সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -০১

কিরে পিচ্চি তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? কথাটা বলেই আমি আমার কাজিনের চুল টেনে ধরলাম। আমার থেকে পিচ্চিটা চুল ছারিয়ে রাগী মুডে তাকালো। এমন ভাবে তাকালো মনে হলো এখনি আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।

_ কথায় কথায় আমাকে পিচ্চি বলে ডাকবেন না,আমি আগের মতো সেই পিচ্চি নেই। আর আমার চুল ধরেও টানবেন না,ব্যথা লাগে। আপনার এই পিচ্চি ডাক শুনে দেখা যাবে,আমার বর আমায় কিশোরী ভেবে বিয়ে বাতিল করে দিলো।

_ “বিয়ে করার শখ দেখি আকাশ সমান। তা পড়ালেখা করার ইচ্ছে নেই নাকি?

_ একদম না,পড়ালেখা কোন মানুষ করে নাকি। আমি তো বিয়ে করে সংসার আর বরের বাচ্চা সামলাতে চাই।

_ কেন বাচ্চার বাবাকে সামলাতে চাস না?

_ একদম বাজে কথা বলবেন না।

_ আচ্ছা তোর বয়স কত?

_ কেন ? কপালটা কুঁচকে প্রশ্ন করলাম ওই হাধারামকে।

_ আরে বল না।

_ অন্য কারো বউয়ের বয়স শুনতে আপনার লজ্জা করবে না।

_ অন্য কারো বউটা আমার কোলে হিসু করে দিয়েছিলো একদিন! সেদিন যদি আমার লজ্জা না করে, আজ কেন করবে।

মানুষটার কথায় আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এভাবে কেউ লজ্জা দেয়। কবে না কবে হিসু করেছি সেই কথা আজ বলছে। ছি্ এই জন্যই আমি এখানে আসতে চাইনি। সব সময় আমাকে দেখলেই এই প্রসঙ্গে কথা বলে।

_ কিরে কোথায় হারিয়ে গেছিস? আর বয়স কত সেটা তো বললি না?

_ সাতারো রানিং, এক বছর পর আঠারো হবে! আর বিয়েটা তখনই হবে। তখন আমি ছোট থাকবো না। একজন নাগরিক হয়ে যাবো এই দেশের।

_ আচ্ছা, বিয়ে ছাড়া মাথায় কি আর কিছু নেই নাকি। যদি কিছু না থাকে,আমার থেকে কিছু শিখতে পারিস না। দেখ সাতাশ বছর চলছে,এখনো লেখাপড়া নিয়ে কতোটা সিরিয়াস সাথে চাকরি করছি।

_ আপনার মতো বিদ্যাসাগর হওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে রাখার জন্য তো জীবনে একটা প্রেমও করতে পারেন নাই। শেষে মিম আপুর মতো একটা গরুকে ধরে এনে চাচা-চাচি বলবে,একেই আমাদের পছন্দ, তোকে একেই বিয়ে করতে হবে।

_ গরু হোক সমস্যা নেই,কিন্তু আমার বউটা তোর মতো যেন গাধাঁ না হয়। যদি হয় তখন কী হবে আল্লাহ? এই একটা টেনশনে আজকাল ঘুম হয় না।

_ কিহহ আমি গাধা

_ আমার ভবিষ্যৎত বউ যদি গরু হতে পারে, তুই কেন গাধা হতে পারবি না।

_ উফপপ,বিয়ে বাড়ির এতো লোকের ভিরে আমাকেই কি আপনার চোখে পড়লো?

_ বাকি সবাই তো মানুষ, একমাত্র তুই গাধা,দেখতেও সবার থেকে আলাদা। তাই তোকেই চোখে পড়লো।

_ যত্তোসব ফালতুলোক।

আমি মুখ ঝামটি দিয়ে গদগদ করতে করতে ওখান থেকে চলে এলাম। এই মানুষটার সুনামে কিনা এতো বড় পরিবার পঞ্চমুখ। সুনাম করতে করতে ঠোঁট সাথে গলা শুকিয়ে কাঠ তৈরি করে লেবুর শরবত খায়। খেয়ে গলা, ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও শুরু করে দেয় গুনোগান গাওয়া। আসলে এই মানুষটা এক নাম্বার শয়তান। না না শয়তান না শয়তানের চাচাতো ভাই। শয়তানের মতো এতো খারাপ মনে হয় না। একটু ভালো গুন আছে হয়তো?

_ আমি কিন্তু সত্যি তোর চাচাতো ভাই। আল্লাহ তাঁর মানে তুই বড় শয়তান। এখনি আমাকে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম পড়তে হবে। আল্লাহ আপনি আমায় রক্ষা করুন।

_ আপনি ঝগরুটে নেতৃত্বের কোন্দলে কবে থেকে জড়ালেন।

_ আজ এই মুহূর্ত থেকে।

_বিরক্তকর একটা মানুষ আপনি সেটা কি জানেন।

_ না আজ জানলাম

মানুষটার গা ছাড়া ভাব কথায় আমার রাগ তরতর করে বেরে গেছে। কোনরকম সামলে ওখান থেকে চলে এলাম। ও আচ্ছা আপনাদের তো পরিচয় দেওয়া হয়নি । আমি নদী, বয়স সতেরো, ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ুয়া চঞ্চল মেয়ে। বাবা মায়ের তিন নাম্বার সন্তান। বড় বোন ঝর্না,মেজ ভাই সাগর,আমি নদী,আর ছোট ভাই মোহন। কি ভাবছেন সকল প্রকৃতির সুন্দর সুন্দর নাম গুলো আমাদের কেন? সেটা পরে বলবো, আগে চলুন ঘুরে আসি বিয়ে বাড়ির হলুদ অনুষ্ঠান থেকে।

——————
অতিরিক্ত সাউন্ডে গান বাজছে। যে শব্দ কিনা আমার মাথায় ভনভন করছে। একটু পর মাথা যন্ত্রণা শুরু হবে। মাথা চেপে আমার ফুপাতো ভাই নয়নের কাছে গেলাম। বর্তমানে তিনিই এই বাজনা বাজাচ্ছে। কি গান চলছে শুনবেন। না থাক শুনতে হবে না। কি গান বাজছে সেটা জানুন তাতেই হবে। শুনতে হলে তো আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে আসতে হবে। এভাবে অন্য কারো বিয়ের দাওয়াত তো আর আমি দিতে পারি না। আমি নিজেই এখানের অতিথি। তো গান বাজছে শুনুন, না থুক্কু দেখুন।

মেরা গানা বাজা দে,গানা বাজাদে ডিজে গানা বাজা দে,গানা বাজা দে! ডিজে ডিজে ডিজে।(গানে ভুল হলে মাফ করবেন এসব গান আমি শুনি না। এখানে ওখানে বাজতে যতোটুকু শোনা সেখান থেকে লেখা।)

বাকিটা আর মনে পড়ছে না। পরে যদি মনে পরে তখন বলবো। কিন্তু কথা সেটা নয়,কথা হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে বিয়ের গান চলবে,ডিজে কেন চলবে। তাই আমি গিয়ে নয়নের কান চেপে ধড়লাম।

_ আহহ আপু কি করছো,কান ধরে টানছো কেন?

_ কান ধরে টানবো না তো কি করবো? কি সব হাবিজাবি গান বাজছে।

_ এই গানগুলো তোমার হাবিজাবি গান মনে হচ্ছে।

_ গান মানুষের অন্তর জ্বালিয়ে দেয়। তাই গান শোনা হারাম।

_ এটা আমাকে কেন বলছো,মামিকে গিয়ে বলো না। তিন দিনের জন্য ভাড়া করে এনেছে এটা। যদি না বাজাই মামার টাকা গুলো জলে যাবে। কথাটা আমার নয় মামির।

_ তাঁকে বোঝাতে গেলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোকে বোঝাতে তো হবে না। তাই তোকে বোঝাচ্ছি।

_ তুমি এই গান বন্ধ করে রাখছো, দেখো এখনি মামি এসে ঝামেলা করবে।

_ সে দেখা যাবে,যদি গান বাজাতেই হয় তাহলে আস্তে সাউন্ড দিয়ে বিয়ের গান বাজা।

_ কিরে নয়ন গান বন্ধ করলি ক্যান। আমি যেদিকে নজর একটু কম দেই, সেদিকেই গন্ডগোল।

_ এসে গেছে, এবার তুমি এনাকে বোঝাও।

_ তুই চুপচাপ বসে থাকবি,যা বলার আমি বলবো।

_ আচ্ছা।

_ নাসিমা বেগম আমার ছোট চাচি।আমি সহ আমার পুরো পরিবার তাঁর বড় মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে এসেছি৷ মানুষটা নিজের ভালো ছাড়া কারো ভালো বুঝে না। এমন কি কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেও ছাড়ে না। কিন্তু তবুও তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। এই ভালো মানুষ বলার জন্য একটা বড় কাহিনি আছে! কিন্তু এখন না পরে বলবো। আচ্ছা আপনারা রেগে যাচ্ছেন না তো সব পরে বলবো বলে?

_ কিরে নয়ন গান বন্ধ কেন?

_ চাচি আমি বন্ধ করে দিছি।

চোখমুখ কালো হয়ে গেলো নদীর কথায় নাসিমা বেগমের। তিনি যে নদীর কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে গেছে তা বোঝাই গেলো।

_ কেন?

_ আসলে চাচি বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। এখানে এসব হারাম কাজগুলো না করাই উত্তম।

_ আমাকে এখন তোর মতো প্রতিবন্ধীর থেকে জ্ঞান নিতে হবে।

নাসিমা বেগমের কথায় রেগে গেলো নয়ন।

_ মামি ঠিক করে কথা বলেন,আপনি আপুকে এভাবে বলতে পারেন না। মামা শুনলে এই মুহূর্তে কিন্তু এখান থেকে চলে যাবে।

_ গেলে যাবে,তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওরা থাকলেও আমার মেয়ের বিয়ে হবে! না থাকলেও হবে।

_ যদি সবাইকে ছাড়া মেয়ে বিয়ে দিতেই পারিস, তাহলে আমাদের ডেকেছিস কেন নাসিমা?

হঠাৎ অন্য কারো কন্ঠে আমি আর নয়ন পিছন ঘুরে তাকালাম। তখন দেখলাম আমার মা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। অবস্থা খারাপ হতে পারে ভেবেই আমি মায়ের কাছে দৌড়ে গেলাম।

_ মা প্লিজ এখানে সিনক্রিয়েট করো না। চলো এখান থেকে। আসলে দোষ আমার,তাই চাচি কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেলেছে আমায়। ইচ্ছে করে তো বলেনি।

_ তুই চুপ থাক নদী। তুই কি করতে পারিস সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে।

_ মা তুমি–

_ ভাবি আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।

আমি কথা শেষ করার আগেই চাচি মায়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।

_ তোর মান আছে যে অপমান করবো। যদি থাকতো আমার মেয়েকে এতো বড় কথা তুই কখনোই বলতে পারতি না। আমরা এখনি চলে যাবো। যেখানে আমার মেয়েকে অসম্মান করা হয় ওর কমতির জন্য, সেখানে আমি এক মুহূর্তও থাকবো না। আর সেই কমতিকে কিনা প্রতিবন্ধী বলে খোঁচা মেরে কথা বলছে।

মা রেগেমেগে হেঁটে গেলেন। মা যে খুব কষ্ট পেয়েছে তা ভালোই বুঝলাম। এই কষ্টটা মা আমার জন্ম থেকেই পেয়ে আসছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়,সবার সকল অভিযোগ থেকে দূর সরে দাঁড়াই। মুখোমুখি হতে বড্ড কষ্ট হয় যে আমার। কিন্তু আমার পরিবারের ভালোবাসা যখন আমায় জড়িয়ে নেয়! তখন মনে হয় আমি পৃথিবী জয় করতে পারবো একাই। হয়তো এই জন্যই আজ আমি এতদূর পৌঁছাতে পেরেছি। এমন পরিবার অনেকের স্বপ্ন। যেটা আমার সত্যি । আমি দৌড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলাম।

_ মা,আমার সোনা মা। এভাবে রাগ করছো কেন? চাচি তো এরকমই তাই না? কষ্ট পেয়ো না মা আমার। মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।

_ তুই আমাকে বলছি কিছু মনে না করতে তাই না? তোর বাবা আর ভাই-বোনেরা শুনলে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবে। কারো সাদ্ধি নেই ওদের আটকানোর।

_ ওরা জানবে কীভাবে চাচি যে এগুলো বলেছে।

_ আমি বলবো ওদের।

_ উঁহু বলবে না। তুমি না বলো,অন্য কারো উপর কখনোই রাগ করতে নেই। রাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। তুমি একটু রাগলেই সব শেষ।

_ আমি তো এটাও বলি হিংসা ধ্বংসের মূল । নাসিমা তোকে হিংসা করে সেটা কি ওর ধ্বংসের কারণ নয়।

_ মা আমার, অবুঝের মতো কথা বলো কেন? কে কি বললো সব যদি কানে তুলি, তাহলে তো মিথ্যাকেও সত্যি ভাবতে হয়।

_ তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।

_ আর আমার তোমার চোখের জল সহ্য হয় না।

_ তুই এতটা স্বাভাবিক কীভাবে থাকিস মা।

_ কারণ আমাদের দেশের 90% প্রতিবন্ধী সন্তান পরিবারের বোঝা হয়। আর আমি আমার পরিবারের একটা ভালোবাসার অংশ। তাঁরা কখনোই আমার এই কমতির জন্য কথা শোনায় না। আমার কাছের মানুষের ভালোবাসার চাদর আমায় এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যে,কোন খারাপ ছোঁয়া আমায় ছুঁতে পারে না। কারণ আমার কমতি আছে,এটা আমার পরিবার বিশ্বাস করে না। তাঁরা মনে করে,প্রতিটা মানুষের মাঝে কোথাও না কোথাও কমতি আছে। তাই আমার এই কমতি কিছুই না।

_ আমার মেয়ে প্রতিবন্ধী সেটা নিয়ে তো আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই! তাহলে অন্যদের কেন থাকবে। তাঁরা তোকে খাওয়ায় না পড়ায়।

_ ওই যে পরের দেওয়া ভাতে বালি বেশি। পারফিউমে গন্ধ বেশি।

_ আমার সোনা মেয়েটা কবে যে ছোট্ট থেকে এতো বড় হয়ে গেছে বুঝলামই না।

_ আমি এখনো তো ছোটই আছি। এই যে চাইলেই মায়ের বুকের সাথে মিশে যেতে পারি।

সায়লা বেগম মেয়েকে মমতার চাদরে বুকে জড়িয়ে নিলেন। চোখেমুখে চুমু খেয়ে মনে মনে ভাবলেন।

_ আমরা কখনোই তোর এই কমতির জন্য তোকে কষ্ট পেতে দিবো না। তুই সেরা,সবার থেকে সেরা।

আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে মনে মনে ভাবছি! আর কতোদিন আমাকে এভাবে আগলে রাখবে মা। আমার এই কমতির জন্য তো আমাকে সারাজীবন কথা শুনতে হবে। তোমরা যেদিন আমার পাশে থাকবে না, আমার কি হবে সেদিন?

ইনশাআল্লাহ চলবে,,

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
(সূচনা পর্ব ১)

কপি করা নিষেধ।
নতুন গল্প কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুলগুলো দেখিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো। আর একটু রেসপন্স করার আহ্বান রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here