#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৪
#Tahmina_Akther
-আঙ্কেল?
-হুম। কি রে মা কখন এলি? আয় আয় বস এখানে।
-আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো কিন্তু বলার সময় পাচ্ছিলাম না।
-বল কি বলবি?
-আঙ্কেল, আজ আমার ননদ কল করেছিলো।
-ওহ, কি বললো?
-রাফি বিয়ে করেছে আজ দু’দিন হলো।
-এইসব পুরুষেরা বিয়ে ছাড়া আর কি বা করতে পারবে! কিন্তু, তোর ননদ কল করেছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে তাই না?
-হুম, কারন তো আছে। ও বললো আমি যেন রাফিকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। ওর জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা যাতে না করি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বললো রুশা। তবুও মনের এক কোণের খচখচানিটা আর নেই কারণ আজ দেড়মাস ধরে সে ভাবছিলো রাফিকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। যেখানে তার সন্তান ঠাঁই পায় নি সেখানে ও যে ঠাঁই পাবে তার নিশ্চয়তা কি?আর সেখানে নিজের আত্মসম্মান বলি দিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না দরকার হলে এই বাড়ির গৃহস্থালি কাজ করবে। আর যদি উনাদের সমস্যা হয় তবে গার্মেন্টেসে চাকরি করবে তবুও যাবে না সে।
-তুই ভেবে বলছিস তো? মানে পরে যদি আবার সিদ্ধান্তহীনতায় পড়িস?
-দেড়মাস সময় ধরে ভাবছি আর আজ বাস্তবায়ন করতে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করলাম। আঙ্কেল, আমি কি করবো বলুন?মেরুদণ্ডহীনভাবে থাকার চেয়ে আত্মসম্মান নিয়ে মুখ উঁচু করে বাঁচবো।
-আচ্ছা, তাহলে আমি ব্যবস্থা করছি। আর শোন?
-জি আঙ্কেল।
-পড়াশোনা ঠিক ভাবে করবি কারণ তোকে ডাক্তার হতে হবে ঠিক আমার মতো পারবি না, মা?
আঙ্কেলের কথা শুনে দু’মিনিট নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। পড়াশোনা করবো আবারও। পড়াশোনার স্বপ্ন যে কবে মাটি চাপা দিয়েছি। ছলছল নয়নে আঙ্কেলকে বললাম,
-সত্যি পড়াশোনা করবো আমি!
-হুম, তুই চাইলে আবারও পড়াশোনা শুরু করবি। মা’রে জীবনে বড় কিছু হতে চাইলে এর প্রথম ধাপ হলো পড়াশোনা।
তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি তোকে আমার মেয়ে মেনেছি তোর জীবনের সকল স্বপ্ন আমার এই হাত দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করবো। বাকিটা উপরওয়ালার হাতে। যা গিয়ে বিশ্রাম কর শরীর যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে তত তাড়াতাড়ি ভর্তি যুদ্ধে নামতে পারবি।
মনের একপাশে দ্বিধা আরেকপাশে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার অদম্য নেশা চেপে ধরেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন রুমে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি পাশের রুম থেকে চেয়ার টানার শব্দ পাচ্ছিলাম। ভয় পেয়ে গেলাম কেননা এই বাড়িতে শুধুমাত্র তিনটি রুম ব্যবহৃত হয়। একটা আমার অন্যটা আঙ্কেলের আরেকটা ফাহিমা খালার। তাহলে, এই রুমে শব্দ আসছে কিসের? চোর টোর নয়তো। মুখ দিয়ে আওয়াজও বের হচ্ছে না। এই জন্যই হয়তো লোকে বলে বিপদ আসলে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে যায়।
এরইমাঝে রুমের দরজাটা খুলে কে যেন বাইরে হুড়মুড়িয়ে চলে এলো।আমি তো এক চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁপছি।
একটু পর আমার গালে কারো স্পর্শ পেলাম। এক চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম,
শ্যামবর্ণের একটি মায়াবী মুখ,বড় বড় চোখ কিন্তু চোখের নিচে অনেক কালি জমে আছে, ঠোঁট গুলো শুকিয়ে কেমন অমসৃণ হয়ে আছে! কপালের ছোট চুলগুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমি এবার পুরোপুরি দৃষ্টি মেলে তাকালাম। আমার গালে স্পর্শ করে বলছে,
-তুমি কি পুতুল? আমাদের বাড়িতে এলে কি ভাবে?আব্বা, আব্বা এইদিকে আসেন। দেখেন আমাদের বাড়িতে পুতুল এসেছে।
মেয়ের কন্ঠ শুনে তড়িঘড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে এলেন রায়হান সাহেব। মেয়ের রুমের সামনে আসতেই দেখতে পেলেন রুশা আর কাজল দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে কাজলকে বললেন,
-কি হয়েছে কাজল? কে তোর পুতুল এনেছে?
-এই দেখেন না আব্বা এই যে ওই তো পুতুল।
রায়হান সাহেব মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন। আসলেই রুশা কিন্তু পুতুলের মতো সুন্দর।
-হ্যা পুতুল। কিন্তু ওর নাম রুশা। আজ থেকে তুমি ওকে রুশা বলে ডাকবে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন রায়হান সাহেব।
-না, বাবা ওকে আমি পুতুল বলে ডাকবো। এই পুতুল শুনো?
আমি এতক্ষণ ধরে বাবা-মেয়েকে দেখেছিলাম।আচ্ছা, উনার কথাগুলো এমন কেন? উনি কি ভারসাম্যহীন!
পুতুল বলে আমাকে ডাক দিতেই আমি উনার দিকে তাকালাম,
-জি বলুন, আপু।
-তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? এখন থেকে আর কোথাও যাবে না ঠিক আছে।
-আচ্ছা, আমি আর কোথাও যাবো না।
সেদিন রাতে আঙ্কেলের থেকে জানতে পারলাম কাজল আপু হঠাৎ করে এমন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন।আজ চারবছর ধরে উনি এমন। চিকিৎসা করিয়ে তেমন ফল পাচ্ছেন না। তবুও আশায় আছেন কোনো একদিন কাজল আপু আবারও সেই আগের মতো প্রণোবন্ত হবেন। আমি সিজারের জন্য কিছুদিন হাঁটাচলা করতে পারিনি তাই কাজল আপুকে এতদিন দেখিনি।
——————–
একসপ্তাহ আগে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি। আর কোনোপ্রকার লেনদেন নেই আমার রাফির সাথে। সে তার পথে আমি আমার পথে।
আয়াত উনি আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন আমার সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে। সেখানে থেকে এসে আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য তোরজোড় শুরু করে দিলেন। ভালো এক কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে ফাহিমা খালা এসে দিয়ে যান আবার সাথে করে নিয়ে যান। কোচিংয়ের পাশাপাশি আয়াত অনেক সাহায্যে করতেন পড়ার বিষয়ে।
যথারীতি পরীক্ষার দিন চলে এলো। কাঁপাকাঁপা শরীর নিয়ে আঙ্কেলের কাছে যখন দোয়া চাইতে গেলাম, তখন আঙ্কেল হেসে বললেন,
-তোর জন্য আমি সবসময় দোয়া করি তবে আজ যদি তুই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হস তবে আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে রুশা হাসানের প্রথম জয়ের গল্প থাকবে।
কাজল আপু কি বুঝলেন কে জানে তবে সেদিন আমায় বুকে জড়িয়ে বলছিলেন,
-পুতুল বেস্ট অফ লাক।দোয়া করি তুই তাড়াতাড়ি ডাক্তার হয়ে যা।
আমি হেসে আপুর গালে চুমু দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েছিলাম আয়াতের সঙ্গে।
পরীক্ষার হলে ঢুকবার আগে আয়াত আমায় বললেন,
-রুশা, এই যে এই সাদা এপ্রোণ দেখছো। এইটার রং কিন্তু রঙিন না সাদা। তবুও এই এপ্রোণ যারা গায়ে জড়িয়েছ তাদের জন্য অনেকের জীবন বিভিন্ন রঙে রাঙিয়েছে। তাই বলবো নিজের স্বপ্নের আগে তোমার কর্তব্য হলো এই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় তুমি নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করবে। তবেই তোমার স্বপ্নের সার্থক হবে।
ভালো ভাবে লিখো, বেস্ট অফ লাক।
সবার উপদেশ মূলক বানী আমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেলো। মন থেকে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম আর বলছিলাম। যদি আমি চান্স না পাই তবে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের মন ভেঙে যাবে। তাদের জন্য হলেও আমাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।
———————-
অবশেষে আজ পরীক্ষার রেজাল্ট জানাবে। দুরুদুরু বুকে মাথা নিচু করে বসে আছি ড্রইংরুমে। আমার পাশে বসে আছে কাজল আপু কিন্তু উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি এই জগতে নেই অন্য জগতে বিরাজমান।
আঙ্কেল বসে বসে টিভিতে নিউজ দেখছেন আর ফাহিমা খালা পান সাজিয়ে নিজে নিজে খাচ্ছে।
একটু পর সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন আয়াত। এসে সর্বপ্রথম সবাইকে সালাম দিয়ে সোফায় বসলেন।
এরপর, আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-রুশা, যাও তো আমার জন্য ঠান্ডা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।
এদিকে আমার মন বিচলিত হয়ে পড়েছে রেজাল্ট জানার জন্য আর উনি কি না এখন ঠান্ডা পানি চাইছেন!হয়তো গলা ভিজিয়ে এরপর বলবেন, যাই আগে পানি নিয়ে আসি নয়তো যত দেরি করবো ততই রেজাল্ট জানতে দেরি হবে।
রান্নাঘর থেকে একগ্লাস পানি এনে উনার সামনের টেবিলের উপরে রাখলাম৷ উনি পানি হাতে নিয়ে বললেন,
-রুশা, পরীক্ষায় পঞ্চম হয়ে আমাদের শুধু ঠান্ডা পানি দিয়ে আপ্যায়ন করছো এটা কিন্তু ঠিক না।
আয়াতের মুখে আমার রেজাল্ট শুনে কিছুক্ষণের জন্য বাকরূদ্ধ হয়ে রইলাম। আমি পঞ্চম হয়েছি!
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৫
#Tahmina_Akhter
দরজায় কারো কড়াঘাতে আমার ঘুম ছুটে গেলো। চোখ খুলে সর্বপ্রথম দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওমা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে!
খাট থেকে নেমে চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে মাথায় ওড়না দিয়ে দরজা খুললাম।
রায়হান আঙ্কেল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বললেন,
-কি রে সারারাত ঘুমাসনি? চোখ লাল হয়ে আছে যে।
-আসলে হয়েছে কি?আজ যে আমার মেডিকেল কলেজের প্রথমদিন সেই আনন্দ-উত্তেজনায় রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় নি।
মাথা নিচু করে বললো রুশা।
রায়হান সাহেব হেসে ফেললেন রুশা বাচ্চামো কথা শুনে।
-এখন তো আর ঘুমানোর সময় নেই। হসপিটালে আট’টার আগে পৌঁছাতে হবে।এখন জলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয় তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।
-কিসের সারপ্রাইজ আঙ্কেল?
আঙ্কেল নীচে চলে যাচ্ছিলেন আমার প্রশ্ন শুনে থেমে গিয়ে বললো,
-সারপ্রাইজ দেখতে চাইলে চট করে ফ্রেশ হয়ে জলদি নিচে চলে আয়।
আঙ্কেলের কথা শুনে আর দেরি করি নি।তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে কালো রঙের থ্রী-পিছ পড়ে নিলাম।
ওড়না মাথায় জড়িয়ে নিচে চলে এলাম। কিচেন থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। ফাহিমা খালা তো রান্নার সময় এমন শব্দ করে না! দেখি তো কি হয়েছে?
কিচেনের সামনে যেয়ে দাঁড়াতে আমার চক্ষু ছানাবড়া। কারণ, কাজল আপু রান্না করছে। আর উনার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন ফাহিমা খালা।
আমি উত্তেজনা চেপে ধরে রাখতে না পেরে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-এই আপু তুমি রান্না করছো কেন? আরে হাত পুড়ে যাবে তো।চলে আসো, তোমার রান্না করা লাগবে না। ফাহিমা খালা আপনি কিছু বলছেন না কেন আপুকে?
-আমি কি কমু?আমি কিছু কওনের লাইগা মুখ খোলনের আগে হে আমার যে ধমকি মারছে, মা। আমি আর কিছু কমু না।
-পুতুল?দেখ আমি কিন্তু রান্না করতে পারি। কিন্তু মাঝে মাঝে কি যেন হয় আমার তখন আর কিছু ভালো লাগে না।আম্মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন কত নতুন নতুন আইটেম ট্রাই করতাম আর আম্মাকে খাওয়াতাম। আজ কিন্তু তোর জন্য রান্না করছি তুই খেয়ে বলবি কেমন হয়েছে? আজ কতদিন হলো রান্না করি না। না জানি স্বাদ কেমন হয়?
-আচ্ছা, আমি খেয়ে দেখবো। এখন তুমি বের হয়ে আসো বাকি কাজ আমি আর ফাহিমা খালা মিলে করে নিবো।
-তোমাগো কিছু করন লাগতো না। এমনিতেই বেবাগ কাম শেষ তোমরা টেবিলে যাইয়া বোও। আমি সব রেডি কইরা আনতাসি।
আমি কাজল আপুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম রান্নাঘর থেকে। টেবিলের কাছে আসতেই দেখলাম আঙ্কেল আর আয়াত ভাই বসে আছেন। কাজল আপু আয়াত ভাইকে দেখে আমাকে আস্তে করে বললেন,
-পুতুল, আমি এখানো বসবো না। তুই আমাকে রুমে দিয়ে আয়।
-কেন? কি হয়েছে?এখানে বসে সবার সাথে খাবার খেলে ভালো লাগবে তোমার। আর আজ তো তুমি রান্না করেছো তোমার হাতের রান্না করা খাবার তাদের কাছে কেমন লেগেছে শুনবে না?
-হুম, শুনবো তো।
-তাহলে এসো আমার সাথে।
টেবিলের সামনে এসে একটি চেয়ার টান দিয়ে কাজলকে বসিয়ে দিলো রুশা। এরপর, আরেকটি চেয়ার টেনে সেও বসে পড়লো।
এরইমাঝে, আয়াত ভাই আমার দিকে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-হসপিটালের যাবার আগে এটা পরিধান করো।
আমি প্যাকেট হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম একটি অ্যাশ কালারের বোরকা সাথে নিকাব। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আঙ্কেলের দিকে তাকাতেই আঙ্কেল আমাকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলেন। তাই আর কোনো কথা বললাম না।
-রুশা?
-জি আঙ্কেল।
-আয়াত শুধু তোমার জন্য নয় আমাদের সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে এনেছে।তোমার জন্য বোরকা, ফাহিমার জন্য শাড়ি, আমার জন্য পাঞ্জাবি আর সবশেষে কাজলের জন্য এইটা। বলে কাজল আপুর দিকে একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন।
কাজল আপু উনার আব্বার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার আয়াত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্যাকেট হাতে নিলেন।
-আচ্ছা, তাহলে আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। রুশা তোমার শেষ হলে গাড়িতে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।
-আয়াত ভাই খেয়ে যান। আজ আমাদের কাজল আপু রান্না করেছে।
আয়াত যেন ভুল কিছু শুনেছে তাই ও প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে ফাহিমা খালার দিকে তাকালো। ফাহিমা খালা হ্যা জানাতেই আয়াত এসে আগের জায়গায় বসে পড়লেন। খালা উনার পাতে একে একে সব খাবার তুলে দিলেন। উনি এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এরপর, বললেন
-আজ ঠিক কতদিন পর কাজলের হাতের রান্না খেলাম! খিচুড়ি, গরুর মাংস, ইলিশ মাছ ভাজা আহহ অনেক মজা হয়েছে।
-অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে। কাজল?
-জি আব্বা।
-মা’রে আমার আগে মতো হয়ে যা।তোকে সুস্থতে মানায় তুই অসুস্থ থাকলে তোর আব্বার এই দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে যায়। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল মা?
কাজল কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে আছে। দু’তিনদিন ধরে ঠিক আগের কথাগুলো মনে পড়ছে যেখানে তার পরিবারের সাথে কাটানো সকল স্মৃতি, জায়ানের সাথে তার খুনসুটি সব। জায়ানের কথা সে করতে চায় না। কারণ, যখনি জায়ানের স্মৃতি তার দৃশ্যপটে ভাসমান হয় ঠিক তখনি তার আর কিছু মনে থাকে না। মনে হয় এই জগত থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুশা রুমে চলে যায় তৈরি হতে। বেশ কিছুক্ষণ পর বোরকা-নিকাব পড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে রুশা। এরপর, রায়হান সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-আঙ্কেল দোয়া করবেন আমার জন্য। আজকের এই দিনের শুরু যেন আমার সমাপ্তিতে আনন্দে ভরপুর থাকে। আপনি আসবেন আজ আমার সাথে?
-তোর জন্য দোয়া মন থেকে এমনিতে আসে। একটা মনে রাখিস আজ যদি আমি তোকে নিয়ে তোর শিক্ষাঙ্গনে যাই তবে সকলে তোকে ডা.রায়হানের আত্মীয় হিসেবে চিনবে। কিন্তু, আমি চাই না তোকে কেউ ডা.রায়হানকে দিয়ে চিনুক। আমি চাই তুই তোর নিজের পরিচয় তৈরি কর. যেখানে কোনো ডা.রায়হানের পরিচয় তোর প্রয়োজন হবে না।হয়তো আমার কথা আজ তোর খারাপ লাগতে পারে কিন্তু কোনো একদিন বুঝবি তোকে কেন কথাগুলো বলেছিলাম।
বেস্ট অফ লাক রুশা হাসান।
আঙ্কেলের প্রত্যেকটি কথা অতন্ত্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছি আমি। তার প্রত্যেকটি শব্দে ছিলো জীবনে আমাকে বড় হতে দেখার মনোবাসনা
-পুতুল, ভালো ভাবে পড়াশোনা করিস। নয়তো টিচাররা মাইর দিবে।
বলে হাসতে লাগলো কাজল আপু। সাথে আমরাও হেসে ফেললাম।
বাড়ির সকলের থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর আয়াত ভাই চললাম ঢাকা শিশু হাসপাতালের উদ্দেশ্য।কিছুদূর যাবার পর গাড়ি জ্যামে পড়লো। আমি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছি। কত ছোট ছোট শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে।হঠাৎ করে এক দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো।নিজেও কোনদিন বাবা-মায়ের সাথে স্কুলে যেতে পারেনি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বাবা-মা ছিলো না। যদি বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে আমার জীবনটা আজ অন্যরকম থাকতো।
-রুশা,বোরকা পরতে বলেছি বলে রাগ করেছো?
-না, কেন রাগ করবো? এই কয়দিনে অন্তত এটা বুঝতে পেরেছি আপনি আমার ভালো চান। তাহলে বোরকা পরার বিষয়টা আমার রাগের কারণ হবে কেন?
-তোমার ভালো আমি অবশ্যই চাই। কিছু কথা বলি শুনবে?
-হুম, বলুন।
-পর্দা’ শব্দটি মূলত ফার্সী। যার আরবী প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ- আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আড়াল, অন্তরায়, আচ্ছাদান, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি। মূলত ‘হিজাব বা পর্দা’ নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ। নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়।
নারীদের পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষার্থেই তাদের উপর এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা আহযাব: ৩৩)
এ বিধান অনুসরণের মাধ্যমে হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সূরা আহযাব: ৫৩)
পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহযাব: ৫৯)
হাদীস শরীফেও পর্দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। (তিরমিযী: ১১৭৩)
-হুম, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু, পুরুষদের জন্য পর্দার বিধান নেই কেন?
-কে বলেছে পুরুষদের জন্য পর্দার বিধান নেই?
পবিত্র কোরআন মাজীদে সূরা নূরের ৩০ নং আয়াতে মহান আল্লাহপাক বলছেন, ‘হে নবী! মুমিনদের (পুরুষ) বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতেই তাদের জন্য পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে, আল্লাহ তা সম্পর্কে অবহিত আছেন।’ (সূরা: আন-নূর, আয়াত: ৩০)
এই আয়াতের শুরুতেই ঈমানদার পুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে। ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত কিংবা তাকানোই হচ্ছে- যৌন প্রবৃত্তির শুরুর এবং এর শেষ পরিণতি পাপ ও ফেতনাসহ জিনা ব্যভিচার যার পরিণাম ভয়ঙ্কর।
হয়তো কথাগুলো বুঝতে তোমার খানিকটা সময় লাগতে পারে। কিন্তু, এমনও তো হতে পারে তোমার আপন কেউ এভাবে খোলামেলা চলাফেরা পছন্দ করে না?
আয়াত ভাইয়ের শেষের কথায় আমার ভীষণ হাসি পেলো। কে আসবে আমার জীবনে? এই জীবনে আর কাউকে আপন করতে চাই না। একলা আছি বেশ আছি।
এরইমাঝে জ্যাম ছুটে গিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিছু সময় পর গাড়ি থেমে গেলো বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম। আমার স্বপ্নের ঠিকানা ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
#চলবে
#চলবে