শেষ বিকেলের আলো পর্ব শেষ

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ৩০

আপনার জীবনের খারাপ মুহুর্তে কিংবা প্রচন্ড সমস্যায় যখন আপনি জর্জরিত, ঠিক তখন আপনার পাশে যদি কেউ ছায়ার মত আপনার থাকে, তখন সমস্যা বা যন্ত্রণা যত বড় ই হোক না কেন, সেটার সাথে যুদ্ধ করা সহজ হয়।

রুমাইসার পাশে ইহান ছিল বিয়ের পর সব সময় ছায়ার মত। প্রতিটা সময় ইহান রুমাইসা কে মনের শক্তি দিয়েছে। খুব কম মানুষ এই সময় গুলোতে কারো সাহায্য নিয়ে আবার উঠে দাড়াতে পারে।

সাহিল যখন মাথার উপর একটা তীব্র যন্ত্রণা হয়ে দাড়ালো, তখন ইহানের সাথে বাড়ির সবাই ওর পাশে দাড়ালো। সাহিল কে শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে মামলা করা হল। জাস্ট ৩ দিনের মাথায় সাহিল ধরা পড়ল। যদিও সবার মাঝে জানাজানি হয়েছিল ঘটনাটা, তবুও সেই সময় রুমাইসার পাশে ছিল ওর ইহান আর তালুকদার পরিবার। নাসিমা বেগম ই প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল এ ব্যাপারে। যে ছেলে মা কে মেরে, তার উপর দিয়ে হেটে চলে যেতে পারে, তাকে সন্তান ভাবলে ও পাপ হবে। সাহিলের মামলা-মকর্দমা চলল প্রায় ২ মাস। আর তার মাঝে সাহিল অসংখ্য বার হুমকি দিয়েছে রুমাইসা আর ইহান কে। কিন্তু দুই মাস পর সাহিলের ৫ বছরের জন্য জেল হয়ে যায়। রুমাইসা কে এটেম্পট টু রেপ, নিজের মা কে আর সন্তান কে হত্যা করার চেষ্টা আর নিয়মিত ইয়াবা আর নেশা করার জন্য ওর শাস্তি হল।

তারপর তালুকদার পরিবারে যেন শান্তি নেমে আসল। ইমতি বড় হচ্ছিল আর ইহান রুমাইসার ভালোবাসার বন্ধন তত বাড়ছিল।বিয়ের প্রথম ম্যারিজ ডে তে রুমাইসা ইহানের জন্য রাতে সারপ্রাইজ এরেঞ্জ করল। রুম টা কে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল।রুমাইসা কেবল ঘড়ির কাটা দেখছে আর রাত ১২ টার অপেক্ষা করছে। রাত ১১.৪০ বাজে, অথচ ইহান বাইরে যে গেছে আর ফিরে আসার নাম ই নেই। এইদিকে শাড়ি পরে, মেকাপ করে রুমাইসা পরী সেজে বসে আছে। কিন্তু মনের ভেতর অজানা উৎকন্ঠা জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। রাত ১১.৫৫ বেজে গেল ইহানের না লাগছে ফোন, না ফিরছে বাসায়। রুমাইসার আত্মায় পানি নেই। কিছু হল কিনা রাস্তায় আবার। পাগলের মত একবার বারান্দায় একবার রুমে পায়চারি করছে। তা উপর বাইরে প্রচন্ডরকম বৃষ্টি হচ্ছে। ১২ টা বাজতেই ঘড়ির কায়া ঢং ঢং করে বেজে উঠল।রুমাইসা ফ্যাকাসে চোখে চেয়ে রইল ঘড়ির দিকে। ইহান কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সারাদিন কত রকম প্লান করেছে। অথচ ইহান ই বাসায় আসছে না। খেয়ে বলল, কোন বন্ধু নাকি ফোন দিয়েছে যেতে হবে। হুটহাট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। রুমাইসার সহ্য হচ্ছে না কিছু। এই অনুভূতি টা যে মানুষ কে কতটা অস্থির করে তুলে সেটা বর্ননা করার মত না।

রাত ১২.৩০ মিনিটে দরজার বেল বাজল। রুমাইসা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল কাক ভেজা হয়ে ইহান দাড়িয়ে আছে আর হাতে একটা প্যাকেট। খুব সম্ভবত কেকের প্যাকেট।
ইহান কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হ্যা… হ্যা… হ্যাপি ম্যা… ম্যা.. ম্যারিজ ডেএএ মিসেস ইহান। ”

রুমাইসা বোকার মত দরজায় দাড়িয়ে রইল।ভাবলো উইশ করবে ওকে আগে, অথচ সারপ্রাইজ তো পেল ই উল্টা ইহান ই আগে উইশ করে বসে রইল। রুমাইসা দরজার বাইরেই ইহান কে জড়িয়ে ধরল। ইহান তখনো ঠান্ডায় কাঁপছে।

“আমার এমন সারপ্রাইজ লাগবে না কোন দিন। আপনি আমাকে না বলে এভাবে চলে গেলেন। জানেন আমি কত ভয় পেয়েছিলাম। এমন সারপ্রাইজ কেউ দেয়। আমার কোন কেক, গিফট কিছু লাগবে না। আমার শুধু ইহান কে চাই। ”

ইহান কাঁপতে কাঁপতে হাসছিল রুমাইসার কথা শুনে। রুমাইসা মাথা টা একটু উঁচু করে বলল, “এত ভিজলেন কিভাবে? ”

ইহান বলল, “ভেতরে ঢুকে ফ্রেশ হইতে দেন ম্যাডাম। তারপর আপনার রোমান্স আর প্রশ্ন কইরেন। এই মুহুর্তে আমি শীতে জমে যাচ্ছি। ”

রুমাইসা লজ্জায় ইহান কে ছেড়ে কাচুমাচু করে দরজার পাশে দাড়িয়ে গেল। ইহান জুতো জোড়া বাইরে রেখে হাতের ব্যাগ গুলো রুমাইসা কে দিয়ে এক ছুটে রুমের ভেতর ঢুকল। রুমাইসা ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে খুশিতে হেসে দিল আর তখন একটা চিৎকার এর আওয়াজে কান খাড়া হয়ে গেল। এক ছুটে রুমে পৌছে দেখল রুমের ফ্লোরে ছড়ানো ফুলের পাপড়ির উপর আছাড় খেয়ে পড়ে আছে ইহান। রুমাইসার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল এটা দেখে।

প্রথমত মুখ দিয়ে হো হো করে হাসি বের হল। ইহান ওর দিকে তাকাতেই হাসি বন্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। ইহান কিছুটা রাগ করে বলল, “আপনার মনি মুক্তা দিয়ে বাধাই করা দাঁতের হাসি দেখানো বন্ধ করে আমাকে তুলেন আর তোয়ালে, কাপড় দেন। ”

রুমাইসা হাসি চেপে ইহান কে হাত ধরে তুলল। ইহান অপমানিত বোধ করছিল রুমাইসার সামনে। একটু রাগ নিয়েই কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ইহান যাওয়ার পর রুমাইসা কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল। এত সুন্দর করে রুমে ফুল ছিটিয়ে ম্যারিজ ডে লিখেছিল। এই ম্যারিজ ডে এর এম নেই, আর নেই, জি এর অর্ধেক নেই। আর ডে এ-র তো কিছুই নেই ফুল এলোমেলো হয়ে গেছে।রুমাইসার মুখ থেকে হতাশ সূচক ধ্বনি বের হল। ফ্লোরের কাদা মুছে রুমাইসা ব্যাগ গুলো নিয়ে বসল।

কেকের প্যাকেট টা খুলতেই দেখল উপরের হ্যাপি আর প্রথম বর্ষর ক্রিম প্যাকেটের উপর লেগে আছে। রুমাইসা হাসবে না কান্না করবে মাথায় ঢুকছেই না।কপাল টা ওর এত খারাপ, একটা জিনিস ও ভালো হল না আজকে। আর বৃষ্টি আসার আর সময় পেল না। পাশের প্যাকেটে রুমাইসার জন্য গোলাপের তোড়া ছিল। সেগুলোতে ও পানির ফোটা ছিল অনেক।রুমাইসা হতাশ হয়ে সবকিছু খুলে রেখে বসে রইল। ইমতি আজ দাদা দাদীর সাথে ঘুমিয়েছে। ভেবেছিল আজ ইহানের সাথে প্রথম বারের মত একান্ত কিছু মুহুর্ত কাটাবে, তা আর হল কই।

ইহান ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল রুমাইসা রুমে নেই। তবে মেইন দরজা লাগানো। তার মানে বারান্দায় আছে হয়ত। বিছানার উপর কেক খুলে পড়ে আছে। কেকের অবস্থা একদম নাজেহাল। ফুলের উপর পানি আছে এখনো। ফ্লোরের ফুলগুলো ও এখন নেই।

ইহান বুঝতে পারল রুমাইসা এসব দেখে খুব মন খারাপ করেছে। দুজনেই দুজনের জন্য প্লান করেছিল কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। তোয়ালে টা বিছানায় ফেলে রুমাইসার কাছে বারান্দায় গেল ইহান। মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে সাথে বৃষ্টির তীব্র ঝাপটা। ইহান পেছন থেকে রুমাইসা কে জড়িয়ে ধরল। রমাইসার কাছে এ স্পর্শ নতুন না। কোন সাড়া দিল না ও। চুপচাপ বিষন্ন মনে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।

ইহান রুমাইসার কাধে মুখ নিয়ে বলল, “সরি, আসলে আমি তোমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেখ সবকিছু তেই পানি পড়ে গেল। আমি এক্সট্রিমলি সরি।”

রুমাইসা বিষন্ন গলায় বলল, “সমস্যা নেই, আপনি আমার কাছে আছেন এর চেয়ে বেশি কিছু আমার প্রয়োজন নেই। আমি আমার লাইফের সব সুখ পেয়েছি। সামান্য এসব ব্যাপার নিয়ে হালকা একটু মন খারাপ হয়েছে ঠিক ই।বাট ইটস ওকে। ”

ইহান বলল, “মন খারাপ করার চান্স ই নেই। আমি তোমার জন্য আরো একটা সারপ্রাইজ রেখেছে। ”

রুমাইসা অবাক হল। পেছনে ঘুরতে চাইলে ইহান একটু দূরে সরে সেই সুযোগ টা করে দিল। রুমাইসা এবার ইহানের চোখে চোখ রেখে বলল, “কি সারপ্রাইজ রেখেছেন আমার জন্য আবার?”

ইহান প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে রুমাইসার সামনে ধরল। রুমাইসা অবাক চোখে দেখছিল বক্স টা। ইহান বক্স টা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ফ্রেম বেরিয়ে আসল। সেখানে ইহান রুমাইসা আর ইমতির ছবি খোদাই করে আকা। এত সুন্দর লাগছিল যে রুমাইসা চোখ সরাতেই পারছিল না। ইহান হেসে বলল, “এটা ছোট্ট একটা উপহার ছিল। এটা জন্য ই এত দেরী হয়েছে। ”

রুমাইসা ইহানের দিকে চেয়ে বলল “এত সুন্দর একটা গিফট তাও বলছেন ছোট্ট উপহার? ”

ইহান হেসে বলল, “আমি যদি তোমাকে এক জোড়া কানের দুল ও এনে দেই, তবুও তুমি বলবে এটা তোমার জন্য সেরা গিফট। ”

রুমাইসা হেসে দিল এটা শুনে।”কারন আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গিফট আছে। আমার আর কিছুর প্রয়োজন নাই। ”

ইহান রুমাইসা কে যখন রুমে নিয়ে গেল রুমাইসা দেখল বিছানার উপর প্রায় ৪/৫ টা বক্স রাখা। রুমাইসা কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এসব কি ইহান? ”

“তুমি নিজেই খুলে দেখ রুমাইসা। ”

রুমাইসা প্রথম বক্স টা খুলতেই চোখ হা হয়ে গেল। খুব সুন্দর একটা স্বর্নের হার। রুমাইসা অবাক চোখে তাকাল ইহানের দিকে। ইহান মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “বাকি গুলাও খুলে দেখ, আমার দিকে চেয়ে লাভ নাই।”

রুমাইসা একে একে সব বক্স খুলল। হাতের, গলার, কানের,মাথার সব গুলো গয়না স্বর্নের ছিল। রুমাইসা এত অবাক হয়েছে। ইহান কে ডেকে বলল, “আপনি এত টাকা খরচ করে এগুলো কেন বানিয়েছেন? ”

“আম্মু আজ পর্যন্ত তোমাকে স্বর্নের একটা কিছু দেয় নি। দায়িত্ব দেওয়ার বেলায় তো একবার পিছপা হয় নি। সাইয়ারার বিয়েতে গহনা পড়লে তাও তৃষা ভাবীর গুলো। আবার বিয়ের পর মা নিয়ে নিল সব। আমি সেদিন ই ঠিক করেছি। আমার কারো অনুগ্রহের প্রয়োজন নেই। আমি আমার নিজের কামাই দিয়ে আমার বউকে সব কিনে দিব। এই যে একটা বছরের কষ্টের ফল এগুলো। এগুলো আমার পারমিশন ছাড়া কারো কাছে যাতে না যায় মনে রেখ। গিফট দিয়েছি আমি, তাই এগুলো তোমার বাইরে যেন কেউ না পরে। ”

রুমাইসা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। ভেতরের অনুভূতি প্রকাশের মত না। আনন্দে চোখে পানি চলে আসল। তবুও ঠোঁট কামড়ে কান্না টা কে দমিয়ে বলল, “যদি ইমতি কে দেই তাহলে? ”

“আমার মেয়ের জন্য আমি আলাদা বানিয়ে দিব। যেটা আমার বউয়ের সেটা আমার বউ পড়বে। আমার মেয়ের টা আলাদা হবে। ”

রুমাইসা আলমারির কাছে এগিয়ে গেল। আলমারি থেকে একটা বাদামি রং এর শার্ট আর বক্স বের করে ইহানের হাতে ধরিয়ে দিল। ইহান বলল, “এগুলো আবার কি? ”

“খুলেই দেখেন না কি জিনিস? ”

বক্স টা খুলতেই ভেতর থেকে খুব দামী একটা ঘড়ি বের হল। রুমাইসার দিকে চোখ তুলে ইহান তাকাল। রুমাইসা একটু নার্ভাস আর ভয় পাচ্ছিল। ইহান বকা না দিয়ে বসে। কারন ইহান ওকে প্রতিমাসে হাত খরচের টাকা দিত। সেটা দিয়েই রুমাইসা এগুলো কিনেছে। ইহান একবারো প্রশ্ন করল না টাকা কই থেকে এসেছে। উল্টো বলল, “আমাকে ফলো করছ তাই না? ”

রুমাইসা খুব জোরে চেচিয়ে বলল, “এই নাহ। আমি আপনার আগে কিনেছি এগুলো। শুধু লুকানো ছিল তাই দেই নি।”

“নাহ আমি আসলে ব্যাপার টা বুঝতে পেরেছি। ফলো করছিলে আমাকে ভালো ভাবে ই। স্বীকার করতে পারো। ইটস ওকে। ”

রুমাইসা ইহানের হাতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল, “সবাই আপনার মত না ইহান সাহেব। আমাকে ফলো করেছেন আপনি। হুশ হুশ। ”

ইহান হেসে রুমাইসা কে কাছে টেনে নিল। বহু দিন পর দুটো অতৃপ্ত মন যেন আজ ভালোবাসার দেখা পেল। সময় গুলো একান্তই দু’জনের মনে দাগ কেটে গেল। সম্পর্ক গুলো কে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিল। আজ রাতে সম্পর্ক টার অসম্পূর্ণতা পরিপূর্ণতা পেল দুজনের কাছে আসার মধ্যে দিয়ে।

“ইহান আমার জীবনের শেষ বিকালের আলো ছিল।আমার জীবন যখন অন্ধকারে পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছিল, ইহান তখন আবছা আলো হয়ে দেখা দিল।একটু আলোর বিকিরণ টা তীব্র হয়ে গেল সেদিন , যেই দিন ইহান আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসল এ বাড়িতে। আমার ইহিতার নতুন পরিচয় টা ছিল ওর জন্য দারুন। যেই বাড়িতে ওর জন্মদাতা ছিল, সৎ মা ছিল আবার ওর নতুন বাবা ও ছিল। আমার জন্য প্রতিটা দিন ছিল একটা যুদ্ধের মঞ্চ। কত রাত কান্না করতাম আমিও জানি না। আমার মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে চুপ থাকতাম। ইহান বিয়ের কারন যা বলেছিল তারপর আমার আশায় অন্ধকার হয়ে এসেছিল। কিন্তু ক্রমশ ইহান নিজের জায়গা টা তৈরি করছিল আমাদের মা মেয়ের জীবনে। আমার মেয়েটা যদি কথা বলতে পারত, আমি নিশ্চিত মা বলার আগে বাবা বলত। ইহানের কাছে ইহিতা ছিল কলিজা থেকে কোন অংশে কম নয়। কথায় আছে না, জন্ম দিলেই মা বাবা হওয়া যায় না। আমি মা হয়েছিলাম ঠিক ই, বাবা অভি হতে পারে নি। তবে ইহান ঠিক ই বাবা হয়েছিল জন্ম না দিয়েই। যেদিন মেয়েকে হারালাম, এই লোক টার বুকে ভেঙে পড়েছিলাম। লোকটার রাগের কারনে কাচ গুলো ছিল পড়ে মেঝেতে, আর তারপর একট দূর্ঘটনা।আমি হয়ত অন্য সময় হলে লোকটা কে ঘৃণা করতাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার মনে এই লোকটার জন্য ঘৃণা জন্মাতেই দেয় নি। দুটা মাস এক হাতে আমাকে আর ঘর সামলেছে লোকটা । মাঝে মাঝে নামাজে বসে কান্না করতাম, নিজেকে শেষ করতে চাইতাম। অথচ লোকটা ধৈর্য্য দিয়ে, স্নেহ দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক করার সর্বচ্চো চেষ্টা করছিল। কতবার রাগ করে যা তা শুনিয়েছি তাকে। তবুও বেহায়ার মত ফিরে এসেছে। আমিও এক সময় হেরে গেছি।

তারপর আমার কোল ভরতেই যেন আবার ইমতির আগমন হল। আমার আরেক ইহিতা। ইহিতার কমতি কেউ পুরন করতে পারবে না। কারন আমার নারী ছেড়া ধন আমার। কিন্তু আমার যখন বিদ্ধস্ত মানসিক অবস্থা, তখন আমার একদিকে সতীন আবার সম্পর্কে জা চিৎকার করে বলেছিল আমার বাচ্চা টা কে দেখো। সেদিনের অনুভূতি ভুলতে পারি নি ইমতি কে কোলে নিয়ে। যখন একা পেয়েছিলাম ইমতি কে, কোলে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম। আমি এক সন্তানহারা মা, আর ও এক মা হারা এতিম সন্তান। আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছিল আবার তাও ইহান এর মাধ্যমে । সেই দিন থেকে আমি আমার ইমতি কে কোন দিন আমাকে ছাড়া থাকতে দেই নি। ইমতির সব আবদারের জায়গা ওর আব্বু আর ওর আম্মু। পাছে ইমতি কে নিয়ে প্রশ্ন উঠে তাই আমি আর ইহান আজো কোন বাচ্চা নেই নি। যদিও আমাদের মন টানে। কিন্তু না, ইমতি কে কেউ ছোট করবে আর ভবিষ্যৎ এ প্রশ্ন তুলবে এ আমরা সহ্য করতে পারব না। আশেপাশের মানুষ এর কাছে ইমতি যেদিন সত্য শুনে ফেলে, সেদিন খুব কান্না করে। কারো সাথে কথা বলে নি। ওটার মত কষ্ট টাই বা কি আছে যে, যাকে মা- বাবা জানত তারা ওর আপন মা- বাবা না। খুব কাঁদছিল আমার মেয়েটা। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না একদম। রাতে ইহান এসে ইমতির সাথে প্রায় ১ ঘন্টা দরজা আটকে কথা বলে। ১ ঘন্টা পর আমার ১৫ বছরের মেয়েটা যখন ঘর থেকে বের হল, তখন আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার আম্মু তুমি ই। আমি কারো কথা বিশ্বাস করব না। আমার আব্বু আম্মু তোমরাই। ”
সেদিন সারা রাত আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। আমিও ছাড়ি নি আমার মেয়েকে। পাশেই ইহান শুয়ে ছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, “এত সুন্দর করে সবকিছু কিভাবে ঠিক করে ফেলে লোকটা। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লোকটা যেন আলোকিত হয়ে থাকে। এই আলোর মাঝেই যেন আমার দু-চোখ বন্ধ হয়। ”

সাহিল ছাড়া পেয়েছিল বহুবছর আগেই। আমাদের সাথে কোনদিন আর দেখা করতে আসে নি। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটা আমরা কেউ জানি না। তবে একটা কথা কি, ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের টান থাকেই৷ কেউ না জানলেও ইহান ঠিক ই ওর খবর রাখত। সেটা অবশ্য অনেক পরেই জেনেছিলাম। সাহিল নাকি চিল্লায় থাকত। কিছুদিন পর পর এর সাথে ওর সাথে এই মসজিদ আর ওই মসজিদে যেত। আর ঢাকায় আসলে নাকি কবরস্থানের আশেপাশেই থাকত। সারা রাত কবরের পাশে বসে থাকত। ইহিতা আর তৃষার কবরের পাশে। মানুষের জীবনে যখন পাপাবোধ আসে, তখন আসলে মানুষ নিজের এমন পরিবর্তন আনে সেটা অপরের কাছে হয় দৃষ্টিতে বাধে কিংবা কারো চোখে প্রশংসার কারণ হয়।
আমার সেই অত্যাচারী শ্বাশুড়ি অবশেষে স্ট্রোকের পর ভালো আচরণ করতে শুরু করেছিল।ওই যে তার ভেতরের পাপবোধ জেগেছিল। সে সুস্থ হয়েছিল ঠিক ই, তবে আমার সাথে মেয়ের মত আচরন করত। সেই যখন আমার ১৮ বছর তখন এ বাড়িতে এসেছিলাম। তারপর আজ আমার বয়স ৪০ এর কাছাকাছি। মেয়েকে বিয়ে দিলাম এই তো কিছুদিন আগে। বাড়ি টা একদম খালি খালি লাগে। আমি আর ইহান প্রায় রাতেই বসে বসে মেয়ের ছবি দেখি। ইচ্ছে হয় ইমতিকে আবার ছোট দেখতে। ইহান টা আজ কাল অসুস্থ থাকে। আমার শ্বশুর মারা যাওয়া পর সব ওই দেখত। দায়িত্ব আর বয়সের ভারে ও কে অসুস্থ করে দিয়েছে। আমার ভয় হয় এই লোকটা আমার জীবন টা অন্ধকার করে দিয়ে না হারিয়ে যায় আবার। প্রায় রাতেই ওর বুকে শুয়ে কান্না করি। ও মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে “আমি সশরীরে না থাকলেও তোমার জীবনে আমার আলো যত জীবন বাচঁবে সেটা রয়েই যাবে। আমি আগে চলে যাই তো কি হয়েছে, তুমি তোমার নাতী নাতনী কে নিয়ে খেলবে।”

আমি আবার কান্না করি ও কে চেপে ধরে। প্রিয় মানুষ টার কমতি যে হাজার কিছু দিয়েও পূরণ করা যায় না এটা কি করে বুঝাই ওকে। তবে আমি রুমাইসা, আমার জীবনের এতগুলো বছরে যতটুক সুখের আলো দেখেছি, আমি এখন মারা গেলেও আফসোস থাকবে না। শুধু যতটা সময় আমার শ্বাস চলবে আমি আমার জীবনের শেষ সময়ের আলো হিসাবে আমার ইহান কে চাই। রাতের অন্ধকারের মাঝেও আমার ইহান যেন আমায় বাকি রাত গুলোতে আলো হয়েই থাকে। কোম দিন বিকালের শেষ প্রহুরে যখন অন্ধকার নেমে আসবে, তখন যেন আমি আবছা অন্ধকারেও ওর মাঝে তীব্র আলোর দেখা পাই। ”

ডায়েরির পাতায় এটাই ছিল শেষ লেখা। লেখা গুলো পড়তে পড়তে ইমতির চোখে পানি চলে আসল। বাড়িতে এসেছিল আজ মা – বাবার ৪০ দিনের মিলাদে। ঘরে ঢুকে এটা সেটা দেখতে দেখতে ড্রয়ার থেকে মায়ের ডায়েরি টা খুঁজে পায় ইমতি।তারপর থেকে চুপচাপ বসে বসে পড়ছিল বারান্দায় ডায়েরি টা। সেই হাসনাহেনা গাছের সৌরভ, পুরো রুমে দুজনের স্মৃতি, হাতে রুমাইসার ডায়েরি। ইমতির চোখে পানি চলে আসল। ভালোবাসার কোন শেষ হয় না। ইহান মারা যাওয়ার ৫ দিন পর রুমাইসা মারা গিয়েছে। শেষ সময়েও কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে চায়নি।রুমাইসা হয়ত বুঝে গিয়েছিল ইহানের আলো ছাড়া ওর জীবন অন্ধকারময়। তাই ইহানের কাছেই আবার ছুটে গিয়েছে রুমাইসা।

সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here