#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১৮
এর মধ্যে দুদিন পেরিয়ে গেছে। চন্দ্রহীন ম্লান আকাশটার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও আজ নিশ্চুপ হয়ে আছে। গুমোট ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। বেলার মনটা বড্ড অস্থির। ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি যেমন তার নিঃস্তব্ধতা তুলে ধরে, ঠিক তেমন মনে হচ্ছে ওর কাছে। যেন কিছু হতে চলেছে। মনটা ভীষণ কু ডাকছে। জানালা থেকে নজর সরিয়ে বেলা কম্বলের ভেতরে ঢুকে শাইনির বুকে মাথা রেখে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়লো। ঘুমের ঘোরে শাইনিও ওর বক্ষে টেনে নিলো তাঁর প্রিয়তমাকে। রাতে আর ঘুম এলো না ওর। তন্দ্রা এলো ভোরে। যখন চারপাশে শীতল উষ্ণতা ছড়াচ্ছিলো তখন! বাইরে বৃষ্টি পড়ছিলো অবিরামভাবে।
ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে যায় বেলার। উঠে দেখে সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শাইনি ওর পাশে নেই। বেলা দু’বার ওর নাম ধরে ডাকতেই ওয়াশরুম থেকে শাইনির গলা ভেসে এলো।
-আমি ফ্রেশ হচ্ছি!
-একা একা না উঠে, আমাকে ডাকলেই পারতেন।
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে তখন।
-আচ্ছা সাবধানে দাঁড়াবেন। বেশি পানি গায়ে ঢালবেন না। হট ওয়াটার ইউজ করবেন। ওকে?
-হুম।
শাইনি ওকে না ডেকেই ওয়াশরুমে গিয়েছে। বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখলো। ঝুড়িতে রাখা কাপড়গুলোর সাথে আরও কিছু কাপড় যোগ হলো। সবকিছু ধুয়ে দিতে হবে। শাইনির জন্য টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে বিছানার ওপর রেখে দিলো। তারপর তড়িঘড়ি করে ঘর ঝাঁট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিচের বেসিং থেকে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে আসতেই নাজনীন বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন উঠেছো?’
বেলা বলল, ‘জি। রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম তাই।’
-নাস্তা রেডি আছে। শাইনির ভেজিটেবল স্যুপটাও ঢাকা দেওয়া আছে।
-আচ্ছা আন্টি। ধন্যবাদ।
নাজনীন বেগম হাসলেন।
-আপনারা ব্রেকফাস্ট করেছেন?
-হুম।
-শিলা কোথায়?
-স্কুলে। কোনো প্রয়োজন ছিল?
-নাহ, এমনি।
-শাইনি উঠেছে? শরীর কেমন এখন ওর?
বেলা মৃদু হেসে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
-ভালো হলেই ভালো। ওহ আচ্ছা দাঁড়াও।
বেলা দাঁড়ালো।
-কিছু বলবেন আন্টি?
-হুম। তোমরা জন্য মিষ্টি বানিয়েছি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আমার জন্য? কেন?’
নাজনীন বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘আজ খুশির দিন তাই।’
-খুশির দিন? আজ কী আন্টি?
নাজনীন বেগম বললেন, ‘শাইনির শরীরটা আজ ভালো। সেটাই বলছিলাম আরকি!’
-ওহ।
-হুম।
-আচ্ছা আমি ঘরে যাই। ওনার খাবারটা দিয়ে আসি।
-আচ্ছা যাও।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বেলা ভাবলো শাইনির জন্য এমন উৎফুল্লতা কোনোদিন তো নাজনীন বেগম প্রকাশ করেননি! তাহলে আজ এত খুশি কেন? আর এতই খুশি যে মিষ্টি খাওয়ানোর মতো? স্ট্রেজ! মহিলাটার হলো কী? কত রুপ যে দেখাবে ওনি, ওনিই জানে!
ঘরে এসে দেখলো শাইনি বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। বেলা খাবার নিয়ে ওর সামনে রাখলো। স্যুপের গন্ধ পেয়ে শাইনি তাকালো অসহায় ভাবে।
-কতদিন এসব উটকো খাদ্য খাওয়াবে আমাকে?
-যতদিন পর্যন্ত খাওয়া লাগে!
-আমাকে একটু বাইরে নিয়ে চলো প্লিজ। বাসার ভেতর দম বন্ধ লাগছে আমার। একটা কথা শুনো।
বেলা ওকে থামিয়ে দিলো।
-সব কথা পরে শুনবো। খাবারটা ইমিডিয়েটলি শেষ করুন।
শাইনি অসহায় চোখে তাকালো। বলল, ‘ওকে।’
খাওয়ার পর্যায় শেষ করে শাইনি বেলার কোলে মাথা রেখে বলল, ‘আমাকে একবার বাইরে নিয়ে চলো না প্লিজ!’
বেলা কড়া গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক কতটা অসুস্থ তা কি আপনি জানেন?’
-জানতে চাইও না।
-আপনার জন্য আমাদের অনেক চিন্তা হয়, বুঝলেন! শরীরের প্রতি এতটা বেখেয়ালি হবেন না প্লিজ। বাইরে যাওয়াটা কোনোভাবেই পসিবল নয় আপনার পক্ষে!
-আমি তো তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। অন্য কারো সঙ্গে নয়।
-না।
শাইনি অধৈর্য কন্ঠে বলল, ‘বিয়ের পর আমরা কোথাও গিয়েছি? তোমাকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ছিল, তার কিছুই তো পূরণ হলো না। আমার আফসোস হচ্ছে খুব।’
বেলা বলল, ‘আপনাকে সুস্থ করতে যা যা প্রয়োজন, সবই করে যাচ্ছি আমরা৷ এতটা অবুঝ হবেন না প্লিজ।
-শুধু আজকের দিনটা প্লিজ। থেরাপি দেওয়া স্টার্ট করলে তো হসপিটাল আমার বাড়িঘর হয়ে উঠবে।
-নো ওয়ে।
-প্লিজ বেলা বউ না করো না। তুমি সবুজ শাড়ি আর আমি সবুজ পাঞ্জাবি পরে একটু হাঁটবো রাস্তায়। আর কোনো এক রেস্টুরেন্টে ডিনার করে চলে আসবো। ডিনারটা আমি সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে নেব। প্লিজ! আলমিরাতে দেখো শাড়ি-পাঞ্জাবি আছে।
বেলা অবাক হয়ে উঠে গিয়ে আলমিরা খুলে দুটো প্যাকেটে শাড়ি,পাঞ্জাবি দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘কখন কিনলেন এগুলো?’
-সেদিন। আব্বুর সাথে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরার সময়।
-আংকেল যেতে রাজি হলো?
-জোর করে নিয়ে গিয়েছি।
-আপনি লোকটা মানসিক রোগী!
-যা ভাবার ভাবতে পারো।
-হুহ!
-যাবে তো?
বেলা এবার রাজি না হয়ে পারলো না। আর রাজি না হলেও শাইনি ঠিকই ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। বেলা হঠাৎ কেঁদে ফেললো। শাইনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাঁদছো কেন?’
-আপনাকে সুস্থ করতে পারবো তো আমি? আমরা সবাই?
শাইনি ঢোক গিলে বলল, ‘অবশ্যই।’
-আমার নিজেকে প্রচন্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায় আমি তাহলে কীভাবে বাঁচবক? মরে যাবো একদম।
শাইনি হেসে ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়। গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘শোনো বেলা বউ! কেনো ভাবছো তুমি পারবেনা? তুমি দুর্বল? যেই তুমি শক্ত মনে নিজের স্বামীর অন্যায়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, প্রতিবাদ করলে এবং দিনশেষে ভালোবাসলে এবং তাঁকে কঠিন এক রোগ থেকে মুক্তি দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালালে এবং চালিয়ে যাচ্ছো! ভাবো, সেই তুমি কতো টা শক্তিশালী আগের চেয়ে, কতটা নমনীয় এবং অসাধারণ একজন। এটা কি তুমি জানো?’
বেলা শাইনির বুকে মাথা রেখেই বলল, ‘জানিনা। জানতে চাইও না।’
বিকেলের দিকে শাইনিকে নিয়ে বাইরে বেরুলো বেলা। বাড়ির গাড়ি করেই রওয়ানা হলো৷ ড্রাইভার আছে সঙ্গে। শাইনির পরণে সবুজ পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। অসুস্থ রোগা শরীর, তবুও ঠোঁটের কোণে ছিলো প্রশান্তির উষ্ণ হাসি৷ বেলার পরণে সবুজ শাড়ি সঙ্গে খোলা চুল, হাতে কাচের সবুজ চুড়ি। দেখতে ভীষণ মায়াবী লাগছিলো ওকে। কিন্তু শাইনির কাছে কীসের যেন একটা কমতি মনে হচ্ছে। প্রিয়তমার সাথে অনেকদিন পর বাইরে বেরিয়ে শাইনির মনে হচ্ছিল ও পুরোপুরি সুস্থ একটা মানুষ। বেলা আছে বলেই ও বেঁচে থাকার স্বাদ পাচ্ছে। নয়তো জীবনের প্রতি ওর এতোটা মায়াও নেই! গাড়ি থামলো সম্পূর্ণ খালি একটা রাস্তায়। দু-পাশে ঘন সবুজের সমারোহ! তার মাঝে ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। বেলা খুব সাবধানে পা ফেলে ওকে নিয়ে এগুচ্ছে। কিছুদূর এগুতেই বন্যঝোপে ফুটে থাকা জংলি সাদা ফুলের গোছা দেখতে পেয়ে সেগুলো মুঠো করে ছিঁড়ে নিলো শাইনি। বেলার চুলে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এটাই মিস ছিলো। এবার পারফেক্ট!’
বেলা হাসলো। শাইনি স্বপ্নালু চোখে তাকালো ওর দিকে। কন্ঠে উচ্ছলতা।
-তোমার মনে আছে পাহাড়ের ওই দিনগুলোর কথা?
বেলা হেসে বলল, ‘মনে থাকবে না? জীবনের প্রথম কিডন্যাপারের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম তা কী আর ভোলা যায়? হা হা। আমার কিডন্যাপার বর!’
-কিডন্যাপার বরটা কিন্তু একপিসই। আর খুঁজেও পাবেনা।
-তা তো বটেই! বেলা হাসতে হাসতে বললো।
অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর শাইনি বেলাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে এলো। নামীদামি রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন রঙিন আলোয় সজ্জিত। চারপাশটা ভুতুড়ে নীরব৷ ভেতরে কোনো মানুষজন নেই। শাইনি পুরোটাই বুক করে নিয়েছে। ওরা দুজন গিয়ে টেবিলে বসলো। শাইনি বেলার পছন্দমতো খাবার অর্ডার দিতে বললো। নিজের জন্য কিছুই নিলো না। কারণ বাইরের খাবার খাওয়া ওর জন্য মানা। আর বেলা তো খেতেই দিবে না। অবশ্য বেলা হট টিফিন ক্যারিয়ারে ওর পছন্দের খাবার তৈরি করে নিয়ে এসেছে। ওয়েটার খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেলো৷ দুজনে মিলে গল্প করতে করতে খেলো বেশ ভালো একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এলো দুজন।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে শাইনিকে ঔষধ দিয়ে ওর পাশে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। দুজনেই খুব ক্লান্ত থাকায় আর নিচে নামলো না বেলা।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো চেঁচামেচির শব্দ। নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো বেলা। বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কী নিচে? অসুস্থ শরীরে আবার নিচে নামতে গেলো কেন ও? আজ আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে! লোকটাকে আর পারা যায় না! বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বেলা!
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১৯
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো চেঁচামেচির শব্দ। নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো বেলা। বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কী নিচে? অসুস্থ শরীরে আবার নিচে নামতে গেলো কেন ও? আজ আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে! লোকটাকে আর পারা যায় না! বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বেলা! ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে এলো। নাইমুদ্দীন সাহেব এসেছেন। শাইনিও এখানে আছে। অতএব নিচে কী চলছে তা বুঝতে বাকি নেই ওর। নাইমুদ্দীন সাহেব আর শাইনির মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। তিনি কিছুতেই বেলাকে ছাড়া যাবেন না। ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। তবে ওনি খবর কীভাবে পেলেন সেটা বেলা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। কী হবে না হবে এতে শাইনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। এমনিতে লোকটা সারাদিনে হাজার বার টেনশন করে। প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দেয় বেলাকে। সেখানে আবার নতুন করে আরেক ঝামেলা শুরু হলো। বেলার মাথাটা ধরে আসলো খুব। নাইমুদ্দীনের সাহেবের উচ্চ কন্ঠে কথা বলাটা বারবার শাইনির হৃদস্পন্দনকে কাঁপিয়ে তুলছে। গলা শুকিয়ে আসলেও যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় শাইনি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-আংকেল আপনি বোঝার চেষ্টা করুন! বেলা এখনো আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
নাইমুদ্দীন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, ‘তার আগে ও আমার মেয়ে। আর আমার মেয়েকে আমি তোমার মতো লম্পট, চরিত্রহীনের সাথে সংসার করতে কিছুতেই দেব না।
শাইনি বলল, ‘সবটাই আপনার বোঝার ভুল। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল সেটা আপনি জানেন না বিধায় এই কথা বলছেন।’
-আমি কিছুই জানতে চাইও না। অন্তত তোমার কাছ থেকে না।
-এটা কোনো কথা নয় আংকেল!
-তাহলে কোনটা কথা? তুমি আমার মেয়ের জীবনটাই নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। লাভ কী এসব করে?
-আমি ওকে ভালোবাসি আংকেল।
নাইমুদ্দীন সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘ভালাবাসা মাই ফুট। ভালোবাসা কাকে বলে জানো তুমি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কী জানো? বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান আছে তোমার? কিচ্ছু নেই। আসলে এসব তো পরিবার থেকে শিখতে হয়৷ যেখানে তোমার বাবা-মা তোমাকে এসব শিক্ষা দেয়নি, সেখানে তাদের ছেলে কেমন হবে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’
শাইনি রাগ চেপে বলল, ‘আমার পরিবারের লোকজনদের এর মধ্যে টানবেন না।’
-টানতে হবে। কারণ ওনারা তোমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী। ছেলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবরণ ওনাদের শোনা দরকার।
শাইনি বলল, ‘আংকেল আপনি শান্ত হোন আর আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনুন। আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেন যা যাতে আমার ভালোবাসা আমার থেকে দূরে সরে যায়!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আমি তোমার ভালোবাসা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। যে ছেলে বিয়ের আগে-পরে অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখে তাকে নিয়ে বলার মতো কিছু আমার শব্দ ভান্ডারে নেই।’
আলম সাহেব বরাবরই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। ঝুট ঝামেলা তার পছন্দ নয়। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন তিনি। তার অসুস্থ ছেলেটাকে এতোটা হার্ট করবে কেউ, আর তিনি বসে বসে সহ্য করবেন তা কখনোই হতে পারেনা। নো নেভার। এতক্ষণ বসে বসে ছেলে আর নাইমুদ্দীন সাহেবের কথা শুনছিলেন তিনি। নাজনীন বেগম ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছেন। শিলা বোধহয় বাড়িতে নেই, বেলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছে। ভয়ে এক পা নড়ার সাহস হচ্ছেনা ওর। শাইনিকে ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবেনা ও। বাবা কেন কোনো কথা শুনতে চাইছেনা? ওর বাবা তো এমন নয়!
আলম সাহেব এবার মুখ খুললেন। তিনি মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে নাইমুদ্দীন সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
-ভাইজান, আপনি আমার কথা শুনুন।
বেলার বাবা অনিচ্ছাবশত বলল, ‘দেখুন ভাই। আমি আপনাদের সাথে তর্কে জড়াতে আসিনি। আমার মেয়েকে দিন, এই নরক থেকে নিয়ে যাই!’
আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়েকে আমরা নরকে রাখিনি। ও যথেষ্ট সুখে আছে।’
-যে ছেলে কিডন্যাপ করে আমার মেয়েকে নিয়ে আসে, সে আমার মেয়েকে সুখে রেখেছে এটা আমার মানতে হবে? আর যাইহোক, আজ আমার মেয়েকে নিয়ে তবেই যাবো। দরকার হলে পুলিশ ডাকবো।
আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়ে যথেষ্ট ভালো। মানছি আমার ছেলে একটা ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু তা শুধরে নিয়েছে শাইনি। আর আপনি তো জানেন আমার ছেলে অসুস্থ!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এটা অসুস্থতা নয়। এটা আপনাদের চাল, নাটক। আমার মেয়েকে আপনার চরিত্রহীন ছেলের বউ করার জন্য বেলার ব্রেইন ওয়াশ করে চলেছেন আপনারা। সেসব কী আমি জানিনা ভেবেছেন?
শাইনির রক্ত ছলকে উঠলো। মাথা গরম হয়ে গেলো। আলম সাহেব শক্ত করে ওর হাত ধরে রাখলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘বেলা অবুঝ বাচ্চা না যে আমরা যা বলবো সে তা বিশ্বাস করে নেবে। আপনার মেয়েকে আপনি ভালো চিনেন ভাইজান।’
-দেখুন। আমার সময় নষ্ট না করে বেলাকে ডাকুন।
শাইনি এবার রুখে দাঁড়ালো। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বেলা বউকে আপনি কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেব না।’
-আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব। দেখবো কে আটকায়!
-আংকেল আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সবকিছুর লিমিট থাকে!
-লিমিট তুমি ক্রস করেছো। আমার মেয়েকে তুলে এনে। জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতে বাধ্য করেছো।
শাইনির বুক কেঁপে উঠলো।
-বেলাকে নিজের ভালোবাসার মিথ্যে নাটক করে ফাঁসিয়েছো । আমার বোকা মেয়ে তাই মেনেছে।
শাইনি ধরা গলায় বলল, ‘ও আমাকে ভালোবাসে।’
-এটা তোমার ভুল ধারণা। আমার মেয়ের বিশ্বাস যে একবার ভাঙে সে দ্বিতীয়বার হাজার ভালো কাজ করে বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করলেও তাকে মন থেকে মাফ করেনা। আর সেখানে তোমাকে? ইম্পসিবল! তোমার অসুস্থতা, অসহায়তার কথা শুনে হয়তো সাময়িকভাবে তোমার প্রতি উইক হয়ে পড়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। ও তোমাকে ভালোবাসেনা এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করতে পারবে ততই কম কষ্ট পাবে তুমি।
শাইনি একেবারে চুপ হয়ে গেলো। ধপ করে সোফায় বসে পড়লো৷ চোখের কোণে পানি জমলেও তা গড়িয়ে পড়ে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। সত্যিই তো, ওর জোরাজুরিতেই তো বেলা এ বাড়িতে রয়েছে। তাহলে কী নাইমুদ্দীন সাহেবের কথাই ঠিক? বেলা ওকে ভালোবাসে না? শুধু ওর মন রক্ষার জন্য এসব করছে? ও অসুস্থ বলে দয়া দেখাচ্ছে?
সোফায় বসে থাকা নাইমুদ্দীন সাহেবের এবার চোখ পড়লো সিঁড়িঘরে দাঁড়ানো বেলার ওপর। নিমিষেই তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠলো। তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেলার সামনে এসে কিছু না বলেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন। বেলা হতভম্ব হয়ে গেলো। নাইমুদ্দীন সাহেব শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী করো তুমি?’
বেলা ভয়ে চুপসে গেলো। কয়েক কদম দূরে শাইনি বসে আছে। ওর মুখাবয়ব দেখেই বেলা বুঝতে পারলো ভীষণ রেগে গেছে ও। শুধু চুপচাপ বসে নাইমুদ্দীন সাহেবের কান্ড দেখছে। বেলার গায়ে হাত উঠানোর পর শাইনি আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিন্তু আলম সাহেব ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললেন। নয়তো পরিস্থিতি সামলানো দায় হয়ে পড়বে!
বেলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমুদ্দীন সাহেবের কথার উত্তর দেয় না ও। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে পারলে এসব করতে? ওই ছেলের জন্য নিজের বাবাকে মিথ্যা বলতে একবারও বিবেকে বাঁধা দিলো না?’
বেলা দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে দিলো। এতদিন পর বাবাকে দেখে মনটা শান্ত হলেও কান্না পেয়ে গেলো।সাথে ভয়ও হচ্ছে। শাইনিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। বাবার বুকে মাথা রেখে ক্রন্দনরত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-আব্বু, কেমন আছো?
নাইমুদ্দীন সাহেব মেয়ের ওপর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, ‘ভালো আছি। এসব করার আগে আমার কথা মনে পড়েনি? আজ দুইমাস তুমি বাসা ছেড়ে বেরিয়েছো এই ছেলেটার সাথে। জানি তুমি নিজে যাওনি, জোর করে নিয়ে এসেছে। তবুও, শহরে ফেরার সাথে সাথে তুমি আমাকে একবারও জানাওনি কেন? দিনের পর দিন তোমার মাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছো৷ এসব কী ঠিক ছিল? আমাকে কেন অন্যের কাছ থেকে খবর নিয়ে এখানে আসতে হলো?’
-জানানোর মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না।
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘যাইহোক, চলো আমার সঙ্গে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
-বাসায়। এতদিন বাড়ি ছেড়ে আছো। এবার তো চলো।
শাইনি বলে উঠলো, ‘কোথাও যাবেনা ও। আমার সঙ্গে থাকবে।’
-কখনো হবেনা এটা।
চলবে…ইনশাআল্লাহ! কী মনে হয়?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!