#সমাপ্তিতে_তুমি
পর্ব-০৭(শেষ)
লেখিকা-#খেয়া
কারো জীবন কারো জন্য জন্য থেমে থাকেনা।সময় চলছে তার আপন গতিতে।এবাড়িতে এসেছি আজ চারদিন।এখানকার মানুষগুলোকে আগের মতোই আপন লাগছে।তবুও মামনি বাবাইকে খুব মিস করছি।চারটে বছরতো তারা আমাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছে।আরহার সাথে প্রায়ই কথা হয়।সবার সাথে আগের মতো অনেকটা ফ্রি হতে পারলেও রুদ্ধর সাথে হতে পারিনি।
তবে আমার স্মৃতি ফেরা নিয়ে সবাই একটু চিন্তায় আছে।রুদ্ধ ভাইয়া আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছে।
—————-
রুদ্ধ ভাইয়ার সাথে ডাক্তারের কাছে এসেছি।গতকাল কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছিলাম।তার রিপোর্ট গুলোয় আজ দেখাতে এসেছি।ডাক্তার অনেকক্ষণ রিপোর্ট গুলো দেখার পর বললেন
—- দেখো রুদ্ধ, আমি রিপোর্ট গুলো দেখলাম।তবে স্মৃতি নষ্ট করার জন্য রাতকে যে মেডিসিনগুলো দেওয়া হয়েছিল তা যথেষ্ট পাওয়ারফুল এবং বেশ কড়া ডোজ দেওয়া হয়েছিল ওকে।যার ইফেক্ট এখনো রাতের মাঝে আছে।তাই এক্ষেত্রে ওর স্মৃতি ফেরার চান্সটা একদম কম।তবে ঠিকঠাক চিকিৎসা করালে হয়ত এটা সম্ভব হতেও পারে।
আমি এবার ডাক্তারকে বললাম
—-তবে ঐ স্বপ্নগুলো?
—-তোমার পুরোনো স্মৃতিগুলো তুমি ভুলে গেলেও সেগুলো তোমার ব্রেনে রয়েই গেছে।সেগুলো বারবার তোমার ব্রেন রিপ্লেস করতে চাইত বলেই তার যে রিফ্লেকশন সেটা তুমি দেখতে।
—- ওহহ।
আরো কিছু কথা বলে ওখান থেকে বাসায় চলে এলাম।
বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই রুদ্ধ ভাইয়া এসে বলল
—- রাত!আমি জানি তোর আগের কোনকিছুই তের মনে নেই।তোকে আমি কী প্রচন্ড পরিমান ভালোবাসতাম হয়ত তোর মনে নেই।কিন্তু তোকে যে আমার ভীষন দরকার রে।আমি আবার তোর সেই প্রিয় মানুষটা হতে চাই।তোকে ছাড়া যে আমার বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
—-আমার হয়ত আগের কিছু মনে নেই। তবে আমি মানুষটা অনুভূতিহীনও নই। আমি আগের সেই সবকিছু ফিল করতে পারি।
—- তবে এটা কেন বোঝোনা যে তোমাকে ছাড়া আমি প্রতিনিয়ত পুড়ছি।
মানুষ পোড়ার গন্ধ যে কতটা বাজে সেটা তুমি বুঝবেনা, রাতপাখি।মানুষ পোড়ার গন্ধটা যে বাতাসে ভাসেনা।সেটা যে অনুভব করতে হয়।অবশ্য এটা অনুভব করার ক্ষমতা তোমার নেই।
—-মানুষ পোঁড়ার গন্ধ বুঝি বাতাসে ভাসেনা?
—- না।যদি মানুষ পোড়ার গন্ধ বাতাসে ভাসতো তাহলে যে পৃথিবীও বাসের অযোগ্য হয়ে যেতো।
আর মানুষ পোঁড়ার গন্ধ যদি তুমি অনুভব করতে পারতে তাহলে যে তোমার বেঁচে থাকাও কষ্টকর হয়ে যেতো।কারন তোমার পাশের মানুষটাও যে প্রতিনিয়ত পুড়ছে।
—- আমার পাশের মানুষটাও যে মানুষ পোড়ার গন্ধটা উপলব্ধি করতে পারেনা।তা না হলে তো সেও বুঝতো যে তার আশে পাশের মানুষগুলো কী বাজে ভাবে পুড়ছে প্রতিনিয়ত।
—- তাই বুঝি রাতপাখি।তুমি এটা জানোনা যে তুমি নামক রোগটা যে তোমার পাশের মানুষটার প্রাণ নিয়ে নিয়েছে।সে মানুষটা যে আর বেঁচে নেই।আর মরা মানুষ যে কোনকিছু অনুভব করতে পারেনা।
—- কারো জন্য নিজেকে শেষ করে নিবেন না, রুদ্ধ সাহেব।মানুষের জীবন যে বড্ড দামী।অন্যের জন্য তা বিলিয়ে দিবেন না।নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন।
—- জানোতো গত চারবছর শুধু এই আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম যে হয়ত আমি আবার আমার রাতপাখিকে ফিরে পাবো।তাকে নিজের করে পাবো।আমার শুরুতে যে রাত ছিল।আমার সমাপ্তিতেও সেই রাতই থাকবে।
—-আপনার আমার সমাপ্তিটাতে মধুর নাও হতে পারে।
—- আবার কিন্তু তোমার আমার সমাপ্তিটা সুখেরও হতে পারে।
রুদ্ধ আর কিছু না বলই চলে গেলেন।আমিও নিচে গেলে গেলাম।
এইবাড়ির লোকগুলো আমার আপন হলেও আমার কাছে একদমই অচেনা।তবুও তারা আমাকে আগের মতো আপন করে নিয়েছে।এখানে এসে জেনেছি আমার বাবা- মা নাকি অনেক আগেই মারা গেছে।তবুও দীপ্তর মা আমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন।উনি সম্পর্কে আমার ফুফু হন।আর যাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম উনি রুদ্ধর দাদী।একটা এক্সিডেন্টে আমার বাবা- মা মারা যাওয়ার পরই থেকেই নাকি আমি এখানে থাকতাম।
এই বাড়ির মানুষগুলোও চায় আমি আবার নরমাল লাইফে ফিরে যায়। তাই ঠিক করেছি কাল থেকে ভার্সিটি যাবো।রুদ্ধ সকালে যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাবেন।
—————–
অনেকদিন পর ভার্সিটি এসে বেশ ভালো লাগছে।আজ অনেকদিন পর আবার আরহার সাথে দেখা হবে ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেলো।
আরহা এসেই বলল
—- তোর সাথে অনেক কথা আছে। ক্যান্টিনে চল।
—- আচ্ছা চল।
আমি আর আরহা ক্যান্টিনে বসে ছিলাম।তখনই আরহা বলল
—- আমাকে মাফ করে দিস রাত।আমার বাবা,মা, ভাই যে এতটা জঘন্য আমি ভাবতেও পারিনি।তাদের হয়ে আমি তোর থেকে মাফ চাচ্ছি।জানি শুধু ক্ষমা চেয়ে কিছু হবেনা তবুও তুই,
—- এসব কী বলছিস তুই আরহা।এতে তুই ক্ষমা চাচ্ছিস কেন।তুই তো উল্টো আমাকে হেল্প করেছিস।
—- তুই কী জানিস রাত যে ভাইয়া জেল থেকে পালিয়েছে।
—- এসব কী বলছিস তুই আরহা।
—- হুম।তুই একটু সাবধানে থাকিস।আর ক্লাস টাইম হয়ে গেছে চল যায়।
—-হুম চল।
ক্লাস শেষে রুদ্ধ বললেন তার নাকি একটা মিটিং আছে।আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেও আমি রিক্সা করে চলে যাবো বলে বেড়িয়ে আসি।রাস্তায় এসে একটাও রিক্সা পেলাম না।হেঁটেই এগোচ্ছিলাম।রাস্তাটা একদমই ফাঁকা।খানিক এগোনোর পর পিছন থেকে মাথায় বেশ ভারীকিছুর আঘাত অনুভব করলাম।মুহুর্তেই লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে।
চোখখুলেই নিজেকে হাতপা বাধা অবস্থায় অন্ধকার একটা ঘরে আবিষ্কার করলাম।
সামনে তাকিয়ে একটা ছায়মূর্তিকে দেখলাম।লোকটা ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছিল।তাকে দেখা মাত্রই বলে উঠলাম
“আরিশ”।
আরিশ একটা বিচ্ছরি হাসি দিয়ে বললো
—- কীভেবেছিলে এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দিবো।তোমাকে পাওয়ার জন্য কম কষ্ট তো করিনি।এভাবে কীভাবে ছেড়ে দিবো বলো।রুদ্ধ কে শেষ করে দিবো আমি তোমার মাধ্যমে।তুমি আমার না তো কারো না।
কথাগুলো বলেই আরিশ আমার দিকে একটা বন্দুক তাক করলেন।আমি এখন শুধু এটাই ভাবছি যে আজ হয়ত আমার নিস্তার নেই।আমি হয়ত আজই শেষ।হঠাতই একটা গুলির শব্দ কানে এলো।কিন্তু গুলিটা আমার গায়ে লাগেনি।চোখখুলে দেখি আমার সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে আরিশ।
পাশেই বেশকিছু পুলিশ।তাদের সাথে রুদ্ধ ও আছেন।উনি দ্রুত এসে আমার হাত পায়ের বাধন খুলে আমাকে নিয়ে ওখান থেকে বেড়িয়ে এলেন।আমি এখনো একটা ঘোড়ের মাঝে আছি।
————–
কেটে গেছে অনেক গুলো দিন।সেদিনের গুলির আঘাতে মারা গিয়েছিল আরিশ।আমি হয়ত এখনো মামনি বাবাইয়ের কাছে তাদের ছেলের খুনি হয়ে থেকে গেলাম।সবকিছু তার আপন নিয়মে চলছে।আমিও অনেকটাই নরমাল হয়েছি।রুদ্ধর সাথেও অনেকটা নরমাল হয়েছি।সেই আগের মতো বিশ্বাস করতে পারি আমি তাকে।তার চোখে আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি সে ভালোবাসাকে বিশ্বাস করতে পারি।
নিহা আপুর বাবা রুদ্ধকে রিকুয়েস্ট করেছিলেন সে যেন সত্যি নিহা আপুকে বিয়ে করে।
রুদ্ধ তো সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে বিয়ে করলে আমাকেই করবে। রুদ্ধরর বাড়ির লোকরাও তাই চায়।আমিও না করিনি। তাদের ইচ্ছে গুলোকেও সম্মান করা আমার দায়িত্ব।
ধুমধাম করে কিছু করার মানসিকতা এখন কারো নেই। তাই ঘরোয়া ভাবে সবকিছুর আয়োজন হয়েছে।
খুব সাধারণভাবেই আমার আর রুদ্ধর বিয়েটা সম্পন্ন হলো।আজ অনেকদিন পর এইবাড়ির লোকগুলো প্রাণ খুলে হেসেছে।
রাত্রিবেলা প্রিয় মানুষটার সাথে চন্দ্রবিলাস করার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে খুব কমই আছে।আর সেই সুন্দর জিনিসটা উপোভোগ করার সুযোগ পেয়েছি আমি।রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললাম
—- যার জন্য এই চারটা বছর অপেক্ষা করলেন সে যদি আপনার কাঙ্খিত মানুষটা না হতো।
—- যে জিনিসটা আমার ভাগ্যে আছে সেটা আমারই হবে।হয়ত একটু সময় লাগবে একটু কষ্ট হবে তবুও সে আমারই হবে।
আমি কেবল শান্ত দৃষ্টিতে তারদিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি আমার খুব কাছে এসে কানে কানে বললেন
” আমার শুরুতে তুমি ছিলে, আমার সমাপ্তিতেও তুমি।”
সমাপ্ত
(