সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৬.
সোফায় বসে খবরের কাগজের পাতা ভাঁজ করছেন বাবা।চোখ মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।এমনটা ঠিক তখনই হয় যখন বাবা মনে মনে পাহাড় পর্বত সমান চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন।তার একদম পাশেই ইয়া লম্বা এক বারান্দা।বাতাসে মন ভালো হয়ে যায় বলে তিনি এ সময়টাতে এসি বন্ধ রাখেন।তার মতে প্রাকৃতিক সবকিছু উপভোগ করতে হলে যান্ত্রিক সবকিছুকে বন্ধ রেখে দিতে হয় তা নাহলে প্রকৃতির স্বাদ মেটে না ভালোমতন।
মেধা দরজা জানালা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে।কাল ঐ তিনটেকে জায়গা মতন রাখতে রফাদফা হয়ে গিয়েছিলো।অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে হয়েছিল তাকে।বাসায় ফিরে মাকে হাজার রিকুয়েস্ট করেও দমাতে পারেনি। খবরটা মা বাবার কানে পৌঁছেই দিয়েছেন শেষে।
মৌমিতা স্কুলে যাবে বলে তৈরি হয়ে দুটো বেনি ঝুলিয়ে পা দুলাচ্ছে বাবার পাশে বসে।বাবা নাস্তা সেরে ওকে নিয়ে বের হবেন।প্রতিদিন ওকে সাথে নিয়েই বের হোন তিনি।তার অফিসের আগেই মৌমিতার স্কুল পড়ে।
সেসময়ে মা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললেন,’আমি কিছু শুনতে চাইনা।তুমি মেধার সঙ্গে কথা বলবেই বলবে।বুঝতে পারছো তুমি?আমার কপালে বন্দুক ধরেছিল।কত বড় সাহস।কি না কি হয়ে যেতো!আমাকে আর মৌমিতাকে রুমে বন্দি করে রেখেছিল।ইশ!মনে করতেই গা গুলিয়ে আসছে আমার।না আমি কিছু শুনতে চাইনা।মেধার সঙ্গে তুমি আজই এই বিষয় নিয়ে কথা বলবে।একজন পুলিশ অফিসারের বউ হয়েছি আর ক্রাইম ব্রাঞ্চে কর্মরত মেয়ের মা হয়ে বলে কি আমায় রোজ রোজ এসবের সম্মুখীন হতে হবে?আমার ছোট মেয়েটার কি দিন এমনেই চলবে?কাল সারারাত ওর বিক ধুকধুক করছিলো।আমি ওকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।তোমার মেয়েকে বলো চাকরি ছাড়তে।ভালো, বিদেশে চাকরি করে এমন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।আমাদের কাছে থাকলে ওর শত্রু সব রোজ এসে এসে ভেঁংচি দিয়ে যাবে।এই টুকুন মেয়ের শত্রুর অভাব নেই।তোমাকে কি বলছি শুনছো?’
বাবা খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে বললেন,’হ্যাঁ শুনছি।মেধার উত্তর কি হবে তাও জানি আমি।সে পরামর্শ দেবে, আমরা যেন বাসা পাল্টে দূরে কোথাও গিয়ে থাকি।আর আমার বড় মেয়েকে একা রেখে অন্য কোথাও থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।কিন্তু সে প্রতিউত্তরে এই সাজেশনটাই দেবে।’
মা রুটি ছেঁকার খুন্তি নিয়ে তেড়ে এসে বললেন,’সেটাই ভালো।আমি জানি তোমার ঐ সাহসী মেয়ে বিপদে পড়েও বেঁচে যাবে।কিন্তু আমি?আমার ছোট মেয়েটা?আমরা না পারি মারামারি আর না আমাদের কাছে সবসময় বন্দুক থাকে আত্নরক্ষার জন্য।আমাদের কি হবে?নাহয় তোমরা আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।কিন্তু এই যে কদিন বাদেই বন্দুকের মুখোমুখি হতে হয় সেটাতে তো একদিন না একদিন হার্ট এটাক হয়েই বসবে’
-‘মিতুল থামো একটু।আচ্ছা ঠিক আছে,আমি মেধার সঙ্গে আলাপ করবো এই নিয়ে।তুমি জলদি খাবার তৈরি করো।আমার দেরি হচ্ছে।’
-‘বাবা আমার ও তো দেরি হচ্ছে’
-‘জানি তো আম্মু।’
_____
মেধা ঘুম থেকে উঠছেনা দেখে বাবা নাস্তা সেরে মৌমিতাকে নিয়ে চলে গেছেন।ঠিক দশটার দিকে মেধার ফোনে কল আসলো। ঝাপসা চোখে ফোন হাতিয়ে খুঁজে বের করে কানে ধরলো সে।
ওপাশ থেকে কর্কশ আওয়াজে একটা ধমক শুনতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে।শাওনের কল এটা।
-‘সরি স্যার।আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম কাল থেকে অফিসে জয়েন হয়েছি।’
শাওন কল কেটে দিয়েছে ততক্ষণে।অফিসে সবাই এসেছে অথচ মেধাই আসেনি।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর।
নুহাশ কফির মগ নিচ্ছিল রহিমের হাত থেকে।নিতু টেবিলে মাথা রেখে বললো,’আজকেও কি রেদোয়ানের বাসায় যেতে হবে?’
-‘তা নয়ত কি?শাওন খুব ক্ষেঁপে আছে আজ সকাল থেকে।কে জানে কি হলো।মনে হয় আজই খুনির গলা চেপে ধরবে’
-“ক্ষেঁপার কারণ মনে হচ্ছে মেধা।সে এখনও অফিসে ঢোকেনি।দশটা বেজে গেলো।’
শাওন তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললো,’তোমরা সবাই রওনা হও।
আমি গিয়াস স্যারকে সাথে নিয়ে আসবো।তোমরা গিয়ে বাকি যা কিছু ইনভেস্টিগেট করার তা করতে থাকো’
নুহাশ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’খাবে?’
-‘নাহ।মুড নেই।তোমরা খাও’
_____
শাওন তার কেবিনে ঢোকার দু মিনিট পর মেধা এসে হাজির।টাই ঠিক করতে করতে নিতুর সামনে এসে দাঁড়ালো সে
নিতু ব্রু উঁচু করে বললো,’চুলের এই হাল কেন?চোখ মুখের ওমন অবস্থা কেন?ঘুম থেকে কখন উঠেছো?’
-‘দশ মিনিট আগে।ছুটে এলাম।রেডি হবার টাইমটুকু পাইনি।
শ্যাওলা স্যার,সরি আই মিন শাওন স্যার যে ধমক দিলো আমায়’
নিতু হাসতে হাসতে বললো,’আরও ধমক ওয়েট করছে।যাও ভেতরে’
মেধা মাথার চুল হাত দিয়ে মিহিন করতে করতে ভেতরে গেলো।শাওন টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।চোখ দূরের একটা লেকের দিকে।ওর কেবিন থেকে লেকটা স্পষ্ট দেখা যায়।মেধা ঢোক গিলে এই নিয়ে দুবার জিজ্ঞেস করেছে ভেতরে আসবে কিনা।শাওন তৃতীয় বারের সময় পেছনে ফিরলো।মেধা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে
-‘ইউ নো হোয়াট?তোমার মাঝে আমি মেধা বাদে বাকিসব দেখি।লেট,স্লো,উইক,শাই, এ্যাটসেটরা!’
মেধা চোরের মতন দাঁড়িয়ে শাওনের বকা শুনছে
শাওন টেবিলের উপর ঠাস করে হাত রেখে বললো,’আর একদিন লেট করলে চাকরি খাবো তোমার।’
মেধা এক দৌড়ে পালালো।অফিস রুমে এসে দেখলো কেউ নেই।
শাওন তার ফোন পকেটে ঢুকিয়ে সেও বেরিয়ে একই কাহিনী দেখলো।কোথাও কেউ নেই।ফোনটা আবার বের করে গিয়াস স্যারকে কল করলো।
-‘হ্যালো শাওন।হ্যাঁ বলো কি হয়েছে?’
-‘স্যার আপনি কোথায়?আমার তো আপনার সঙ্গে রেদোয়ানের বাসায় যাবার কথা ছিল আজ।নুহাশ,রায়হান আর নিতুকেও তো দেখছিনা’
-“আরে ওরা আমার সাথে।আমরা অলরেডি রওনা দিয়ে ফেলেছি’
-‘মানে!’
-‘তুমি মেধাকে নিয়ে এসো।এতদূর তো সে একা আসতে পারবেনা।টিমের সবাই একসাথে আসা যাওয়ায় মেতে থাকাই ভালো।তাছাড়া তোমার আর ওর বোঝাপড়ায় কমতি পরিলক্ষিত।আমি চাই সেটার সংখ্যা শূন্য হোক।’
শাওন ফোন রেখে মেধার দিকে তাকালো।মেধা চেয়ারের উপর পা তুলে গোল হয়ে বসে কফি খাচ্ছিলো।শাওন আরেকটা ধমক দিয়ে বললো,’আমার সাথে চলো রেদোয়ানের বাড়ি যাবে।গিয়াস স্যারের অর্ডার এটা।নাহলে আমার শখ নাই ভীতুর ডিমকে আমার সাথে নিয়ে যাবার’
মেধা জলদি করে কফিটা শেষ করে ছুটলো শাওনের পিছু পিছু।শাওন কারে ড্রাইভিং সিটে বসেই দেখলো মেধা ওর পাশের সিটের দরজা খুলেছে বসবে বলে’
শাওন থামতে বললো ওকে।
-‘ওখানে না।পেছনে বসো।’
মেধা মুখ বাঁকিয়ে কারের পেছনের সিটে বসলো।শাওন ড্রাইভ করতে করতে ওর পাশের সিটটার দিকে তাকাচ্ছে।এমন ভাব করছে যেন কেউ বসে আছে সেখানে।মেধা একশোবার মাথা সামনে এনে দেখেছে তাও কাউকে দেখেনি তার পরেও শাওন এতবার ওদিকে তাকাচ্ছে কেন?গিলুটিলু আছে নাকি এই লোকটার মাথায়??
একটা সময় কি নিয়ে শাওন হাসতে গিয়ে কার থামিয়ে ফেললো আর একটুর জন্য একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে যেতো।
মেধা সামনের সিটের সঙ্গে দুম করে বাড়ি খেয়ে এখন কপাল ঘষছে।শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’কি হয়েছে তোমার?’
মেধা কথা বলছেনা।শুধু কপাল ঘষছে।শাওন আরেকটা ধমক দিয়ে ওর কপাল থেকে হাত সরালো।ব্যান্ডেজের উপরিভাগে লাল আবরণ হয়ে গেছে রক্তের।কালকের ক্ষতে আবারও চোট পেয়েছে সে।আচ্ছা এই মেয়েটা চোট ছাড়া আর কিছু পেতে পারেনা?দেখা হবার পর থেকে দেখতেছি কালি চোটই পাচ্ছে।এর নাম মেধা না হয়ে ব্যাথা হওয়া উচিত ছিল।’
শাওন পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে ওর কপালে লাগিয়ে ধরে বললো,’চেপে ধরে রাখো।কারে বসে সিট বেল্ট লাগাতে হয় জানোনা?এখন দোষ তো আমার দিবা’
-‘অবশ্যই দোষ আপনার।এই সিটের সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েই তো আর একটুর জন্য এক্সিডেন্ট করে বসতেন।আপনি তো মরতেন না,আপনার সিট ও মরতো না,ফাঁক দিয়ে আমি মরতাম।আমার হবু বর বিয়ের আগেই হবু বউহীনতা রোগে ভুগতো।’
-‘সিটের সাথে প্রেম মানে?হোয়াট ননসেন্স! ‘
-‘তা নয়ত কি।আমাকে এই সিটে বসতে দিলেন না।সেই কখন থেকে খেয়াল করছি।সিটটাকে দেখেই যাচ্ছেন।পারছেন না নিজের সিট রেখে উঠে এই সিটকে জড়িয়ে ধরছেন আবার হাসাহাসিও করছেন।এগুলো প্রেম না তো কি ছেলেখেলা?’
শাওন মাথা ঘুরিয়ে বসে গাড়ী স্টার্ট করলো।সমস্যা হলো গাড়ী স্টার্ট হচ্ছেনা।মেধা দাঁত কেলিয়ে শাওনের চেষ্টা করা দেখছে।শাওন অনেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে মেধার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে নামলো গাড়ী থেকে।মেধাও নামলো।ফাঁকা রাস্তায় এসে গাড়ী নষ্ট হলো।একটা মানুষ তো দূরে থাক কাকপক্ষী ও নেই।সবুজ আর সবুজ মাঝো নীল রাস্তা,আর দুপাশে জঙ্গল আর সেখানে নষ্ট গাড়ী।কি সুন্দর না?
কথাটা আস্তেই বললো মেধা।শাওন খেয়াল করেনি।সে গাড়ীর সামনে গিয়ে পিটাপিটি করছে।রিমোট বাড়ি দিলে রিমোট ঠিক হয়ে যায়,গাড়ী বাড়ি দিলে গাড়ী ঠিক হয় কিনা তারই এক্সপেরিমেন্ট করছে শাওন।মেধা শাওনের পাশের সিটটা জানালার এপারে থেকে দেখছে দৃঢ় দৃষ্টিতে।
-‘কিছুই তো নাই।লোকটা যেভাবে তাকাচ্ছিল যেন এই সিটে বিশ্বসুন্দরী একজন বসে ছিল।আমি তো কিছুই দেখিনা।ধ্যাত!
এই যে স্যার!আর কতদূর??আই মিন হেঁটে যেতে হবে নাকি?’
-‘যাও হেঁটে।তুমি না গেলে তো রেদোয়ানের কেস সলভ্ই হবেনা’
মেধা দাঁত কেলিয়ে বললো,’একদম সত্যি কথা’
চলবে♥