শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -১৭ ও শেষ

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akther

(১৭)অন্তিম

আবছা কুয়াশায় শহরের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে গেছে।হাড় কাঁপানো শীতে জুবুথুবু হয়ে কম্বলের নিচে শুয়ে আছে রুশা, ওর বুকে মাথা গুজে গুটিশুটি হয়ে আছে ওর রাজপুত্র আরুশ। আদিল আর রুশার ছেলে আরুশ রহমান।চারমাসের ছোট পুত্র কি আর শীত সহ্য করতে পারে!

এদিকে আদিল রুশাকে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। এ যেন অনন্য এক দৃশ্য আদিলের বক্ষ-বন্ধনে রুশা আর রুশার বন্ধনে আরুশ আবদ্ধ।

কারো হাসির শব্দ ঘুম ভাঙল রুশার,চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো ঘরে কেউ নেই। পাশ ফিরে আদিলের দিকে তাকিয়ে দেখে আদিলও ঘুমাচ্ছে। আবারও হাসির শব্দ শোনা গেলো। রুশা এবার আরুশের দিকে তাকাতেই দেখলো, আরুশ ঘুমের ঘোরে গাল বাঁকা করে হাসছে।

আরুশের হাসি দেখে রুশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আদিলকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে। আদিল চোখ মেলে রুশাকে প্রশ্ন করার আগে রুশা ইশারায় চুপ থাকতে বলে আরুশের দিকে তাকাতেই বললো।আদিল আরুশের দিকে তাকাতেই দেখলো, আরুশ ঘুমের ঘোরে মনের সুখে গাল বাঁকা করে হাসছে।

আদিল রুশার দিকে তাকিয়ে হাসছে,ফিসফিসিয়ে রুশাকে জিজ্ঞেস করে,

-রুশা, আরুশ এভাবে হাসছে কেন?

-হয়তো ভালো কিছু দেখেছে!দেখুন না ওর হাসিটা কত পবিত্র! এত সুন্দর করে হাসে কেন আমার পুত্রটা!

রুশা একমনে আরুশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে।

-কারণ, তার মায়ের হাসি সুন্দর।

আদিলের কথার প্রেক্ষিতে রুশা আদিলের মুখের দিকে তাকালো। রুশা দেখছে আদিল একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুশা প্রায়শই খেয়াল করেছে, আদিলের একেক সময়ের চাহনি এক একরকম।এই যে এখন ওর চাহনি দেখলেই অজানা অনুভূতিতে পুরো দেহে শিহরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আদিল শোয়া অবস্থায় রুশার দিকে ফিরে একহাতে ভর করে রুশার কপালে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে, একমনে তাকিয়ে রইলো। রুশা ফিসফিসয়ে আদিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-কি দেখছেন ওমন করে?

-দেখি আমার কাব্যে লুকিয়ে বসত করা মাধুর্যকে। তুমি আমার জীবনে এলে বলেই আজ কত সম্পর্কের সাথে পরিচিত হয়েছি আমি। বাবা হবার কি এক অনুভব! মাধুর্য তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না। এই বুকে আগে শান্তির জোয়ার এসেছে তোমার মুখ দেখে ইদানীং আরও একটি মুখ যোগ হয়েছে, আর সেই মুখ হলো আমার আরুশের।

রুশা আদিলের বুকে মাথা রাখতেই আদিল রুশাকে একহাতে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে।রুশা আদিলের বুকে আঁকিবুঁকি দাগ কাটতে লাগলো। হুট করে রুশা বলে,

-আদিল?

-হুম

-আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ঠিক ততটা ভালোবাসি যতটা ভালোবাসলে মৃত্যুর পরও এই ভালোবাসার একরত্তি অনুভব ভোলা যায় না। আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই মৃত্যুর পরও। আদিল আমি যদি আপনার আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, আপনি কিন্তু আমাকে ভালোবাসতে ভুলে যাবেন না। আমি আপনার জীবন গল্পের ভালোবাসা নামক উপন্যাসের শেষ পাতা অব্দি থাকতে চাই।

রুশার মৃত্যুর কথা শোনার পর আদিলের বুক অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। রুশাকে নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

-রুশা,মৃত্যু প্রত্যেকের জন্য অনিবার্য। আমরা নিজের মৃত্যুর চেয়ে আমাদের ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু হবে এই ব্যাপারটি নিয়ে বেশি ভয় কাজ করে৷প্লিজ,রুশা তুমি কখনো আমার সামনে তোমার মৃত্যুর কথা বলো না। আমি ভাবতে পারবো না, যে তুমি আমাকে কোনো একসময়ে একা করে চলে যাবে। বরং, তুমি তোমার সকল মোনাজাতে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করো আমি যাতে তোমার আগে এই ধরনীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারি৷ আমি তোমাকে ছাড়া বহুবছর থেকেছি সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আর সাহস হয় না আমার, তোমাকে ছেড়ে একাকী বিষন্ন মনে দিন পাড় করতে।

হুট করে আদিল আর রুশার মন বিষন্ন হয়ে গেলো। রুশা আদিলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টোপিঠে চুমু খেলো।
নিশ্বব্দে কাটিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলো দুজন।

কিছু কিছু সময়ে কথার কোনো মানে হয় না, চুপ থাকাই বরং স্বাভাবিক।

*******************

হসপিটালে রাউন্ড শেষ করে বাড়িতে ফিরে যাবার উদ্দেশ্য কেবিন থেকে বের হবে রুশা। এমন সময় ওর এসিস্ট্যান্ট এসে জানালো, কেউ ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। রুশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, দুপুর দু’টো বাজে। আরুশ হয়তো কান্না করছে না জানি কি করছে আমার ছেলেটা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশা বললো,

-ভিতরে বসতে বলুন।

রুশা অস্থির হয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। দরজা খুলে একজন পুরুষ আর একজন বৃদ্ধা প্রবেশ করলো। রুশার খুব পরিচিত এই দুইজন কারণ, তার সাজানো গোছানো জীবন উলটপালট হবার পিছনে এই দুজন মানুষের অবদান অনেক বেশি।

রাফি আর তার মা এসেছে রুশার সঙ্গে দেখা করতে। রুশাকে আজ এমন এক অবস্থানে দেখে রাফি আর তার মায়ের লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেছে।

রুশা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো রাফির মায়ের উদ্দেশ্য। রাফির মা সালামের জবার দিয়ে বললো,

-কেমন আছো, রুশা?

-বেশ ভালো আছি। আপনারা?

-আমরা ভালো আছি।

এতক্ষণে মুখ খুললো রাফি, রুশা রাফিকে একপ্রকার ইগনোর করে রাফির মাকে জিজ্ঞেস করলো,

-কিছু বলবেন, আপনি?

-আসলে, কিভাবে যে বলি কথাটা? আমাদের মাফ করে দিস। আমাদের ভুল হয়েছিল সেদিন তোকে ওভাবে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া আমাদের উচিত হয়নি।

রুশা নিচের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। রাফির মায়ের সব কথা বলা শেষ হবার পর রুশা বলে,

-আমি আপনাদের মাফ করার কে? তবে আপনাদের প্রতি আমার কোনো রাগ অবশিষ্ট নেই। যেদিন থেকে আমি রায়হান আঙ্কেলের মেয়ে হিসেবে মাথা উচু করে এই সমাজে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়েছি ঠিক সেদিন থেকে। ওই মানুষটা যদি সেদিন আমাকে সাহায্য না করতো তবে আমার অবস্থান কি হতো আমি জানি না। থাক সে সব কথা শুনেছি আপনার দুজন নাতনি হয়েছে। তাদের দেখে রাখবেন, মেয়ে হয়েছে অবহেলা করবেন না আবার।
আমি চলি আমার ছেলে হয়তো আমার অপেক্ষায় পথের দিকে চেয়ে আছে।

রুশা খুব তাড়াহুড়ো করে কেবিন ছেড়ে বের হয়ে গেলো। অতি সন্তর্পনে চোখের পানি মুছে আদিলের কেবিনের সামনে যেয়ে দরজায় নক করে বললো,

-স্যার, আসবো?

-আদিল রুশা কন্ঠ শুনে মুচকি হেঁসে বললো,

-হ্যা আসুন।

রুশা ভিতরে প্রবেশ করে বললো,

-চলুন, আপনার ছেলে আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে।

আদিল তার এপ্রোন একহাতে নিয়ে রুশার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে দীর্ঘ চুমু দিয়ে বললো,

-সকালে আজ দেয়া হয়নি, মনে হচ্ছিল কি যেন মিসিং! এখন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।

রুশা কপালে হাত দিয়ে হেসে ফেললো। আদিল রুশা একহাত ধরে কেবিন থেকে বের গেলো।

করিডোর দিয়ে বের হবার সময় রাফি আর ওর মা দেখলো কারো হাত ধরে রুশা বের হয়ে যাচ্ছে। নিকাবে ঢাকা মুখ কিন্তু উন্মুক্ত দুচোখ দেখে মনে হচ্ছে রুশা অনেক সুখি। কারণ, সব মিথ্যে হলেও চোখের ভাষা কখনোই মিথ্যে বলে না।

বাড়িতে প্রবেশ করতেই আদিল আর রুশা দেখলো তাদের পুত্র আরুশ তার দাদার ঘাড়ে মাথা রেখে জোর গলায় কাঁদছে। রুশা আর আদিল দ্রুতপায়ে হেটে আরুশের কাছে গিয়ে একসাথে বলল,

-কি হয়েছে আমার বাবার?আমাদের মিস করছিলে বুঝি?

ছোট আরুশ কি বুঝলো কে জানে? কিন্তু, ওর দন্তবিহিন হাসিতে বোঝা গেলো, ওর মা-বাবাকে দেখে ও অনেক খুশি হয়েছে।

রুশা আরুশকে রায়হান সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। ছোট্ট আরুশ তার মায়ের বুকে চুপটি করে আছে। আদিল ঝুকে আরুশের মাথায় চুমু দিয়ে হাত বুলিয়ে দিলো।

রায়হান সাহেব হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ছেলের পরিবারের দিকে। আজ তার আদিল কত খুশি!

-তুমি ঠিক ছিলে, আমি ভুল ছিলাম। তোমার ছেলে আদিল আজ কত সুখি! তুমি যদি নিজ চোখে দেখতে হয়তো তুমিও অনেক আনন্দিত হতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বিড়বিড় করে নিজের মৃত স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে রায়হান সাহেব।

বিকেলে ছাঁদে দাঁড়িয়ে নিজের মায়ের সঙ্গে মোবাইল কথা বলছে রুশা।কাজল,আয়াতের বাবা-মা,কানাডায় চলে গিয়েছে আজ দু’মাস হবে। রুশা তার মা’কে প্রচন্ড মিস করে। আজও মিস করছে তাই এইসময় কল দিয়ে কথা বলছে,

-মা,তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না। আরুশ তার নানুকে অনেক অনেক মিস করছে।

রুশার গোমড়া মুখ দেখে রুশার মায়ের বুকে কেঁপে উঠেছে। অদূর দেশে ভিডিও কল একমাত্র মাধ্যমে নিজের প্রিয়জনদের দেখার।

-আমিও তোকে ভীষণ মিস করছি, রুশা। তবে তোর থেকে আরুশকে বেশি। আর কিছুটা দিন এরপর একেবারে তোদের কাছে ফিরে আসবো।

মোবাইল স্ক্রিণে চুমু দিয়ে নিজের মেয়েকে বললেন।

রুশা মুচকি হেসে বললো,

-বাবা,কেমন আছে?

-তোর যে বাবা আছে, এটা কি তোর খেয়ালে আছে না-কি?

এবার মোবাইল স্ক্রীনে দেখা গেলো রুশার বাবা অর্থাৎ আয়াতের আব্বুকে।

-না, বাবা ভুলিনি।হসপিটালের ডিউটি,তোমাদের আরুশের সাথে সময় কাটাতে যেয়ে কখন সময় গড়িয়ে যায় টের পাই না।

-ভালো থাকিস, আর আদিলের, আরুশের এবং নিজের খেয়াল রাখিস। নে তোর সাথে নাকি আয়াত কথা বলবে।

আয়াত ভাই মোবাইল হাতে নিয়ে বলে,

-তুই তো এখন আমার বোন তাই না?

-হ্যা, হ্যা, ভাইয়া।কিছু হয়েছে?

-কিছু হয়নি বলছিস? আমাকে একটিবার নিজ থেকে কল দিয়ে বলিস ভাইয়া কেমন আছো?
একটিমাত্র বোন আমার, সেই বোন যদি ভাইয়ের খোঁজ খবর না নেয় তবে কেমন লাগে?

আয়াত মুখ কালো করে বললো।রুশা জিভে কামড় দিয়ে বললো,

-সরি ভাইয়া, নেক্সট টাইম আর কখনো ভুল করবো না। ভাবি কেমন আছে?

-তোর ভাবি ভালো আছে তবে এবার নাকি তোর জন্য কানাডা থেকে সারপ্রাইজ গিফট নিয়ে আসবে।

-কি সারপ্রাইজ?বলো না।

-বলতে হবে?

-হ্যা, বলতে হবে।

-তোর ভাতিজাকে নিয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসবে তোর কাছে। আরশির নাকি ভাইয়ের প্রয়োজন আর তোর ভাইয়ের ছেলে?

-তারমানে, ভাবি?

-ইয়েস তোর ভাবি অন্তঃসত্ত্বা।

এত এত খুশির খবর শুনে আমি অনেক আনন্দিত। কাজল ভাবির সাথে কথা বলে খুশিমনে কল কেটে দিলাম।

নিজের পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেলাম। আমি জানি সে কে? আমার পিঠ এলিয়ে দিলাম তার বুকে। দু’হাতে পেচিয়ে আমায় জড়িয়ে নিলো তার বুকে।

সামনের আকাশে লাল আভা ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো। সময়টা শেষ বিকেলের কি না!

-আপনি আমার জীবনে এলেন বলেই আজ আমার জীবনের প্রতিটি কোণে সুখে ভরা।

রুশার মুখে হাসি অথচ চোখ ভর্তি জল।রুশার কাঁপা স্বরের কথা শুনে আদিল রুশাকে নিজের দিকে ফেরালো।

রুশার চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছে বললো,

-কান্না করছো কেন?

-কিছু কান্না সুখের হয়, আপনি বুঝবেন না।

আদিল রুশার মুখ নিজের দুহাতে উঁচিয়ে নিলো।রুশার চোখে চোখ রেখে বললো,

-কান্না সুখের হোক বা দুঃখের, আমি চাই আমার মাধুর্যের চোখে কোনো পানি না আসুক, হোক বিন্দুমাত্র।

রুশা দুহাত দিয়ে আদিলের গলা জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে এনে বললো,

-আমাকে নিয়ে এত ভাবতে কে বলেছে আপনাকে?

-আমি ভাববো না তো কে ভাববে?সারাদিনের খোঁজাখুঁজির পরও যখন তোমায় পেলাম না, সেই আমার জীবনে শেষ বিকেলে এলে তুমি ।

রুশার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে আদিল।

-ভালোবাসি আপনাকে।

-আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি মাধুর্য।

অদূরে আকাশে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্যের লালিমা ছড়িয়ে শেষ বিকেলকে করে তুলছে আরও মনোমুগ্ধকর। গা শিরশিরে বাতাস বইছে চারদিকে,বাতাসের কলকলানি সুরে কেউ গাইছে ভালোবাসার পূর্ণতার গান।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here