেনা। এখন নিজেই নিজেকে দোষ দিচ্ছে কেন যে সে ওইদিন এসব বলতে গেলো। সাদাফ মুগ্ধকে কল দিলে কল ধরেনা মুগ্ধ। সাদাফ আর থাকতে পারছেনা এভাবে। এদিকে মুগ্ধকে বাসায় ৩দিন ধরে দেখে মেহের কারণ জিজ্ঞেশ করলে মুগ্ধ বলে সে ছুটি নিয়েছে কয়েকদিনের জন্য। মেহের কথা সত্যি ভেবে আর তেমন পাত্তা দেয়নি।

রাত ৮টা,,মুগ্ধ নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সাদাফের দেওয়া চাদরটা। মুগ্ধের খুব প্রাপ্তির কথা মনে পরছে। কিন্ত যাবেনা সে আর ওবাড়ি। বাহিরের হিমশীতল বাতাস গায়ে নিচ্ছে মুগ্ধ। তখন আচমকা চোখ যায় ওর বারান্দার সামনের রাস্তাটায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ ভালোভাবে তাকিয়েও বুঝতে পারছেনা কে হতে পারে ওটা। হঠাৎ করেই লোকটার হাতে আলো জ্বলে ওঠে। আর আলোয় লোকটার মুখ দেখা যায়। লোকটাকে দেখেতো মুগ্ধ অবাক। কারণ এতো সাদাফ। সাদাফ হাতে একটা সরি লেখা বোর্ড নিয়ে দাঁড়ানো তাতে টুরিবাল্প লাগানো। সাদাফ বোর্ডটা মুগ্ধের দিকে এগিয়ে ধরে মুগ্ধ বোর্ডা দেখে আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যার মানে সরি এক্সেসেপ্টেড না। সাদাফ এবার নিজের কান ধরে উঠবস করে লাগে। মুগ্ধ সেটা দেখে ফিঁক করে হেঁসে দেয়। সাদাফ মুগ্ধের হাঁসি দেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মুগ্ধকে ইশারা করে উপরে তাকাতে। মুগ্ধ উপরে তাকিয়ে দেখে ফানুশ উড়ছে আর সরি বেলুন উড়ছে। মুগ্ধ এগুলা দেখে অবাক হয়ে যায়। মুগ্ধ পুনোরায় আবার সাদাফের দিকে তাকায়। সাদাফ আবার সরি বলে কান ধরে। এবার মুগ্ধ নিজে নিচে চলে আসে। সাদাফ মুগ্ধকে দেখে খুশি হয় তবে এখনো মাথা নিচু করে আছে। মুগ্ধ সাদাফের সামনে আসতেই সাদাফ আবার বলে,
সাদাফ:আমি সরি। আমি জানি আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি আর কোনোদিন এমন করবোনা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও।
মুগ্ধ: আর যদি ক্ষমা না করি তবে?
সাদাফ:প্লিজ। তোমার প্রাপ্তিও তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
মুগ্ধ: হুম যান মাফ করলাম আপনাকে।
সাদাফ:সত্যি!
মুগ্ধ:হুম।
মুগ্ধ বাসায় চলে আসার জন্য পা কয়েককদম বাড়ালে পিছন থেকে সাদাফ বলে,,,
সাদাফ:”আমি তোমাকে ভালোবাসি মুগ্ধ।”
সাদাফের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় মুগ্ধ। বার বার কানে সাদাফের বলা কথাটা বেঁজে চলেছে। মুগ্ধ পিঁছনে ঘুরে তাকালে সাদাফ আবার বলে,

“আমি জানিনা কখন কিভাবে তুমি আমার মনে এতোটা জায়গা করে নিয়েছো। যেই আমি কোনোদিন ২য় বার আর কারো মায়ায় জরাবোনা ভেবেছিলাম সেই আমি তোমার মায়ায় জরিয়ে যাই। আমি তোমাকে সেদিন কথাগুলো বলেছিলাম ঠিকই তবে আমি সত্যি চাইনা তুমি আমার অতীতে জায়গা করো। আমি চাই তুমি আমার বর্তমান আর ফিউচারে তোমার জায়গা করো। আর তুমি সত্যি আমার মনে আমার বর্তমানে নিজের জায়গা করে নিয়েছো। আমি তোমাকে জোর করবোনা কোনোদিন। আমি জানি বিশ্বাস করে একবার ঠকলে ২য়বার আবার বিশ্বাস করে হাত ধরাটা খুব সহজ না। তুমি যত সময় লাগে নেও। যেদিন তোমার ইচ্ছা হবে সেদিনই আমি তোমার জীবনের শেষ থেকে শুরু হবো।”
সাদাফের প্রত্যেকটা কথা মুগ্ধকে অবাক করছে। মুগ্ধ কিছুই বলছেনা। মুগ্ধ এক দৌড়ে বাসায় ভিতরে চলে যায়। সাদাফ মুগ্ধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মুগ্ধ নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। এতো নার্ভাস লাগছে কেনো ওর ও জানেনা। মুগ্ধ দরজায় হেলান দিয়ে বসে ভাবে,,
“কেনো জানিনা আপনাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। কিন্ত অতীতের কথা গুলো ভাবলেই এই ইচ্ছা ভয়ে রূপান্তর হয়। যাকে সব দিয়ে ভালোবেসেছিলাম সে আমাকে ঠকালো। অথচ তাকে সবার সামনে ভালো বানিয়ে নিজেকে বানিয়েছিলাম খারাপ। আমি তো একেবারে অক্ষম নই। তবুও হয়েছি পুরো অক্ষম তাকে ভালো বানিয়ে। সেই আমাকে ঠকালো। ভয় হয় আবার যদি….। ”

মুগ্ধ এসব ভাবতে ভাবতে দরজার সাথেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো।
#শেষ_থেকে_শুরু_২
#পর্ব_১৭[রহস্যভেদ]
#নন্দিনী_চৌধুরী

৩২.
দেখতে দেখতে প্রায় ১মাস চলে গেছে। এই ১মাসে আরিশ চেয়েও পারেনি মুগ্ধের সাথে দেখা করতে। এর কারণ এটাই আরিশ জানেনা মুগ্ধ কোথায় আছে। সায়মাদের বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখেছে ওখানে নেই। সায়মার মাকে জিজ্ঞেশ করলে সে সাফ জানায় সে জানেনা মুগ্ধ কই। আরিশের শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সেদিনের পর থেকে আরিশ সায়মা একদম আলাদা হয়েগেছে। আরিশ নিজের মতো করে থাকে আর সায়মা নিজের মতো। ইদানিং সায়মার শরীরও অনেক খারাপ করছে। চাইলেও সায়মা আগের মতো লাইফ লিড করতে পারছেনা।
আরিশের বিজনেসের অবস্থা অনেক খারাপ হয়েগেছে। একদিকে রোগের চিকিৎসা করানো তারপর সংসার চালানো সব একদম নাজেহাল অবস্থা। অফিস আরিশের প্রায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে।

আরিশ আর সায়মা রেডি হচ্ছে আজকে সায়মাদের বাসায় যেতে বলেছে মাহফুজ। তাদের সাথে তার দরকার আছে জানিয়েছে মাহফুজ। আরিশ সায়মা রেডি হয়ে চলে আসে সায়মাদের বাসায়। সায়মাদের বাসায় এসে দেখে সামিয়া,সামিয়ার স্বামী,সালমা,মাহফুজ সবাই বসে আছে। সামিয়া ওদের দেখে ওদেরকেও বসতে বলে। ওরা বুঝতে পারছেনা ওদের ডেকে এভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে কেনো। কিছু সময় বাদে বাসায় আসলো মেহের, মুগ্ধ, মেহেরের অফিসের মেনেজার। এতো গুলা মাস পর আজ আরিশ মুগ্ধ মুখামুখি। মুগ্ধ যেমন আরিশকে দেখে অবাক হয়েছে তেমনি আরিশ মুগ্ধকে দেখে অবাক হয়েছে। আরিশ মুগ্ধকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। মেহেরের আরিশকে দেখে রাগ উঠে গেছে কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে মেহের। মুগ্ধের হাত শক্ত করে ধরলো মেহের। তারপর গিয়ে ওরা ৩জনেও সোফায় বসলো। আজকে এখানে সবাই একত্রিত করেছে মেহের। তার সবার সাথে কথা আছে সেই জন্য।
মাহফুজ মেহেরেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
মাহফুজঃকি ব্যাপার মেহের তুই সবাইকে এখানে আসতে বললি যে?
মেহেরঃহ্যাঁ সবাইকে আসতে বলেছি কারণ আমার তোমাদের সবাইকে কিছু জানানোর আছে।
মাহফুজঃকি?
মেহেরঃ তোমাদের সবাইকে আমি এখানে আসতে বলেছি, কারণ আজ আমি তোমাদের অনেক এমন অজানা কথা জানাবো। যেটা তোমরা জানোনা। যা তোমাদের থেকে অজানা।
সালমাঃ কি বলতে চাও তা ক্লিয়ার করে না বললে কেউ কিভাবে বুঝবে।
মেজেরঃজ্বি আজ অনেক কিছু ক্লিয়ার করবো। তো প্রথমে আসি আমার মা বাবার মৃত্যুর ঘটনায়।

আমরা সবাই জানি আমার মা বাবা মারা গেছে একটা এক্সসিডেন্টে। সবাই এটাকে এক্সসিডেন্ট মানতে চাইছিলোনা। অনেকেই বলেছিলো এটা মাডার। তো আমি সেই জন্য সেই বহু বছর আগের ঘটনাটাকে খোঁজ লাগাই আর জানতে পারি যে আসলেই আমার মা বাবার এক্সসিডেন্ট আসলে কোনো দূর্ঘটনা নয় বরং এটা একটা পরিকল্পনা করা মাডার।

মেহের কথা শুনে সবাই চমকে গেলো। সালমা মেহেরের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। মাহফুজ মেহেরকে বলে,
মাহফুজ:কি বলছিস মেহের!
মেহের:হুম চাচ্চু। আমি ঠিক বলছি।

আমার মা বাবার যেই গাড়িতে এক্সসিডেন্ট হয় সেই গাড়িটার ব্রেক কেউ ইচ্ছা করে নষ্ট করে দিয়েছিলো। তাই সেই গাড়িটা ব্রেকফেল করে আর পাহাড় থেকে পরে যায়।
মাহফুজ:কে করেছে এসব জানতে পেরেছিস?
মেহের:হুম।
মাহফুজ:কে সে?
মেহের এবার কিছুসময় চুপ করে থেকে সালমার দিকে তাকিয়ে বলে,
মেহের:প্রিয় চাচি আমিই কি সব বলবো নাকি এবার আপনি আপনার মুখটা খুলবেন।
মেহেরের কথা শুনে সালমা ভিতু চোখে তাকায় ওর দিকে। মেহেরের কথায় সবাই যেনো আকাশ থেকে পরছে। সালমা ভিতু গলায় বলে,
সালমা:আ.আমি কি ব.বলবো।
মেহের:সেইতো আপনি কি বলবেন। আপনি বলবেন কেনো আপনি আমার মা বাবাকে মারলেন। আপনি বলবেন কি শত্রুতা ছিলো আপনার তাদের সাথে।
মেহেরের কথায় সালমা এবার ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। মাহফুজ সালমাকে বললো,
মাহফুজ: সালমা মেহের কি বলছে। এসব কি সত্যি। কি হলো বলো এসব সত্যি।
সালমা এবার আর থেমে থাকতে পারলোনা চিৎকার দিয়ে বললো,
সালমা:হ্যাঁ সত্যি। এটা সত্যি আমি মেহেজাবিন আর মেহেরাবকে মেরেছি। কিন্ত আমি শুধু মেহেজাবিনকে মারতে চেয়েছিলাম মেহেরাবকে না।
মেহের:কেনো! কেনো আপনি আমার মাকে মারতে চেয়েছিলেন বলুন।
সালমা: আমি আর মেহেজাবিন একই কলেজে পড়তাম। আমাদের সিনিওর ছিলো মেহেরাব। মেবেরাবকে আমার শুরু থেকে ভালো লাগতো ভালোবাসতাম আমি মেহেরাবকে। একদিন আমি ঠিক করি আমি মেহেরাবকে আমার মনের কথা জানাবো। যেদিন আমি মেহেরাবকে নিজের মনের কথা জানাতে যাই সেদিন জানতে পারি মেহেরাব মেহেজাবিনকে ভালোবাসে। সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তারপর অনেক চেষ্টা করেছিলাম মেহেরাবকে ভুলতে কিন্ত পারিনি। তারপর একদিন মেহেজাবিন ওর জন্মদিনের পার্টিতে আমাকে ইনভাইট করে। আমি সেখানে যাই সেখানে যাওয়ার পর মেহেজাবিনের ভাই আমার দিকে কুনজরে তাকিয়ে ছিলো আমি সেটা বুঝতে পেরে তাকে এরিয়ে চলছিলাম। কিন্ত সে আমাকে একটা ওয়েটারকে দিয়ে নেশা মিশানো জুস খাওয়ায়। তারপর আমার নেশার সুযোগ নেয় যে। পরেরদিন যখন নিজেকে বিছানায় নিজের সব থেকে দামি জিনিশ হারানো অবস্থায় দেখি সেদিন ও অনেক কেঁদেছিলাম। মেহেজাবিনের ভাই আমাকে ভয় দেখায় আমি যেনো কাউকে কিছু না বলি। সেদিনের মতো বাসায় এসে নিজেকে ঘর বন্ধি করে দিলাম। এর কয়েকমাস পর বুঝতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলামনা। মেহেজাবিনের ভাইকে জানালে সে বলে বাচ্চা ফেলে দিতে। আমি তার পায়ে ধরি বাচ্চা না ফেলার জন্য কিন্ত সে আমাকে অনেক অপমান করে। সমাজের মানুষের কথার ভয়ে বাবা মায়ের সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে নষ্ট করে দেই আমার বাচ্চাটাকে। এর কিছু সপ্তাহ পর বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে মাহফুজের সাথে। বিয়ের আগেও আমি জানতাম না যে মাহফুজ মেহেরাবের বড় ভাই। যেদিন আমার বিয়ে হয় সেদিন মেহেরাবকে দেখার পর জানতে পারি এটা। কি কপাল আমার যাকে ভালোবাসলাম তার বড় ভাইয়ের ঘরের বউ হলাম আমি। বিয়ের পর মাহফুজকে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কারণ চোখের সামনে মেহেরাবকে দেখতাম। এরপর দেখতে দেখতে মেহেরাব মেহেজাবিনের বিয়ে হয়ে গেলো। মেহেজাবিনকে আমি সয্য করতে পারতামনা একদম। ওকে দেখলে নিজের সাথে হওয়া সব অন্যায় এর কথা মনে পরে আর মেহেরাবের সাথে দেখলে আরো রাগ লাগে। মেহেজাবিনের বিয়ের কারণে ওর ভাই বাসায় আসতো সেখানে এসে আমাকে দেখে সেও অবাক হয়। এভাবেই যাচ্ছিলো দিন। বছর ঘুরতেই শুনি মেহেজাবিন প্রেগন্যান্ট। এই খবর শুনে সবাই খুশি হতে পারলেও আমি পারিনি খুশি হতে। মেহেজাবিনের ছেলে হবার পর আমি জানতে পারলাম আমি আবার প্রেগন্যান্ট। দেখতে দেখতে আমার মেয়ে হলো। কিন্ত মেহেজাবিনের প্রতি রাগ আমার কমছিলোনা। ওকে ওর ভাইকে দেখলেই আমার প্রতিশোধের নেশা জেগে ওঠে। এভাবে যাওয়ার পর মুগ্ধ আসলো ওদের ঘরে। একদিন আমি আমার হাতে আমার শশুড়ের করে যাওয়া দলিল পাই। সেখানে দেখি তিনি তার ছোট ছেলের বউয়ের নামে সম্পত্তির হাফ দিয়েছেন। বাকিটা ভাগ করেছেন তার ছেলেদের মাঝে। এটা দেখার পর মেজাজ আরো খারাপ হলো। তাই ভেবে নিলাম আর বাঁচিয়ে রাখবোনা মেহেজাবিনকে। পরিকল্পনা করলাম বাসায় থেকে ওকে মারা যাবেনা বাহিরে এটা করতে হবে। তাই সবাইকে নিয়ে চলে গেলাম পাহাড়ে বেড়াতে। সেখানে গিয়ে আমি ফিরে আসার দিন মেহেজাবিনের গাড়ির ব্রেক নষ্ট করিয়ে দেই। কারন কথা ছিলো মেহেজাবিন একা আসবে মেহেরাব কাজের জন্য যেতে পারবেনা। কিন্তু আমি জানতাম না যে মেহেরাব ওই গাড়িতে বসবে। এক্সসিডেন্টের জানতে পারলাম গাড়িতে মেহেজাবিন আর মেহেরাব দুজনেই ছিলো। ভয় হচ্ছিলো যদি ধরা পরে যাই। এরপর সব মিটে গেলো। পুলিশ কোনো তেমন প্রমান পায়নি যে এটা মাডার।

সালমা একটু চুপ করে শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলো,,,

এরপর মেহেরকে ওর মামারা নিয়ে গেলো আর মুগ্ধকে আনলো মাহফুজ। আমি মেহেরের মামাকে ভয় দেখিয়েছিলাম যদি সে মেহেরকে আমাদের কাছে দেয় তবে আমি ওকে মেরে দেবো যেমন ওর বোনকে মেরেছি আর এটাও সবাইকে বলে দেবো ও আমার সাথে কি করেছিলো। এই ভয়ে ওর মামা মেহেরকে এদিকে তেমন যোগাযোগ করতে দিতোনা। মেহেরের থেকে মুগ্ধকে আলাদা করে দিতে পেরেছিলো পুরোপুরি ওকে দেশের বাহিরে নিয়ে গিয়ে। আমি মেহেরের মামার থেকে তখন টাকা নেওয়া শুরু করি মুগ্ধের নাম করে। সব জায়গায় টাকা আনার সময় নিজেকে মুগ্ধের মা বলেছি আমি। মুগ্ধের আসলে কোনো দোষ ছিলোনা কিন্তু তবুও ও মেহেজাবিনের মেয়ে ছিলো তাই ওকে সয্য হতোনা আমার। আর তাছাড়া সম্পত্তির ভাগ ওকেও দিতে হতো। তাই ভাবতাম ওকে মেরে দেই কিন্তু এটা করলে বিপদ হতো। তাই ওকে অত্যাচার করতাম সবসময়। তারপর যখন ওর বিয়ে হয়ে যায় ভাবলাম আপদ বিদায় হইছে কিন্ত না পরে জানলাম ও স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছে এটা জেনে প্রথমে খুশি হলাম। জানতাম না তখন যে আমার মেয়েই এর মূলে আছে। মুগ্ধ বাসায় আসার পর মেহেরকে দেখে আমি ভয় পেয়েযাই। যদি মেহের সব জেনে যায় সেই ভয়ে। তাই আমি রিস্ক নিলাম মুগ্ধকে মারার। লোক দিয়ে হামলা করালার ওর উপড়। কিন্তু মুগ্ধ বেঁচে যায় প্রানে। পরে জানলাম আরিশ যেই মেয়ের জন্য মুগ্ধকে ডিভোর্স দিয়েছে সেই মেয়ে আর কেউনা সায়মা। এটা জানার পর আমি ভয় পাই। যে মেহের জানলে তো সায়মাকে আস্ত রাখবেনা। এমনিতেই মেহের টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ করেছে। তখনি বুঝতে পেরেছি মেহের কিছু জানতে পেরেছে। তাই সায়মাকে বুদ্ধি দেই বাচ্চা নেওয়ার। কিন্ত এতো সব করেও শেষ রক্ষা হলোনা। ঠিক সেই মেহের সব জেনে গেলো। তবে ভালোই হয়েছে আমার প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে মরেছে মেহেজাবিন তার ভাই। আমার আর কোনো আফসোস নেই এখন ধরা পরার। তবে হ্যাঁ আরেকটা কথা বলেই দেই তোমাদের মামাকেও আমিই মেরেছি। তোমার মামার সব থেকে কাছের সেক্রেটারিকে দিয়েই খুন করিয়েছি। আমি সফল আমার প্রতিশোধে।

সালমার কথা শুনে রুমে থাকা সবাই স্তব্ধ হয়েগেছে। মুগ্ধ তো যেনো একদম ঘোরে চলে গেছে। মাহফুজ সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে সামিয়াকে ওর স্বামী চেয়ার টেনে বসালো। সায়মা একদম বোবার মতো চুপ আর আরিশ সেও চুপ! এক মা মেয়ে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা ভাবছে আরিশ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here