#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
ঘুরতে যাওয়ার কথাটা বেলা কাউকে বলেনি। আসলে সেভাবে বলা হয়ে উঠেনি। দীর্ঘ একমাস পরীক্ষা চললো। পরীক্ষার চাপে পড়ে শাইনি নামক মানুষটাকে একপ্রকার ভুলেই গেলো। লোকটার জন্য ওর কোনো অনুভূতি ছিলোনা। আসলে তাদের বিয়েটাই তো ছেলেখেলার মতো ছিল। হঠাৎ করেই বিয়েটা হলো, পরক্ষণেই একটা ঝড়ে সেটা টুকরো হয়ে ভেঙে গেলো। যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্ক কি আর আগায়?
নাইমুদ্দীন সাহেব এতদিন কোনো যোগাযোগ না রাখলেও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। সেজন্য তিনি পরিচিত এক লয়ারের সাথে যোগাযোগ করলেন। ডিভোর্সের যাবতীয় প্রক্তিয়া বিষয়ে ধারণা নিলেন। বেলার পরীক্ষার পরপরই সেটা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেন কিন্তু শাইনি তখন দেশে ছিলোনা। ওর মা নাজনীন বেগমকে ফোন করে সব জানালেন নাইমুদ্দীন সাহেব। তিনি ভীষণ অনুরোধ করলেন যেন তাদেরকে আরেকটু সময় দেওয়া হয়, কিন্তু তাতে বেলার ফ্যামিলির কেউ রাজি হলোনা। শাইনির বাবা আলম সাহেব হুট করে একদিন ওদের বাসায় হাজির। ভদ্রতা রক্ষার্থে ওনাকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হলো। বিভিন্ন কথাবার্তা শেষে ওনি বেলাকে ডাকলেন। ও ভীষণ অবাক হলো। ওর সাথে এই লোকের কী কথা? ড্রইংরুমে গিয়ে বসে সালাম দিলো বেলা। আলম সাহেবের মুখটা বিষন্ন। বোঝাই যাচ্ছে ডিভোর্সের ব্যাপারটায় তিনি মোটেও খুশি নন। তিনি বেলাকে বললেন, ‘তুমি কী চাও এই ডিভোর্সটা হোক?’
নাইমুদ্দীন সাহেব মাঝখানে বলে ওঠলেন, ‘মেয়ে আবার কী চাইবে? ও নিজেই আমাকে বলেছে বিয়েটা ভাঙতে চায়৷ তাছাড়া আমি আপনার ছেলের কাছে কিছুতেই মেয়ে রাখব না।’
-আমি ওর কাছ থেকে জানতে চাইছি।
বেলা মাথা নিচু করে বলল, ‘জি চাই। আমার মতামত শুনেই বাবা এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
-আসলে আমার ছেলেটা ভীষণ অসুস্থ!
-কী হয়েছে?
-ডাক্তাররা আমাকে কিছু জানায়নি এখনো। তবে খুব শ্রীঘ্রই জেনে যাব।
-ওহ!
-বলছিলাম কি, ডিভোর্সটা ক’দিন পরে করালে হতোনা?
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘তাতে কী আংকেল? অসুস্থ তো আমরাও হই। তাই বলে সামান্য সাইনটা করতে পারবেনা?’
আলম সাহেব মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘তা পারবে।’
-তাহলে তাই করুন আংকেল।
বেলা সেখান থেকে চলে গেলো। ওর মা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন। মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে সেটা মানতে তার কষ্ট হচ্ছে। কত টাকাপয়সা খরচ করে, আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে বিয়ে দিয়েছেন এখন সাধের সেই বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অবশ্য ছেলের কুকর্মের জন্যই তা হচ্ছে। তার মেয়ের তো আর দোষ নেই!
পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু-সপ্তাহ পর একদিন বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে বেলা সময় কাটাতে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলো। তাদের এদিকে নদীর পাড়ে খুব সুন্দর একটা পার্ক হয়েছে। বিকেলটা ওখানে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলো ওরা। এদের মধ্যে একজন বায়না ধরলো ফুচকা খাবে৷ বেলা একটা ফুচকার ভ্যান খুঁজে বের করলো। গিয়ে বলল, ‘মামা পাঁচ প্লেট ফুচকা দিন তো।
ফুচকাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, ‘ঝাল দিয়ে?’
-না কম।
আপনেরা ওইহানে বসেন।
-একটু তাড়াতাড়ি দিয়েন মামা। একটু পর মাগরিবের আযান দিবে।
-আচ্ছা আফা।
বেলা তার বান্ধবীদের নিয়ে চেয়ারে বসলো। কে কোথায়, কোন কলেজে ভর্তি হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ফুচকা খেয়েদেয়ে বিল মিটিয়ে দিলো বেলা। এখান থেকে গাড়িতে ওঠা যায়না। একটা বড় গলি পেরিয়ে সরু কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে মেইনরোড পর্যন্ত যেতে হয় হেঁটে। সেখান থেকে রিকশা বা অটো ধরতে হয়। মিনি একটু আহ্লাদী টাইপ মেয়ে। সে আর্তনাদের মতো ভান করে বলল, ‘আমি আর হাঁটতে পারব না গাইজ। এটলিস্ট একটা গাড়ি তো যোগাড় কর তোরা।’
সাবা রেগে বলল, ‘তুই একা হাঁটছিস না। আমরাও যাচ্ছি। কষ্ট আমাদের সবার-ই হচ্ছে। এখন চল।’
-সত্যি বলছি আমার পা ব্যথা করছে।
বেলা বলল,’দোস্ত চল। এখন এসব করলে তো আর গাড়ি পাওয়া যাবেনা৷ মেইনরোড পর্যন্ত যেতে হবে।
-হুহ।
-এছাড়া আর উপায় নেই!
-তোকে আসতে কে বলে আমাদের সাথে? যতবার আসিস একটা না একটা নাটক করিসই। বলল সাবা।
-আমি নাটক করি?
সাবা কটমট করে বলল, ‘এছাড়া আর কী?’
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুজন ঝগড়া লেগে গেলো। বাকি তিনজন ওদের থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে। বেলার বিষয়টা একদমই পছন্দ হলোনা। ও ধমকে দুজনকে থামালো। কড়া গলায় বলল, ‘তোদের দুজন কি যাবি? নাকি এখানে ঝগড়া করবি? আমি যাচ্ছি আর কখনো আসবোনা তোদের সাথে।’
অতঃপর তাদের ঝগড়া থামলো। মিনি অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও সবার সাথে হেঁটে চললো। বেলা সবার সামনে। অনেকদিন পর বাইরে বেরিয়ে মনটা ভীষণ ফ্রেশ লাগছে। আসার সময় আবার শপিংও করলো। এই করতে করতে রাত আটটা বেজে গেলো। বাকিরা রিকশা নিয়ে যার যার মতো চলে গেলো। বেলার ভয় করতে লাগলেও মনে মনে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে রিকশা ঠিক করলো সে। কিন্তু রিকশায় উঠার আগেই কারো ডাক শুনে পেছনে ঘুরলো বেলা। কাউকে দেখতে পেলোনা সে। কিন্তু কন্ঠস্বর অতি পরিচিত। একপ্রকার ভয়ে আর আতংকে জরাগ্রস্ত হয়ে বাসায় পৌঁছে বেলা।
তার পরদিন।
দুপুরের খাবার-দাবার সেরে কলেজের ফর্ম ফিলআপ করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে বেলা। নাইমুদ্দীন সাহেব ওকে একটা পরিচিত দোকানের সামনে নামিয়ে দিয়ে বাজার করতে চলে যান। বেলাকে একাই বাসায় চলে যেতে বলেন। ও প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে একাই বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো৷ হঠাৎই একটা কার এসে ওর সামনে থামে। বেলা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাদা রঙের কারটাকে দেখে। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই দরজা খুলে কেউ একজন বেরিয়ে আসে। বেলাকে ডাকে। সে ঘুরে তাকিয়েই চমকে ওঠে। এ কি! শাইনি কোথা থেকে এলো? ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে যায় আর শাইনি এসে ওকে থাপ্পড় মারে। বেলা আতংকিত হয়ে পড়ে। দুপুরবেলা রাস্তাঘাট খালি, মানুষজন প্রায় নেই বললেই চলে। তার মধ্যে একলা শাইনির সামনে দাঁড়িয়ে বেলার মনে হচ্ছে ও বুঝি ভয়েই মরে যাচ্ছে!
-কী? খুব তো আছো দেখছি? ঘুরছো, ফিরছো, খাচ্ছোদাচ্ছো! শ্লেষের হাসি হেসে বললো শাইনি।
বেলা কোনোরকমে বলল, ‘আ আপনি? আপনি তো দেশে ছিলেন না?’
-তোমার জন্য এসেছি জান।
-আমার জন্য? কিন্তু কেন?
শাইনির চোখমুখ লাল হয়ে আছে। তার মাথায় টুপি পরা। বেলার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে জোর করে টেনেহিঁচড়ে ওকে গাড়িতে ওঠালো। বেলা চেঁচাচ্ছে, কিন্তু সেই চেঁচানো কারোর কানে পৌঁছালোনা। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। ড্রাইভিং সিটে অন্য একজন বসা৷ শাইনি বেলাকে নিয়ে পেছনে বসলো। বেলা ড্রাইভার লোকটিকে বলল, ‘ভাই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? প্লিজ আমাকে যেতে দিন।’
শাইনি হুংকার দিয়ে বলল, ‘একদম চুপ!’
-আ আমার ব্যাগ কোথায়?
-ফেলে দিয়েছি।
-কিন্তু এসব কেন করছেন?
-সাহস কী করে হয় আমাকে ছাড়ার? না করিনি আমি? বাবা-মায়ের কথায় আমি তোর থেকে দূরে যেতে বাধ্য হই। অসুস্থ আমি বুঝেছিস? ট্রিটমেন্ট ফেলে তোর জন্য এখানে এসেছি। আর কী সুন্দর তুই এখানে ঘুরেফিরে খাচ্ছিস, একবারও তো আমার খোঁজ নিলি না? এত্ত অহংকার? এই তোমাদের ভালো মানুষি? আমাকে ধোঁকা দিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানোটা ভালো মানুষির কোন পর্যায়ে পড়ে?
বেলা বিস্ময়ে হতবাক। ধোঁকার কথা আসছে কেন? ওর বাবা তো সব আইনি মোতাবেকই করেছে। বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনাকে কীসের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে?’
ক্ষেপে উঠলো শাইনি। বলল, ‘আমার বাবা। আমার নিজের বাবা আমার সাথে ছলনা করে সাইন নিয়েছে। বলেছে হসপিটালের কোন একটা কাজে আমার সাইন লাগবে। পরে বলে এটা নাকি আমাদের ডিভোর্স পেপার।’
বেলা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘এখানে আমাদের কী দোষ? আপনার বাবা আপনাকে জানায়নি!’
-সেটাতো তোমাদের ভালোর জন্য। যাতে আমি কিছু না করি, বাঁধা না দিই!
বেলা বলল, ‘আমার সাথে তাহলে এটা করছেন কেন? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন!’
-ছাড়বোনা, কখনো না। নিশার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ করেছি। এখন দেখি কে কী করে!
-যা ইচ্ছে করুন। কিন্তু আমার জীবনটা প্লিজ নষ্ট করবেন না।
-একদম চুপ।
-আপনি আমায় তুলে এনেছেন কেন?
-কিডন্যাপ করেছি আমি। কিডন্যাপড। এমন উচিৎ শিক্ষা দেব না, আমাকে ছাড়ার কথা ভুলেও মাথায় আসবেনা। মাইন্ড ইট!
বেলা ঘৃণাভরা কন্ঠে বলল, ‘খারাপ, জঘন্য মানুষ আপনি!’
শাইনি উচ্চস্বরে হেসে বলল, ‘নমুনা দেখার জন্যই কিডন্যাপ করেছি। আর রইলো বাকি ডিভোর্স? এ জীবনে আর তা হচ্ছেনা। মনে রেখো প্রিয় বউ আমার!’
বেলার মাথা ঘুরছে। কিডন্যাপ করা শাইনির পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। ওর স্বভাবটাই ওরকম জঘন্য। কোথায় ওকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। দু-পাশে ঘন গাছপালা। লোকালয় থেকে অনেক দূরে বোঝাই যাচ্ছে। বাসার সবার কথা চিন্তা করে গলা শুকিয়ে এলো বেলার। সাথে ফোনটাও নেই যে সবাইকে সবকিছু জানাবে। কে করবে এখন ওকে সাহায্য? শাইনির উচ্চস্বরে কথা বলা, অধিক টেনশন আর দুর্বলতায় বেলা একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!