#শেষ_চৈত্র [০৫]
আজকে রাতে কার সাথে থাকবো এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমার স্বামী আমাকে শাশুড়ীর কাছে দিয়ে এলো, এদিকে আমি গোপনে শুনে নিয়েছি শাশুড়ী আমাকে রাখতে পারবেন না।
যা শুনেছি তা কি আমার ভুলে যাওয়া উচিত? অমিতও তো পরিষ্কার বলে দিলো তার মায়ের নামে অভিযোগ তোলা যাবেনা। তবে তাই হোক, অভিযোগ তুলবোনা, যা বলেছে তাও ভুলে যাবো। মান্য করে চলবো!
শুধু একটা বিষয় ছাড়া, সেটা হলো অমিতের বিদেশ ত্যাগ ও পূর্ব বিয়ের গোপন সত্য। এটা যেভাবেই হোক বের করতে হবে।
বাকিসবকিছুতেই আমি স্বাভাবিক থাকবো বলে শপথ করলাম। এখন দেখা উচিত আম্মা কি করছে! উনার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠতে হবে!
আমি আমার শাশুড়ীর সন্ধানে রুম থেকে বের হলাম।
ভেবেছিলাম শাশুড়ী মা রান্না করার সময় যেমন আচরণ করছিলো এখনো তেমন করবে। কিন্তু নাহ, তুমুল পরিবর্তন। তাহলে কি অমিতের কথাটাকে উনি গুরুত্বসহীত নিলেন? যে আমার বয়স কম,আমাকে ছাড় দিয়ে চলতে হবে?
যাক তাহলে সবদিকেই ঠিক। আজকেও উনার সাথেই থাকলাম। তবে কালকের মতো না। আজকে রাতের পানটা আমিই সাজিয়ে দিয়েছি, তারপর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মাথায় বিলি কেটে দিয়েছি। শাশুড়ী কোনো কিছুতে আপত্তি করেনি, বরং একবার বলেছিলো ‘তুমি ঘুমাইয়া যাও বউ। আমার এইসব লাগেনা। এমনি ঘুমে ধরে।
‘
পরেরদিন যথারীতি আমাদের বাড়ি থেকে মানুষ আসলো, কাছের আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসছে শুধু আসেনি আমার ভাই নাফিজ!
এটা দেখতেই আমার হৃদয় ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেলো। একটা ভাই আমার! সে আমার শ্বশুর বাড়ি আসলোনা তা আমি কি করে মেনে নেবো?!
আর আসবেই বা কি করে? ওর কি আসার মুখ আছে? অমিত ওর সাথে যেই আচরণ করেছে, সে যদি এই জেদ ধরে রাখে মনে হয়না জীবনে অমিতকে আর দুলাভাই বলে ডাক দিবে কিংবা আশেপাশে ঘেঁষবে! অমিত সেদিন খুব খারাপ একটা কাজ করেছিলো, সবকিছুকে কোনো রকম মেনে নিলেও, কিংবা যুক্তিসঙ্গত অল্প কারণ থাকলেও, ওর এই ব্যপারটা নিতান্তই বাজে ছিল।
যতদিন না অমিত নাফিজের কাছে এর জন্য নতজানু হবে ততদিন আমারও বিরাট দুঃখ থেকে যাবে!
হ্যাঁ আমি ভাগ্য বলে এটাকেও মানতে চেষ্টা করেছি যে একজন পূর্বে বিয়ে করলেই সে পঁচে যায়না, যদি তার বর্তমান ভালো হয়। হয়তো ধিরে ধিরে আরো পাকাপোক্তভাবে মেনে নেবো। শুধু অতীতের কোনো প্রভাব বর্তমানে না পড়ুক।
যারা এখানে প্রথম এসেছে তারা বাড়ির আশপাশ ঘুরে দেখলো। একদম বিকেলের দিকে অমিতসহ আমাকে নিয়ে রওয়ানা দিলো।
অমিত স্বাভাবিক! পাশের সিটে বসে ফোন ঘাঁটছে। আমার সাথে কোনো কথা বলেনি! কতটা অন্য প্রকৃতির স্বামী আমার! আমিও আমার মতো করে বাইরে তাকিয়ে আছি। তবে আমার ভেতরটা বেশ উৎফুল্ল, স্বামীরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ির যাত্রাটা বোধহয় প্রতিটা মেয়ের জন্যই অন্য রকম আনন্দের।
বাড়িতে পৌঁছে আমরা দুজন যখন গাড়ী থেকে নামলাম তখন কেউ আমাদেরকে আগ্রহের সাথে এগিয়ে নিতে আসেনি। কয়েকজন দূর থেকে তাকিয়ে আছে। অথচ গ্রামের প্রতিটা ফেরযাত্রার বরকে বেশ সাদরে গ্রহণ করতে দেখেছি আমি। তারা কি অমিতের বদরাগী আচরণের ভয়েই আগাচ্ছেনা? ভাবছে, নাফিজের মতো তাদের সাথে কিছু করে বসে কিনা!
অবশ্য উনি করতেও পারে, উনার নিজের বাড়িতেই তো সবাই উনার আশেপাশে ঘেঁষেনা।
অমিত যেমন এটাকে একদম পরোয়া করেনি আমিও করিনি। আমরা একা একাই ঘরে প্রবেশ করলাম। মার সাথে কথা বলেই আমি নাফিজকে খুঁজতে লাগলাম।
সবখানে খুঁজেও নাফিজকে দেখতে পেলাম না। আমি মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ আম্মা নাফিজরে দেখতাছিনা কেরে? ও কই?
আম্মা আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ হে তোর নানাবাড়িত গেছেগা, তোর জামাই যদ্দিন থাকবো তদ্দিন নাকি আইবোনা।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো। নাফিজ আর সামনে আসবেনা।
নাফিজ ছোট হলেও ইগোসম্পন্ন মানুষ। ভালোই করছে চলে গেছে, উনার সামনে না আসাটাই সম্মানের। তবে ওকে না দেখে আমার কলিজা হাহাকার করছে। দুইদিন ধরে ওর মুখটা দেখিনা, আগে প্রতিদিন কোথাও বেরুনোর সময় টেনে ধরে ওর শার্টের বাকি অর্ধেক বোতাম লাগিয়ে দিতাম। এক সময় গলায় গলায় ভাব থাকতাম আবার একেক সময় ঝগড়ায় চিৎকার চেঁচামেচি করে একে অপরকে চিরশত্রু বলে প্রমাণিত করতাম!
এদিকে অমিত একটাবারের জন্যও প্রশ্ন করলোনা নাফিজ কোথায়? কোনো রকম অনুশোচনা নেই মানুষটার। এতো খারাপ আর অহংকারী কোনো মানুষ হয়? উনার কি মন নেই? উনি শুধুই মানুষের থেকে দূরে থাকতে চান! উনার মা ছাড়া মনে হয়না দুনিয়ার কারো সাথে উনি ভালো করে কথা বলেন! এমনকি ভালো মন্দ ছাড়া আমার আম্মার সাথেও এসে কোনো কথা বলেনি। আম্মা ভীতু চেহেরায় জিজ্ঞাসা করেছিলো,
‘ জামাই আপনের আম্মা ভালা আছেনি? আর আমার মাইডাটা বুইঝা দুইদিন চলতারছেনি?
উনি বেরসিক মুখে জবাব দিয়েছিলেন,
‘ থাকতে থাকতে পারবে।
আগের প্রশ্নটা যে ছিল উনার আম্মা কেমন আছে, সেটার জবাবও দেননি।
এখন সমস্যা হলো আমার, কেউ উনার সামনে আসেনা। খাবারদাবার থেকে শুরু করে সব আমাকে জিজ্ঞাসা করে করে করতে হয়। আমার চাচাতো বোনরা পর্যন্ত উনার সামনে আসেনি, যেই মেয়েগুলো একসময় বলতো, চৈতি তোর জামাই বিয়ার পরে যহন আইবো, দেহিস যাওয়ার সময় পকেট হাতড়ে গাড়ী ভাড়াও পাইতোনা। একবারে ফকির বানাইয়া ছাড়ুম!
এসব ভাবতেই মনে হয় ৮-১০ টা মানুষের মতো আমার নতুন জীবনের শুরু অস্বাভাবিক। হয়তো পুরো এলাকায় আমিই এক পোড়াকপালি!
‘
রাতে ঘুমানোর সময় আমি শুধু এদিক ওদিক ঘুরছিলাম, আমাদের দুজনের জন্য কোণার রুমটা গুছানো হয়েছে। অমিতও আসার পর থেকে ওই ঘরে আছে। কিন্তু আমি কোথায় থাকবো? রুমটা বেশ ছোট, নিচেও তেমন ফাঁকা জায়গা নেই! ওখানে তো শাশুড়ীর সাথে ছিলাম, কিন্তু এখানে? আম্মাকে বললে বিষয়টা জটিল হবে না?
আমি বেশ দুটানা নিয়ে উনাকে বললাম,
‘ আমি কিতা আম্মার সাথে থাকুম?
অমিত চোখ বড় করে বললো,
‘ দূর পাগল তুমি? আমাদের বাড়ি আর এটা কি এক নাকি?
আমি নিরব থাকলাম। আম্মাকেও আমার দুইদিনের ভেতরকার করুণ যন্ত্রণাগুলো জানালাম না। জানালাম না উনার পূর্ব বিয়ের সংবাদ। আম্মাই একদিন বলেছিলো, জামাইর বাড়ির কথা বাপের বাইত কইবার সুযোগ দিলেই মাইয়াদের সাবাস বাইড়া যায়, কিন্তু যেই মাইয়া বুইঝা ধৈর্য ধরতে পারে হেই মাইয়া অই পরে সবার থেইকা সুখী হয়।
কথাটা মাথায় গাঁথা ছিল। কেননা আমিও এটা উপলব্ধি করতে পারি আমি এসব বললে আম্মা ইমোশনাল হয়ে যাবে। আমার সাথে সমপরিমাণ দুঃখ প্রকাশ করবে, আর মায়েরা কখনো মেয়েকে দুঃখের বন্যায় ভাসতে দিতে চায়না। হয়তো তখন আম্মার আবেগ বিদারক কথা আমার মনকে ছোট করে দিবে। আমি আর সংসারে ধৈর্যের সাথে মনোনিবেশ করতে পারবোনা। তার চেয়ে ভালো ভেতরেই সব চাপিয়ে নেই, দেখি কি হয়?
‘
রাতে অমিতের সাথেই ছিলাম, খুব গুঁটিশুটি মেরে টিনের পাশ ঘেঁষে। অবশ্য কয়েকবার বলছিলো মধ্যে শুতে, উনি একপাশে সরে আসবেন! কিন্তু আমি শুনিনি।
অমিত আগেই বলছিলো পরেরদিন সকাল সকাল চলে যাবে। গিয়ে সে তার দোকানে বসবে।
তার উপরে তো কথা বলার কেউ নেই,তাই আম্মাও জোর করলোনা।
সকালের খাবারদাবারের পরেই আমরা চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। অমিত নিজের জিনিস গুছিয়ে আমাদের বাইরে টিউবওয়েলে হাতমুখ ধুতে গেছে।
এদিকে আমি শাড়ী পরছি, সাথে হালকা সাজগোজ। এর উপরে এখন আবার বোরকা পরবো।
বোরকাটা দড়ি থেকে টেনে গায়ে জড়াতে যাবো তখনি অমিতের ফোন বেজে ওঠলো। আমি তাকিয়েও আবার ফিরলাম। বোরকা পরে হিজাব হাতে নিলাম। এত মধ্যে আবার ফোন আসলো।
আমি উনাকে বাইরে ডাকতে চেয়েও না ডেকে ভাবলাম, রিসিভ করে বলে দেই উনি ঘরে নেই। আসলে ফোন দিবে।
এটা ভেবেই রিসিভ করলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই একটা পুরুষ কণ্ঠে ওপাশ কে জানি বলে উঠলো,
‘ অমিত তোর আগের বউ যে সুমনা, হে তো তোর বিয়ার খবর পাইয়া খুব ক্ষেইপা গেছে, আজকা মনে হয় আইতাছে। এই মাইয়া দেশে আইলো কবে খবর পাইলাম নাতো।
এই কথা শুনে আমার হাত কাঁপতে লাগলো। তবুও কাঁপা হাত কাঁপা গলায় বললাম,
‘ হেরে আইতে দেন!
আমার কণ্ঠ শুনে লোকটা সাথে সাথে কেটে দিলো। আর ফোনটাকে বিছানার উপর রাখার পরেই অমিত রুমে প্রবেশ করলো। আমি হিজাবের পিন লাগাতে লাগাতে বললাম,
‘ আরে জানেন আমার সতীন সুমনা আইতাছে আজকা।
এটা বলার পর আয়নার মধ্যেই আমার পানিভর্তি ঝাপসা চোখে দেখলাম মূহুর্তেই অমিতের মুখ অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে!
চলবে….
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার