#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____________
পু’ড়ে যাওয়া হাত নিয়েই রান্না করতে হলো আমাকে। পুরো শরীর ব্যাথায় টনটন করতেছিলো। ভেতর থেকে কেমন একটা হাহাকার আসতেছে তারপরও টিকে থাকতে হচ্ছে। এ বাড়িতে কু’কু’রকেও ততটা দাম দেওয়া হয় যতটা বাড়ির বউকে দেওয়া হয় না। নাহ নাহ ভুল বললাম, বড় বউ আর ছোট বউকে দাম দেওয়া হয় শুধু অ’ত্যা’চার করা হয় মেজো বউকে। কারণ সে তো দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। মোটা টাকার যৌ’তুক তো দিতে পারেনি এই বাড়ির লোকদের। পু’ড়ে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ কান্না পেলো। হাতটা আলতো ভাবে ছুঁয়ে নিজের পরিণতির কথা ভেবেই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথেই কোথা থেকে তন্ময় এসে সেই পো’ড়া হাতই চেপে ধরে। ব্যাথায়, কষ্টে আর্তনাদ করে উঠি। তন্ময়ের সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতো টেনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। ভাঙা গলায় বললাম,
‘আমার হাত ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি ভীষণ ব্যাথা পাচ্ছি।’
তন্ময় ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকায়। আমি আঁতকে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি৷ তাতে বিশেষ লাভ হলো না। তন্ময় আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন। সহ্য করতে না পেরে চোখ থেকে একাই ঝড়ের মতো জল পড়তে থাকলো। সব কিছু উপেক্ষা করে উনি আমাকে টেনে আনলেন লিভিং রুমে। ছুড়ে ফেললেন আমার শ্বাশুড়ির পায়ের নিচে। আমি কোথায় আছি সব ভুলে আগে হাত টা আগলে নিলাম। মানুষ কতটা নি’ষ্ঠুর হতে পারে তা এদের না দেখলে জানা হতো না আমার। হাতে বার বার ফু দিতে থাকলাম। জায়গা জ্ব’লে যাচ্ছে। এর মধ্যেই কানে আসলো তন্ময়ের কয়েকটা অকথ্য ভাষার গা’লি। কান ঝা ঝা করে উঠে। আমি সব ব্যাথা ভুলে তাকায় তার দিকে৷ সে অকথ্য ভাষায় আরো কয়েকটা গা’লি দিয়ে বললো,
‘তুই আমার মা, রিতু এদের সাথে খারাপ ব্যবহার করিস কোন সাহসে? তোর কি যোগ্যতা আছে ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার!’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। একবার রিতু আর একবার শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালাম। তারা মিটমিট করে হাসছে। রাগে আমার গা জ্বা’লা করে ওঠে। কিন্তু উত্তর দেওয়া মানেই নিজের পায়ে নিজের কু’ড়োল মা’রা। আজ যতটুকু মা’ইর খাইছি এরপর আর শরীরে একফোঁটাও শক্তি নেই। আমি কিছু বললাম না। বড় জা চেঁচামেচির আওয়াজে ছুটে আসলেন লিভিং রুমে। এসেই আমাকে আগলে নিয়ে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘কি হয়ছে? তুমি ওর সাথে এমন করতেছো কেন?’
পাশ থেকে শ্বাশুড়ি মা হুং’কার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘বড় বউ মা তুমি চুপ করে থাকো। ওদের ব্যাপার ওদের মিটাইতে দেও।’
তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘তুমি চুপ করে আছো কেন? তুমি কোন সাহসে আমার মা আর নিতুর সাথে খারাপ ব্যবহার করছো বলো!’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘আ-আমি কিছু করিনি।’
ব্যাস সাথে সাথেই এক লা’থি মা’র’লেন উনি। ছিটকে পড়লাম কিছুটা দুর। ভয়ে, ব্যাথায় কান্না করে দিলাম। বড় জা রেগে বললেন,
‘তন্ময়! খবরদার আর ওর গায়ে হাত দিলে তোমাকে কিন্তু আমি মানবো না। তোমরা মানুষ নাকি জা’নো’য়া’র!’
শ্বাশুড়ি মা রেগে গেলেন। বড় ভাবিকে যা তা ভাষায় গা’লি দিলেন। বড় ভাবিও রেগে তর্ক শুরু করলেন। এতকিছুর মধ্যে আমার বলার মতো কিছুই নাই। ভাবি রেগে রুমে চলে গেলেন। সে কিছুতেই এবাড়িতে থাকবে না। শ্বাশুড়ি মা আমার কাছে এসে কিছু অকথ্য ভাষায় গা’লি দিয়ে বললেন,
‘এই অ’লক্ষীর জন্য আজ আমার সংসারে এতো অশান্তি।’
আমি কিছু বলার মতো পেলাম না। এবাড়ি তো কবেই ছেড়ে দিতাম শুধু মাত্র বাবা-মা নামক মানুষগুলোর জন্য ছাড়তে পারিনি। অবশ্য আমার সন্দেহ হয় তারা আসলেই বাবা-মা কি না! তারা জানে তাদের মেয়ের শা’রীরিক, মানসিক অত্যা’চারের কথা তবুও তারা তাদের মেয়েকে বাঁচাতে আসেনি৷ এই ন’র’ক থেকে বের করে নিয়ে যায়নি। তাদের একটু সাপোর্ট পেলে আমি এদের মুখে থু’থু দিয়ে কবেই এই নোং’রা লোকদের মধ্যে থেকে চলে যেতাম। আমার ভাবনার মাঝেই তন্ময় তার মা’কে বললো,
‘মা আমি মায়াকে ডিভোর্স দিতে চাই।’
আমি চমকে তাকালাম। শ্বাশুড়ি মা খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘কি বললি বাবা! তুই সত্যিই এই অ’লক্ষী কে বিদায় করবি!’
তন্ময় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ। তাছাড়া এই ফ’কি’ন্নি’র বা’চ্চার জন্য আমাদের পরিবারে যেমন অ’শান্তি হচ্ছে তেমনই ‘ও’ আমার জীবনেও অ’শান্তি। আবার আমার পিছু পিছু গোয়েন্দাগিরি করতে যায়।’
শ্বাশুড়ি মা আর রিতু খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলাম। আমাকে ডিভোর্স দেবে এতে আমার আ’ক্ষেপ না শান্তি আসতেছে মনে। এই ন’র’ক থেকে ন’র্দমায় পঁ’চে ম’রা ভালো। ইশশ কেনো যে ডিভোর্স টা আরো আগে দিলো না! আমার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠের ডাক ভেসে এলো,
‘বুবু!’
আমি চমকে উঠলাম। ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার ছোট ভাই মাহিদ। ওকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। আমার স্বামী, শ্বাশুড়ি আর ছোট জাও সেদিকে তাকায়। শ্বাশুড়ি চোখ মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বলে,
‘আসছে আরেকটা ফ’কি’ন্নি’র বা’চ্চা।’
আমি শুনতে পেয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। আমাকে যা বলে বলুক তাই বলে আমার ভাইকেও বলবে! মাহিদ আমার কাছে এগিয়ে এসে কিছু না বলেই হাত ধরে টেনে তোলে। ক্ষ’ত জায়গায় জোড়ে চাপ লাগায় ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায়। তবুও নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘তুই আসবি বলিসনি তো ভাই!’
মাহিদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে৷ পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। হাতের পো’ড়া দাগ, কালশিটে পড়ে যাওয়া ক্ষ’ত কোনো কিছুই যে ওর চোখ এড়ায়নি তা খুব করে বুঝলাম। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। আমি দ্রুত ওর হাত টেনে ধরলাম। ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তন্ময়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
‘আপনার যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন বুবু সাইন করে দিবে।’
তন্ময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কোথায় পাঠাবো?’
‘আমাদের বাড়িতে।’
শ্বাশুড়ি মা ব্যাঙ্গ করে বলে, ‘কোথাকার কোন মহারাণী এসেছেন উনি যে উনাকে আবার পেপার পাঠিয়ে দিতে হবে!’
মাহিদ হেঁসে বলে, ‘অ’লক্ষী তাড়াতে হলে তো আপনাদেরই ডিভোর্স পেপার পাঠাতে হবে।’
শ্বাশুড়ি কিছু বললেন না। ভাই আমার হাত আলতো করে ধরে বলে, ‘চলো বুবু!’
তন্ময় বলে, ‘কোথায় যাবে?’
‘আপাতত বাড়িতেই নিয়ে যাবো। দেখি তারপর না হয় থানায় যাওয়া যাবে।’
তন্ময় ক্ষে’পে উঠে বলে, ‘থা’নায় যাাবে মানে কি হ্যাঁ? ওর সাথে এখনো আমার ডিভোর্স হয়নি তাই ‘ও’ কোথাও যাবে না।’
মাহিদ পাত্তা দিলো না। পুরো ঘটনায় আমি নিশ্চুপ। মাহিদ যে কতটুকু শুনেছে তা আমি জানি না৷ তবে আমার শরীরের ক্ষ’ত গুলো দেখে যা বুঝার ‘ও’ বুঝে নিয়েছে। মাহিদ আমার হাত টেনে সামনে এগোতে এগোতে বলে,
‘পারলে আটকে দেখান। দেখি আপনার কলিজা কত বড়!’
তন্ময় তে’ড়ে আসতে নিলে শ্বাশুড়ি মা হাত দিয়ে আটকায়। ফিসফিস করে কিছু বললে শান্ত হয়ে যায় তন্ময়। আমার ভাই কোনোদিকে না তাকিয়ে আমাকে ধরে ধীরে ধীরে সদর দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে পেছনে ফিরে বলে,
‘আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আল্লাহ আপনাদের শা’স্তি এমন ভাবে দিবে যে প্রতিটা মিনিটে মিনিটে আফসোস করবেন আর মৃ’ত্যু কামনা করবেন।’
আর এক মিনিটও দাঁড়ায় না। এতোদিন পর ন’র’ক থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে চোখ ভিজে আসে। মাহিদ শান্ত কন্ঠে বলে,
‘গত ৪ বছরে কি একটা বারও আমাকে বলতে পারতে না বুবু? তোমার সাথে এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমি জানিই না!’
আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, ‘বাবা-মা কে বলেছিলাম ভাই। কিন্তু তারা আমার সাথ দেয়নি উল্টো ঠেলে দিয়েছে এখানে। তুই তো ছোট তোকে কি বলতাম!’
মাহিদ দীর্ঘশ্বাস নেয়। আমি একবার বাড়িটার দিকে তাকায়। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে। এই বাড়ির মানুষগুলোকে আমি কখনো মাফ করবো না। যতটা আঘাত এরা আমাকে করেছে তার থেকেও বেশি আঘাত করেছে আমার বাবা-মা। তারা মান সম্মানের এতোটাই পরোয়া করে যে নিজের মেয়ের কথা ভুলে গেছে। আমি জানি আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্য করেন কিন্তু এতো ভালো আমার সাথেই হওয়ার ছিলো! আমি এদের সবার শা’স্তি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। হোক ইহকাল নয়তো পরকাল! বিনা কারণে আমাকে আঘাত করার প্রত্যেকটা আঘাত আল্লাহ ওদেরকেও দেবে। আমি চাইলেই হয়তো পুলিশের কাছে যেতে পারতাম কিন্তু তন্ময়রা টাকা দিয়ে ঠিকই সব কিছু ঠিক করে নিতো। আমি উকিল দিয়ে হয়তো কেইস লড়তে পারতাম কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট, পর্যাপ্ত টাকা কোনোটাই আমার নেই। আমাদের মেয়েদের জীবনটাই কেমন যেনো এলেমেলো। সব সময় সব কিছু আমাদেরই সহ্য করতে হয়। আত্মসম্মান আমাদেরও আছে কিন্তু আমার মতো পরিস্থিতিতে যে পড়ে সে জানে এই সময় কতটা আত্মসম্মান দেখানো যায়! সবসময় প্রতিবাদ করা যায় না। আজ যদি বাবা মা তাদের ওপর বোঝা না ভেবে অল্প বয়সে বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করাতো হয়তো এমন হতো না আমার সাথে। আর এতকিছুর পরও যদি তারা আমাকে সাপোর্ট দিতো আমি এই ন’র’ক থেকে বের হয়ে যেতাম। তারা সাপোর্ট না দিলেও যদি পড়াশোনা টা অন্তত শেষ করতে পারতাম তাহলে যেভাবেই হোক এখান থেকে বের হয়ে যেতাম। কোথাও না কোথাও নিজের জন্য একটা ছোট্ট জব নিয়ে থেকে যেতাম কিন্তু আমি তো একদম শূণ্য হাতের। না আছে সাপোর্ট, না আছে পড়াশোনা, না আছে কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা তাহলে কি করে করতাম প্রতিবাদ! আর সামান্য উচু গলায় কথা বললেই যেখানে আমার মা’র খেতে হয় সেখানে প্রতিবাদ করতে চাওয়াটা আমার কাছে বিলাসিতা মাত্র। প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত পড়াশোনা শেষ করা। আমি জানি ইসলামে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বলা হয়েছে কিন্তু সব মেয়েই যে শ্বশুরবাড়ি ভালো পাবে তার কি গ্যারান্টি! আমাদের সমাজ এতো পঁ’চে গেছে যে এখানে যৌ’তুক না দিলে বাড়ির বউয়ের ওপর শা’রীরিক, মানসিক অ’ত্যা’চারের কমতি রাখে না। কার ভাগ্যে কি আছে আমরা তা কেউই জানি না কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়া থাকলে অন্তত এমন পরিস্থিতিতে নিজে বের হয়ে কিছু করা যায়।
মাহিদের ডাকে ভাবনা থেকে বের হলাম। তাার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলে, ‘কি ভাবছো! বাড়ি যাবে না?’
‘বাড়িতে বাবা-মা আমাকে ঢুকতে দিবে?’
‘কেনো দিবে না! ওটা তো তোমারও বাড়ি।’
আমি হাসলাম। মাহিদের বাহুতে হাত রেখে বললাম, ‘ওটা আমার বাড়ি হলে গত ৪ বছর থেকে আমাকে কষ্ট পেতে হতো না। মা’র খেতে খেতে শরীরের ক্ষ’ত বাড়াতে হতো না। মেয়েদের নিজের বাড়ি হয় না ভাই। তারা বরাবরই সবার ওপর বোঝা হয়ে থাকে।’
মাহিদ শক্ত করে আমার হাত ধরে বলে, ‘আমি আছি না বুবু! আমি তোমাকে সবকিছু থেকে আগলে রাখবো৷ তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।’
আমি হাসলাম৷ ভাইয়ের সাথে পা মিলিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি জানি সামনে আমার কি কি সহ্য করতে হবে! এই সমাজের সাথে সাথে আমার বাবা-মাও হয়তো আমাকে বাঁচতে দিবে না। অবশ্য এমন জীবনে বেঁচে থেকে কি হবে! যে জীবনে সুখ নামক বস্তুর এক বিন্দুও দেখা পেলাম না। তবে কি আমি নামক মায়া এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যাবে!
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনারা তো দেখি এক পর্ব পড়ে একদম ফুল থিম জেনে গেছেন! যদি একই থিমের গল্প লিখতে হতো তাহলে আমি লিখতামই না।)