শেষ বিকেলের আলো পর্ব ২২+২৩

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২২

এমন সময় বাবুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল সাথে ইহানের ডাক। রুমাইসা তাড়াতাড়ি সব বই খাতার নিচে ডায়েরি দুটো লুকিয়ে ভেতরে চলে আসল। ইহান ঘুম ঘুম চোখে বলল “একটু ওই রুমে নিয়ে যাও ওকে। ঘুমাব আমি।

ইহানের এই কথায় রুমাইসার মুখের রং পাল্টে গেল। ইহান কোন দিন এমন কথা বলে না।আজ কি হল হঠাৎ ! রুমাইসা মেয়ে কে নিয়ে চলে গেল সাইয়ারার রুমে। সাইয়ারা বাসায় ছিল না। তাই রুমাইসা আরাম করে শুইয়ে খাওয়াতে লাগল আর চিন্তার জগতে হারিয়ে গেল।

রুমাইসার বাবা মা মারা যাওয়ার পর ফুপি কোন দিন ও কে নানীবাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নি।রুমাইসা এক রকম ভুলেই গেছে নানা নানী কে। মাধ্যমিক এর গন্ডি পেরিয়ে যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে আসল, তখন একদিন একটা আইডি থেকে রিকোয়েস্ট আসল। আইডির নাম ছিল রুহানি তালুকদার। রুমাইসা এক্সেপ্ট করতেই অপর পাশ থেকে মেসেজ আসল ” হায় রুমু, কেমন আছিস? ”

রুমাইসা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল “আপনি আমাক্র চিনেন? ”

“তুই আমার ছবি দেখেও চিনতে পারিস নি? ভুলে গিয়েছিস তাই না? ”

রুমাইসা আরো অবাক হল। দ্রুত প্রোফাইলের ছবি টা দেখল। একটু চেনা চেনা লাগছে কিন্তু আসলে কে ঠিক চিনতে পারছে না।তাই একটু দ্বিধা নিয়েই বলল “দেখুন আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আপনি কি একটু পরিচয় দিবেন? ”

ওপাশ থেকে সিন হল শুধু। এদিকে রুমাইসার ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছে বারবার। মেয়েটা কে যে এটা বলল। ৫/৭ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু কোন উত্তর আসল না। অবশেষে রুমাইসা নিজের থেকে নক করল। “কিছু বলছেন না যে? আমি আপনাকে চিনি? ”

দুই মিনিট বাদে সিন হল আর একটা ছবি ও আসল সাথে। রুমাইসা দেখল ছবি টা ওর ছোট বেলার ছবি। পাশে আরো তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা আর একটা বয়স্কা মহিলা।

রুমাইসা ছবি দেখে রিপ্লাই করল “আমার আসলে কিছু মনে পড়ছে না। কাইন্ডলি বলবেন এরা কারা? ”

ওপাশ থেকে উত্তর আসল “আমি তোর রুহি আপু। তোর মামাতো বোন। এই যে তার পাশে তোর যুথি আপু, প্রিয়া আপু । আর তার পাশে দাদু দাড়িয়ে আছে মানে তোর নানু। ”

রুমাইসা বিষ্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল। নানী বাড়ির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আজ অনেক বছর। কিছু মনেও নেই কি হয়েছে তখন। ফুপি বরাবরই ও কে এসব থেকে দূরে রাখতে রাখতে মেমোরি টা একদম আবছা করে দিয়েছে। রুহির কথায় ছোট বেলার অনেক কিছুই মনে পড়ল সেদিন। তারপর একদিন সময় করে নানু বাড়ির সবার সাথে কথা হল। কিন্তু ফুপি কে ভুলেও জানতে দেয় নি রুমাইসা। কারণ ফুপির কড়া নির্দেশ ওদের সাথে কন্টাক্ট না রাখার।

একদিন নানু বাড়িতেও গিয়েছিল কলেজের নাম করে। তারপর একদিন ফুপি কিভাবে যেন জেনে যায় এসব। খুব বকা আর মার খেয়েছিল সেদিন রুমাইসা। ফলশ্রুতিতে ওর ভাই কে দিয়ে ফেসবুক আইডি ডিলিট সহ সব রকম সম্পর্ক ই নষ্ট করে দিয়েছে ফুপি ওদের সাথে রুমাইসার।তারপর আর কোন দিন যোগাযোগ হয় নি।

সেই রুহি আপু ইহানের গার্লফ্রেন্ড ছিল। বুক টা ধক করে উঠল রুমাইসার। সেই রুহানি তালুকদার, ইহান তালুকদার এর নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে।কিন্তু রুহি আপুর বিয়ে হয়েছে তো। হঠাৎ রুমাইসার মনে হল জুই বলেছিল রুহির বিয়ে হয়ে গেছে তাই ইহান কষ্ট পেয়েছিল। এবার যেন হিসাব দুইয়ে দুইয়ে চার হতে লাগল। কিন্তু বুক টা ভার হয়ে উঠল রুমাইসার কেন জানি। প্রাক্তন শব্দ টা তো ওর অতীতের সাথেও জড়ানো , তাহলে ইহানের বেলায় এত কষ্ট পাচ্ছে কেন।

মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখল আবার ঘুমিয়ে গেছে। রুমাইসা ও কে শুইয়ে দিয়ে আবার রুমে গেল। পুরো খাট ছড়িয়ে শুয়ে আছে ইহান। রুমাইসা দূর থেকে কষ্ট পেল। বাবু আর রুমাইসা বিছানায় শোওয়ায় হয়ত ইহান এখন আগের মত ঠিকঠাক ঘুমাতেই পারে না। কত কিছু সেক্রিফাইজ করতে হচ্ছে ও কে। দূর থেকে ঘুমন্ত চেহারা টা দেখে যেন বারবার ওর চোখে রুহির মুখ ভেসে উঠছে।

বারান্দায় ফিরে গিয়ে রুমাইসা আবার বইয়ের নিচ থেকে ডায়েরি বের করল।ডায়েরির পাতা উল্টে রুহির ছবিটা আলতো করে ছুঁয়ে দেখল। ওর বোন টা ওর তুলনায় অনেক সুন্দর আর মায়াবী। আর রুমাইসা তো কিছুই না। তার জন্য ই অভি শুধু টাইম পাস করেছে। ইহান ও কোন দিন ভালোবাসবে না। হঠাৎ শেষ কথাটা ভেবেই লজ্জায় কান্না পাচ্ছিল ওর। ঠোঁট দুটো কে চেপে সহ্য করছিল কান্না। পাছে ইহান ওর কান্নার শব্দে উঠে যায়। ডায়েরির প্রতিটা পাতায় রুহি কে নিয়ে লিখা গল্প,কবিতা, ছন্দ কিংবা প্রতিদিন এর ঘটনা। রুমাইসা যত ই পড়ছে তত ই বুকের ভেতরে আঘাত পাচ্ছে। কিছু স্মৃতি ওর আর অভির স্মৃতি গুলোর সাথে মিলে যায় যে। ডায়েরির শেষ দিকে আসতেই দেখল কয়েক পাতা ছিড়ে গেছে।রুহি পরের পেজ পড়া শুরু করব এমন সময় পায়ের আওয়াজ পেল। রুমাইসার আত্মা কেঁপে উঠল। ইহান যদি দেখে তাহলে নিশ্চিত ও কে পড়তে দিবে না।তাই লুকিয়ে ফেলল আবার।বই ঝাড়া ঝাড়ি করতে লাগল।

ইহান হামি দিতে দিতে বারান্দায় আসল। রুমাইসা কে এগুলো করতে দেখে জিজ্ঞেস করল “কি ব্যাপার এই অসময়ে এগুলো পরিষ্কার করছ কেন? ”

“ঘর টা গুছানো হয় না তাই এগুলো আজকে পরিষ্কার করে কাল বিছানার নিচে টা পরিষ্কার করব।সামনে বিয়ের দিন চলে আসছে আবার। ”

“গোসলের আগে এগুলা করবা না? আর একা কেন মিলি কে ডেকে নেও সাথে। ”

“নাহ নাহ সমস্যা নেই। আমি ই পারব এই কয়টা বই। ”

ইহান আর কথা বলল না। মুখ ধুতে চলে গেল।
রুমাইসা তাড়াতাড়ি সব পরিষ্কার করে ডায়েরি দুটো লুকিয়ে ফেলল বিছানার নিচে। ইহান বিকেল বেলা বের হয়ে গেল বাইরে। রুমাইসা জানে আসতে আসতে সেই রাত আবার। সাইয়ারার রুম থেকে বাবু কে আনতে যাওয়ার সময় দেখা হল সাহিলের সাথে। সাহিল কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু রুমাইসা সেটা না শুনেই চলে গেল।

বিয়ের আর মাত্র ৫ দিন বাকি। কাজের জন্য রুমাইসা ডায়েরি ধরার সময় ই পাচ্ছিল না।যখন ফ্রি হয় তখন ইহান চলে আসে আর ধরতে পারে না।বিয়ের বাড়িতে যেন কাজের কমতি হয় না। একা হাতে মিলি কে নিয়ে সারাদিন কাজ করতে হয় ওর। মিলিও কেমন আলসেমি দেখায় এখন। রুমাইসা জোর দিয়ে বলতে পারে না। শ্বাশুড়ি বসে বসে আগের মত আবার ফুট ফরমায়েশ দেওয়া শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আবার একা বসে ন্যাকা কান্না জুড়ে দেয়। তৃষা আর ইহিতার নাম বলে বিলাপ পাড়তে থাকে।বাবুর নানীরা বাবু কে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু নাসিমা বেগম বাবু কে ছাড়বে না একটুও। রুমাইসা ও এখন নতুন ইহিতার মাঝেই ওর ইহিতা কে খুজে নিয়েছে।

সারাদিন কাজ আছেই সাথে আবার সাহিলের উৎপাত।যখনি একা পাবে হাত ধরে ফেলে কিংবা আবেগের কথা বলতে থাকবে। কতদিন রুমাইসা অপমান করেছে। অথচ নির্লজ্জর মত সামনে চলে আসবেই। মেয়ের বাহানায় বারবার শুধু কাছে ঘেষতে চায় রুমাইসার। দুই চারদিন ইহানের চোখে ব্যাপার টা পড়েছে। রুমাইসা বেশ লজ্জা ও পেয়েছে কিন্তু ইহান যেন কিছু দেখে নি কিছু ভাবে নি এমন ভাব করে রয়েছে।

হলুদের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সব কাজ শেষ করর রুমাইসা রেডি হতে গেল। এরি মাঝে ইহিতার কান্নাকাটি বেড়ে গেছে। গানের আওয়াজে বাড়ি কাঁপছে সাথে ইহিতা কান্না করছে। রুমাইসার ইচ্ছে করছে চুল ছিড়তে। না পারছে রেডি হতে না একটু বসতে মেয়েকে নিয়ে। ইহিতা কে খাওয়াতে খাওয়াতে মুখের মেকাপ করল এক হাতে। নারী যখন মা হয়, তখন বুঝি এভাবেই সামলাতে হয় সব। কোন মতে রেডি করল চেহারার গেটাপ। এখন চুল আর শাড়ি টা বাকি। ইহিতা ছাড়ছেই না ওকে।ছাড়াতে গেলে এত চিৎকার করছে বলার বাইরে। রুমাইসা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। ইহান টা আজ একবারো সামনে আসে নি ওর। পাঞ্জাবি পড়ে যে বের হয়েছে আর খবর নেই।

বাবু কে নিয়ে দাড়াতেই দরজা খুলে ইহান ঢুকল। রুমাইসা তাকিয়ে দেখল কাচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি তে লোক টা কে ভয়াবহ রকম সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বাইরে গেলে কেউ উঠিয়ে নিয়ে যাবে। রুমাইসা চোখ সরাতে পারছে না। ইহান সামনে এসে দাড়াতেই রুমাইসা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।

“কি ব্যাপার এ অবস্থা কেন তোমার ? রেডি হও নি এখনো ? ”

“ইহিতা আজ ছাড়ছেই না। কোল থেকে রাখলেই কান্না করছে। ”

“আমার কাছে দেও, আর তুমি রেডি হোও। লেট হচ্ছে। সাইয়ারাকে স্টেজে নিতে হবে আবার। ”

“আচ্ছা নেন ওকে। আমি রেডি হচ্ছি তাড়াতাড়ি। ”

ইহান কোলে নিতেই ইহিতা চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। ইহান বিব্রত হয়ে গেল। ইহান ও কে চুপ করাতে চাচ্ছিল কিন্তু চুপ হচ্ছেই না। রুমাইসা শাড়ি টা নিয়ে কোন মত একটা অংশ গুজতে পারল কোমড়ে তার মধ্যেই ইহান এসে বলল “পারছি না আমি তুমি ধর ও কে। ”

“আমি রেডি হব ইহান। ও কে ধরে পারছি না। ”

ইহান চেয়ে রইল রুমাইসার মুখের দিকে। রুমাইসা ইহানের কাছে যেয়ে দুই হাত বাড়িয়ে ইহিতা কে নিল। রুমাইসা অনুভব করল ইহান ওর আঙুল গুলো ইচ্ছে করে যেন ছুঁয়ে দিল। রুমাইসার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। ইহিতা কে নিয়ে বুকের সাথে মেশাতেই আরামে চুপ হয়ে গেল। “আজ আর রেডি হতে দিবি না আমাকে তাই না? ” ইহিতার দিকে তাকিয়েই এটা বলল ও।

ইহান হাসতে হাসতে বলল “তুমি ওর থেকে বেশি সুন্দর হবে এটা ওর ভালো লাগছে না মনে হয়। ”

“ছি কি কথা আপনার। আমার মেয়ে এমন না বুঝেছেন। আর আমার মেয়ের তুলনায় আমি কিছুই না। ”

ইহান অন্য দিকে ফিরে খুব আসতে করে বলল “হ্যা মা যে কেমন তা তো দেখছি ই। কখন যেন হার্ট বিট মিস করিয়ে দিবে আমার। ”

“কিছু বললেন আপনি? ” রুমাইসা কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“কই না তো। বললে শুনতে পেতে। এখন কিভাবে রেডি হবে সেই ব্যবস্থা কর। আমার বাইরে কাজ আছে। ”

এটা বলেই ইহান বের হয়ে গেল। রুমাইসা কপালে হাত দিয়ে বলল কপাল আমার। রেডি হতেও পারছি না একটু।

অনুষ্ঠান চলছে পুরোদমে। একে একে সবাই হলুদ লাগাচ্ছে সাইয়ারা কে। ইহান দেখল ইহিতার নানীর কাছে ও ঘুমিয়ে আছে। মহিলা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে ও কে নিয়ে। ইহান দু চোখে কেবল রুমাইসা কে খুঁজছে। হঠাৎ পেছন থেকে রুমাইসা আঙুল দিয়ে গুঁতো দিয়ে বলল “কাউকে খুঁজছিলেন নাকি? ”

ইহান গলা খাকড়িয়ে বলল “কই কই না তো। ”

রুমাইসার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল ইহান। বুকের ভেতর কেমন আওয়াজ অনুভব করছে ও। রুমাইসা মুচকি হাসি দিয়ে তখনো দাড়িয়ে আছে সামনেই। “কি ব্যাপার দাড়িয়ে আছো কেন ? যাও ওই দিকে কাজ কর। ”

রুমাইসা মাথা ঝাকিয়ে বলল “উহু, সবাই তো সবার হাজবেন্ড এর সাথে দাড়ানো। আমি কেন সিঙ্গেল থাকব! ”

“বাহ বাহ, আজ আমার সাথে দাড়ানোর এত ইচ্ছা হল কেন আপনার শুনি একটু? ”

“এমনেই। তেমন কোন কারন নেই। ওইখানে চলুন বসবেন আমার সাথে। যাতে সবাই বুঝে আপনি আমার সম….”

“সম? থেমে গেলে কেন! ”

“মানে স্বামী, হাজবেন্ড, বেটার হাফ এই আর কি। ”

রুমাইসা খুব লজ্জা পেল।বলতে চেয়েছিল ইহান ওর সম্পত্তি।কিন্তু কোথায় যেন বাধা পেয়ে গেল গলা দিয়ে শব্দ টা বের হতে।

একটা মেয়ে এসে বলল “ভাইয়া আপনি সাইয়ারার ছোট ভাই না? ”

“হ্যা কেন? ” ইহান সুন্দর করে জবাব দিল।

মেয়েটা ওড়নায় কুচি করতে করতে বলল “নাহ এমনেই। একটা ছবি তুলা যাবে প্লিজ?আমি কিন্তু সাইয়ারার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওই যে আপনার সাথে একবার ধাক্কা খেয়েছিলাম যে। ” মেয়েটা লজ্জায় হাসতে লাগল।

“ও ভাইয়া একটু হলুদ ও লাগাবো কিন্তু। মানা করবেন না প্লিজ।” মেয়েটার সোজা সাপটা আবদার।

রুমাইসা তেলে বেগুনে জ্বলছে। আর শেষ কথা শুনে তো আগুনের মত জ্বলে উঠল। ফিসফিস করে বলল “হ্যা আরো বেশি করে ধাক্কা খান, হলুদ লাগান ওই মেয়ের সাথে। আমি নিয়ে আসছি নিচ থেকে।”

রুমাইসা সিট থেকে উঠে গেল। ইহান ঠিক কি রিএকশন দিবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটা এইদিকে ইহান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেল্ফি তুলা শুরু করল গায়ের সাথে লেগে। ইহান বিরক্ত হচ্ছে আবার কিছু বলতেও পারছে না। অবশেষে ছবি তুলা শেষ করে মেয়েটা বলল “ভাইয়া আপনাকে কিন্তু ট্যাগ দিব। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট কইরেন প্লিজ প্লিজ। ”

ইহান হু বলে সিট ছেড়ে উঠে গেল দ্রুত। রুমাইসা কে হন্য হয়ে খুজছে এ রুম থেকে ওই রুম। কোথাও না পেয়ে যখন রান্নাঘরে গেল, দেখল উপটান বানাচ্ছে। কাঠি দিয়ে জোরে জোরে নাড়াচাড়া করছে যেন এখনি ফেলে দিবে।

ইহান সামনে গিয়ে বলল “কি ব্যাপার উঠে আসলে কেন?”

“মনে চেয়েছে তাই। আপনার কি? ”

“আমি একা একা বোর হচ্ছি। চল উপরে। ”

“আমি আপনার জন্য হলুদ বানাচ্ছি। আপনি আর ওই মেয়ে গায়ে লাগাবেন। ” খুব তাচ্ছিল্য করে বলল কথাটা।

ইহান ঠোঁট কামড়ে মুচকি মুচকি হাসি দিয়ে বলল “মেয়েতো চলে গেছে। আমি এখন কাকে হলুদ লাগাব? ”

রুমাইসা আরো ক্ষেপে উঠল এটা শুনে। “নিজের মাথায় ঢালুন তাহলে। ”

রুমাইসা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইহান পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। রুমাইসা এত বেশি অবাক হল যে মুখ দিয়ে কথা বলতে পারল না। এত কাছে কবে এসেছিল ইহান মনে পড়ে না তো ওর।

রুমাইসা ছাড়ানোর চেষ্টা একটু ও করল না। ঠায় দাড়িয়ে রইল সেখানে। ইহান রুমাইসার আঙুলের ভাজে আঙুল রেখে হলুদ উপটান নিজের হাতে মাখিয়ে নিল। রুমাইসা সামনে থেকে জিজ্ঞেস করল “এভাবে ধরলেন কেন? কেউ এসে পড়লে? ”

“তাতে কি? আমরা কি বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড নাকি? ”

” না হই তাতে কি? বাড়ির বউ তো আমি। ”

“আমিও বাড়ির ই ছেলে। কিছু অসমাপ্ত কাজ করতেই ধরে রেখেছি। ”

রুমাইসা আবার প্রশ্ন করল “কি কাজ? ”

ইহানের নিশ্বাসের শব্দ ক্রমশ রুমাইসার ঘাড়ে পড়ছে। রুমাইসা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইহান আলতো করে হলুদ রুমাইসার গালে লাগিয়ে দিল। রুমাইসা ফ্রিজ হয়ে গেল সাথে সাথে।

“আমাদের বিয়ের পূর্ণতা দিলাম হলুদ লাগিয়ে। সারাজীবন মনে থাকবে এবার। ”

রুমাইসা বিরবির করে বলল “সব স্মৃতি মুছে গেলেও আপনার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো বুঝি অবিস্মরণীয় হয়ে স্মৃতিতে আটকে থাকবে।”
শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২৩

রুমাইসা যে মন থেকে হাসছিল সেটা ইহানের চোখে পড়ছিল না।পড়ার কথাও না। ইহানের বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে রুমাইসা। ইহান শুধু অনুভব করতে পারছে রুমাইসা কে।

রুমাইসা ইহানের হাত দুটো ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে দাড়ালো । ইহান ভাবলো কাজ টা বোধ হয় ঠিক হল না। শত হোক রুমাইসা ও কে টাচ করার অধিকার দেয় নি এখনো। মন টা মুহুর্তের মাঝে খারাপ হয়ে গেল। সাথে সাথে সেটার প্রতিচ্ছবি পড়ল চেহারায়। রুমাইসা ওর দিকে তাকিয়ে রইল। চেহারার রং সাদা না হলেও মানুষ যে অসম্ভব সুন্দর হতে পারে সেটা ইহান কে দেখে মনে হয় রুমাইসার।

ইহান ছোট্ট করে একটা সরি বলল রুমাইসার দিকে চেয়ে। একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল আবার।মনে হল কোন পর নারী ইহানের সামনে দাড়িয়ে আছে।রুমাইসা ব্যাপার টা বুঝল না। কিন্তু এখন ওর মনে অন্য কিছু চলছে। ইহান ভাবল রুমাইসা আসলেই খুব খারাপ ভেবেছে তাই এখনো কথা বলছে না কোন। এ জায়গা থেকে ওর চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো হবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। ইহান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগেই রুমাইসা দুই হাতের সব টুকু উপটান ঘষে দিল ইহানের মুখে। তারপর পুরো রান্নাঘর জুড়ে বাজতে লাগল ওর খিলখিল হাসির শব্দ। ইহান বোকার মত দাড়িয়ে রইল রুমাইসার দিকে চেয়ে। এক হাত দিয়ে উপটান মুছে দিল নিজের গালের।
রুমাইসা কে কিছু বলতে যাবে এমন সময় নাসিমা বেগম চলে আসল। পেছন থেকে ডাক দিল “কি হয়েছে? ”

রুমাইসা আর ইহান অস্বস্তি তে পড়ে গেল। ইহান লজ্জায় ঘুরতে পারছে না আর রুমাইসা লজ্জায় তাকাতে পারছে না। দুজনেই এমন লজ্জাজনক অবস্থায় মাথা নিচু করে আছে। নাসিমা বেগম ফ্রিজ থেকে মশলার বাটি বের করতে করতে বলল “রুমাইসা খাটের নিচে যে পানের ডালা রেখেছি সেটা নিয়ে ডাইনিং এ রাখো। তোমার খালা শ্বাশুড়ি, চাচী শ্বাশুড়িরা চাইছে। ”

রুমাইসা জ্বি আম্মা বলে ছুটে চলে গেল। নাসিমা বেগমের সামনে পড়ল না আর। কিন্তু ইহান ঠায় দাড়িয়ে আছে। লজ্জায় মায়ের দিকে মুখ ফেরাতে পারছে না। ইহান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নাসিমা বেগম বলল “কি ব্যপার তুই কেন দাড়িয়ে আছিস? কিছু লাগবে তোর? ”

ইহান তোতালাতে তোতলাতে বলল “না.. নাহ। ওই প্লেট খুজছিলাম। খাবো। ”

নাসিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বলল “প্লেট কি ওই চুলার সামনে রাখি নাকি। প্লেট তো দরজার পাশেই। এই নে। ”

ইহান জবাব দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পেল না।বাধ্য হয়ে মুখ ফেরাতেই নাসিমা বেগম চেচিয়ে উঠল । “কিরে তোর গালে এমন করে হলুদ লাগালো কে! দেখছ মুখ টা কে কি করে দিয়েছে। ”

ইহান উত্তর দেওয়ার আগেই ছোট খালা রান্নাঘরে আসল। নাসিমা বেগম কে শুনিয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল “কেন বুজি, তুমি বুঝো না এই হলুদ কে লাগাইসে! বউয়ের গালেও তো দেখলাম। এখন তোমারে কি সব বুঝায় বলতে হইব বুজি? ”

ইহানের হলুদ ছোঁয়া গাল যেন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে মা- খালা কে এড়িয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে খালার হাসি আর টিপ্পনী শুনল বেশ কয়েকটা। রুমাইসা শ্বাশুড়ির খাটের নিচ থেকে পানের ডালা বের করতে গিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে। আসার সময় ছোট খালা দেখে কেমন দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল যেন। ইশ সবাই যেন কি ভাবছে ওকে দেখে। গাল থেকে মুছতে ইচ্ছে করছে না ইহানের ছোঁয়া। পানের ডালা নিয়ে ডাইনিং এ রাখতেই তৃষার আম্মু আসল পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে।

রুমাইসা দেখেই পান রেখে ছুটে গেল। ইহিতা কে কোলে নিয়ে বলল “খালাম্মা কি হয়েছে পায়ে?”

মহিলা চেয়ারে বসে বলল “আর বল না মা। এক মেয়ে পায়ের উপর চেয়ার দিয়ে বসে পড়ছে। আহ পায়ে কি ব্যথা টাই পাচ্ছি। ”

রুমাইসা ইহিতা কে নিয়েই নিচু হয়ে ওনার পায়ে হাত দিল। তেমন কিছু হয় নি কিন্তু ব্যথা পাচ্ছে পায়ে। রুমাইসা উঠে যেয়ে রুম থেকে ওয়েনমেন্ট এনে লাগিয়ে দিল। পুরাটা সময় ইহিতা ওর কোলেই ছিল। কেউ ধরেও নি, কারো কাছে দেয় ও নি। তৃষার আম্মু চশমা টা চোখে টেনে বলল “মা একটু ঘুমাব, শরীর খারাপ লাগছে রে অনেক। কোন রুমে যাব? ”

রুমাইসা কিছু না ভেবেই বলল “আসুন আমার রুমে এসে শুবেন। ”

তৃষার মা হেটে হেটে রুমাইসার সাথে গেল। যেতে যেতেই বলল “কোন দিন মেয়ের বাড়িতে থাকব ভাবি নাই। আজ মেয়ের বাড়িতে আছি কিন্তু আমার মেয়ে নাই রে মা। ওর বাবা তো আসল না। আমি তো নাতনীর টানে চলে আসি কি করতাম মা। ”

তৃষার আম্মু কে কি বলে স্বান্তনা দিবে রুমাইসা জানে না। মহিলা রুমাইসার বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ল এক সাইডে। রুমাইসা বাকিটা সময় এই কাজ সেই কাজে ব্যস্ত। ইহিতা কে কোলে নেওয়ার মত কেউ নেই। রুমাইসা অনুভব করল, যত ই ইহিতা কে আপন বলুক কিন্তু ও কে যেন এতিম হিসাবেই সবাই অবহেলা করে। কেউ কোলে নিতে চায় না। কাছে আসলেই বলে আহারে এতিম মেয়েটা। জন্মের কালে মা হারাইল।রুমাইসার গায়ে আগুনের মত লাগে কথাটা। ইহিতার মা মরলে কি ও তো ওর মা। এটাই যেন কেউ মানতে পারে না।

তবুও সব মেনে হাসিমুখে কাজ করছে। যে যা বলছে তাই করছে। সবাই খুব খুশি ওর উপর। ওর সামনেই বলতাসে সবাই ওর শ্বাশুড়ি কে, “নাসিমা রে ভালো একটা বউ পাইসোস রে। দুধের বাচ্চা নিয়া কাম করতাসে সারাদিন। ”

নাসিমা বেগম এর চোখ চকচক করছে সবার প্রসংশা শুনে। একটু কেমন যেন গর্ব গর্ব লাগছে। রাতের বেলা সব রুমে সবার বিছানা দিয়ে রুমাইসা আর ওর মেয়ের শোওয়ার জায়গা নাই।

একবারো কেউ বলল না দুজন কই ঘুমাবে। এত আত্মীয় স্বজন যে ডাইনিং এর ফ্লোরে পর্যন্ত জায়গা নেই। সাইয়ারা নিজের রুম ওর বান্ধবীদের নিয়ে দখল করে বসে আছে। ইহান তো বাবুর্চির সাথে কাজ দেখছে। মেয়েটা খালি কান্না করছে বারবার। অথচ একটা জায়গা নেই যে শোওয়াবে। রুমাইসার কান্না আসছে। রাতের ২ টা বাজে, ছাদে তেমন কেউ নেই। ইহানের কাজিন রা বসে গল্প করছে।

রুমাইসা কে ছাদে উঠতে দেখে ইহানের চাচাতো ভাই এগিয়ে এসে বলল “ভাবী কিছু লাগবে আপনার? ”

রুমাইসা লজ্জা পেল। সামনে সব ছেলেরা দাড়িয়ে আছে। রুমাইসা কথা এড়াতে বলল “না ভাই, ওই একটা জিনিস খুজতে এসেছি। তোমরা যাও ভাই। ”

“আর ইউ সিউর ভাবী? ” ইহানের চাচাতো ভাই কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

রুমাইসা হাসি মুখে মাথা নাড়াল সব ঠিক আছে বুঝাল। মানুষ গুলো কেমন যেন অদ্ভুত নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না। সেই কখন থেকে খেতে পারছে না ইহিতা কান্না করছে অথচ কেউ একটু সুযোগ দিচ্ছে না ওকে খাওয়ানোর।দুনিয়া বড় পাষাণ।

(কাল টুইস্ট আসবে একসাথে সব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here