শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -০২

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akhter

(২)

আদিলের নগ্ন বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রুশা। রাত প্রায় দু’টো বাজে ; আদিলের চোখে আজ ঘুম নেই৷ সব যেন স্বপ্নের মতো লাগছে।এই যে রুশা ওর বুকে মাথা পেতে ঘুমিয়ে আছে এটাও তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

রুশাকে যখন থেকে ভালোবাসতে শুরু করলো তখন থেকে প্রতিরাতে আদিলের ঘুমের রাজ্যে আনাগোনা বেড়ে যেতো রুশার। যেখানে কখনোবা রুশা কান্নারত অবস্থায় থাকতো,কখনোবা হাসিমুখে তাকিয়ে থাকতো, কখনোবা গভীর ভালোবাসাময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আদিলের দিকে।

সে সব স্বপ্ন আজ সত্যি পূর্ণ হলো।গভীর আবেশে রুশাকে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলো আদিল।গভীরভাবে চুমু দিলো রুশার কপালে।

আজ হসপিটালে রুশার ভেজা চোখ দেখে আদিল বুঝতে পেরেছিলো।হসপিটালের অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে আসা সেই দম্পতি রুশার খুব পরিচিত কেউ। হয়তো, রুশার অতীত জীবনের কেউ যাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের বাকি পথ চলতে চেয়েছিলো কিন্তু যাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে সে তো রুশাকে তার জীবন থেকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে।

বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা পেড়িয়ে রুশা আজ তার অবস্থান তৈরি পাকাপোক্ত করেছে। অতীত ভুলে নিজের অন্তঃকরণে আদিলের নাম এঁকেছে। নতুন করে জীবনের মানে বুঝতে শিখেছে আর কি চাই রুশার?

অ্যার্লামের শব্দে আদিলের ঘোর কেটে গেলো। মোবাইল হাতে নিয়ে অ্যার্লাম অফ করে দিলো এবং সময় দেখে নিলো,রাত তিনটে বাজে।

আদিল আলতো করে রুশার গালে চুমু দিলো, কপাল ছড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করে, আস্তে করে রুশাকে ডাক দিলো,

-রুশা, এই পাখি, শুনছো?

-হুম?

-উঠে পড়ো। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য রওনা দিতে হবে সকাল সাতটায় ফ্লাইট। এখন, উঠে গেলে আস্তেধীরে তৈরি হয়ে, এয়ারপোর্টে ঝামেলা ছাড়াই যাওয়া যাবে।শুনছো, পাখি?

-শুনেছি। কিন্তু, আমার চোখে ভীষণ ঘুম। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।

আদিলের বুকে নাক ঘষে কথাগুলো বলছে রুশা।

-এখনই, তোমার চোখ খোলার ব্যবস্থা করছি।

বলেই রুশাকে কোলে নিয়ে খাট থেকে নেমে পড়লো আদিল। রুশা ভয়ে চোখ খুলে ফেললো, প্রথমে ভেবেছিলো ও বুঝি খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। আদিল রুশাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে দেখে রুশা প্রায় চিৎকার করে বললো

-এই এত রাতে ওয়াশরুমে কেন? কোল থেকে নামান আমাকে।

-কেন?এখন দেখছি চোখ খুলেছো আবারও চিৎকার করছো।গোসল করাতে নিয়ে যাচ্ছি তোমায়। বাকি যতটুকু ঘুম আছে সেগুলো গোসল করলে কেটে যাবে।

-এই রাতে গোসল করলে আমি ঠান্ডায় শেষ হয়ে যাব আদিল।

কথাটা শেষ হতে না হতেই রুশাকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে শাওয়ার অন করে দিলো।বেচারি রুশার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।রুশার কান্ড দেখে আদিল হেঁসে ফেললো। আদিলের হাসি দেখে রুশার গা জ্বলে উঠলো তাই রুশা এবার আদিলকে হেঁচকা টানে শাওয়ারে মাঝে দাঁড় করিয়ে দিলো। বেচারা আদিল ভাবতেও পারেনি রুশা এমন একটা কাজ করবে।

রুশা আর আদিলের মাঝে দূরত্ব তিন ইঞ্চি। প্রতিটি জলের বিন্দু দু’জনকে সিক্ত করে দিচ্ছে। রুশা প্রথমে বিষয়টা মজা হিসেবে নিলেও এখন বেশ লজ্জা পাচ্ছে। কারণ, আদিলের দৃষ্টি বেশ ধারালো ;তার ওই ধারালো চোখে তাকালে হৃদয় ছেদন হবে সহস্রবার।

হঠাৎ, করে রুশা আদিলের কাছ থেকে সরে গেলো। এরপর, আদিলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-কক্সবাজার যাবেন?

-অবশ্যই যাবে।

-নিশ্চয়ই, ওয়াশরুমে পরে থাকলে কক্সবাজার কেউ দিয়ে আসবে না তাই না।

-নতুন বৌ যেখানে থাকবে সেখানটায় কক্সবাজার মনে হবে,জায়গা কোনো ম্যাটার না।

-হয়েছে এবার ওয়াশরুম থেকে যান।

-ওকে ওকে।

বলে আদিল ভেজা গায়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল কি মনে করে আবারও রুশার কাছে ফিরে এলো। রুশা জিজ্ঞেস করলো,

-কি হলো, আবার?

-কিছুই হয়নি। তবে এখন হবে।

রুশার ভেজা অধরে চুমু খেয়ে আদিল বের হয়ে গেলো ওয়াশরুম থেকে আর রুশা লজ্জায় ওয়াশরুমের আয়নার দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারেনি।

অতঃপর, সবকিছু গোছগাছ করতে করতে ফজরের ওয়াক্ত হয়ে এলো।নামাজ শেষ করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের গেলো আদিল আর রুশা, উদ্দেশ্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

কারের ড্রাইভিং সিটে জনি তার পাশের সিটে আয়াত এবং পিছনে আদিল আর রুশা। আদিল আয়াত ভাইকে বিভিন্ন রকমের উপদেশ দিচ্ছে।যেন বাবার খেয়াল রাখে,কাজল আপু এবং আরশির খেয়াল রাখে।

আমি বিরক্তিকর লুক নিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর আদিল আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো,

-কি হয়েছে, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

-বলি কি, আয়াত ভাইয়ের ওয়াইফ হচ্ছে কাজল আপু এবং আয়াত ভাইয়ের মেয়ে হচ্ছে আরশি।উনি সবসময় ওদের খেয়াল রাখছেন।এভাবে উপদেশ দিয়ে বলার কি দরকার, বলুন তো?

নিচু কন্ঠে কথাগুলো বললাম, যদি আয়াত ভাই বা জনি শুনে ফেলে।

-মন তো আর মানে না। কারণ ওদের নিয়ে আমার পৃথিবী। ইশশ,আজ যদি আম্মা বেঁচে থাকতো! তোমাকে দেখলে ভীষণ খুশি হতো।

কথাগুলো বলতে বলতে আদিলের কন্ঠ কেমন ভারী শোনালো হয়তো আজ আম্মার কথা আদিলের অনেক মনে পড়েছে।

আমি আদিলের বামহাত আমার হাতের মাঝে নিলাম। আদিল আমার দিকে তাকালে আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছোট একটি হাসি ফিরিয়ে দিলাম।

———————————-

ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কক্সবাজার এয়ারপোর্টগামী বিমানটি কক্সবাজারে অবতরণ করলো সাতটা পয়তাল্লিশ মিনিটে। বিমানবন্দরের বিভিন্ন ফর্মালিটি শেষ করে বের হয়ে এলো আদিল আর রুশা ।

একটি ক্যাব ভাড়া করে রওনা হলো বিলাসবহুল হোটেলের উদ্দেশ্য যা আগে থেকে আদিল বুকিং করে রেখেছিলো।

হোটেলে পৌঁছানোর পর সকালের নাশতা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো রুশা। কারণ,বিয়ের ধকল সামলে উঠতে না উঠতে আবারও কক্সবাজারে এসেছে।

আদিল রুশার কান্ড দেখে হালকা হেসে, ওর আব্বার কাছে কল করে জানিয়ে দিলো ওরা কক্সবাজার ঠিকঠাক ভাবে পৌছে গেছে।

আদিল রুশার পাশে বসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

-পাখিটার উপর ভীষণ ধকল গিয়েছে নয়তো কেউ চোখের সামনে বিশাল সমুদ্র রেখে গভীর ঘুমে থাকতে পারে!

ঘুম থেকে জেগে দেখি দুপুর বারোটা বেজে গেছে। দুপুরের খাবার শেষ করে চলে এসেছি সমুদ্রের তীরে।

এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছু পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে।বাতাসের তোড়ে ভেসে আসছে সমুদ্রের কলকলানি। আদিলের হাত ধরে সমুদ্রের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছি আমি।

তীব্র বাতাস, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, নীলচে পানির সাথে সাথে মিশে আছে দূর আকাশের নীলচে মেঘের প্রতিচ্ছবি।

আদিলের মোবাইলে কে যেন বারবার কল করছে। আদিল কল রিসিভ করেছে, কিন্তু ওপাশের কথা বুঝতে পারছে না হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা। তাই আমি আদিলকে বললাম,

-একটু সাইডে যেয়ে দেখেন,

-তোমাকে একা রেখে কিভাবে যাই। বরং,তুমিও আসো আমার সাথে।

-আপনি যান আমি সমুদ্র দেখি।আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।

আদিল খুব বেশি দূরে যায়নি, রুশা আদিলের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগলো। এমন সময়, কেউ এসে রুশাকে বললো,

-এক্সকিউজ মি,আপনার নাম কি?

রুশা তাকিয়ে দেখলো ওর পাশে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স আনুমানিক চব্বিশ হবে। রুশা উল্টো জিজ্ঞেস করলো,

-কেন, আমার নাম জেনে আপনি কি করবেন?

-কারণ, আপনাকে আমার ভাবি বানাবো।

রুশা ছেলেটার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মানে কি! অপরিচিত এক ছেলে হুট করে এসে, ওর নাম জিজ্ঞেস করছে, আবার বলছে ভাবি বানাবে!

-আপনি আমাকে চেনেন?

-পরিচয় দিলে অবশ্য চিনতে পারতাম বাট আপনি তো নামটা পর্যন্ত বলছেন না। আমি রাফসান মির্জা। ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আপনাকে দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে তাই আমি চাচ্ছি আপনাকে আমার ভাইয়ের বৌ বানাতে।

ছেলেটির কথা শুনে রুশার ভীষণ হাসি পেলো। ভার্সিটির স্টুডেন্ট এত বোকা হয় কি করে! রুশা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-আমাকে দেখে আপনার ভালো লেগেছে। কিন্তু,আপনি তো আমার চেহারা দেখেননি, আমি কালো নাকি ফর্সা।

-শুনেন, সুন্দর আমরা সবাই। যার যার নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে কারণ আপনি কত সুন্দর করে নিজেকে আবৃত করে রেখেছেন পর্দার মাধ্যমে। অথচ, কিছু মানুষ আছে যারা কোথাও বেড়াতে গেলে নিজের পর্দা ছেড়ে রঙচঙ মেখে চলে যায়। এই জিনিসটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে।আপনার নাম ঠিকানা দিন আমি নিজে আপনার পরিবারের সাথে বিয়ের আলাপ করবো।

-কে ভাই আপনি? আমার ওয়াইফের পরিবারের সাথে আপনার কাজ কি?

আদিল রুশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে প্রশ্ন করলো।

-আপনি কি উনার ভাই হোন? ভালোই হলো আপনাকে পেয়ে গেলাম আসলে উনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। উনাকে আমার ভাবি বানাতে চাই।

রুশার এবার ভীষণ হাসি পেলো কারণ আদিলের চেহারাটা হয়েছে বেশ।

-ভাই রে ভাই, ও আমার স্ত্রী। আপনি কি না ওকে আমার বোন বানিয়ে আপনার ভাইয়ের বৌ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here