শেষ বিকেলের আলো পর্ব ১

দুই দিনের বাচ্চা কে নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে রুমাইসা। হাতে একটা ছোট ব্যাগ। কই যাবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দুনিয়া টা কত পাষান আর নিষ্ঠুর খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় গলা ফেটে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সদ্য জন্মানো বাচ্চাটা যেন মায়ের কষ্ট টা খুব আন্দাজ করতে পারছে। তাই তো চুপচাপ ঘুমাচ্ছে। রুমাইসার কোলে তার মেয়ে। সকাল বেলা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে এসেছে মেয়ে কে নিয়ে। টাকার অভাবে ডেলিভারি হচ্ছিল না।তবুও ওর অবস্থা খারাপ দেখে এক রকম বাধ্য হয়ে হসপিটালে ওর ডেলিভারি হয়। কিন্তু ওদের এক কথা টাকা ছাড়া এক পাও নড়তে দিবে না বাচ্চা নিয়ে। রুমাইশা কত কান্না করল, কিন্তু ওর কথা শুনতে নারাজ ডক্টর । শেষ এ বাধ্য হয়ে এক আয়ার সাহায্য নিয়ে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে আসল।

এসব ভাবতেই চোখের পানি টুপ করে বাচ্চার কপালে পড়ল। রুমাইসা হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে সামনের একটা গলি ধরে এক বস্তির দিকে এগিয়ে গেল। শুনেছে এই এলাকা টায় একসাথে অনেক গুলো বস্তি বাড়ি আছে।গলির মুখ শেষ করতেই দেখা গেল এক সিরিয়ালে অনেক গুলো ঘুর। সামনে আগাতেই কিছুটা দূর থেকে ই চিৎকার চেচামেচি শুনা যাচ্ছে মানুষের। রুমাইসা ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে গেল। দুজন মহিলা কি নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। একজন আরেকজনের গায়ে হাত তুলছে আর সেটা উপভোগ করছে বাকি বস্তিবাসী। রুমাইসা কে দেখে দু চারজন তাকাল। কিন্তু বেশিক্ষন দৃষ্টি দিল না। চোখ ঘুরিয়ে আবার ঝগড়া উপভোগ করতে লাগল লোক গুলো। কি নোংরা গালিগালাজ করছে একজন আরেকজন কে।আর এক একজনের গলা যেন মাইক থেকে কম না।

রুমাইসার মেয়েটা এত চিৎকার এ উঠে গেল। ভয়ে জোরে জোরে কান্না করতে লাগল। রুমাইসা বারবার আদর করে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এবার বস্তির জমাট বাধা লোকজনের দৃষ্টি গেল ওর দিকে। মহিলা দুজন ও ওর দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়েকে বাচ্চাসহ এভাবে দেখে সবাই কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রইল। রুমাইসা বাচ্চার কান্না থামাতে গিয়ে আড় চোখে দেখছিল সবাইকে। খুব অস্বস্তি লাগছে ওর কাছে।

একটা বয়স্কা মহিলা ওর সামনে এসে দাড়াল। বাচ্চাটাকে না ধরেই, চোখ দিয়ে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। রুমাইশা ভয় পাচ্ছে কিছুটা। না জানি কোথায় চলে আসল। মহিলা ভারী গলায় বলল “কি গো মাতারি, মাইয়ারে খাওন দেও না কে? মাইয়া তো খিদায় কানতাসে দেহি।”

রুমাইশা করুন চোখে মহিলার দিকে তাকাল। আশেপাশের উৎসুক জনতা কানাঘুষা করতে লাগল। রুমাইশা ভাঙা গলায় বলল “খাবার নেই আমার কাছে। বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না তাই কান্না করছে।”

মহিলা চোখ বড় বড় করে বলল “এই মাতারি, কি কও তুমি। মাইয়ারে কিছু খাওয়াও নাই? এ কয়দিন হইল বাছছার? ”

“দুই দিনের বাচ্চা আমার। থাকা খাওয়ার কোন জায়গা নেই। আপনাদের এইদিকে কি থাকার মত জায়গা হবে কোন? ” রুমাইশা বাচ্চা টা কে বুকের সাথে জড়িয়ে বলল।

মহিলা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল “একটা রুম আসে খালি।তয় ওই রুমে এক বেটি ফাসি দিসিল।এরফর তে কেউ থাহে না।তুই থাকতে চাইলে ১০০০ টাকা দেওন লাগব।এমনে রুমে সব ই পাবি ফাও ফাও। বেটির জিনিস হাত লাগায় নাই কেউ ডরে। ”

রুমাইশার গলা শুকিয়ে গেল।প্রথমত ফাসি দেওয়া রুম তারপর আবার ১০০০ টাকা। আমতা আমতা করে রুমাইসা বলল “টাকা টা কি এখনি দিতে হবে?”

মহিলা রুমাইসার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে কোমড়ে হাত দিয়ে বলল “কেন টেকা নাই নাকি? ”

“আসলে আমার হাতে একটা টাকাও নেই এখন। আমি মাস শেষ এ টাকা দিয়ে দিব। আমাকে আমার বাচ্চা টা কে নিয়ে একটু থাকার জায়গা যদি দিতেন দয়া করে আমি খুব কৃতজ্ঞ হতাম।”

আশেপাশে আমার কথার গুঞ্জন শুরু হল। একটা যুবতী বয়সের মেয়ে এগিয়ে এসে বলল “বাচ্চার বাফে কই? তুই একা ক্যা? ”

রুমাইসার যেন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কি বলবে মানুষ কে। যে মেয়ে বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হয়ে বাচ্চা কে জন্ম দেয় তাকে কি এই সমাজ মেনে নেয় আদৌ? এতগুলো মানুষের সামনে কি করে এই তিক্ত সত্য টা স্বীকার যাবে রুমাইসা?

মেয়েটা ওকে চুপ থাকতে দেখে সেই বয়স্কা মহিলা কে হাত দিয়ে খোচা দিয়ে বলল “দেখো খালা, কোন পাপ লইয়া আইসে তোমার বস্তিত। কোন বেডার পাপ লইয়া ঘুরতাসে কে জানে।”

রুমাইসা এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুহুর্তেই যেন গলায় একটা প্রতিবাদ ধ্বনি বেজে উঠল। চিৎকার করে বলল “ও কোন পাপ নয়।আমার নিষ্পাপ মেয়ে।আর ওর বাবা ওর দুনিয়াতে আসার আগেই মারা গেছে। আমাদের থাকার কোন জায়গা নেই, তাই হন্য হয়ে এখান থেকে ওখানে ঘুরছি।”

রুমাইশা কান্না করে দিল। কোলের বাচ্চাটাও যেন মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কান্না শুরু করে দিল।রুমাইসা বাচ্চাটাকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে লাগল।ওর উত্তর শুনে সবাই চুপ হয়ে আছে। বয়স্কা মহিলা বলল “আইচ্ছা আইচ্ছা। বুঝতে পারসি আমরা। ওই মনির মা আমার ঘরের তে ওই রুমের চাবি টা দে ছেড়িরে। ”

মনির মা দ্রুত পায়ে ভীরের মাঝে মিলিয়ে গেল। এত সময় সামনে থেকে দাড়িয়ে পুরো কাহিনি দেখছিল। আর অর্ডার পেতেই যেন সুড়সুড় করে পা বাড়িয়ে চলে গেল। রুমাইশা ওর মেয়ে কে কোলে নিয়ে থামাতে চেষ্টা করছে। ঘরে যেয়েই আগে দুধ মুখে দিবে। এতলোকের সামনে তো আর সেটা করতে পারবে না।মহিলা যেন ব্যাপার টা বুঝতে পারল। একটু কঠিন স্বরে বলল “এইদিকে খাড়ায় রইস কেন? আহো আমার পিছে পিছে আমি ঘর দেখাইতাসি। ”

রুমাইসা মহিলার পিছে পিছে হাট্টে লাগল। ভীর মুহুর্তের মাঝে ভেঙে গেল। যে যার যার মত সরে গেল সেখান থেকে । ঝগড়ারত মহিলার গলা আবার পাওয়া যাচ্ছে পেছন থেকে । রুমাইসা কান দিল না সেখানে। এই পরিবেশ এ এগুলা অসম্ভব কিছু নয়। নিয়তির কি খেলা। ফ্লাটে থাকা রুমাইশা আজ এত নোংরা বস্তিতে থাকতে এসেছে। শুধু মাত্র নিজের নাড়ির টানে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুমাইশা।

মহিলা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিতেই একটা ভাপসা গন্ধ নাকে আসল রুমাইসার।নাক টা চেপে ধরে অন্ধকার রুমে ঢুকল ও। মহিলা রুমাইসার দিকে তাকিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বলল “ওরে বাবা, থাকতে আইসো বস্তিতে আবার নাক খুইলা গন্ধ নিতে পার না। শুনো মাইয়া, এই বস্তিতে এইসব নিয়াই থাকতে হবে। এই রুমে সব ই আসে।খাট, আলনা,মগ গেলাশ,বাটি সব ই পাইবা। খালি ছেমড়ি গলায় দড়ি দিয়া মইরা আমার ঘর টারে একদম শেষ কইরা দিয়া গেসে। শালী মরার লাইগা আমার ঘর টাই পাইসিল।”

অশ্রাব্য ভাষায় বেশ কয়েকটা গালি দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হল মহিলা। রুমাইশা দাত চেপে এগুলো শুনছিল। একজন মৃত ব্যক্তির নামে কেউ এত নোংরা কথা বলতে পারে ওর জানা ছিল না। মহিলা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “তোমার নাম কি হুনি? ”

“রুমাইসা ” খুব কোমল গলায় বলল কথাটা ও।

“নাম দেহি সুন্দর ই। মাইয়ার নাম কি রাখস? ”

“এখনো রাখি নি। মাত্র ই জন্ম হল ওর। আজ কালের ভেতর রেখে দিব। ”

মহিলা এত সময় রুমের চারদিক এ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। এক একটা জিনিস যেন গুনে গুনে রাখছিল যাতে চুরি হলেও ধরতে পারে। রুমাইশার খুব বিরক্ত লাগছিল। খুব ক্লান্ত লাগছে ওর কাছে। মহিলা গেলে একটু শুয়ে পড়ত।

মহিলা আরো কর সময় বক বক করে যাওয়ার সময় রুমাইশার মাথায় হাত রেখে বলল “শুন ছেড়ি। রুমে কেউ থাকতে চায় না ফাসির ঘর দেইখা। তুই তো ঠেকায় পইড়া থাকতাসোস। তাও কইয়া যাই, দোয়া দুরুদ পইড়া লইস। বাচ্চা তো ছোট খেয়াল রাহিস একটু। যা আরাম কর গা। ”

রুমাইশার এতটুক স্নেহ খুব ভালো লাগলে। অচেনা মহিলা টা যতই মুখের ভাজে ভাজে কাঠিন্য আর গলায় কর্কশ ধ্বনির ব্যবহার করুক তবুও একটু আধটু মায়া আছে মনের ভেতর। রুমাইশা মুচকি হেসে বলল “আচ্ছা খালা দোয়া করবেন। ”

মহিলা দরজার সামনে যেয়ে আবার ফিরে এসে বলল “তোর কাছে খাবার আসে নি? ”

রুমাইশা মুখ টা লজ্জায় নিচু করে বলল “নাহ খালা। খাবার টাকা কিছুই নেই। ”

মহিলা কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রুমাইশা মেয়ের দিকে তাকাল। এখন ঘুমিয়ে আছে। তেল চটচটে তোশকের উপর ই শুইয়ে দিল মেয়েকে। হাতের ব্যাগ টা বিছানায় রেখে ব্যাগ থেকে একটা ওড়না বের করে সেটা দিয়ে বাবুকে আগা গোড়া মুড়িয়ে শুইয়ে দিল। সকাল থেকে বাবু না খাওয়া। হাত মুখ না ধুইয়ে বাচ্চার মুখে খাবার দিবে না রুমাইশা। দরজা খুলে বের হয়েই ওয়াশরুম। ফাসির রুমের পাশেই বলে মানুষ জন দিনের বেলায় এখানে তেমন আসে না। রুমাইশা কলের পানি তে মুখ ধুতে ধুতে নিজের জীবনের গল্প টা মনে করছে। চোখের পানি আর মুখের পানি মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

অভির সাথে প্রেম টা খুব জমে গিয়েছিল কলেজ লাইফে। অভি ছিল চাকুরী করা একজন যুবক। আর রুমাইশা ছিল কলেজের দশটা সুন্দরী আর ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীদের মাঝে একজন। পরিচয় টা হয়েছিল খেলার মাঠে সবুজ দলের জার্সি কে সাপোর্ট করা নিয়ে। অভি ছিল হলুদ দলের ক্যাপ্টেন।সে সময় সে ছিল সেরা প্লেয়ারদের একজন। দেখতে যে আহামরি খুব সুন্দর ছিল তা না।গায়ের রং টা ছিল খুব চাপা। তবে দেখার মত ছেলে ছিল অভি। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও লম্বা উচায় মোটামুটি পার্ফেক্ট বলা চলে। সেই মাঠে সবুজ দল হেরে যাওয়ায় খুব করে বকাঝকা করছিল রুমাইশা হলুদ দলের ছেলেপেলেদের।

এরিমাঝে অভি এসে ট্রফি হাতে সামনে দাড়াল। রুমাইশার সামনাসামনি দাড়িয়ে বলল “এই যে পিচকু, এত সময় যেন কি কি বলছিলে আবার বল তো? ”

রুমাইশা থতমত খেয়ে গেল। মুখ দিয়ে এবার আর কথা বের হচ্ছে না। কোন মতে ঠোঁট কামড়ে বলল “ট্রফি হাতে আপনাকে ছাগলের মত লাগছে। ”

বলেই এক ছুটে দৌড় দিল স্টেডিয়ামে এর বাইরে। এদিকে অভি হা করে চেয়ে রইল। হুট করে কি হল বুঝতে পারল না।

বাচ্চার কান্নার আওয়াজে রুমাইশার ঘোর কাটল। কোন মতে হাত মুখ ধুয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে । বাচ্চা টা কে শুইয়ে খাওয়াতে লাগল রুমাইশা। আবার ডুবে গেল পুরান গল্পে।

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ Tanisha Ahmed
পর্ব ১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here