সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৪.
বাগানে যে শুধু বিদেশীফুল দিয়ে সারি বানানো তা কিন্তু নয়।নামকরা গুটিকয়েক দেশী ফুলও দেখতে পাওয়া যায়।সাদা আর হলুদ গোলাপ নজরে পড়লো সবার আগে।তাছাড়া রজনীগন্ধা, বেলি,জুঁই ও আছে।বিদেশী ফুল রেখে শাওন দেশী ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।দেশী ফুলে আলাদা অনুভূতি জমা আছে।তাদের ছুঁতে আপন আপন ভাব আসে যেটা বিদেশীগুলো থেকে আসেনা।
তার মানে নিশ্চয় মিঃ রেদোয়ান এখান থেকেই ফুল তুলে নিয়ে ফুলদানিতে রাখতেন।তিনি বড়ই সৌখিন মানুষ ছিলেন।তার ওয়াইফ ও নিশ্চয় সৌখিন ছিলেন?কারণ একজনের পক্ষে প্রতিটাদিন শখের জিনিসের এত যত্ন নেওয়া সম্ভব না।মালি ছিল না।নিজ হাতে এই বিরাট বাগান সামলাতেন।
যতদূর জানি তাদের কুক অনলি একজন ছিল।আশ্চর্যকথা!এতবড় কোটিপতি একটা মানুষের কুক মাত্র একজন?তাও সে এই মূহুর্তে নিরুদ্দেশ। অন্তিক স্যার জেনেবুঝে এরকম পোঁচানো একটা কেস আমাদের ঘাড়ে ফেললেন।কুক মালিককে খুন করার সাহস দেখাবে না।তবে সে পালিয়ে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে।ধরা পড়লে পিঠে কয়েক ঘা পড়বে।সেগুলো আমি দেবো।গরুটা থাকলে অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যেতো এতক্ষণে।পালিয়ে আমাদের কাজ বাড়ালো।”
শাওন এবার তার হাতের ফুলটার গাছ খুঁজছে হেঁটে হেঁটে।সবার শেষের সারিতে এসে অবশেষে দেখা পেলো হোয়াট এগরেট ফ্লাওয়ারের।ধবধবে সাদা এই ফুলের পাপড়িগুলোর মাথার দিকে নকশার মতন খাঁজ কাঁটা।
-‘দারুণ!ভাবলাম মিসিং ফুলদানির ফুল পেয়ে গেলাম।কিন্তু আফসোস তা পেলাম না।এখানে দেখি অর্কিড,জার্বেরা,ল্যাভেন্ডার, গ্লাডিওলাস,আইরিশ সহ আরও অনেক বিদেশী ফুলগাছ আছে।মিসিং ফুলদানিটা খুঁজে পেতে হবে তো।!’
মেধা কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে বললো,’শাওন স্যার আমি আপনাকে ফুলদানিটা খুঁজে দেই?’
শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’আমার থেকে দূরে থাকো।তোমাকে বললাম না ডিস্টার্ব করবা না।নুহাশের কাছে যাও।দেখতে হসপিটাল থেকে পালানো রোগীদের মতন লাগছে, উনি নাকি আমাদের অফিসের নতুন অফিসার!’
মেধা মন খারাপ করে চলে আসলো নুহাশের কাছে।নুহাশ আর নিতু মজা করছিল একটা ঘটনা নিয়ে।রায়হান নাকি ফুলদানিটা একা উঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ আধ ঘন্টা ধরে।
মেধা ওদের হাসিঠাট্টাতে অংশগ্রহণ না করে সোজা রেদোয়ানের রুমে এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে।রুমটার মাঝখানটায় বড়সড় একটা বিছানা পাতা।তার দুপাশে সবুজ রঙের ফুলদানি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জায়গা দখল করে।এই লোকটা ফুলদানি বলতে পাগল ছিল মনে হয়।বেডরুমে কেউ ফুলদানি রাখে?এসবের ভেতরেও টাকা নেই তো?
বারান্দা থেকে পুলের ভিউ আসে।নিচে একটা ছোটখাটো পুল আছে।সেটা ভালো করে না দেখেই মেধা অন্য কাজে আসলো।
আলমারিটা খুলতেই একটা হাতুড়ি গিয়ে সোজা পড়লো ওর পায়ে।ব্যাথা পেয়ে দুম করে নিচে বসে পড়লো সে।পা ধরে বললো,’লোকটা মরেও শান্তি দিলো না হাতুড়ি কেউ আলমারিতে রাখে?আশ্চর্য!’
হাতুড়ি পড়ে মেধার পা অর্ধেক অবশ হয়ে গেছে।উঠার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ।এই পুরো বাড়িটা কুফাতে পরিণত হয়েছে মনে হয়।অনেক কষ্টে শেষে উঠতে পারলো সে।হাতুড়িটা আলমারিতে রাখতে গিয়ে দেখতে পেলো তাতে রক্তের দাগ।তাও শুকিয়ে আছে।জোর গলায় নুহাশকে ডাক দিলো সে।তার বদলে আসলো রায়হান।
রক্ত দেখে সে সোজা শাওনের কাছে চলে গেছে।মেধা আলমারির জামাকাপড় সব সরাতে গিয়ে হাতুড়ির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব লোহা তামার জিনিস পেলো।স্ক্রু ডাইভার ও কেউ জামা কাপড়ের সঙ্গে রাখে?
শাওন হাতুড়িটাকে ল্যাবে পাঠিয়ে রেদোয়ানের রুমে আসলো পুনরায়।মেধা আলমারি দেখছে নিজে অর্ধেক ভেতরে ঢুকে।শাওন ওকে সরিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,’তোমার গ্লাভস কই?’
মেধা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলে কি আমাকেও ধরে নিয়ে যাবেন নাকি?আর যদি পান ও,সেটা স্কিপ করবেন।সিম্পল ‘
-‘তার চেয়ে ভালো হবে তুমি গ্লাভস পড়লে।এটা নিয়ম।এত বার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করার ঝামেলা থাকবেনা তাহলে’
—-
এক এক করে সব ধাতু পাতের সরঞ্জাম একসাথ করেছে রায়হান আর নুহাশ মিলে।সবার মুখ ফ্যাকাসে।সব গুলো সরঞ্জামে রক্ত লেগে আছে।এগুলো দিয়ে কাকে টর্চার করা হতো?আর কেন?’
ময়নাতদন্তের রেসাল্ট আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে।আজকের জন্য কাজ শেষ।যে যার বাসায় ফিরছে।
শাওন ও বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।মেধা রেদোয়ানের বেডরুমের আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আয়নাটা ছুঁয়ে দেখে ভয় পেয়ে ছুটে চলো গেলো।পায়ে হালকা ব্যাথা বলে ছুটতে চেয়েও অর্ধেক পথে গিয়ে আস্তে হাঁটতে হলো তাকে।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রেদোয়ানের বাসা থেকে বের হবার পর যে রোডটার মুখোমুখি হতে হয় সেটা বড় রাস্তার মোড়।গাড়ী গোড়ার অভাব নেই।খুব সহজেই একটা রিকশা পেয়ে গেছে মেধা।শাওন তার প্রাইভেট কার ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছে।আজিমপুরের বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে একটি ভবনের আটতম তলায় সে থাকে।তার পুরো পরিবারকে নিয়ে।বাবা,মা আর ছোট দুটো বোনকে নিয়ে।গাড়ী পার্ক করে লিফটে ঢুকলো সে।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পাশে তাকিয়ে একজনকে দেখে মুখে হাসি ফুটলো ওর।তার পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রশ্নি।
শাওন ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,’তা ম্যাম আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
-‘উহু’
শাওন হাত ভাঁজ করে বললো,’পারফেক্টলি বলো’
রশ্নি ভ্রু কুঁচকে পিছিয়ে গিয়ে বললো,’রাগ হলো একটুখানি।তবে সেটা চলে যাবে।সমস্যা না।যদি শাওন স্যার আমার চুলে বেনি করে দেন তো!’
শাওন নাথা নাড়িয়প বললো,’যথা আজ্ঞা’
——
অষ্টম তলা আসতেই লিফট খুলে গেলো।শাওন রশ্নির দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে এসে কলিংবেলে চাপ দিলো।ওর বড় বোন তৃনা এসে দরজা খুলেছে।শাওন ওর মাথায় হালকা পাতলা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,’কি অবস্থা বিয়ের কনে?’
-‘এই তোর আসার সময় হলো?আমি না বললাম আজ তোকে নিয়ে শপিংয়ে যাব?’
-‘আজকে না।আমি অনেক টায়ার্ড ‘
কথাটা বলে গিয়ে কাঁচের ডাইনিং টেবিলটার পাশে চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢালছে শাওন।তৃনা কোমড়ে হাত দিয়ে এদিকে এসে বললো,’সমস্যা কি??কিসের এত টায়ার্ড তুই?সারাদিন কাজ আর কাজ।যখন আমি বিয়ে করে চলে যাব তখন বুঝবি আমি কি ছিলাম’
-‘এই যে আপা শোনেন!!আপনার শ্বশুর বাড়ি বেশি দূরে না।
প্রতিদিন গিয়ে একবার করে দেখে আসতে পারবো।এত সেন্টি খাওয়ার কিছু নেই’
তৃনা মুখ বাঁকিয়ে ওর জন্য চা বানাতে চলে গেছে।শাওন দরজার কাছে এসে রশ্নির হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে এসে দরজা লাগালো।তারপর সোজা নিয়ে গেলো নিজের রুমে।
—-
-‘ম্যাম আপনি বসুন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি’
রশ্নি মাথা নাড়ালো।শাওন তোয়ালে হাতে চলে গেছে।
তৃনা চায়ের কাপ হাতে পাক্কা দশ মিনিট পর শাওনের রুমে আসলো।দরজায় নক না করেই ঢুকতেছে সে।শাওন বসে বসে রশ্নির চুলে বেনি করে দিচ্ছিলো।রশ্নি নিচে কার্পেটে বসে আছে গোল হয়ে আর আর শাওন বিছানায় বসে আছে।দুজনের মুখেই হাসি আর কত আড্ডা!
শাওনের রুমে ইয়েলো টোনের আলো জ্বলছে।বারান্দায় লাল, নীল, সবুজ, হলুদের ছোটবড় লাইট ঝুলছে।লম্বা বাতাসে টবে ঝুলন্ত ফুলগাছগুলো দুলছে।শাওন বেনি টান দিয়ে বললো,’টব দুলছে বাতাসে।তুমি কিসের জন্য দুলছো?’
রশ্নি মাথা বাঁকিয়ে বললো,’আমি দুলছি শাওনের কেয়ারিংয়ে’
-‘শাওন শুনছিস?’
শাওন চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তৃনা আপু হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে। সে উঠে গিয়ে তৃনার হাত থেকে কাপটা নিয়ে বললো,’মা কোথায়?’
-‘তার রুমে’
শাওনকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না তৃনা।সোজা হেঁটে মায়ের রুমে চলে গেছে সে।মা তখন একটা নামকরা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন বিছানায় বসে বসে।তৃনা ছুটে এসে বললো,”মা কিছু একটা করো’
মা মাথা তুলে বললেন,’কেন?কি হলো আবার?’
-‘শাওনকে এই ঘটনাটা থেকে বের করো মা।আর কতদিন এটা চলবে?’
মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ম্যাগাজিনটা গুছিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,’মানুষের দেহের চিকিৎসা হয়।কিন্তু মনের না।ওকে নামিদামি ডাক্তার দেখিয়ে কি লাভ হলো আমাদের?সেই তো অফিস থেকে ফিরে সারা রাত ধরে গল্প করে রশ্নিকে নিয়ে।আফসোস হয়।রশ্নিকে আমরা কেন দেখিনা।’
তৃনা মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,’যে ওকে পাগলের মতন ভালোবাসতো সেই তো ওকে দেখার সৌভাগ্যটা পেয়েছে’
-‘এটা সৌভাগ্য না তৃনা।এটা একটা রোগ।চেয়েও কিছু করতে পারছিনা আমরা।’
—–
-‘চলো রশ্নি! আমরা বিয়ে করে ফেলি।আমাদের সংসার হবে।বাচ্চাকাচ্চা হবে।আর কত অপেক্ষা করবো বলো?বয়স তো কম হলোনা’
রশ্নি চুল ঠিক করে উঠে বারান্দায় চলে গেছে।শাওন ওর পিছু পিছু এসে পা উঁচু করে উপরের ঝুলন্ত টবটা থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে বললো,’আর কত পালাবে?বিয়ের কথা বললেই পালাও কেন বলোতো?’
কথা শেষ করে শাওন ওর কানে ফুলটা গুঁজে দিতে যেতেই ফুল গড়িয়ে ফ্লোরের উপর পড়ে গেলো।শাওনের চোখে সাথে সাথে পানি চলে এসেছে।রশ্নি হাত দিয়ে ওর মুখ স্পর্শ করে বললো,’প্লিজ এই সামান্য বিষয় নিয়ে এখন কাঁদবেনা’
শাওন রশ্নির হাত ধরে বললো,’আমি তোমায় ছুঁতে পারলে ফুল কেন তোমায় ছুঁতে পারেনা?’
চলবে♥
Afnan Lara