শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ১৯

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১৯

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো চেঁচামেচির শব্দ। নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো বেলা। বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কী নিচে? অসুস্থ শরীরে আবার নিচে নামতে গেলো কেন ও? আজ আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে! লোকটাকে আর পারা যায় না! বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বেলা! ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে এলো। নাইমুদ্দীন সাহেব এসেছেন। শাইনিও এখানে আছে। অতএব নিচে কী চলছে তা বুঝতে বাকি নেই ওর। নাইমুদ্দীন সাহেব আর শাইনির মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। তিনি কিছুতেই বেলাকে ছাড়া যাবেন না। ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। তবে ওনি খবর কীভাবে পেলেন সেটা বেলা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। কী হবে না হবে এতে শাইনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। এমনিতে লোকটা সারাদিনে হাজার বার টেনশন করে। প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দেয় বেলাকে। সেখানে আবার নতুন করে আরেক ঝামেলা শুরু হলো। বেলার মাথাটা ধরে আসলো খুব। নাইমুদ্দীনের সাহেবের উচ্চ কন্ঠে কথা বলাটা বারবার শাইনির হৃদস্পন্দনকে কাঁপিয়ে তুলছে। গলা শুকিয়ে আসলেও যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় শাইনি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-আংকেল আপনি বোঝার চেষ্টা করুন! বেলা এখনো আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
নাইমুদ্দীন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, ‘তার আগে ও আমার মেয়ে। আর আমার মেয়েকে আমি তোমার মতো লম্পট, চরিত্রহীনের সাথে সংসার করতে কিছুতেই দেব না।
শাইনি বলল, ‘সবটাই আপনার বোঝার ভুল। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল সেটা আপনি জানেন না বিধায় এই কথা বলছেন।’
-আমি কিছুই জানতে চাইও না। অন্তত তোমার কাছ থেকে না।
-এটা কোনো কথা নয় আংকেল!
-তাহলে কোনটা কথা? তুমি আমার মেয়ের জীবনটাই নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। লাভ কী এসব করে?
-আমি ওকে ভালোবাসি আংকেল।
নাইমুদ্দীন সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘ভালাবাসা মাই ফুট। ভালোবাসা কাকে বলে জানো তুমি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কী জানো? বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান আছে তোমার? কিচ্ছু নেই। আসলে এসব তো পরিবার থেকে শিখতে হয়৷ যেখানে তোমার বাবা-মা তোমাকে এসব শিক্ষা দেয়নি, সেখানে তাদের ছেলে কেমন হবে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’
শাইনি রাগ চেপে বলল, ‘আমার পরিবারের লোকজনদের এর মধ্যে টানবেন না।’
-টানতে হবে। কারণ ওনারা তোমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী। ছেলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবরণ ওনাদের শোনা দরকার।
শাইনি বলল, ‘আংকেল আপনি শান্ত হোন আর আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনুন। আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেন যা যাতে আমার ভালোবাসা আমার থেকে দূরে সরে যায়!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আমি তোমার ভালোবাসা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। যে ছেলে বিয়ের আগে-পরে অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখে তাকে নিয়ে বলার মতো কিছু আমার শব্দ ভান্ডারে নেই।’

আলম সাহেব বরাবরই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। ঝুট ঝামেলা তার পছন্দ নয়। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন তিনি। তার অসুস্থ ছেলেটাকে এতোটা হার্ট করবে কেউ, আর তিনি বসে বসে সহ্য করবেন তা কখনোই হতে পারেনা। নো নেভার। এতক্ষণ বসে বসে ছেলে আর নাইমুদ্দীন সাহেবের কথা শুনছিলেন তিনি। নাজনীন বেগম ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছেন। শিলা বোধহয় বাড়িতে নেই, বেলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছে। ভয়ে এক পা নড়ার সাহস হচ্ছেনা ওর। শাইনিকে ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবেনা ও। বাবা কেন কোনো কথা শুনতে চাইছেনা? ওর বাবা তো এমন নয়!

আলম সাহেব এবার মুখ খুললেন। তিনি মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে নাইমুদ্দীন সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
-ভাইজান, আপনি আমার কথা শুনুন।
বেলার বাবা অনিচ্ছাবশত বলল, ‘দেখুন ভাই। আমি আপনাদের সাথে তর্কে জড়াতে আসিনি। আমার মেয়েকে দিন, এই নরক থেকে নিয়ে যাই!’
আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়েকে আমরা নরকে রাখিনি। ও যথেষ্ট সুখে আছে।’
-যে ছেলে কিডন্যাপ করে আমার মেয়েকে নিয়ে আসে, সে আমার মেয়েকে সুখে রেখেছে এটা আমার মানতে হবে? আর যাইহোক, আজ আমার মেয়েকে নিয়ে তবেই যাবো। দরকার হলে পুলিশ ডাকবো।

আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়ে যথেষ্ট ভালো। মানছি আমার ছেলে একটা ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু তা শুধরে নিয়েছে শাইনি। আর আপনি তো জানেন আমার ছেলে অসুস্থ!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এটা অসুস্থতা নয়। এটা আপনাদের চাল, নাটক। আমার মেয়েকে আপনার চরিত্রহীন ছেলের বউ করার জন্য বেলার ব্রেইন ওয়াশ করে চলেছেন আপনারা। সেসব কী আমি জানিনা ভেবেছেন?

শাইনির রক্ত ছলকে উঠলো। মাথা গরম হয়ে গেলো। আলম সাহেব শক্ত করে ওর হাত ধরে রাখলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘বেলা অবুঝ বাচ্চা না যে আমরা যা বলবো সে তা বিশ্বাস করে নেবে। আপনার মেয়েকে আপনি ভালো চিনেন ভাইজান।’
-দেখুন। আমার সময় নষ্ট না করে বেলাকে ডাকুন।

শাইনি এবার রুখে দাঁড়ালো। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বেলা বউকে আপনি কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেব না।’
-আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব। দেখবো কে আটকায়!
-আংকেল আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সবকিছুর লিমিট থাকে!
-লিমিট তুমি ক্রস করেছো। আমার মেয়েকে তুলে এনে। জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতে বাধ্য করেছো।
শাইনির বুক কেঁপে উঠলো।
-বেলাকে নিজের ভালোবাসার মিথ্যে নাটক করে ফাঁসিয়েছো । আমার বোকা মেয়ে তাই মেনেছে।
শাইনি ধরা গলায় বলল, ‘ও আমাকে ভালোবাসে।’
-এটা তোমার ভুল ধারণা। আমার মেয়ের বিশ্বাস যে একবার ভাঙে সে দ্বিতীয়বার হাজার ভালো কাজ করে বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করলেও তাকে মন থেকে মাফ করেনা। আর সেখানে তোমাকে? ইম্পসিবল! তোমার অসুস্থতা, অসহায়তার কথা শুনে হয়তো সাময়িকভাবে তোমার প্রতি উইক হয়ে পড়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। ও তোমাকে ভালোবাসেনা এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করতে পারবে ততই কম কষ্ট পাবে তুমি।

শাইনি একেবারে চুপ হয়ে গেলো। ধপ করে সোফায় বসে পড়লো৷ চোখের কোণে পানি জমলেও তা গড়িয়ে পড়ে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। সত্যিই তো, ওর জোরাজুরিতেই তো বেলা এ বাড়িতে রয়েছে। তাহলে কী নাইমুদ্দীন সাহেবের কথাই ঠিক? বেলা ওকে ভালোবাসে না? শুধু ওর মন রক্ষার জন্য এসব করছে? ও অসুস্থ বলে দয়া দেখাচ্ছে?

সোফায় বসে থাকা নাইমুদ্দীন সাহেবের এবার চোখ পড়লো সিঁড়িঘরে দাঁড়ানো বেলার ওপর। নিমিষেই তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠলো। তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেলার সামনে এসে কিছু না বলেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন। বেলা হতভম্ব হয়ে গেলো। নাইমুদ্দীন সাহেব শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী করো তুমি?’

বেলা ভয়ে চুপসে গেলো। কয়েক কদম দূরে শাইনি বসে আছে। ওর মুখাবয়ব দেখেই বেলা বুঝতে পারলো ভীষণ রেগে গেছে ও। শুধু চুপচাপ বসে নাইমুদ্দীন সাহেবের কান্ড দেখছে। বেলার গায়ে হাত উঠানোর পর শাইনি আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিন্তু আলম সাহেব ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললেন। নয়তো পরিস্থিতি সামলানো দায় হয়ে পড়বে!

বেলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমুদ্দীন সাহেবের কথার উত্তর দেয় না ও। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে পারলে এসব করতে? ওই ছেলের জন্য নিজের বাবাকে মিথ্যা বলতে একবারও বিবেকে বাঁধা দিলো না?’
বেলা দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে দিলো। এতদিন পর বাবাকে দেখে মনটা শান্ত হলেও কান্না পেয়ে গেলো।সাথে ভয়ও হচ্ছে। শাইনিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। বাবার বুকে মাথা রেখে ক্রন্দনরত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-আব্বু, কেমন আছো?
নাইমুদ্দীন সাহেব মেয়ের ওপর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, ‘ভালো আছি। এসব করার আগে আমার কথা মনে পড়েনি? আজ দুইমাস তুমি বাসা ছেড়ে বেরিয়েছো এই ছেলেটার সাথে। জানি তুমি নিজে যাওনি, জোর করে নিয়ে এসেছে। তবুও, শহরে ফেরার সাথে সাথে তুমি আমাকে একবারও জানাওনি কেন? দিনের পর দিন তোমার মাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছো৷ এসব কী ঠিক ছিল? আমাকে কেন অন্যের কাছ থেকে খবর নিয়ে এখানে আসতে হলো?’
-জানানোর মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না।
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘যাইহোক, চলো আমার সঙ্গে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
-বাসায়। এতদিন বাড়ি ছেড়ে আছো। এবার তো চলো।
শাইনি বলে উঠলো, ‘কোথাও যাবেনা ও। আমার সঙ্গে থাকবে।’
-কখনো হবেনা এটা।

চলবে…ইনশাআল্লাহ! কী মনে হয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here