#শেষ_চৈত্র [০৭]
অমিত আমাকে ভালোবাসে এই কথাটা বেশ জোড়ালো কণ্ঠেই তার প্রথম স্ত্রীকে বললো। অথচ আমার কাছে এটাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যতম বাক্য! অমিতের মতো মানুষ ভালোবাসতে জানে? কীভাবে সম্ভব?
কিন্তু এটার সম্ভব অসম্ভবের ফলাফল স্থির রেখে আমি শুনলাম সুমনা মেয়েটা তোড়জোড় করে বলছে,
‘ অমিত আমার হাত ছাড়ো। ঠিকাছে আমি এই বাচ্চা মেয়েকে কিছু করবোনা। শুধু তুমি ওকে মুক্তি দিয়ে আমাকে স্ত্রীর সম্মানে মেনে নাও।
অমিত সুমনার হাতটা ছিঁটকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
‘ আরেহ মুক্তি তো আপনার প্রাপ্য ম্যাম, যা বহু আগেই দিয়ে এসেছি! আর চৈতি হলো আমার পাঁজর। নিজের জন্য হলেও ওকে যত্নে আগলে রাখতে হবে। এবং সবকিছুর বিনিময়ে তাকে আজীবন আমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হবে।
আমি অবাক হয়ে শ্রবণ করে যাচ্ছি অমিতের মুখের অসম্ভাব্য কথাগুলো। ভেতরে চলছে একটা আশংকাজনক পূর্ণতার ঝড়! অদ্ভুত সুন্দর সেই অনূভুতি! কিন্তু অমিতের মুখে এমন কথা সুমনার গায়ে আরো আগুণ ধরিয়ে দিলো। সে ভয়ংকর চোখে হাত দুটো নিশপিশ করতে করতে আমার দিকে তাকালো। পারলে এখনি মেরে ফেলবে যেন!
অমিত সুমনার সেই দৃষ্টিকে খেয়াল করে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
‘ ওর দিকে এভাবে তাকাবেন না আপনি। আপনার কুদৃষ্টি আমার স্ত্রীর উপর না পড়ুক।
এটা শুনতেই সুমনা কাঁদো কাঁদো চোখে অমিতের দিকে এগিয়ে গেলো। আমি যা বুঝতেছিলাম সে অমিতকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছে, কোনোভাবে হলেও মন গলাতে পারে কিনা! আমার ভেতরে তখনি কেমন যেন একটা ব্যথা অনূভব করলাম, সাথে সাথে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পারলাম অমিত তার বাম হাত দিয়ে আমার মুখটা তার বুকের সাথে লেপ্টে ধরেছে। আমি আচমকা চোখ খুলে দেখলাম সুমনা উনার কাছে আসার আগেই উনি আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন।
সুমনা কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, আর অমিত চোখ দুটো একটু নিচু করে আমাকে বললো,
‘ চৈতি তুমি তাকাবেনা ওইদিকে, এক অশুভ মানুষের অশুভ দৃষ্টি তোমার উপর পড়েছে, সেটা আমি সামলাবো!
বলেই উনি আবার সুমনাকে বললো,
‘ আপনি শুনুন, মিস সুমনা! পৃথিবী উল্টে গেলেও অমিত কোনোদিন আপনাকে মেনে নিবেনা। সে আপনি যাই করেন না কেন? অযথা সময় নষ্ট না করে চলে যান, এটা আপনার এবং আমার দুজনের জন্যই মঙ্গলজনক।
আমার কাছে এসব স্বপ্ন মনে হচ্ছে, বিশালদেহী মানুষটার বুক পর্যন্ত কোনো রকম আমার মাথা পৌঁছেছে। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো মুখ গুঁজে আছি। প্রতিটি বাক্য উচ্চারণ করতে অমিতের বুকে যে কম্পন হচ্ছে তা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। এমন অপূর্ব সুন্দর আশ্রয় জুটলে দুনিয়ার কোন ভয় আমাকে গ্রাস করবে? আর কোন অশুভ শক্তি আমাকে কাবু করবে? আমি তো সবচেয়ে বেশি নিরাপদ!
এদিকে সুমনা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কিছুদূরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে,কিন্তু কোনো এক অজানা ভয়ে কেউ কাছাকাছি আসছেনা। সুমনা তাদের দূরে থাকার রহস্য ধরতে পারলোনা। এখানে আছে শুধু রফিক আর অমিতের মা।
সে কিছুক্ষণ চিৎকার করে করে মানুষজন ডাকলো। কিন্তু কেউ আসলোনা। যার দিকে উদ্দেশ্য করে ডাকতে চায় সে-ই সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়।
কেই বা আসবে অমিতের ব্যপারে নাক গলাতে?
অথচ মেয়েটা এখনো বুঝতে পারছেনা অমিত মানুষ হিসেবে কতটা নির্দয় আর খারাপ মেজাজের।
সুমনা মানুষের সাহায্য না পেয়ে দিশা হারিয়ে ফেললো যেন, এবার সে আমার শাশুড়ী কাছে চলে গেলো, আর অনুনয় করে বলতে লাগলো,
‘ প্লিজ মা, আপনার ছেলেকে একটু বুঝান। শত হোক আমি তার প্রথম স্ত্রী ছিলাম। আমি তখন ওকে বুঝতে পারিনি, ওর সাথে অনেক খারাপ করেছি, যার ফল এখন ভোগ করছি। প্লিজ শুধু একটা সুযোগ দিতে বলুন। আর আমাদের তো কোনো ছাড়াছাড়িও হয়নি, শুধু একটু দূরত্ব হয়েছিলো।
আমার শাশুড়ী ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। কেননা উনি জানেন যেই ছেলে সুমনা কিংবা তার কোনো ইঙ্গিতে শুনলেই হুলস্থুল কান্ডতে চারপাশ আতংকিত করে ফেলে, সেই ছেলের সামনে এই মেয়ের সাথে কথা বলাও বিপদজনক। সে মাকেও ছাড় দেওয়ার ছেলে নয়।
কিন্তু সুমনার অনুরোধ থামছেনা। হাতে কাঁধে হাত রেখে বলে চলেছে,
‘ মা একটা সুযোগ দিতে বলুন আমায়। আমাকে সাহায্য করুন।
অমিত এবার আমার মাথা উঠিয়ে বিরক্ত চোখে একবার সুমনা দেখলো। তারপর আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে চললো। সুমনা বাইরে আমার শাশুড়ীকে এসব বলার অবস্থায় যখন দেখলো আমাকে নিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে তখন সে দৌঁড়ে ভেতরে আসতে চাইলো, কিন্তু অমিত গিয়েই সাথে সাথে সামনের দরজা বন্ধ করে দিলো।
আমি চাপা স্বরে বললাম,
‘ আম্মা আইতোনা?
অমিত তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,
‘ একদম চুপ। তুমি কোনো কথা বললে খবর আছে! আম্মা বাইরে বসে ওই মহিলার কীর্তন শুনুক।
আমি এমন অবস্থাতেও আমার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসির রেশ বুঝলাম। তাহলে এই মানুষটার ভালোবাসা শুধু আমার! নাহ পূর্বে এই ভালোবাসার আর কোনো ভাগ হয়নি, শুধু একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিল!
অমিত ভেতরে এসে আমাকে ছেড়ে নিজের রুমে গেলো। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ বন্ধ করে ভাবছি নিজেকে এখন এতো সুখী মনে হচ্ছে কেন? ঘন্টাখানেক আগেই না উনার আচরণে আমি হুহু করে কাঁদছিলাম?
আমার একটুও জানতে ইচ্ছে করছেনা কিসের চুক্তিতে উনি প্রথমবার বিয়ে নামক কিছুতে আবদ্ধ হয়েছিলেন, শুধু মনে হচ্ছে আমি অপূর্ণ নয়।
দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। আমি ভেতরে এদিক ওদিক পায়চারী করছি। আর অমিত নিজের বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে। একবার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সুমনাকে দেখার চেষ্টা করছি, আবার গিয়ে অমিতকে দেখছি।
সুমনা উঠানে পা ছড়িয়ে বসে আছে। পাশেই একটা শুকনো গাছের উপর আমার শাশুড়ী গালে হাত দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। রফিককে আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনা। বোধহয় চলে গেছে।
‘
তিন ঘন্টা চলে গেলো। দুপুর হয়েছে, অমিতের আজকে দোকানে যাওয়ার কথা থাকলেও এই অবস্থায় আর যায়নি।
এদিকে আম্মার কথা ভেবে অমিত উঠে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এখনো কি সে যায়নি? আর আম্মা!
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
‘ না এখনো যায়নি, আর আম্মাও বসে আছে।
অমিত হনহনিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ডাকলো,
‘ আম্মা তুমি ঘরে আসো।
আমার শাশুড়ী উঠে আসার আগেই সুমনা দৌঁড়ে আসতে লাগলো। বারান্দায় পা রাখতেই অমিত দরজার বাইরে কাঠের টুলটাকে একটা জোরে লাথি দিয়ে সুমনার দিকে ছুড়ে মারলো। সুমনা তৎক্ষনাৎ সরে যাওয়ায় সেটা তার পায়ে পড়েনি। কিন্তু চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। হয়তো অমিতের এমন রূপ সে আগে আর দেখেনি ।
তবুও সে ভয় না পেয়ে বারান্দায় উঠে এসে বললো,
‘ তোমার এতো বড় সাহস? তুমি আমাকে আঘাত করতে চাইলে? আমি যে এর জন্য তোমাকে নির্যাতন মামলায় ধরিয়ে দিতে পারি জানো?
অমিতের চোখ মূহুর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করলো। সুমনার দিকে এগিয়ে এসে তার গালে সর্বোচ্চ শক্তিতে একটা থাপ্পড় মেরে বললো,
‘ যাহ গিয়ে যা মন চায় কর। সম্মানের স্থান রাখলি না তুই, আর নির্যাতন! সেটা তো তুই করেছিলি আমার উপর, পাক্কা দেড়টা বছর। আমাকে অমানুষ বানিয়ে দিয়েছিস তুই। আমার এককালের কোমল হৃদয়টাকে পাথরে রূপান্তর করেছিস! তুই এখন অযথা নির্যাতন মামলা দিবি আমার নামে? এর একটা কারণ লাগবেনা? আর আমিও মিথ্যা মামলায় ফাঁসার চেয়ে অন্যায় করেই ফাঁসি না?
বলেই গালে হাত বুলাতে থাকা সুমনার দুই গালেই পর পর আরো কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। ফর্সা লাল প্রথম থাপ্পড়ে লাল হয়ে গেলেও পরেরগুলোতে গালে রক্তের ছোঁপ স্পষ্ট হয়ে এলো।
সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ তুমি অমিত তো?
চলবে……
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার