#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১৬
জয়নব খালা বাবাকে ডাকতে গিয়ে ফিরে এলেন শূন্য ফলাফল নিয়ে। বাবা আসেননি। আসতে পারলেন না তিনি হয়তো জোড়ালো অভিমানের বেড়ি পেরিয়ে আমাকে বিদায় জানাতে। আমার মন খারাপের মাত্রা আর বাড়লো না যেন। হৃদয় ভীষণ নির্দয়, পানসে রূপ দখল করেছে। খালার অশ্রুসিক্ত আকুতিভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
— আমি যাচ্ছি, খালা। ভালো থাকবেন।
খালা মাথা ঝাঁকালেন। আমি হাতের ব্যাগ টেনে সব কিছু পিছু ফেলে পথ ধরলাম সম্মুখের। বুকের মাঝে বইতে লাগলো ঝড়। আমি কেমন মেয়ে? আমার আসল ঠিকানা, আমার আসল মানুষ আমাকে আপন করতে পারলো না। ভাবতে গিয়ে একবার পিছু ফিরে চাইলাম। খালা দাড়িয়ে আছে মেইন ডোরের সাথে মাথা ঠেকিয়ে। স্মরণ! তাকে একবার দেখার ইচ্ছে হলো খুব। কিন্তু সে যে আমার থেকে আড়ালে। চোখের কোটরে অশ্রু ভীড় করলো। মায়ের কথা ভীষণ মনে পরলো। বাবার ভালোবাসার অভাব বোধ করে কাঙ্গালিনী হয়ে উঠলাম হুট করে। আমার একুল ওকুল দুই-ই সর্বনাশা দূর্দশা ডুবিয়ে দিয়েছে। আমি এই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া পরিস্থিতি গুলো কার হাত ধরে পারি দেবো? চোখ বেয়ে জল গাড়িয়ে গেলো। অগ্রসর হলাম পুনরায় সামনের দিকে। সরু পাকা পথটার দুপাশে গোলাপ গাছের সমারোহ। বামে ফুলের বাগান। শিউলি তলা যেন দূর হতে আমাকে ডাক দিয়ে বলে যাচ্ছে
” মনে আছে, খেয়া? আমার ফুল কুড়িয়ে স্মরণ একদিন তোর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ”
বেলি গাছ নীরবে যেন বলছে
” ছোঁয়ার জেদের কাছে হার মেনে স্মরণ তোকে বেলিও উপহার দিয়েছিল মনে আছে? ”
খুব মনে আছে আমার। কাঠখোট্টার সম্পর্কে কিছু মধুর স্মৃতি কি করে ভুলে যাই আমি? এও মনে আছে সেদিন জ্বরে আক্রান্ত ছোঁয়াকে নিয়ে আমি ছাদে গিয়েছিলাম। কোলে উঠে কাঁধে ভর দিয়ে শুয়েছিল ছোঁয়া। আকাশে অর্ধবৃত্ত চাঁদের ঝলক লেপ্টে ছিল ছাদের প্রতিটি অংশে। মেয়েকে আমার কাছে রেখে স্বস্তি মেলেনি স্মরণের। মাগরিবের নামাজ মসজিদে আদায় করে এসেই ছুটে গিয়েছিল ছাদে৷ ছোঁয়া নিজের কাছে নিতে চাওয়ার বিপরীতে তাকে আমার পাশাপাশি দাড়িয়ে দেখতে হয়েছিল চাঁদ।
— ম্যাম বড় স্যার আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে বলেছে।
হঠাৎ অচেনা কন্ঠের সুর। ভাবনা দূরে পালিয়ে গেলো। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই নজরে পরলো ড্রাইভার কে।
— ঠিক আছে। চলুন।
অল্পবয়সী ড্রাইভার ছেলেটা সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলো। আমি ওর পিছু নিলাম। বেহায়া মন এক টুকরো আশা রেখেছিল সে আসবে। কিন্তু সে এখনো লাপাত্তা। নিজের মনের আশার ওপর ধিক্কার দিলাম বার কয়েক। যদিও বা সে এসে বললেও আমি ফিরে যেতাম না ভুলেও।
.
সোজা এসে উঠে পরলাম প্রিয়ার বাসায়। মুঠোয় দু’টো ঘুমের ওষুধ নিয়ে আজকের মতো এবেলা পরে পরে ঘুমানোর সিধান্ত নিলাম। নড়চড় হলো না। প্রিয়া বেশ কয়েকবার আমার নিকট জানতে চাইলো কেন এমন করছি আমি? জবাবে বললাম পরে বলবো। এখন আমাকে একটু একা ছাড়। কথা বাড়ায়নি প্রিয়া। আমি ঘুমিয়েছিলাম বেশ সুখে। এই সুখ টেকেনি। ঘুম ছুটে যেতেই আবারও ভর করল দুঃখ, বিষন্ন। সন্ধ্যা পেরোলো তিক্ততা নিয়ে। রাত গেলো উদাসীন হয়ে। পরদিন সকালে স্কুলে ছুটতে হলো। বাচ্চাদের সাথে কেটে গেলো দুপুর। একটা টিউশানি করলাম দুপুর দুইটা থেকে তিনটা অব্দি। অতঃপর প্রিয়াদের বাসায় ফিরলাম সাড়ে তিনটার নাগাদ। প্রিয়ার মা-বাবা বাসায় নেই। গত দু’দিন হলো তারা কোনো এক আত্মীয় বাড়িতে অতিথি বেশে আছে। আমি ফ্রেশ হয়ে টিভির সামনে বসেছিলাম। টিভি চালু করতেই প্রথমে যা নজরে এলো তা এড়িয়ে যেতে বাধ্য হলাম। নিজের মনের ভুল ভেবে অনেকটা বিরক্ত হলাম নিজের প্রতি। কিন্তু অবাক করা বিষয় তা মোটেও আমার মনের ভুল ছিলো না। টিভিতে ঠিকই দেখানো হচ্ছে স্মরণের হাস্যজ্জল মুখ। তিন তিনবার চোখ ঘষে তাকালাম। প্রতিবারই ফলাফল স্মরণ। অতি অবাকে উঠে দাড়িয়ে গেলাম আমি। কৌতুহলের সাগরে ডুবে গভীর মনোনিবেশ করলাম টিভির পর্দায়। সেখানে বলা হচ্ছে “ক্রাইম ইনভেস্টিকেশন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অফিসার স্মরণ আহমেদ কর্তৃক আজ হাতেনাতে ধরা পরেছে নারী ব্যবসায়ী জয়। যেকিনা গতরাতে পাচার করতে যাচ্ছিলো দশজন নারীকে। রাত তিনটার নাগাদ, জুনিয়র অফিসার স্মরণ সাহসীকতার সাথে তার টিম নিয়ে হাজির হয় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। ক্রিমিনাল এতোটাই পাকাপোক্ত ও ভয়ানক ছিলো যে সিনিয়র অফিসার একাজে জুনিয়র অফিসার স্মরণকে যেতে বাঁধা প্রদান করেন। কিন্তু তিনি বাঁধা নিষেধ মানেননি। একথা স্বয়ং সিনিয়র অফিসার আলম নিজ মুখে স্বীকার করেন। এছাড়াও এক তত্বে জানা গেছে অফিসার স্মরণের ব্যাক্তি জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে পুরোনো কোনো শত্রুতা ক্রিমিনালদের । তবে তা কি? এটা এখনো জানা যায়নি। অফিসার স্মরণ ক্যামেরার সম্মুখে আসতে নারাজ। তিনি এমন গর্বের কাজ করার পরও মুখ খোলেননি সাংবাদিকদের প্রশ্নে। বাবার নজর এড়িয়ে চাকরিতে যোগদান করে আজ তিনি হাজার মানুষের স্যালুট প্রাপ্ত। পূর্বে পাচার কৃত নারীদের ফিরিয়ে আনার ওয়াদা দিয়েছেন সিআইডি অফিসার আলম। এ অভিযান চলবে। ফিরে আসছি ছোট একটা বিরতির পর…..”
আমি নিজের অজান্তেই শরীরের ভার ছেড়ে পরে বসে পরলাম সোফায়। বিস্ময়ের চূড়ায় পৌছে গেলাম সংবাদ শুনে। স্মরণ ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা? নারী পাচারকারীর সাথে তার দ্বন্দ্ব? ভাবতে গিয়েই হুট করে মাথায় জ্বলজ্বল করে উঠলো একটা নাম ‘ অথৈ’। মুহূর্তেই শিহরিত হলো দেহ। গলায় ছু*ড়ি দিয়ে আ*ঘা*ত করা লা*শ। তবে কি….? হ্যা ঠিকই মিলে যাচ্ছে হিসেব খানা। তড়িঘড়ি করে ভাবনা ফেলে ফোন হাতে নিলাম। বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম বার কয়েক। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য বাবা ফোন তুললেন না।
.
বিরাট একটা ধাক্কা যেন খেয়েছি আমি। বিষয়টা জালের মতো ছড়িয়ে গেছে যেন দেশে। ওয়ারেসিয়া, নীলিমা, শান্ত সকলে আমাকে ফোনে একটা কথাই বলছে
” স্মরণের আগের বউকে কি এরাই মেরেছে? শোনা যাচ্ছে স্মরণকের ওয়াইফ মার্ডার হয়েছে। কিন্তু স্মরণ কাউকে জানায়নি। তুই কিছু জানিস?”
প্রিয়া আছরের পর ফোন ঘাঁটতে গিয়ে ইউটিউবে নিউজ পেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে দেখিয়ে গেলো। সঙ্গে বলে গেলো
— হুহ! এই মহান কাজের জন্য তাকে নোবেল দেওয়া হলেও আমি তাকে একটা চপ্পলও কিনে দেবো না। বুইড়া ব্যাডা। নিজের বউ ফেলে দিয়ে অন্যের বউ উদ্ধার করতে গেছে।
কারো কথার পিঠে কোনোরূপ জবাব দিতে পারলাম না আমি। শুধু ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে ছিলাম। সকলেই আমাকে বকে বকে এপার হতে ওপারে ফেলে এলো। কিন্তু একবারও বোঝার চেষ্টা করলো না আমিও তাদেরই অবস্থানে দাড়িয়ে। আমিও অবগত নই এ বিষয়ে।
.
বেলা কাটলো স্মরণের বিষয়কে ঘিরে ভাবতে ভাবতে। দুদিন পর রোজা। প্রিয়া গোধূলির শেষ ভাগে বেরোলো প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে। আমি একা রইলাম বাসায়। চায়ের পানি চুলায় দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ। ভাবলাম ভুলো মনের মেয়েটা পার্স বা ফোন ফেলে চলে গেলো কিনা। এমন ভাবনা মনে চেপে দরজা খুলে দিতেই ভাবনা বদলে গেলো। চোখের সামনে দাড়ানো চারজন ছেলে। প্রত্যকের মুখ ঢাকা মাস্কে। অজান্তেই মন কু ডেকে উঠলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হঠাৎ। পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার মনে হলো না আমার। আমি ঠাস করে দরজা বন্ধ করার মনোভাব পুষতেই হুট করে একজন আমার হাত ধরে বসলো। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার।
— ঐ হাত ছেড়ে দে। হাত ধরতে মানা করছে স্যার। সুন্দর করে কিডন্যাপ করতে বলছে।
— হুম। আমাদের শুধু দেখে যেতে বলেছে ম্যাম আছে কিনা।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম অচেনা ব্যাক্তিদের কথোপকথন শুনে। প্রশ্ন করে বসলাম
— স্যার কে? কোন স্যার?
জবাব পেলাম
— জোহান ফোন কর স্যারকে। আর ক্লোরোফর্মটা দে।
চলবে…… #শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১৭
জোহান নামের ছেলেটা ক্লোরোফর্ম দিতেই আমার নাকে মুখে স্প্রে করা হলো। কিডনাপের ধরণ, চলণ দেখে হতবাক আমি হতবুদ্ধি। নিজেকে বাঁচানোর কথা মাথায় আসার পূর্বেই তারা স্প্রে করে দিলো ক্লোরোফর্ম। ক্রমেই চোখে আধার নেমে ঢুলে পরলাম মাটিতে। অতঃপর কতটা সময় অতিবাহিত হয়েছে তা আমার অজানা। যখন চোখের পল্লব খুলে গেলো তখন সামনে দাড়িয়ে ছিল সেই চারটে ছেলে। এবার মুখ উন্মুক্ত। মাস্ক বিহীন। তাদের ছেড়ে দৃষ্টি আরো একটু সামনে দিতেই চোখে ভেসে উঠলো সাগরের উত্তাল ঢেউ। হীম হীম দমকা হাওয়া গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমার লম্বা চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে আমাকেই বিরক্তির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতি ঠিক সহ্য সীমার বাইরে চলে গেলো। কোন কিডনাপার এমন মগা, রোগা লোক পাঠিয়েছে? শুধু বৈদ্যুতিক খুটির মতো সরু আর লম্বাই যেন। বুদ্ধি এখনো কচু গাছের গোঁড়ায় ঝুলছে। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রেখেছে, হাতেও স্কচটেপ দিয়েছে। ভয় ভীতের ছিটেফোঁটা মনে অনুভব করছি না। আমি অনুভব করছি বিশালাকারের এক বিরক্তি। মহা বিরক্তি। অগ্নিঝড়া চক্ষু নিয়ে তাকালাম চারটে মানুষ রূপী বৈদ্যুতিক খুঁটি গুলোর দিকে। ইশারায় বোঝাতে চাইলাম মুখ মুক্ত করে দিতে। কিন্তু তারা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এবার আমার অতি রাগে চোখে জলের আগমন ঘটলো। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু বালির ওপর পতিত হতেই অনুভব করলাম কেউ আমার পেছনে দাড়িয়ে আছে। শুধু দাড়িয়ে থাকাতেই সে সীমাবদ্ধ নয়, অতি যত্নে মুখের স্কচটেপ খুলে দেওয়ার মগ্ন হয়েছে সে। আমি ঝট করে মুখ উর্ধ্বে তুলে দৃষ্টি রাখতে চাইলাম আগন্তুকের পানে। আলো আঁধারে মিলন মেলায় চোখে ফুটে উঠলো চিরচেনা মুখের অবয়ব। আমার চোখে চোখ পরতেই সে অবিলম্বে সরল কৌশলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অবাক আমি, বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের পানে। স্মরণ আমাকে কিডন্যাপ করলো? কোন হেতুতে? আসমান জামিনের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললাম শুধু হেতু খুঁজে। কিন্তু বিফল আমি খুঁজে পেলাম না খড়কুটোর মতো তুচ্ছ কোনো বিষয়ও।
— যেতে পারো তোমারা।
চারটা ছেলের উদ্দেশ্যে একথা ছুড়ে দিতেই তারা হনহন করে প্রস্তান করলো। আমার বিস্ময় ফুরোয়নি। ফ্যালফ্যাল করে তার পানে তাকিয়ে আমি কারণ খুজতে ব্যাস্ত। তাকে বুঝে ওঠার লড়াইয়ে মত্ত।
— দারুণ ওয়েদার।
সে মন্তব্য রাখলো প্রকৃতিকে ঘিরে। আমি অন্তরালে ক্ষিপ্ত হলাম তার এমন ‘কিছু হয়নি’ ভাব দেখে। চড়াও হয়ে কন্ঠস্বর কঠিন করে বললাম
— আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে আসার কারণ? আপনি কি ভাবছেন কি নিজেকে? দেখুন আমিও একটা মানুষ। আমারও সহ্য সীমা আছে। আপনাকে মুক্তি দিয়ে আমি চলে এসেছি। এখন আবার কি চান আপনি?
স্মরণ সমুদ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। দাঁড়ালো আমার চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি। দমে নেই আমিও। অনমনীয় মন নিয়ে তার চিত্তগ্রাহী অক্ষিতে দৃষ্টি ফেলে রাখলাম। কাটলো সময় এভাবে মিনিট দুয়েক। শুধু চলছিল সমুদ্রের গর্জন আর বাতাসের শা শা ধ্বনি। নিস্তব্ধতা ভেঙেছে স্মরণের একটা বাক্যে।
— আমিও চেয়েছিলাম কল্প জগতে বা বাস্তবে আর কোনোদিন কখনো তোমার সাথে আমার দেখা না হোক কিন্তু আমার খা খা করা মরুভূমি হৃদয়ে তুমি বৃষ্টি ঝড়ালে।
যেন এক সেকেন্ডের জন্য আমার তনু মন স্তব্ধ হয়ে গেলো স্মরণের এ কথা শুনে। অশ্বের চাইতেও দ্রুত গতিতে আমি তাকালাম তার চোখের দিকে। খোলা আকাশে পূর্ণ চাদের কিরণে চোখে ভেসে উঠলো স্মরণের নিরূপায় মুখ। আমি সব কথা ভুলে গেলাম। মস্তিষ্ক অসাড় হলো যেন। এ আমার জন্য এক বিড়াট ঝটকা। স্মরণ দু কদম বামে সরে একটু পেছন পথ ধরলো। তার পথচলার সাথে চলল আমার দৃষ্টিও। আরো একটা বিস্ময় আমাকে গুলিয়ে দিলো আমি স্বপ্ন জগতে নাকি বাস্তবে? জলন্ত ক্যান্ডেলের মেলা। বাতাসের দাপটের কাছে হার না মেনে বেঁচে আছে। ক্যান্ডগুলো বিন্যস্ত লাল গোলাপের পাপড়িতে লেখা কিছু অক্ষর কে ঘিরে। কেউ ভীষণ যত্ন করে লিখেছে
” I need you in my life ”
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার স্মরণের পানে তাকিয়ে আবার তাকালাম আবেগের স্পর্শ পাওয়া লেখাগুলোর পানে। স্মরণ নিজের অবস্থান হতে আমাকে জানিয়ে দিলো
— খেয়া, ফিরে চলো। আমরা বাবা মেয়ে তোমাতে আসক্ত হয়ে গেছি। আমি কখনো তোমাকে অথৈয়ের জায়গা দিতে পারবো না। তবে তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে একটু হলেও বেরিয়ে এসেছি তোমার জন্য। আমার ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করে। সুস্থ হয়ে বাচতে ইচ্ছে করে। আমার তো কোনো দোষ নেই। আমি তো চাইনি তোমাকে। কিন্তু তুমি এমন কিছু করেছো যার জন্য তুমি বাড়ি ছাড়ার কথা বললে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে দু’দিন পর। সেই রাতে আসামি ধরতে আমি সৈকতে আসি। পরদিন পর্যন্ত ইনভেস্টিগেশন চলে। এই সুযোগে তুমি উধাও। ব্যাস, বুকে একটা ব্যাথা শুরু হলো। সেই ব্যাথা সময়ের সাথে বাড়তেই লাগলো বাড়তেই লাগলো। টেবিলে খাবার দিচ্ছে না কেউ, আমার ঘরে উঁকি দিচ্ছে না কেউ, হুটহাট রান্না ঘরে ভুলবশত এটা ওটা ফেলে দিয়ে শব্দ করছে না কেউ।
স্মরণ বিরতি নিলো যেন। বড় করে একটা শ্বাস টেনে পুনরায় শান্ত কন্ঠে বলল
— জানো, অথৈ আমাকে একটা কথা বলতো। ‘স্মরণ তোমার আরেকটা বিয়ে হবেই হবে। দেখে নিও তুমি।’ ওর এই কথা শুনে খুব রেগে যেতাম আমি। ও যুক্তি দেখাতো, ‘যারা দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায় না তাদেরই বাধ্য হয়ে বিয়ে করে নিতে হয়। আর যারা বিয়ে করতে চায় তাদের কপালে বিয়ে থাকে না। আচ্ছা স্মরণ, আমি মারা গেলে তুমি আবার বিয়ে করবে?’ ওর এই কথা শুনে আমি ওর সাথে কথাই বলতাম না রাগে। ও তখন আমার হাত ধরে আমাকে বুঝিয়ে বলতো, ‘দেখো, বিয়ে করে দিও বুঝেছো? যদিও আমার কষ্ট হবে। কিন্তু আমি তোতখন কিছু দেখতে পারবো না। আমার কষ্টের চাইতেও তোমার কষ্ট আমাকে বেশি কষ্ট দেবে। আর শোনো, তুমি কিন্তু আমার চাইতে ওকে বেশি ভালোবাসতে পারবে না। বুঝেছো? তাহলে অনেক কষ্ট হবে আমার।’
স্মরণের গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেলো। আমার আপন চোখে কখন যে জলের আগমন ঘটেছে তা আমি ঠাহর করতে পারিনি। গত পাঁচ মাসের বন্দি দুঃখ গুলো সে যেন আজ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। স্মরণ এবার আর অথৈ এবং তার মিষ্টি সম্পর্কের প্রসঙ্গে প্রবেশ করলো না। হেটে সোজা পথে চলে এলো আমার নিকট। ধুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো আমায় বেঁধে রাখা চেয়ারের নিকট। আকুতিভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— তুমি আর অঙ্কনের সাথে কথা বলো না কখনো। আমার সহ্য হয় না। আমি দ্বিতীয় বার একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছি। এটা হারাতে চাই না। যে জিনিসটা আমার সেটা শুয়ে আমারই। আমার মানে শুধু আমার। তার একসিকিও কাউকে দিতে রাজি নই আমি।
আমি ভাবনার দরিয়ায় পরে গেলাম। স্মরণ ইতিমধ্যে পুনরায় আমাকে বলল
— খেয়া, আই নিড ইউ ইন মাই লাইফ। প্লিজ ফিরে চলো।
আমি এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পূর্বে মিহি সুরে বললাম
— আমার হাতের স্কচটেপ খুলে দিন আগে।
স্মরণ প্রতিবাদ করে বলল
— আগে তুমি উত্তর দাও তারপর। আমি জানতাম এভাবে কিডন্যাপ করে না আনলে তুমি আমার একটা কথাও শুনতে না। এখন হাত খুলে দিলে কয়েকটা ঝাড়ি মেরে তুমি চলে যাবা।
চলবে….
( আমি গল্প শেষ করতে চাচ্ছি আর গল্প শেষ হতে চাচ্ছে না 🤧। বিপদদদদ, ভয়ঙ্কর বিপদ)