সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -২০+২১

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২০

কেন রোদের মতো হাসলে না?
আমায় ভালোবাসলে না?
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না।
এই মন কেমনের জন্মদিন, চুপ করে থাকা কঠিন! তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।
নতুন সকাল-গুলো কপাল ছুঁলো তোমারই।
দূরে গেলেজ এটাই সত্যি তুমি আমারই,শুধুই আমারই।

মিষ্টি কন্ঠের মিষ্টি গানটা শুনতে শুনতেই ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নদী। দরজা খুলে বের হতেই সবাইকে ড্রইংরুমে দেখলো। সবাই কাউকে ঘিরে বসে আছে। মোহন গিটার বাজাচ্ছে, তাহলে গানটা গাইছে কে? নদীর অচেতন মন বর্ণের কথাটা মাথায় আনলো না। গানটা নদীর খুব পছন্দ। তা-ই তো সে নিজেই এবার গেয়ে উঠলো গানের বাকি অংশ।

জলে ভেজা, চোখ বোজা, ঘুম খোঁজার ভোর।
নিশানা তীর স্মৃতির ভীর
এলোমেলো ঘরদোর
মেঘে আসে এলো কে’সে
ছুঁয়ে দিলেই চুপ
সেই মেঘবালিকার গল্প হোক
শহরজুড়ে বৃষ্টি হোক,রোদ্দুর হোক আজ শুধুই তাহার ডাকনাম।
পাতাভরা সব দু’টুকরোরা
কাল বৈশাখীর মতো মুখচোরা
সব ভিজে যাক শুধু বেঁচে থাক অভিমান।
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারই। বেঁধে রাখতে পারলে তুমিও হতে আমারই,শুধুই আমারি।

সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে নদীর পানে। আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ণ। এলোমেলো চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে। কুঁচকে যাওয়া জামার অংশ লেপ্টে আছে নদীর শরীরময়। একপাশের ওড়না মাথার উপরে,বাকি কিছু অংশ হাওয়ায় ভাসানো। কিছু ছোট্ট ছোট্ট চুল চোখের কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে আছে। কপালে ভাজ পড়ে আছে, মনে হচ্ছে সে খুব বিরক্ত তাঁর এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে থাকা চুলের উপর। ভাসা ভাসা মায়াবী চোখের নিচে পড়েছে কালি। এমন এলোমেলো রূপে কখনোই নদীকে বর্ণের দেখা হয়নি,সে জন্য হয়তো সে এতো মুগ্ধ। তাঁর ভালো লাগার সিমান্ত যেন আজ বাঁধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। শুষ্ক ঠোঁটের কোণা লাল হয়ে আছে। শুষ্ক ঠোঁটের কোণায় তখনো লেগে আছে অমায়িক হাসি। নদীর এমন প্রসন্নমুখ খানা দেখে বর্ণের হৃদয়খানা শীতল জলের মতো ভিজে উঠেছে। বুকে হাত বেঁধে দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে গানের শেষ লাইন শেষ করলো নদী। বর্ণ তখন মনে মনে আওড়ালো গানের শেষের অংশটা– বেঁধে রাখতে পারলে তুমিও হতে আমারই,শুধুই আমারি। গানের শেষ লাইনটা কেমন জানি ধাক্কা দিলো বর্ণের বুকে, কাঁটার মতো বিঁধল। তাহলে কী–

_ বাহ্ আজ অনেক দিন পর ছোট আপুর গলায় গান শুনলাম। আমার গিটার বাজানোটা স্বার্থক হয়েছে। উফপ কি দারুণ গান করিস আপু তুই, কেন যে গানের স্কুলে ভর্তি হলি না।

ছোট ভাইয়ের কথায় আমি চোখ খুলে তাকালাম। তখন দেখলাম সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনেক দিন পর গাইতে শুনেছে তাই। একটু বিব্রতবোধ করলাম। আমি অবশ্য শিখতে চেয়েছিলাম গান। কিন্তু আব্বু বারন করেছে,তাই আর শেখা হয়নি। আর আব্বুর না করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিলো! তাই আর অমান্য করার মতো সাধ্যি ছিলো না।
প্রতিটা মানুষের কোন না কোন গুন থাকে! আমার হয়তো গাইতে পারার একটা গুন আছে। আমি মুচকি হেঁসে বললাম–

_ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন সবাই আমার দিকে?

_ সত্যি অনেক সুন্দর হয়েছে

হঠাৎ বর্ণ ভাইয়ের কন্ঠে আমি অবাক হলাম। ভালো করে খেয়াল করলাম,সবাই যাকে ঘিরে বসে ছিলো সে বর্ণ ভাইয়া। অসময়ে আমাদের বাড়িতে উনাকে দেখে আমিও কিছুটা অবাক হলাম। আর তাঁর মুখে এমন প্রসংশা শুনে আমি এদিক ওদিক মাথা কাত করলাম। মা উঠে এলেন। আমার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আছে কিনা?

_ জ্বর নেই। ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তোর জন্য খিচুড়ি রান্না করেছি। খেয়ে ঔষধ খাবি। একদম সুস্থ হয়ে যাবি। আচ্ছা সবাই থাকো আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি। আজকের সকালটা সত্যি অনেক সুন্দর। আমার মেয়ে টাও সুস্থ হয়ে গেছে আল্লাহর রহমতে।

মা চলে গেলেন। একে একে সবাই উঠে খাবার ঘরে চলে গেলেন। আমিও ঘরের দিকে চলতে রইলাম।

_ কিরে পিচ্চি তোর নাকি জ্বর এসেছে?

কথাটা বলতে বলতেই এগিয়ে এলো বর্ণ ভাইয়া আমার নিকটে।

_ কিরে কথা বলছিস না কেন?

কি কথা বলবো,সেদিন এতোকিছু হওয়ার পর আমার সাথে কেমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন উনি। এটাই তো আমার হজম হচ্ছে না। নতুন করে তাই তো কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছি না।

_ হেই

_ হু, আমি লাফিয়ে উঠলাম।

_ কথা বলছিস না কেন?

_ কিই বলবো? আর আপনি আমাদের বাড়িতে, কখন এলেন?

_ কাল রাতে। দুই মাসের লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছি তোদের বাড়িতে থাকবো তাই।

_ কেন? আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন কেন? আপনাদের বাড়ি কি হয়েছে?

_ কিছু হয়নি,মনে চাইলো তাই চলে এলাম।

_ আমি বুঝতে পেরেছি আপনি—

_ কি তুই, তুই ভালো করেই জানিস আমি কেন এসেছি? কি এটাই বলতে চাইছিস?

_ হ্যা আমি জানি আপনি কি মতলব নিয়ে এখানে এসেছেন?

_ তাহলে বল তো কি মতলব নিয়ে এখানে এসেছি?

_ আপনি তো—

_ উঁহু বাকিটা তোর বলতে হবে না আমি বলছি। আমি নতুন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এখানে এসেছি। এখানের ভালো কোন মেসে উঠতে চেয়েছি,কিন্তু আমার এতো ভালো চাচ্চু থাকতে সেটা কি হতে পারে বল। তাই বাধ্য হয়ে তোদের বাড়িতে উঠতে হলো। হে’রে তুই কি ভেবেছিস?

_ আআআমি তো? এমন কিছুর জন্য আমাদের বাড়িতে উনি আসতে পারে আমি জানতাম না। তাই বলার মতোও আর তেমন কিছু খুঁজে পেলাম না।

_ তোর সাথে ভালোবাসার ঘর বাঁধতে এসেছি এটা ভেবেছিস।

_ একদম এসব ভাবিনি। আমার সোজাসাপটা উত্তর।

_ তাহলে?

_ আমি কিছু ভাবিনি।

_ না ভাবলেই ভালো। তোর মাথায় তো সব সময় উদঘট চিন্তা ঘুরপাক খায়।
আচ্ছা তুই গোসল করিস না কতোদিন সেটা বল আগে। ইসস কী গন্ধ তোর গায়ে! কেমন জানি একটা জ্বর জ্বর গন্ধ। আজ ভালো করে লাক্স সাবান দিয়ে ঘসে ঘসে গোসল করবি। না হলে কিন্তু তোর হবু বর তোকে বিয়ে না করেই পালাবে। হা হা হা হা।

_ খারাপ লোক একটা। আমি রাগ করে ওখান থেকে চলে এলাম নিজের ঘরে। সব জেনেও আমার সাথে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে মানুষটা। দূরে ছিলো ভালো ছিলাম। এতো কাছে আসার কি দরকার ছিলো। তাও কিনা দুই মাসের জন্য ভাবা যায়। চোখের আড়াল ছিলো তাই হয়তো নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে পেরেছি,যদি এমন ভাবে কাছাকাছি থাকে ঠিক ধরা পরে যাবো। আল্লাহ এবার উপায়?

ভেঁজা চুল গুলো মুছতে মুছতে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ফুরফুরে শীতল হাওয়া শরীরে বয়তেই শীতে জুবুজুবু অবস্থা হলো আমার। দু’দিন গোসল না করার জন্য আজ যেন শীত একটু বেশিই লাগছে,তাও আবার ঠান্ডা পানি দিয়ে। বেলকনির এককোনায় দাঁড়ালাম কড়া রোদ্দুর দেখে। শীতের মিষ্টি রোদ এতো ভালো লাগে কি বলবো। যে রোদ শীতে মানুষের প্রশান্তির কারণ, সে রোদই গরমে সকলের বিরক্তের কারণ। বিষয়টা ভারি অদ্ভুত। এই জন্যই হয়তো বলে মানুষের রুচি বদলায়,কারণে অকারণে বদলায়। স্বার্থে সচলায়তন নীতিমালা প্রয়োগে সব কিছুতেই সে বদলায়। চুলগুলোকে আরো একটু মুছে ভালো করে দাঁড়ালাম। তখন আমার ঘরে কারো উপস্থিত টের পেলাম। ওড়নাটা মাথায় ভালো করে পেঁচিয়ে নিতেই দেখলাম বর্ণ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে দৃঢ় দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকিয়ে আছে। আমি চোখটা নিচু করলাম। এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিৎ আমি ভেবে পেলাম না। আমাকে এমন বিব্রত হতে দেখে বর্ণ ভাইয়া মুচকি হাসলেন। হঠাৎ তাঁর এই হাসির কোন কারণ আমি খুঁজে পলাম না। তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে ধরে খেয়াল করলাম,তিনি কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে আমার সাথে । অবশ্য আমি যথাক্রমে তাঁকে এরিয়ে চলছি। এই তো সকালে নাস্তার টেবিলে সবার সামনে তিনি একটা আপত্তিকর ব্যাপার ঘটিয়ে ফেললো। ঘটনটা এমন ভাবে ঘটেছে, যে আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। তিনি নিজের প্লেটের ডিম ভাজি আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বললো–।

_ একটু বেশি বেশি খেয়ে মোটা হ নদী। দু’দিন পর বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গেলে,তোর শ্বশুর বাড়ির লোক বলবে! তাঁদের বউমার উপর বড্ড অনাদর করেছি আমরা। না খেতে দিয়ে এমন শুকনো পাটকাঠির মতো শুধু লম্বাই তৈরি করেছি। তাঁদের ঠকিয়ে মেয়ের বদলে পাটকাঠি দিয়ে দিয়েছি।
তাই বেশি বেশি খেয়ে মোটা হওয়ার চেষ্টা কর। যতোই হোক তাঁদের বোঝাতে হবে,আমরা আমাদের বাড়ির মেয়েদের ভালো আদর যত্ন দিয়েই মানুষ করেছি। এখন যদি মোটা তালগাছ না হয়ে পাটগাছ হয়,আমাদের আর কী করার? বাবা-চাচাদের পরে তো আমাদের ভাইদের দায়িত্ব তোদের দেখে রাখার। তাই দায়িত্বটা এখন থেকেই পালন করছি।

সবাই হু-হা করে হেঁসে উঠলো বর্ণ ভািয়াী কান্ডে। কিন্তু হঠাৎ এমন ঘটনাটা সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিলেও আমি নিতে পারিনি। দু’দিন আগেও ভালোবাসা দাবি করা মানুষটা হঠাৎ আমার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে পরলো কেন বুঝলাম না। বর্ণ ভাইয়ার কথায় সবাই স্বায় জানালো। অগ্যত আমার বলার মতো কোন কথাই রইলো না৷ তিনি ওখানেও থামেনি। আমার জন্য মা গরম পানি করেছিলো, যেটা দিয়ে আমি গোসল করবো। কিন্তু তিনি সেই পানি মা’কে আমায় দিতে দিলো না। বললো– চাচি জ্বর শেষে গরম পানি দিয়ে গোসল করলে আবার জ্বর আসার সম্ভাবনা থাকে। তাঁর থেকে আজ থেকেই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করুক,দেখবেন মন শরীর দু’টোই সুস্থ হয়ে গেছে।

কেন রে ভাই,তোকে আমার এতো ভালো কে ভাবতে বলেছে। আমার ভালো ভাবার জন্য আর দেখার জন্য মা-বাবা ভাই-আপুরা আছে তো? যেচে গিয়ে অন্যের এতো ভালো করতে তোকে কোন যতি ঋষি বিশ্রবার পুত্র বলেছেন। কিন্তু না তাঁর তো মানুষের ভালো করতে হবে। তাঁকে তাঁর বাবা চাচাদের মতো হতে হবে। বানিতে আমি না বর্ণ ভাইয়া। আল্লাহ ভালো জানেন এবার কোন ভালো আমার জন্য বরাদ্দ করে নিয়ে এসেছেন।

_ আমি কী আসতে পারি মিস নদী?

বেলকনির দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন একটা কথা বললেন বর্ণ ভাইয়া। আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করা আর অনুমতি নেওয়া দেখে আমার তৎক্ষনাৎ কাশি উঠে গেলো। হুটহাট চুল টেনে ধরা,আমাকে নিয়ে মজা করা মানুষটা কিনা অনুমতি চাইছে! আল্লাহ এটা দেখারও বাকি ছিলো।আমি মুখ চেপে ধরে অনুমতি দিলাম। উনি আমার সামনে এসে আরো একটি কান্ড ঘটালেন। আর সেটা —

_ আমি বর্ণ, এই বাড়িতে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। অবশ্য বেড়াতে নয়,কাজেই জন্যই আসা। এটা আমার বড় চাচ্চুর বাড়ি! আপনি এই বাড়ির কে হন,দয়া করে যদি নিজের পরিচয়টা দিতেন। না মানে কথা বলতে একটু সুবিধা হতো এই আরকি।

_ এই এই আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছেন নাকি?

_ কেন? আপনার সাথে কি আমার শালি দুলাভাইয়ের সম্পর্ক নাকি?

_ এমন আজব ব্যবহার করার কি মানে?

_ আজব ব্যবহার কোথায় করলাম? আমি তো যাস্ট আপনার সাথে পরিচিত হতে এলাম।

_ আপনি আপনার কাজিনের সাথে পরিচিত হতে এসেছেন, এটা কি আজব ব্যবহার নয়।

_ কাজিন যদি আমার সাথে অচেনা মানুষের মতো ট্রিট করে,আমার তো মনে হয় এটাই স্বাভাবিক আচরণ করছি আমি তাঁর সাথে ।

_ অদ্ভুত চিন্তাধারা সাথে অদ্ভুত আচরণ। কোনটাই আপনার সাথে যাচ্ছে না।

_ আজ্ঞেমহাসয়া যদি বলে দিতেন কোনটা যায়। না মানে আমার একটু ক্যচ করতে সুবিধা হতো এই আরকি।

_ আপনি এখনি আমার ঘর থেকে চলে যান।

_ যাবো,কিন্তু তাঁর আগে তোকে কথা দিতে হবে তুই আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবি। দেখ পিছনে কি ঘটেছে সেগুলো এই মুহূর্তে ভুলে যা। মনে কর আমরা এখন কাজিন। তোদের বাড়িতে আমি বেড়াতে এসেছি, এবার আমাকে যেভাবে তোর ট্রিট করা উচিৎ, ঠিক সেভাবেই করবি! কি রাজি তো?

বর্ণ ভাইয়ের এমন অদ্ভুত আচরণ সত্যি আমার ভালো লাগছে না। তাঁর আমাকে নিয়ে যে ফিলিংস, সেটা কতোটা গভীর তা আমি ভালো করেই জানি। আমার মতে হুট করেই সেটা হাওয়া হয়ে যাওয়ার মতো নয়। তাহলে কেন সে আমার সাথে এমন আচরণ করছে। তাঁর মনে কি অন্য কিছু চলছে। তৎকালীন কিছু বলার মতো পরিস্থিতি এই মুহূর্তে আমি নেই। তাই আমি চুপ করেই রইলাম। আমাকে চুপ দেখে বর্ণ ভাইয়া হাতে তালি বাজিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আমি তাকাতেই বললো।

_ হ্যা’রে নদী এই ফুলের নাম কী? এমন দেখতে টাইম ফুল ছিলো না? কিন্তু এটা কী ফুল?

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ফুলের দিকে নজর দিলাম। বর্ণ ভাইয়ের হাত সোজাসুজি তাকাতে বুঝলাম উনি পুর্তলিকা ফুলের কথা বলছে,কিন্তু তিনি হয়তো জানে না এই ফুলের আরেক নাম টাইম ফুল। অবশ্য উনি যে ফুলের কথা বলছে,সেটা একটু গোলাপের মতো দেখতে! আর আমার বেলকনিতে যেটা আছে,সেটা কিছুটা তাঁর থেকে ভিন্ন। আমি চোখ বুঁজে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর বর্ণ ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলাম।

_ এটার নামও টাইম ফুল।

_ আমাকে তুই বলদ বানাচ্ছি তাই না? আমি বুঝি টাইম ফুল চিনি না। আমাদের ছাদে এখনো আছে টাইম ফুল। দেখবি ছবি দেখাবো।

বর্ণ ভাইয়া যে ইচ্ছে করে আমায় এমন উদঘট প্রশ্ন করছে তা ভালোই বুঝলাম। তবুও নিজেকে সামলে বললাম।

_ টাইম ফুল হল একটি ফুলগাছ যেটি পরচুলাচাচাই পরিবারের অন্তর্গত। এটি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চল, উরুগুয়ে এবং প্রায় সময় বাগানে চাষ করা হয়। এর আরো অনেক নাম আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোজ মস, এগারটার ফুল,মেক্সিকান গোলাপ,মস রোজ, ভিয়েতনামের গোলাপ, পর্তুলিকা, পরতিউলাকা, সূর্য গোলাপ,পাথর গোলাপ, এবং মস রোজ পার্সলে ।

পাকিস্তানে একে গুল দোপেহেরি বলা হয়। যার অর্থ বিকেল বেলার ফুল। কারণ এটি বিকেলেই সুন্দর প্রস্ফুটিত হয়। আবার বাংলাদেশে একে বলা হয় টাইম ফুল। কারণ এটি বিশেষ সময়ে ফুটে থাকে। এছাড়া স্থান ভেদে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের গ্রামে এটিকে ঘাসফুল নামেও ডাকা হয় যদিও এটা এই ফুলের আসল নাম নয় । বাংলাদেশের শহরে একে “”পর্তুলিকা”” নামেও ডাকা হয় । আর কিছু জানার আছে এই ফুলের সম্পর্কে।

_ না,একটা ফুলের সম্পর্কে তুই এতো কিছু জানিস,শুধু জানিস না আমার মনের সম্পর্কে। কেমন জানি লাগে আমার তোর ব্যবহার। কষ্ট পাওয়া উচিত নাকি দুঃখ জানি না! শুধু জানি তুই সবাইকে মন থেকে বুঝলেও আমাকে বুঝলি না। অদ্ভুত তুই অদ্ভুত তোর ফিলিংস। আর আমি বেহায়া,বেহায়া আমার ফিলিংস।
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২১

মৃদু হাওয়ায় কপালের উপরে থাকা চুল গুলো উড়ছে। তিমির রাতের আকাশে তাকিয়ে আছে নদী। কোথাও চাঁদের আলোর ছিটেফোঁটা নেই। তারার সংখ্যাও খুব কম। সোডিয়ামের আলোয় রাস্তা কিছুটা ঝিমিয়ে আছে। নাম না জানা কিছু ফুলের গন্ধ নাকে ভেসে আসতেই আকাশ থেকে চাহনি সরিয়ে নিলো নদী। বেলকনির দরজার মুখোমুখি মুখ রেখে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। চোখের পল্লব জোড়া বন্ধ করে বর্ণের সাথে নিজের জীবনের সমীকরণটার হিসেব কষাকষি চালিয়ে গেলো। ভাবতে ভুললো না কয়েক সপ্তাহ আগের বলা বর্ণের কথাটা! অদ্ভুত তুই, অদ্ভুত তোর ফিলিংস ! বেহায়া আমি,বেহায়া আমার ফিলিংস। কথাটার ভারপল্লব অনেক ভারিক্কি। কথাটা কোথাও বক্ষঃস্থলে গিয়ে ঠেকলো নদীর। মানুষটাকে সে কীভাবে এরিয়ে যাবে। দূর থেকে চোখের জল আর কণ্ঠনালী চেপে না-হয় লুকিয়ে রাখা যায়,কিন্তু সামনাসামনি তো নিজের মুখের ভাষাও যে হারিয়ে যায়। হঠাৎ করেই বুকের ভেতরে কেউ ধারাম ধারাম আওয়াজে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিলো। তাহলে কি এতোদিনের লুকিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতি গুলো প্রকাশ পেয়ে গেলো হুট করেই। বর্ণের ওই প্রসন্নমুখ দেখলে নদী যে খেয়াল হারিয়ে ফেলে। তাঁকে নিয়ে ভাবতে বসলে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তিময় হাসি। এগুলো কখনো প্রকাশ পেলে ঠিক সে ধরা পরে যেতে পারে। যে ভয় ছিলো সেটাই হয়ে গেছে কাল। নদী যে পুরোপুরি ধরা পরে গেছে। যখন বর্ণ তাঁর কথার জালে নদীকে বেঁধে ফেলে,নদীর দেহ তখন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। পুনরপি বলার মতো কোন কিছুই থাকে না। প্রসন্নচিত্তে কণ্ঠনালি থেকে বেরিয়ে আসে ভগ্নকণ্ঠ। ভেঙে আসে অবিধানের সকল শব্দ। ভাঙা নদীর মতো হারিয়ে ফেলে কূলকিনারা। মানুষটা কি বুঝতে পারে না,তাঁর হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা। শুনতে পায় না বুকের ভেতরে বেড়ে যাওয়া বেগতিক শব্দ। হয়তো পায় না? পেলে কখনো আমায় সহিংসতায় মানবিকে পরিণত করতো না সে। আবারও শীতল পরশ ছুঁয়ে গেলো নদীর অধর খানায়। চোখ মেলে সামনে তাকাতেই ধক করে উঠলো বক্ষঃপঞ্জর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবের অধরযুগল রাতের আঁধারে স্পষ্ট না। কিন্তু যতোটা স্পষ্ট তাতে নদী বুঝলো মানবটি অন্য কেউ নয়, বর্ণ। মুখটা ফিরিয়ে আবারও রাস্তার পিচঢালায় নিবদ্ধ করলো। তাহলে কি গেছে কালের সকল প্রশ্নের উত্তর নিতে আজ এসে গেছে।
পল্লব জোড়া বন্ধ করে বুকটা চেপে ধরলো। শশব্যস্তভাবে পল্লব জোড়া এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করলো। যতোই নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছে,ততোই যেন মানুষটা সব দিক থেকে নদীকে ঘিরে নিচ্ছে। আর তখনই বর্ণ নদীর খুব নিকটতম এসে দাঁড়ালো। তাঁর পল্লব জোড়াও নিবদ্ধ হলো নিরবচ্ছিন্ন পিচঢালা কংক্রিটের সীমানায়। নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে বর্ণ প্রশ্ন করলো–

_ কি দেখিস রাতের পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায়। সেখানে একবুক আফসোস আর শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই। দিনের আলোয় তাঁকে যতোটা মানুষ কাছে টানে,রাতের তিমিরে তাঁকে ঠিক ততোই অনাদর করে। যেমনটা “আমি”। অবশ্য আমাকে কেউ আজ-ও কাছে টানেনি,তাই দূরে সরিয়ে দেওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। তবুও মনকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ। সে যে ছন্নছাড়া বাঁধন হারার মতো ছুটে বেড়ায় এদিক ওদিক। ভালোবাসা পাবার লোভ যে তাঁর প্রচুর। সে যে স্বপ্ন দেখে ভাঙা টিনের চাল থেকে জোছনা ধরার। কিন্তু তাঁকে কে বোঝাবে,স্বপ্ন ঘুমের ঘোরে দেখতে হয়,জেগে নয়।

বিকৃত স্বরেই শেষ করলো নিজের অভিযোগ। অভিযোগ শেষ হতেই বর্ণ তাঁর হাতের যুগলবন্দীতে আঁটকে নিলো বেলকনির রেলিঙের শক্ত লোহার রড। অন্ধকার ওই আকাশের কালো মেঘেদের কাছে জমা করলো তাঁর অভিমান। এই মরণান্তিক যন্ত্রণা তাঁকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। না পারছে সইতে,না পারছে কাউকে দেখাতে। আজ আড্ডায় নদীর বিয়ের আলোচনা ছিলো প্রখর। বর্ণ বুঝে গেছে বিয়ের আর বেশি দিন বাকি নেই। আজ বাদে কাল ছেলে দেশে ফিরলেই বিয়ে। প্রায় এক মাস কেটে গেছে সে এই বাড়িতে আছে। ভেবেছিলো সে এই বাড়িতে এলে বুঝি নদীর মনের খবর জানতে পারবে। কিন্তু নদী তো নদী,কখন জোয়ার আসে আর কখন ভাটি তা কিছুই চোখের কোণে আঁটছে না। তবে একটা বিষয়ে সে সিউর,নদী তাঁকে ভালোবাসে। যেটা সে গেছে কাল জেনেছে। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করতে নারাজ। শুধু নারাজ নয়,ঘোর আপত্তি তাঁর এই বিষয়ে কথা বলায়ও। তাই তো কাল থেকে সে যতোবারই কথা বলার চেষ্টা করেছে,ঠিক ততোবারই তাঁকে এরিয়ে গেছে নদী। সে আরো একটা বিষয় খেয়াল করেছে– নদীর ফোনে প্রায়শই একটা ফোন আসে! সেই ফোনটা আসতেই নদীর চাপা কন্ঠস্বর রুষ্ট হয়ে ধরা দেয়। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে কথা বলে। কাউকে সে হুমকি দেয়,কখনো দেয় কথা। কিন্তু কে এই মানুষটা তা বর্ণ জানে না। অবশ্য কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে, কিন্তু আসলেই এই মানুষটা কিনা সে তা জানে না। শুধু জানে সত্যি যদি ওই কাছের মানুষটা হয়,তখন নিজেকে সামলে নেওয়াটা বড্ড কঠিন হবে তাঁর। নদীর মুখোমুখি দাঁড়াতে তাঁর লজ্জা লাগবে। নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে সে কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না নদীর সামনে। সত্যি যদি ওই মানুষটা হয়ে থাকে,তাহলে কেন সে এসব করছে। কোথাও কি ওই মানুষটাই দায়ী নদীর এতো কঠোর হওয়ার পিছনে । সে কি নদীকে তাঁর কথায় ইন্দ্রজালে ফাঁসিয়ে ফেলছে। যদি এমন কিছুই হয় তাহলে তাঁকে খুব শীগ্রই সেই মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তাঁকে ।জিজ্ঞেস করতে হবে কেন সে অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করছে? কেন সে তাঁর সন্তানের সুখ কেঁড়ে নিচ্ছে?নিজের ভাবনার চিত্ত থেকে বেরিয়ে নদীর হাতের উপর হাত রাখলো। নদী কেঁপে উঠলো বর্ণের শৈথিল্য ছোঁয়ায়। চটজলদি হাতটা সরিয়ে নিলো। প্রশ্নের সম্মুখীনে দাঁড় করালো বর্ণকে।

_ চলে যাচ্ছেন না কেন? আর কেউ জানুক বা না জানুক,আমি তো জানি আপনার এই চাকরির জন্য প্রস্তুতি, ইন্টারভিউ সব কিছুই ভূয়া। আপনি যে কারণে এখানে এসেছেন তা হবে না,বা হবার নয়। কাল যা হয়েছে তা একটা ভুল মাত্র।

_ সেটা আমি ভালো করেই জানি। ভুল করেই তুই আমার এতো কাছাকাছি এসেছিলি। কিন্তু তোর এতো ভয় কিসের?

বর্ণের প্রশ্নে আঁখি দু’টো জ্বলে উঠলো। ভয়, কোন ভয়ের কথা বলছে বর্ণ। কোথাও কি সে–। না আর নয় লুকোচুরি, যা হবার হবে! এবার সকল সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে। নিজের ভেতরের যন্ত্রণা, আগ্রহ সব দূর রেখে কাঠকাঠ স্বরে নদী উত্তর দিলো।

_ ভয়,কিসের জন্য।

নদীর উত্তর যে এমন হবে তা বর্ণ জানতো? সে তাঁর ঠোঁটটা মিথ্যা প্রসারিত করে একবার নাদীর মুখপানে তাকালো। নদী তখনো নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে। বর্ণও একি ভাবে আকাশ পানে তাকিয়ে বললো।

_ যদি ভালোবেসে ফেলিস ভুলে,ভুলে। ভুল করে ভালোবাসতে গিয়ে যদি তোর কাউকে দেওয়া কথা রাখা না হয়। আমার প্রতি যদি দূর্বল হয়ে অন্য কারো নামে কবুল বলতে না পারিস! আমাকে হারিয়ে ফেলার পর যদি মরণান্তিক যন্ত্রণা আমার মতো তোকেও পেতে হয় । সেই ভয়ে হয়তো আমাকে চলে যেতে বলছিস। যেমনটা কাল ভুল করে নিজেকে আমার সামনে উপস্থাপন করেছিলি।

বর্ণের কথায় নদী মুচকি হাসলো। যে হাসি শুধুই লোকদেখানো আয়োজনের মতো। যে হাসিতে শুধুই ঠোঁট প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু প্রাণ নেই সে হাসিতে। কোথাও সেই হাসি বর্ণের হৃৎস্পন্দনে গিয়ে ঠেকলো। কিন্তু ঠাওর করতে পারলো না সেই হাসির আসল রহস্য। উদঘাটন করা হলো না সেই হাসির আসল কারণ। আর নদী তখন বর্ণের মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে বললো।

_ তাঁকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমি কেন পাবো,যাকে আমি পাবো না বলেই জানতাম। ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো নতুন করে ভুল করে ভালোবাসে না। অন্য কারো লিখিত হওয়া বউ হবো এটা তো আমি আরো এক বছর আগে থেকেই জানতাম, তাহলে কেন তাঁর হতে বুক ধুকপুক করবে আজ। কাউকে কথা দেওয়ার আগেই নিজের সীমাবদ্ধতা আমার জানা ছিলো! তাই তাঁকে কথা দিতে ভয় হয়নি। আর কথা ভাঙার ভয় আমার কোন কালেই ছিলো না যে আজ থাকবে। আমি আপনার ভালোর জন্য আপনাকে চলে যেতে বলছি! আপনি সাধারণ আমার বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হতে পারে শুনতেই, ভেঙে চূর্ণ র্বিচূর্ণ হয়ে পড়েছেন ভেতর থেকে,না জানি অন্য কারো চিরদিনের হওয়ার জন্য যখন আমি কবুল বলবো! তখন না আপনি হার্টঅ্যাটাক করেন। তাই মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যান! অকারণে মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার কি দরকার। আপনার মা বড্ড দুশ্চিন্তা করে আপনায় নিয়ে। তাঁকে বোঝান,তাঁর রাতের ঘুম হারাম করে আমি কখনোই সুখের ঘুম ঘুমাতে পারি না। আমার বাবা সেই শিক্ষা আমায় দেয়নি,আমি যে আমার বাবা-র মেয়ে। আমার ঘরে লুকিয়ে এসে আমায় দেখা, আমার জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করা! আমার ফোন বাজতেই কান খাঁড়া করে শোনা। কি মনে করেছেন সব কিছু আমার অজানা। আমার থেকে লুকিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি সেটা ধরে ফেলেছি।
সবই তো জানেন,নতুন করে প্রশ্ন করার কি আছে। তাই প্লিজ দয়া করে বুকের ভার আর বারাবেন না। চলে যান। কি দরকার সেই মায়ায় পরার,যে মায়ার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি বোঝাতে ব্যর্থ আপনার মা’কে। এতোদিন তো আমি বোঝালাম এবার আপনি বোঝালে যদি সত্যিটা বোঝে।

_ হ্যা ঠিক বলেছিস আমি জানতাম। কিন্তু সবটা নয়। এখন এই মুহূর্তে তোর থেকে সবটা খোলাসা হয়ে গেলো। আমি ভয়ে ছিলাম,যাকে আমি ভাবছি সে যেন না হয়। কিন্তু সব কি আর আমার চাওয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এটাও রইলো না। দু’টো মানুষ, যাঁদের কিনা আমি সব থেকে বেশি ভালোবাসি! সেই দু’টো নারীই আমার কষ্টের কারণ আজ। এক জনের জন্য অন্যজন আজ আমার থেকে দূরে। ইসস এমন ব্যথা কারো না হোক। তুই শুধু একবার বল,তুই আমার হতে চাস! আমি তোকে কথা দিচ্ছি,সকলের সাথে যুদ্ধ করে হলেও আমি তোকে আমার করেই নিবো।

_ লোক হাসাবেন না বর্ণ ভাই। আমি চাই না আমার বাবাকে নিয়ে এই বয়সে লোক হাসুক আর এটা বলুক! যে বন্ধু বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিলো,তাঁর কথা রাখার দিনে বাবা পিছুপা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেঁচো খুঁজতে গিয়ে যে সাপ বেরিয়ে আসবে। নিশ্চয়ই আপনি চান না পুরাতন অতীত আমাদের জীবনে ফিরে আসুক নতুন করে। আমার বাবা ঋণী কারো কাছে। সেই ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। সেদিন চাচি যদি একবার চাচাকে ফোনটা দিতো,আজ আমার আব্বুকে কারো কাছে ঋণী হয়ে থাকতে হতো না। আর সেই ঋণ তাঁর মেয়ে বিয়ে দিয়েও শোধ করতে হতো না

_ কোন অতীতের কথা তুই বলছিস আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সেই অতীতের রেশ ধরেই যদি মা আর তুই নিজেদের মধ্যে একটা দেয়াল সৃষ্টি করিস! আমি বলবো সেই দেয়াল আমার রক্তে মাখামাখি হয়ে ভেঙে না যায়। আমি কিন্তু মোটেও তোকে ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি না,ওয়া নিং দিচ্ছি। এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো।

রাগে গদগদ করতে করতে বেলকনি থেকে বেরিয়ে গেলো বর্ণ। আর অন্য দিকে কান্নায় ভেঙে পড়লো নদী। ভাবতো রইলো গেছে একমাসে বর্ণের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো। বর্ণ যেন পণ করেই এসেছে নদীর ভেতরের সকল খবর জেনে নিবে। সেটাই করেছে সে। হুটহাট নদীর ঘরে এসে তাঁর সব কিছু ঘেঁটে দেখা। কলেজে গিয়ে বসে থেকে দায়িত্ব সহকারে নদীকে বাড়িতে নিয়ে আসা। নদীর পছন্দের ফুলগুলো ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই সকাল সকাল ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা। খাবার টেবিলে ওকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা। পুরো পরিবারের সামনে নিজেকে একজন কেয়ারিং মানুষ হিসেবে দাঁড় করানো। আগের থেকেও নদীর পরিবারের কাছে একজন আদর্শ ছেলে হিসেবে পরিচয় দেওয়া। আর কাল রাতে যখন সবাই মিলে রাতের রূপসা সেতু দেখতে গিয়েছিলো,সব যেন দোষ সেদিনের। পুরোটা সময় যেন আজ চোখের সামনে ভাসছে। খুলনায় থাকা হলে-ও কখনো নদীর রূপসা সেতুর সৌন্দর্য দেখা হয়ে ওঠেনি। চলতি বাস থেকে দেখা হলেও কখনো হেঁটে হেঁটে রূপসা সেতুর সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়নি। শীতের আবহাওয়া পড়তেই চারিদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে রাতের রূপসা সেতুর সৌন্দর্য দেখতে। তেমন নদীরাও গিয়েছিলো। সেদিন পরিবারের সবাই নিজেদের মতো করেই ঘোরাঘুরি করেছিলো। কিন্তু বর্ণ যেন নদীর প্রতিটি পদধ্বনির আওয়াজ গুনছিলো ওর পাশে থেকে। সেতুর কিনারে দাঁড়িয়ে যখন রাতের আঁধারে নদীর জল গুলো দেখছিলো, তখন শীতল হাওয়া চোখেমুখে আঁচড়ে পড়ছিলো নদীর। চোখ খুলে তাকাতেই পারছিলো না সে। ঠিক তখন নিজের হাতটা বাড়িয়ে নদীর চোখের সামনে ধরেছিলো বর্ণ। বাতাসের তীব্র ঝাপটা হঠাৎ উধাও হতেই চোখ খুলে তাকালো নদী, চোখের সামনে বর্ণের হাত দেখেছিলো সে।হাতটা এটাই বুঝিয়েছিলো সকল কষ্ট আর বিপদ থেকে সেই পারবে আগলে রাখতে তাঁকে । কোথাও যেন তখন ভালো লাগা কাজ করেছিলো মনে। বর্ণকে পাশে পেয়ে সেই সৌন্দর্য যেন আরো কয়েক গুন বেড়ে গেছে নদীর কাছে। প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে বর্ণের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ যেন নদীকে মাতাল করেছে। কিছু মুহূর্ত যখন নিজ থেকে ধরা দেয়, কার সাধ্যি তাঁকে দূরে ঠেলে দেওয়ার। তেমন নদীও পারেনি বর্ণকে দূরে সরিয়ে দিতে! আর সেটাই কাল হলো নদীর। সেই পুরো সময়টা বর্ণ নদীকে গভীর ভাবে লক্ষ করেছে! যাতে প্রমাণ হয়েছে নদীও প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসে বর্ণকে। যেটা সে মুখে বলতে বা বোঝাতে কখনোই চায়নি। গেছে কালকের স্মৃতি যেন নদীকে আরো কষ্ট দিলো। হুহু করে কেঁদে উঠলো সে। কেন তাঁর সাথেই এমন হলো? হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকালো নদী। দেখতে পেলো রাগ করে চলে যাওয়া প্রেমিক পুরুষটা আবারও ফিরে এসেছে। অর্ধ,নিভন্ত বীভৎসের মতে সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে নিজের কষ্ট যেন সে ভুলে থাকতে চাইছে।
এবার নদী যেন এক ভাঙা প্রণয়ী হয়ে ধরা দিলো বর্ণের কাছে। ঝাপটে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। কান্নার কোন শব্দ নেই,তবে গভীরতা ছিলো।

ইনশাআল্লাহ চলবে

কিছু কথা বলে যান।
ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here