ঘরের এককোণে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে মেঘা আহম্মেদ। কিছুক্ষন আগেই তার বাবা জসিম মিয়া শক্ত এক কাঠ দিয়ে আঘাত করেছে তাকে, খুব তুচ্ছ এক বিষয় নিয়ে। একটু উনিশ-বিশ হলেই তাকে মা/র খেতে হয়। তার মা রহিমা বানু এগিয়ে আসলে, তাকেও মা/র খেতে হয়। রহিমা বানু মলম এনে মেঘার ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে,
–” আজ কি করেছিলি মেঘ? কেনো ওই ন/র/প/শু আবারও তোকে রক্তাক্ত করলো? কি করেছিলি বল? ”
মেঘা ফুপিয়ে উঠে বলা শুরু করলো।
🍂ফ্ল্যাশব্যাক 🍂
রূপসাপুর গ্রামের আকাবাকা মেঠো পথ দিয়ে দুই বিনুনী দুলিয়ে দুলিয়ে বান্ধবীর সাথে হাটছে সদ্য কলেজ পড়ুয়া সুন্দরী রমণী। মায়াবী মুখের আদল, গায়ের রং ফর্সা এবং কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা ঘন কালো রেশমী চুল যেনো তার সৌন্দর্য শত গুনে বাড়িয়ে তুলছে। বাবা মায়ের রঙ পায়নি মেয়েটি। যেমনই তার নাম, তেমনই তার রুপ। হ্যাঁ, মেয়েটির নাম ‘ মেঘা ‘। মেঘের মতোই সুন্দর সে। হঠাৎ বৃষ্টি আশায় ভিজে যায় মেয়েটি এবং তার সাথে থাকা মেয়েটি। দুহাত দিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে নিতে লাগলো যেনো, কাপড় ভিজে যেনো শরীরের সাথে লেগে না যায় তাই ব্যাগে থাকা উড়নাটি দিয়ে নিজেকে আবৃত করে নিলো। বিপত্তি ঘটালো এলাকার চেয়ারম্যান শাওন চৌধুরীর একমাত্র ছেলে শান চৌধুরী। সারাদিন ম/দ্য/পা/ন এবং মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ছাড়া যেনো কোনো কাজই নেই, চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু করতে পারে না। শান মেঘার হাত টেনে ধরে বললো,
” কোথায় যাওয়া হচ্ছে সুন্দরী? বাড়িতে বুঝি! রোজ তো নিজের বাড়িতে যাও, আজ নাহয় আমার সাথেই চলো। অনেকক আদর করে দেবো তোমায়, যথেষ্ট টাকাও দিয়ে দেবো। তা এক রাতের জন্য কতো নেবে? দশ হাজার? ”
বলেই একটি বিদঘুটে হাসি দিলো। তার সাথে থাকা ছেলেটিও হাসতে লাগলো। এসব বাজে কথা শুনে মেঘার চোখ জ্বলে উঠলো। রাগে, দু:খে চোখে পানি চলে এলো, তবে মেঘা চুপ থাকার মেয়ে নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস তার আছে, এই কারনে কতো মা/র খেয়েছে হিসাব নেই। মেঘা দাত কিড়মিড় করে বললো,
” হাতটি ছাড়ুন মিষ্টার শান চৌধুরী। ”
শান আরও শক্ত করে ধরে বললো,
” ওমা, দশ হাজারে পোষাবে না বুঝি? আচ্ছা তাহলে বিশ হাজার দেবো। এবার খুশী তো? ”
মেঘা আর সহ্য করতে না পেরে হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে শানের দুগালে থা/প্প/ড় দিয়ে বলে,
” ব্যাস, অনেক বলে ফেলেছিস। আর নয়, তোর কি আমাকে তোর বোনের মতো সস্তা মনে হয়? দুদিন আগেই তো অবৈধভাবে তোর বোন ধরা পড়লো। আমাকে সেরকম মনে হয়? এই দশ বা বিশ হাজার টাকা যদি তুই মসজিদে বা কোনো গরিবকে দান করে দিতি, তাহলে সারাজীবন সওয়াব পেতি। আর সবসময় বাবার পাওয়ার দেখিয়ে মেয়েদের ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলেছিস। কতো মেয়ে যে আ/ত্ন/হ/ত্যা করেছে একবারও ভেবে দেখেছিস? যদি জীবনে লজ্জা বলতে কিছু থাকে, ভুলেও আমার দিকে হাত বাড়াবি না। ”
বলে মেঘা সেখান থেকে চলে আসতে নিলে, শান বলে উঠে,
” এই থা/প্প/ড়ে/র ফল তুই পাবি মেঘা। শান চৌধুরীর গায়ে হাত দেওয়ার ফল তোকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবো। ”
মেঘা কিছু না বলে চলে আসে। কিছুক্ষন পরে শাওন চৌধুরী মেঘার বাবা জসিম মিয়াকে ডেকে পাঠায়। জসিম মিয়া গিয়ে সালাম দিতেই উনি বলে উঠে,
” জসিম, তুমি নিশ্চয় জানো তোমার মেয়ে কতো বড় কাজ করেছে! তা জসিম, তুমি কি চাও যে তোমাকে গ্রাম ছাড়া করি? আমার জমিগুলো কেড়ে নিই ”
জসিম মিয়া ভয় পেয়ে বললেন,
” না না সাহেব, এমনটা করবেন না। তাহলে যে আমাকে পথে বসতে হবে। আমি মেঘার হয়ে মাফ চেয়ে নিচ্ছি, ও আর কক্ষনো এমনটা করবে না ”
শাওন চৌধুরী বাকা হেসে বলেন,
” আমি তোমার মেয়ে মেঘাকে এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার বাড়ির বউমা বানাতে চাই। ”
জসিম মিয়া লোভী প্রকৃতির হওয়ায়, রাজী হয়ে পায়ে সালাম করে বেড়িয়ে গেলেন। বাড়িতে এসে মেঘাকে বিয়ের কথা বলায় মেঘা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে, বাকি ঘটনা আপনারা জানেন।
🍂ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড 🍂
রহিমা বানু সব শুনে চোখের জল ফেলে বললেন,
” একদিন তুই অনেক বড় হবি মেঘ, সেদিন এই ন/র/প/শুর কাছে থেকে দূরে চলে যাবি। কোনোদিন আসবি না, আমি তোকে ওই শানের সাথে বিয়ে হতে দিবো না। ”
মেঘা তার মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল বিসর্জন দেয় আর ভাবতে থাকে একদিন অনেক বড় হবে। সেদিন তার মাকে নিয়েই চলে যাবে এখান থেকে। মাঝে মাঝে তার জানতে ইচ্ছে হয়, সে কি আদৌও এদের সন্তান? মেঘার গলায় থাকা সোনার লকেটটির হাতে ধরলো। ছোটবেলা থেকেই এটি আছে তার কাছে, রহিমা বানু কখনোই তা বিক্রয় করতে দেন নি। এই লকেটেই লিখা আছে তার নাম ‘ মেঘা আহম্মেদ ‘ , তবে এতো দামী সোনার জিনিসটি কি জসিম মিয়া দিয়েছেন? কিছুটা রহস্য মনে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে নিজেও জানে না।
🍂
আহম্মেদ ভিলায় আজ সবারই মন খুবই খুশী। অনেকদিন পর বাড়ির সকলে একসাথে বিকালে বাড়িতে আসতে পেরেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িটি সিফাত আহম্মেদ এবং মাহিন আহম্মেদ নামক দুই ভাইয়ের। সিফাত আহম্মেদের স্ত্রী শেফালী আহম্মেদ এবং ছেলে শান্ত, শ্রাবন। মাহিন আহম্মেদের স্ত্রী ইশা আহম্মেদ এবং ছেলে ইফতি। শান্ত বাবাদের অফিসে জয়েন করেছে, ইফতি একজন ডাক্তার এবং শ্রাবন বাবাদের অফিসে জয়েন না করে তার স্বপ্নের চাকুরী অর্থাৎ সিক্রেট ডিটেক্টিভ বিভাগে কাজ করছে। আড্ডার এক পর্যায়ে শ্রাবন বলে উঠে,
” বাবা, পাপা, মা, মামনি এবং ভাইয়ারা তোমাদের সবাইকে বলে রাখি, একটা কেস সলভ করতে কাল রূপসাপুর গ্রামে যেতে হবে। ওখানে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হবে। ” ( পাপা এবং মামনি বলে মাহিন সাহেব ও ইশা বেগমকে ডাকে)
উপস্থিত সবারই মন খারাপ হয়ে গেলো। কারন, সব ভাইবোনেরা পুরো বাড়ির প্রান। সবকিছু থাকলেও পুরো বাড়ি একটি মেয়ের শুন্যতা অনুভব করে। এক বৃষ্টির রাতে সেই ঘটনা না ঘটলে আজ এই বাড়িতেও একটা মেয়ে থাকতো, সে বেচে আছে কিনা কেউ জানে না। পরেরদিন সকালে,
কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো ঘড়ি পড়ে বেড়িয়ে গেলো শ্রাবন। ছেলে হয়েও এতোই সুন্দর যেনো কেউ চোখ ফেরাতে পারবে না, শত মেয়ের ক্রাশ সেই কলেজ লাইফ থেকেই। গালের খোচাখোচা চাপদাড়িতে যেনো তার মুখের মায়াবীভাব বাড়িয়ে দিয়েছে।
🍂
দুদিন পর মেঘা খুব তাড়াতাড়ি কলেজে গিয়েছে, তার কলিজার টুকরো বান্ধবো নিশি খানের সাথে সবকিছু শেয়ার না করা অবধি তার শান্তি হচ্ছে না। এই দুদিন শরীর ব্যাথায় কলেজ আসতে পারেনি, আসতে চেয়েছিলো তবে জ্বরে আসতে পারেনি। গিয়ে দেখে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে অপেক্ষা করছে নিশি। গিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরলো মেঘা, উড়না সরে যাওয়ায় গলার দাগটি স্পষ্ট দেখা গেলো। নিশি আতকে উঠে বললো,
” মেঘা! আবারও কি তোর বাবা তোকে মেরেছে? ”
মেঘা ফুপিয়ে উঠে সবকিছুই খুলে বলে। সব শুনে নিশি ভাবে একটা মানুষ কিভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়! বাড়িতে ফিরতেই জসিম মিয়া মেঘাকে বলে,
” এইযে মহারানী, দুদিন পর আপনার বিয়ে। নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। আর একটা কথা মাথায় রাখিস মেঘা, যদি একটুও উলটা পালটা কিছু করেছিস তাহলে তোর কপালে দু:খ আছে৷ তুই কি তোর মা বাবার ম/রা মুখ দেখতে চাস? যদি না চাস, চুপচাপ বিয়েটা করে নে। ”
মেঘা ঘৃণায় কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো। মেঘাদের বাসার পাশেই রূপসা নদী। শান বাধানো একটি ঘাট ও রয়েছে, মেঘা সেখানে গিয়ে বসলো। মন খারাপ হলেই মেঘা এখানে বসে। এদিকে শ্রাবন গ্রাম ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক মেয়েকে দেখে তার চোখ আটকে যায়, কালো রঙের কুর্তিতে ফর্সা শরীরে এতোটাই যে সুন্দর লাগছে যা বলার বাহিরে। ফোন বের করে মুহূর্তটিকে ক্যামেরাবন্দী করে নিলো শ্রাবন। মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ বসের কল এলো, বিরক্তিতে ‘ চ ‘ শব্দ করে ফোনটা নিয়ে চলে গেলো কথা বলতে বলতে। এদিকে, হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মেঘা তাকিয়ে দেখলো রাজ রায়হান বসে আছে। মেঘা চুপ করেই আবারও আনমনে তাকিয়ে রইলো। রাজের কিছুটা খটকা লাগলো, কারন যেই মেয়ে তাকে পেলে সারাক্ষন বকবক করে তার মাথা খারাপ করে দেয় সে আজ চুপ। তাই নিরবতা ভেঙে রাজ বলে উঠলো,
” কিরে মেঘরানী, আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে? তুই আজ এতো চুপ যে? তোর বাবা কিছু করেছে নাকি? ”
মেঘা একপলক তাকিয়ে সব ঘটনা খুলে বললো, এই ব্যক্তিটি তার হয়ে অনেক লড়াই করেছে। ভরসার জায়গা, যার সাথে মন খুলে সব শেয়ার করা যায় চোখ বন্ধ করেই। সব শেষে মেঘা বললো,
” দুদিন পর আমার বিয়ে রাজ ভাই। শান চৌধুরীর সাথে, তোমার দাওয়াত রইলো। তবে আমার বিয়ের নয়, আমার জানাযার। আসবে কিন্তু ”
মুহূর্তেই রাজের চোখ লাল হয়ে গেলো রাগে, থা/প্প/ড় মা/র/তে নিলেও মারলো না। তবে কড়া গলায় বললো,
” আর কখনো যদি এমন শুনি, তাহলে বুঝবি মেঘা। তোর কিভাবে মনে হলো যে এই রাজ থাকতে তোকে ওই জা** এর সাথে বিয়ে হতে দেবে? বিশ্বাস নেই আমার উপর? ”
এমন ভরসার কথা শুনে মেঘার চোখ জ্বলে উঠলো। রাজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এমন সময় শ্রাবন সেদিক দিয়ে ফিরছিলো। এমন কিছু চোখের সামনে দেখে রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠলো। জীবনে প্রথম যাকে ভালো লেগেছে, তার সাথে অন্য কাউকে দেখলে কারোই ভালো লাগবে না। কিছুক্ষন সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মেঘা উঠে যাওয়ার পর, রাজ যখন চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তখন তার পথ আটকায় শ্রাবন। বলে উঠে,
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, মেয়েটি আপনার কে হয়? ”
রাজ বললও,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, কোন মেয়েটি? মেঘা? ”
শ্রাবন ভাবলো বাহ, মেয়েটির নাম তাহলে মেঘা। যেমন নাম তেমন তার রূপ। আমার নামের সাথে মিল আছে, তবে এই নামটা যে তার খুব একজন কাছের মানুষের। শ্রাবন বললো,
” জ্বী ”
রাজ বলে উঠলো,
” মেঘা আমার ব,,”
চলবে,
গল্পের নাম : #শ্রাবনের_মেঘ
লেখিকা : ফারিয়া
সূচনা পর্ব
{