#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akhter
(৩)
-এই রাফসান, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
বলতে বলতে একটি ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।আমি ছেলেটার ডাক শুনে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলেছি কিন্তু আদিল আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে বিশাল অন্যায় করে ফেলেছি।
-উনাদের চিনিস না কি তুই?
ছেলেটা রাফসানের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো।
-না ভাইয়া, উনাদের আমি চিনি না কিন্তু পরিচিত হতে চেয়েছিলাম। আসলে হয়েছে কি?
রাফসান মাথা নিচু করে মাথা চুলকিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলো।
-আসসালামু আলাইকুম।আমি ঢাকা শিশু হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা.আদিল রহমান। ও আমার স্ত্রী রুশা হাসান এবার ইন্টার্ন করছে।
রাফসানের ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো আদিল।
-আমি রওনক মির্জা। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী। ও হচ্ছে আমার ছোট ভাই রাফসান মির্জা।
আদিলের সাথে হ্যান্ডশেক করে কথাগুলো বললো মি. রওনক মির্জা।
-আপনারা কি একে অপরের সাথে পরিচিত মি.আদিল?
-না, ঠিক পরিচিত না। আসলে, রাফসান ছোট একটু বুঝতে ভুল করেছে।
-কি ভুল করেছে?
-আপনি জানলে বরং রাফসান লজ্জা পাবে। চলি তাহলে কখনো ঢাকায় গেলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড।
মি.রওনক আদিলের হাত থেকে কার্ডটি নিয়ে পকেটে রেখে দিলো।
ওদের দু-ভাইয়ের কাছ থেকে কোনোভাবে বিদায় নিয়ে আদিল রুশার হাত ধরে অন্যপথে হাঁটতে লাগলো । রুশা এতক্ষণ ধরে হাসি চেপে রেখেছিল কিন্তু এখন আর পারছে না,হাসি দিয়ে ফেললো। আদিল রুশার হাসি দেখে হাঁটা থামিয়ে রুশার দিকে মিষ্টি চোখে তাকালো।
রুশা বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে আদিলকে বললো,
-আপনি কি কোনোভাবে মি.রওনকের উপর জেলাস ফিল করছেন?
-আমি কেন জেলাস ফিল করবো! রুশা তুমি কিন্ত?
– কিন্তু কি?জেলাস ফিল করছেন সত্য বললে কি হয়। এখন চলেন হোটেলে ফিরে যাই দুপুরের রোদ গায়ে লাগছে বিকেলে বের হবো।
-আগামীকাল দুপুরে চলে যাবো আমরা আর তুমি কি না বলছো এখন হোটেলে ফিরে যাবো। চলো, এখানকার স্থানীয় মার্কেটে যাই, সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
-হুম, চলেন।
রুশা আদিলের হাত ধরে এগিয়ে চললো সমুদ্রের বালুপথে।
——————–
বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র, নানান রকমের আচার কিনে হোটেলে ফিরে এলো দু’জনে।
তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। আদিল গিয়েছে রিসেপশনে কি যেন প্রয়োজন তাই। আমি বসে বসে গতকাল রাতের কথা ভাবছি। সবই স্বপ্ন আগে ভাবতাম কিছু চাওয়া বুঝি কল্পনায় পাওয়া যায় গোছানো অবস্থায়।
গতকাল,রাতে আমার উন্মুক্ত উদরে নিম্ন স্থানের কাটা দাগ দেখে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ে আদিল। কাটা দাগে হাত বুলিয়ে আমার দিকে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি যখন ওকে প্রশ্ন করলাম,
-কি হলো, আদিল?
-কিছু না। আচ্ছা রুশা এই দাগটা রোজ দেখো বলে সন্তানের কথা বেশি মনে পড়ে?
-হুম। আচ্ছা আদিল আপনার কি এখন মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে আপনার স্ত্রীর শরীর খুঁত আছে।
– রুশা, তুমি উল্টো ভাবছো। একটি মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক মূহুর্ত হচ্ছে, দশমাস সন্তানকে গর্ভে রেখে, প্রসবকালীন যন্ত্রণা সহ্য করে সন্তানের মুখ দেখতে পাওয়া। তুমিও সেই কষ্ট করেছো কিন্তু। থাক সেসব কথা। রুশা, তুমি আমার হৃদয়ের একটি অংশ তোমার খুঁত খুঁজতে গেলে আমি যে আমার দেহে খুঁত খুঁজে পাবো।
আদিলের কথার প্রেক্ষিতে আর কিছুই বলতে পারিনি। মনে শুধু একটি কথা প্রতিধ্বনি হয় আদিল বড্ড ভালো মানুষ। নয়তো, এই শো-অফের যুগে কে একটি মেয়েকে ভালোবেসে অপেক্ষায় থাকতে পারে!ভারী আশ্চর্য লাগে, বাবা-মায়ের ভালোবাসা পায়নি বলে স্বামীর কাছ থেকে এত এত ভালোবাসা পাচ্ছি। যার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনলে গায়ে কাঁপন ধরে যায়।
মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠতে রুশা ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে এলো। পাশের টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো আদিল কল করেছে। ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে রইলো। কারণ, নিচে গিয়ে কল করার কারণ কি? আচ্ছা, ওর কিছু হলো না তো?
দুরুদুরু বুকে কল রিসিভ করলো রুশা। ওপাশ থেকে আদিল বলছে,
-রুশা, একটু নিচে আসো তো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
-কিন্তু,
-কোনো কিন্তু নয়। আমি অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি এসো।
কল কেটে দিলো আদিল আর রুশা তৎক্ষনাৎ খার থেকে নেমে জিলবাব পড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
নিচে যাওয়ার পর অনেক খুজেও আদিলের দেখা পায়নি রুশা৷ মোবাইলটা ভুল করে রুমে ফেলে এসেছে এখন ও জানবে কি করে আদিল কোথায় আছে?
-এক্সকিউজ মি, ম্যাম?
রুশা পিছু ঘুরে দেখলো একটি মেয়ে। রুশা প্রথমে অবাক হলো কারণ ও মেয়েটাকে চিনে না। তারপর, বললো,
-জি, আমাকে বলছেন?
-জি, ম্যাম আপনাকে বলছি। আসলে মি. আদিল রহমান আপনার হাজবেন্ড রাইট?
-জি। আপনি জানেন কিভাবে আদিল আমার কি হয়?
-জানি কারণ মি.আদিল আমায় বলেছেন। আপনি এবার আমার সাথে চলুন।
-আমি কেন আপনার সাথে যাবো? আদিলকে বলুন এখানে আসতে।
এরইমাঝে মেয়েটির মোবাইল বেজে উঠলো, মেয়েটি কল রিসিভ করে বলছে,
-স্যার, আপনার ওয়াইফ আমাকে বিশ্বাস করছে না আপনি কথা বলুন।
বলে মোবাইলটা আমার এগিয়ে দিলো আমি মোবাইল নিয়ে বললাম,
-কোথায় আপনি?
-পাখি, আমি আছি এক জায়গায়। তুমি উনার সাথে চলে এসো ট্রাস্ট মি উনি ভালো মানুষ।
-কিন্তু,
-তোমার আদিলের উপর বিশ্বাস নেই।
-নিজের থেকেও বেশি।
-তাহলে, চলে এসো আমি অপেক্ষা করছি।
রুশা সেই মেয়েটির পিছু পিছু হাটতে লাগলো।মেয়েটি একটি রুমের সামনে এসে ইশারা করলো ভিতরে যাওয়ার জন্য। রুশা ভয়ে ভয়ে রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।
————————
রুশা রুমের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলো অন্ধকার কক্ষ, জানালা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো রুমের একাংশে জুড়ে আলোকিত করে রেখেছে।
চাঁদের সেই একাংশ আলোয়ে আদিলের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। একপ্রকার দ্রুত গতিতে হেঁটে ওর বুকে আশ্রয় নিলাম।
আদিল রুশাকে পরম আবেশে বুকের মাঝে চেপে রাখলো।রুশার হৃদস্পন্দন যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে।আদিল কিছুটা সময় নিলো রুশাকে স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত।
কিছু সময় অতিক্রম হবার পর আদিল রুশার মাথায় চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে তোমার, ভয় পেয়েছো?
-ভয় পাবো না তো কি করবো? আপনি রিসেপশনে গিয়ে আমাকে কল করে বললেন আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যেন খুব জলদি চলে যাই কিন্তু সেখানে যাবার পর দেখি আপনি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। তখন,আমার মনের অবস্থা কি হয়েছে আপনি ভাবতেও পারবেন না।
এরপর,এক অচেনা মেয়ে এসে যদি বললো, তার সাথে যেতে। আমি তো ভয়ে শেষ ভাগ্যিস আপনি কল করেছিলেন। নয়তো, আজ যেভাবে হৃদস্পনন্দনের গতি বেড়েছিল, আর বেশিক্ষণ হলে মরে
কথাটা আর পূর্ণ করতে পারেনি রুশা তার আগে আদিল ওর মুখ হাত রেখে বাঁধা দিলো।
-এইসব কথা কেন বলো তুমি?ভয় হয় ভীষণ; তোমাকে ছাড়া বহুদিন পাড় করেছি আর সাহস হয় না তোমাকে ছাড়া একটি দিন কল্পনা করতে।
-থাক আর বলবো না।
রুশা আদিলের চোখে চোখ রেখে বললো। আদিল রুশার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-হুম, আর কখনো বলবে না। কিন্তু, এখন তোমার একটি কাজ আছে।
-কি কাজ?
-তুমি নিজ চোখে দেখে নাও।
আদিল রুশার কাছ থেকে সরে গেলো। রুশা দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে হঠাৎ করে পুরো রুমে আলোকিত হয়ে গেলো। আদিল তাহলে রুমের লাইট অন করেছে।
রুশা এবার পুরোপুরি রুমের মাঝে তাকিয়ে দেখলো,
পুরো রুম জুড়ে নানান ফুলের সমারোহ। বেডের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ আঁকা।
কক্ষের একপাশে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমি সবকিছু দেখে ভীষণ অবাক হলাম। আদিলের দিকে তাকাতে ও আমাকে বললো,
-হানিমুনে আসা নতুন কাপলদের জন্য এই রুম হোটেল থেকে বরাদ্দকৃত;পছন্দ হয়েছে?
আমি হালকা হেসে মাথা কাত করে ইশারায় বললাম,
-ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
আদিল এবার একটি প্যাকেট এনে আমার দিকে এগিয়ে বললো,
-এটার মধ্যে যা কিছু পরে এসো। বাদ-বাকি সব আমি করবো।
-কি আছে প্যাকেটে?
-রুশা তুমি অনেক প্রশ্ন করো। এখন ওয়াশরুমে যাও।
বলে রুশার কাঁধ ধরে ওয়াশরুমের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো।
রুশা ওয়াশরুমের দরজা লক করে প্যাকেট খুলে দেখলো, একটি লাল রঙা জামদানি শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ-পেটিকোট সাথে একটি চিরকুট।
রুশা চিরকুটটি খুলে দেখলো, সেখানে লেখা
“মাধুর্য, আজ তোমায় আমার মনের কল্পনার মতো সাজাতে চাই”
রুশা চিরকুটটি রেখে হালকা হেসে তৈরি হতে লাগলো।
শাড়ি পড়া শেষ হতে ওয়াশরুমের আয়নায় তাকাতে যেয়েও আর তাকায়নি রুশা। কারণ, আজ আদিলের কল্পনার মতো রুশা সাজবে আয়নায় তাকানোর প্রয়োজন নেই।আজ রুশার আয়না হবে আদিল।
হুট, করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হয়ে এলো রুশা। আদিল তখন মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছিলো। কিন্তু, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সম্মোহিত হয়ে পড়লো আদিল।
লাল রঙা জামদানীতে আজ রুশাকে সত্যি বৌ বৌ লাগছে। সাধারণ সাজে আজ রুশাকে অসাধারণ মনে হচ্ছে আদিলের কাছে।
কল কেটে দিলো আদিল এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো রুশার সম্মুখে। রুশা আদিলকে নিজের কাছে আসতে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো।ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে আজ কাল তো এত লজ্জা পায়নি সে তবে আজ কেন!
রুশার অবনত আদল দু’হাতের আজলে ভরে আদিল গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, রুশার লেপটানো সেই কাজল রাঙা চোখে।চোখের পাতায় চুমু দিয়ে রুশার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো আয়নার সামনে এরপর রুশাকে টুলে বসিয়ে বললো,
-আজ আমার মনের কল্পনায় সাজাবো তোমায়।
রুশা কিছু বললো না আজ যে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না শুধু শুনতে ভালো লাগছে।
চোখে গাঢ় করে কাজল টেনে দিলো, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক সর্বশেষ রুশার এলো খোঁপায় বেলিফুলের মালা গুঁজে দিলো।
আদিল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুশার পানে। আজ সত্যি রুশাকে তার কল্পনার চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। ঠিক যেমনটা রোজ কল্পনায় এসে হাতছানি দিয়ে যেতো।
-তুমি আমার কল্পনা জগতের একছত্র রানী মাধুর্য। রোজ তোমায় এভাবে দেখে আমি অভ্যস্ত। দেখো তো আমার রানীকে কেমন দেখাচ্ছে?
রুশা আদিলের কথায় চোখ খুলে তাকালো নিজের প্রতিবিম্ভের মাঝে। সত্যি কি রানীর মতো লাগছে তাকে!
আদিল রুশাকে কোলে তুলে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে যেখানটায় আজ চাঁদের পূর্ণ আলোর মেলা বসেছে।
#চলবে