সঞ্চারিণী পর্ব -০৭

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

৭.
প্রায় মিনিট দশেক ধরে শাওন চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে গাড়ীকে রিস্টার্ট করতে।মেধা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে মাঝখানে বসে আছে গালে হাত দিয়ে।মাঝে মাঝে ফোন নিয়ে টুপ করে পাঁচ ছটা ছবি তুলে ফোন আবার রেখেও দিচ্ছে।তাও শাওনের মেকানিক হওয়ার ইচ্ছার লিমিট শেষ হয়না।লোকটার ধৈর্য্য আছে বলতে হবে।
সেলফি তোলার পর্ব শেষ করে মেধা খেয়াল করলো শাওন তাকে ফেলে সোজা হাঁটা ধরেছে।সেটা দেখে তাড়াহুড়ো করে সেও চললো ওর পিছু পিছু।শাওনের হাঁটার গতির সঙ্গে মেধা পার পাচ্ছেনা।থামলেই দেখে শাওন বহুদূরে।ওর কাছাকাছি যেতে পারা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠেছে।কিন্তু শাওনের এদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।হাতের ঘড়িটা বারবার দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছে সে।

-‘একটু থামুন না।পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার’

শাওন হাঁটতে হাঁটতে বললো,’অনেকটা পথ বাকি।প্রায় ৫কিলোমিটার।এই পুরো রাস্তায় একটা ফিলিং স্টেশন ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বেনা।বসে বসে সময় নষ্ট করে কাজ নেই।’

মেধা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আজকেই কেস ক্লোজ করবেন নাকি?বাপরে আপনার এত মেধা?’

শাওন কিছু বললো না।বরং হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো।মেধা হাঁপাতে হাঁপাতে পুনরায় রোডে বসে পড়েছে।
শাওন কিছুদূর গিয়ে থামলো।এবার সে নিজেও হাঁপিয়ে গেছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে মেধার দিকে তাকালো সে।
মেধা রাস্তায় বসে পা ধরে টিপছে।একে তো হাত ব্যাথা,কপাল ব্যথা সাথে এখন পা ব্যাথা।এই চাকরি করে আর কত কি সহ্য করতে হবে কে জানে।তারপর এই তার ছেঁড়া মার্কা সিনিয়র একজন কপালে জুটেছে।তিনি আমাকে নিজের মতন মনে করেন।আরে মেয়েদের শরীর হলো তুলোর মতন নরম।এদের আগলে রাখতে হয়।চরকার মতন ঘুরালে হয়?আমাকে পানি পাইছে।যে জায়গায় দেবে সেই জায়গায় মিশে যেতে হবে।নিজে তো তেল।তেলে আর জলে কি জীবনে মেশে?
হুহ!!মন চায় কোদাল দিয়ে সব শ্যাওলা উঠিয়ে ফেলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলি।’

শাওন একটা মাইক্রো দেখতে পেলো একদম দূর থেকে আসছে মনে হয়।মুচকি এসে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সে
ওর এমন দাঁত কেলানো দেখে মেধাও তাকালো।মাইক্রো দেখে মেধাও হেসে ফেলেছে।
শাওনের ইশারায় মাইক্রোটা থামলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো সেখানে শুধুমাত্র একটা সিট খালি আছে।মাইক্রোটা বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিল।বরযাত্রী নিয়ে।মানুষে গিজগিজ করছে তাও তারা ঠেসে ঠেসে একটা সিট খালি করতে পেরেছে ওদের জন্য।তার মাঝ থেকে মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা মশকরা করে বললেন,’সম্পর্কে বন্ধুই তো হও তোমরা তাইনা?বন্ধু বন্ধুকে কোলে নিতেই পারে।বসে পড়ো আর তোমার বন্ধুকে কোলে নিয়ে নাও।এসবে লজ্জার কি আছে?বিপদে পড়লে এত সাত পাঁচ ভাবতে হয়না।বুঝলে?’

শাওন পিছিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’ইম্পসিবল’

মেধা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’আপনার প্রেমিকা মানে ঐ সিটটা রাগ করবে বুঝি?একটা বুদ্ধি দেই?
আপনি আমাকে কোলে নিয়েন।আমি আপনার প্রেমিকাকে কোলে নেবো।ইজি’

-‘চুপ!আমি তোমায় কোলে কেন নেবো?কিরকম চিপ একটা ব্যাপার।ভাবতেই লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে।দরকার নেই।তার চেয়ে বরং হেঁটে যাব আমরা’

মাইক্রোটা চলে গেলো।মেধা দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটা ধরেছে আবার।শাওন এবার আস্তে আস্তে হাঁটছে।পথ শেষ হবার নাম নিচ্ছে না।যেন আরও বেড়েই চলেছে।বাঁকের পর বাঁক।মনে হয় এই বুঝি পথ শেষ হয়ে যাবে আর মৃত রেদোয়ানের বাড়ি নজরে আসবে।কিন্তু তা আর হচ্ছে কই?
বেশ অনেকদূর এসে একটা বাস দেখে মেধা লাফিয়ে উঠে বললো,’আমরা বাস পেয়ে গেছি।ইয়ে!!’

শাওন ভ্রু কুঁচকে বললো,’ডানে তাকাও’

মেধা ওর কথামতন ডানে তাকালো।এমা তাকিয়ে দেখলো রেদোয়ানের বাড়ির সামনে তারা।নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয়ে রেদোয়ানের বাড়িতে ঢুকলো সে।
গিয়াস রহিম বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ভাঙ্গা কাঁচের দেয়ালটা দেখছিলেন মনোযোগ দিয়ে।শাওন উনার পাশে এসে দাঁড়াতেই মুখ ঘুরিয়ে বললেন,’এত দেরি হলো কেন?’

-‘স্যার আমার কার নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।হেঁটে এলাম।নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না ফোনে।নাহলে কল করে এক্সট্রা গাড়ী ডেকে আনা যেতো’

-“ওহ।যাই হোক!এই দেয়ালটা দেখেছো?দুটো মানুষের মৃত্যু হলো অথচ এত বড় বাড়ির কোণায় কোণায় ভাঙ্গচুরের চিহ্ন।আদৌ দুজন মারা গেছে নাকি এর পেছনে আরও মৃত্যু আছে?’

-‘স্যার সেটা হলে এতদিনে আমরা লাশ পেয়ে যেতাম’

নুহাশ কাছে এসে বললো,’শাওন আমি রেদোয়ানের ফুফাতো ভাইকে হসপিটালে দেখতে যাচ্ছি।তার আসলেই ডায়রিয়া হয়েছে নাকি আমাশয় হয়েছে তার পরীক্ষা করতে’

-‘যাও।ভালো করে সিওর হবা।পারলে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিও।আর হ্যাঁ!মিসেস রেদোয়ানের বাবা আসার কথা না?তিনি কি এসেছেন?’

রায়হান বাড়ি থেকে বের হতে হতে বললো,’তিনি রেদোয়ানের গেস্ট হাউজে আছেন আপাতত ।চলো আমরা গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আসি।’

গিয়াস স্যার মেধাকেও পাঠালেন শাওনের সঙ্গে।
গেস্ট হাউজটা রেদোয়ানের বাড়ির ঠিক পেছনে।চার রুমের একটা গেস্ট হাউজ।দোতলা।নিচের তলায় দুই রুম,উপরের তলায় দুই রুম।রায়হান আফসোস করে বললো,’এরকম একটা বাড়ি ভাঁড়া দিলে মাসে যে টাকা আসতো ওটা দিয়ে আমার মাস কেটে যেতো অনায়াসেই।
বড়লোকদের ঢং দেখলে মন চায় আমি আজীবন গরীব থাকি’

নিচের তলায় ডাইনিং আর ড্রয়িং রুম আছে।সেখানে মিসেস রেদোয়ানের বাবাকে পেলো না ওরা তাই উপরের তলাতেই গেলো।সেখানে বেডরুমে মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন তিনি।শাওন তার সামনে বরাবর চেয়ার টেনে বসেছে চুপচাপ।
মেধা ড্রয়িং রুম ঘুরে ঘুরে দেখছে।সোফা আর টিভি ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে।সব জায়গায় ফুলদানির ছড়াছড়ি।এগুলো ছোট ছোট।ভেঙ্গে দেখতে হবে সোনা আছে নাকি রুপা।নাকি যহরত!
মনে রাখবে!কবি বলেছেন”যেখানে দেখিবে ছাই,উড়াইয়া দেখো তাই”
“পাইলেও পাইতে পারো,অমূল্য রতন”

আমি এখন এই ফুলদানি ভেঙ্গে দেখবো।মেধা আসলেই তোর অনেক মেধা তাই তো তোর এই নাম রেখেছে তোর ফ্যামিলি।
ধ্যাত!সব দেখি মাটি!টাকা পয়সা নাই কেন?
——-
রায়হান একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে লোকটাকে পরোক করছে।বয়স খুব বেশি মনে হয়।
কথা বলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।এক দৃষ্টিতে হাতের নীল রঙের আংটিটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।ধবধবে সাদা দাঁড়ি তার।যে মারা গেছে তার সাথে হুবুহু মিল। মেয়ে একেবারে তার বাবার মতনই হয়েছে তাহলে।
উনাকে করা শাওনের প্রথম প্রশ্ন ছিল উনি কেমন আছেন।জবাব দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন তিনি।একমাত্র মেয়ে আশাকে ছাড়া তার দুনিয়ায় আর কেউ ছিলনা।আর আজ তাকে হারিয়ে তিনি একেবারে একা হয়ে গেলেন।ফুলের মতন মেয়ে ছিল তার।
বারবার এই লাইনটাই বলে যাচ্ছেন তিনি।
শাওন নড়েচড়ে বসলো।শেষে উনার হাতটা ধরে বললো,’লাস্ট বার কবে কথা হয়েছিল আপনার মেয়ের সঙ্গে?’

-‘শুক্রবারে।’

-‘কি কি কথা হয়েছিলো বলতে পারবেন?’

-“ও ফোন ধরেই বলতো খেয়েছি কিনা।কাজের বুয়ার রান্না ভালো লাগে কিনা।তারপর আর কিছু বলেনি।জামাই নাকি ওরে ডাকছিলো।তাই কল কেটে দিয়ে চলে গেছে।এটাই শেষ কথা হবে কে জানতো!আমার মেয়ের মতন সহজ সরল কেউ ছিল না।বিশ্বাস করেন!!ওকে কে মারবে!যে মারার কথা সে তো….’

-“মানে?কি বললেন?কে মারার কথা?আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’

-‘হ্যাঁ।একমাত্র একজনকে সন্দেহ হয়।সে হলো রেদোয়ান।কিন্তু এখন তো সে নিজেই মারা গেছে।আমি আর কাকে দোষারোপ করবো?’

শাওন উঠে দাঁড়ালো।থুঁতনির নিচে দুই আঙ্গুল দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে দরজা খুলে বের হতেই মেধার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো ওর।
মেধা পড়েই যাচ্ছিল।ঠিক সময়ে নিজেই শাওনকে ঝাঁপটে ধরে ফেললো।ওকে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ির দিকে তাকালো ভয়ার্ত চোখে।শাওন ওর হাতটা নিজের শার্ট থেকে ছাড়িয়ো বললো,’এরকম চোরের মতন দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?’

-‘চোরের মতন দাঁড়াবো কেন?আমি তো ড্রয়িং রুম দেখে এদিকেই আসছিলাম।
আপনি সে সময়ে ঠাস করে দরজা খুললেন।কে জানতো আপনি এসময়ে দরজা খুলবেন?
আরও একবার আপনার কারণে আমি চোট পেতাম’

-‘তোমার এই হাতের চোট আমি দিই নাই।’

মেধার সাথে কথা না বাড়িয়ে শাওন আবারও আশার বাবার কাছে এসে বললো,’রেদোয়ান কি আপনার মেয়েকে অত্যাচার করত?’

-‘করত মানে!!আমি ওদের বিয়ের পর আমার মেয়েকে দুবার দেখেছিলাম।দুবারই ওর গায়ের দাগ দেখে আমার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছিলো।এত অত্যাচার মানুষ মানুষকে করতে পারে?’

-‘আপনি কেস করলেন না কেন?বা আপনার মেয়ে কখনও পুলিশকে জানায়নি এ ব্যাপারে?’

-‘সে অনেক কাহিনী।আমার ঔষুধের খরচপাতি সব রেদোয়ানই বহন করত।যার কারণে আশা এত কিছুর পরেও সব কষ্ট সহ্য করে আসছিল।আমি তো বাবা বুড়ো বয়সে পানি টুকু ঢেলে খাওয়ার শক্তি খুঁজে পাইনা।বয়সের এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি সব কিছু দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।’

শাওন দুহাতের আঙ্গুল একবার দাঁড় করাচ্ছে আবার নেতিয়ে ফেলছে।তারপর কি ভেবে বললো,’আশার কোনো বান্ধবী ছিল?মানে ধরুন সে রেদোয়ানের বাসায় আসা যাওয়া করত এমন।আশাকে অনেক কাছের ভাবত এমন?’

-‘রেদোয়ানের চরিত্র খারাপ ছিল।তবে আশার তেমন কোনো বান্ধবী নেই যে কিনা সোজা বাসায় আসবে।একজন আছে সে আমার বাসার পাশেই থাকে।সে এদিকে কখনও আসেনি’

-‘রেদোয়ানের ব্যাপার এসব কি আপনাকে আশা জানাতো?’

-“হ্যাঁ।সে ফোন করে আমাকে সব বলতো।আমি শুধু শুনতাম।বুক ফেটে কান্না আসতো মেয়ের কষ্টের কথা শুনে।কিন্তু কি করবো বলো আমার কিছুই করার ছিলনা।আশা আমাকে বলতো বাবা তুমি শুধু শুনবে।কিছু বলবেনা।আমি বুকে চাপা থাকা কষ্ট বলছি শুধু।তোমাকে কিছু করতে হবেনা।নাহলে তোমার মুখে ভাত তোলার অর্থ আমাকে আর রেদোয়ান দেবেনা’
চলবে♥
#Afnan_Lara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here