সম্পর্ক,পর্ব-৪

সম্পর্ক (৪)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

_____________
মৌনি হতবাক! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এটা কী হলো? সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি এভাবে প্রান্তের সামনে অপদস্ত হবে। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মৌনি। পড়েছে, পড়েছে, এভাবে ধপাস করে পড়তে হল! ইশ… প্রান্তের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা লাগছে মৌনির। কোনোভাবেই প্রান্তকে সুযোগ দেওয়া যাবে না, তার এই পড়ে যাওয়া নিয়ে মজা করার ব্যাপারে, তাই দ্রুত উঠার চেষ্টা করল মৌনি, পায়ের ব্যথায় পারল না। পড়ে গিয়ে ব্যথা টা বেশি লাগছে এবার। প্রান্ত উঠে দাঁড়াল, মৌনি পা ছড়িয়েই বসে রইল।

–‘আমার হাত ধরে উঠার চেষ্টা করো।’ বললো প্রান্ত, হাত বাড়িয়ে দিল। মৌনি হাত ধরল না, উলটো নাকের পাঠা ফুলিয়ে বলল, ‘আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ফেলে দিয়েছেন তাই না? ফেলে দিয়ে এখন আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে?’

–‘আমি তোমাকে ফেলে দিছি? নাকি তুমি আমাকে ফেলে দিছো?’

–‘আমি কখন ফেললাম? ফেলছেন তো আপনি, তাও ইচ্ছে করে।’

প্রান্ত’র মেজাজ গরম হয়ে গেল। কত্তো মিথ্যুক মেয়ে! প্রান্ত বাড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে নিতে চাইল, মৌনি নিজে থেকে প্রান্তের হাত ধরল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। পায়ে প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে।

মৌনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি বাবাকে বলে দিবো, আপনি আমাকে ফেলে দিয়েছেন।’

–‘আমি তো ফেলিনি।’

–‘আমি মিথ্যে বলব, সমস্যা?’

–‘তাহলে আমিও আংকেল কে বলে দিবো, তুমি এখানে এসে তোমাকে পড়াতে মানা করছো।’

–‘প্রমাণ আছে কোনো?’

–‘তোমার কাছেই বা কী প্রমাণ আছে যে আমি তোমাকে ফেলে দিছি?’

কথার পিঠে যুক্তিসঙ্গত কিছু খুঁজে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল মৌনি। এবার প্রান্ত হাসল, কৌতুক মিশ্রিত হাসি, ‘শোনো মেয়ে, তোমার মতো এরকম উশৃংখল রোগী আমি অনেক দেখেছি আর এদেরকে কীভাবে টাইট কর‍তে হয়, সেটাও আমি জানি। তাই শুধু শুধু আমার সাথে লাগতে এসো না। বুঝছো?’

প্রান্ত মৌনির সামনে থেকে সরে গিয়ে খাটের উপর বসল। মৌনি ঠোঁট ভেঙে বলল, ‘আমি উশৃংখল?’

–‘তা নয়তো কী?’

–‘আমি… আমি আপনাকে দেখে নেবো।’

–‘তোমার সামনেই তো আছি। যত ইচ্ছা দেখে নাও। কোনো সমস্যা নেই।’

মৌনি কথা বাড়ালো না। তার মেজাজ তুঙ্গে.. সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোরকমে নিচে চলে গেল। প্রান্ত হাসল, বিজয়ের হাসি। তাকে কাবু করা এত সহজ নয়। হুহ!

____________
কোচিং এ এসেছে দুপুর, কিন্তু চাঁদ নেই। ক্লাসে আসেনি। দুপুর চাঁদের বাসায় গেল এরপর। চাঁদ গেমস খেলছিল, হুট করে দুপুরকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।

দুপুর ঘরে ঢুকেই চাঁদের উপর চড়াও হয়। কাঁধ থেকে ব্যাগ টা খুলে নিয়ে চাঁদের গায়ে ছুঁড়ে মেরে বলল, ‘আমার ফোন কেন ধরছিলে না?’

চাঁদ গমগমে আওয়াজে বলল, ‘এটা তোমার বাসা না বা পাবলিক প্লেস না। এটা আমার বাসা, বিহেভ ইউরসেল্ফ।’

দুপুর একটু নিভল। চাঁদের পাশে বসে ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘আমার কতটা টেনশন হচ্ছিল জানো?’

–‘টেনশন কী আমার জন্য হচ্ছিল নাকি আমি তোমার হাজবেন্ড কে সব বলে দিয়েছি, এটা ভেবে হচ্ছিল।’

–‘দুটো নিয়েই হচ্ছিল। তবে আমার বিশ্বাস আছে, আমার ক্ষতি হয় এমন কিছুই তুমি করবে না চাঁদ!’

চাঁদ রহস্য করে হাসল, ‘তুমি আমার কে হও দুপুর? তোমাকে নিয়ে এতো ভাবার সময় কই আমার?’

দুপুর অবাক হল, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো চাঁদ, তাই না?’

–‘ধুরো! তোমার মতো বোকা মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি। তোমার হাজবেন্ড আছে, তুমি বিবাহিতা, এরপরও তোমাকে কেন ভালবাসবো আমি? হোয়াই? আর যেই মেয়ে হাজবেন্ড থাকা স্বত্তেও অন্য ছেলের কাছে নিজেকে সপে দেয়, সেই মেয়েকে আমি ভালবাসবো? আমি? প্রশ্নই আসে না দুপুর।’

দুপুরের চোখ ভরে এলো।

–‘শোনো দুপুর, এসব কান্নাকাটির নাটক আমার সাথে করবে না তো প্লীজ। আম্মু দেখলে সন্দেহ করবে আবার। দ্রুত চোখ মুছো।’

দুপুর নিঃশব্দে চোখ মুছল।

–‘মজা তুমিও পাইছ, আমিও পাইছি। ব্যস, শেষ।’

–‘তাহলে যে তুমি আমার জন্য হাত কেটে চিঠি লিখেছিলে? লিখেছিলে, তুমি আমাকে ভালবাসো, সেসব?’

–‘আরে ধুর! ওটা মুরগীর রক্ত ছিল। আমার ঠ্যাকা পড়ছে তোমার মতো একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য নিজের হাত কাটব?’

দুপুর স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো, পরমুহূর্তেই জ্বলে উঠল, ‘তোমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমারও কোনো ঠ্যাকা পড়ে নাই চাঁদ। কথাবার্তা সাবধানে বলো। আমাকে থার্ড ক্লাস বলার আগে নিজের স্ট্যান্ডার্ড দেখো।’

–‘আমার স্ট্যান্ডার্ড? হাহ! আর তুমি সাবধানে কথা বলো। আমি চাইলে তোমার অনেক কিছুই করতে পারি।’

–‘কী করবে শুনি, কী করার থ্রেট দাও আমাকে, শুনি তো।’

চাঁদ ফোনের গ্যালারি ওপেন করল। সেখানে দুপুরের সাথে অসংখ্য ক্লোজ পিক তোলা। গতকাল ঘুরতে গিয়েও তুলেছিল। সেসব দুপুরের সামনে তুলে ধরতেই দুপুর ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। চাঁদ হেসে উঠল, ‘আমাকে ২০০০ টাকা দিয়ো তো দুপুর।’

–‘আমি এত টাকা কই পাব!’ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল দুপুর।

–‘আমি কী জানি? সেটা তোমার ব্যাপার। আমাকে দিতে হবে ব্যস, নইলে…’

–‘নইলে?’ দুপুরের বুক ধুকপুক করছে।

–‘এই ছবিগুলো দেখেও বুঝতে পারছো না নইলে কী?’

দুপুর কান্না করে ফেলল।

–‘আমি কোথায় পাবো দুই হাজার টাকা! প্লীজ আমাকে ক্ষমা করো চাঁদ। এসব কাউকে দেখিয়ো না। প্লীজ।’

–‘কেঁদে লাভ নেই। আমার রেকর্ড সম্পর্কে জানা নেই তোমার? আমার পা ধরেও কেউ ক্ষমা পায় না, আর তুমি তো! না কেঁদে বাসায় যাও, দুইদিন সময় দিলাম। সুন্দর মতো টাকা নিয়ে দু’দিন পর হাজির হবে। আল্লাহ হাফেজ।’

দুপুর অনুনয় করে, অনুরোধ করে, চাঁদ কিছুই শুনলো না। এক পর্যায়ে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা আঁটকে দিল। দরজায় টাকাটাকি করার সাহস দুপুরের হয় না। বাসায় চাঁদের আম্মা আছেন। পরে উনি কিছু একটা সন্দেহ করবেন। তাই চুপচাপ বেরিয়ে আসে দুপুর। এসেই মনে হয়, তার শরীর ভেঙে যাচ্ছে। আর পারবে না, এক পা-ও চলতে পারবে না সে।

আরাফ রাতে বাসায় ফিরে। ডিনার শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল, রতি নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

–‘একটা কথা বলতে চাই।’ সাহস সঞ্চয় করে বলল রতি।

–‘কান আছে শুনছি।’ যেন রতির কণ্ঠস্বর শুনেই বিরক্ত হয়ে পড়েছে আরাফ।

–‘আহ্নির কাছে একটা চাকরি আছে। অফিসিয়াল চাকরি। ভালো বেতন, মোটামুটি, আমার জন্য অনেক। আমি চাকরিটা করতে চাই।’

আরাফ ফিল্টারে শেষ টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে রতির দিকে তাকাল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।

তারপর একসময় বলে,
–‘চাকরির দরকার কী?’

–‘এমনিই। আমি নিজে কিছু একটা করতে চাই আরাফ। আমি মেয়ে বলে কী শুধুই ঘর সামলাবো?’

–‘ছেলেরা বাহিরে কাজ করলে হয় বাদশা, আর মেয়েরা বাহিরে কাজ করলে হয় বেশ্যা। তুমি বেশ্যা হতে চাও?’

–‘আরাফ, তোমার অফিসেও তো কত মেয়ে কাজ করে, তাই না? তারা কী বেশ্যা?’ রতির বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে।

–‘হ্যাঁ, বেশ্যা। একেকটা রাত পর্যন্ত অফিসে থাকে। বসের সাথে ঢলাঢলি করে। ঘরের ভেতর আরামে আছো, সেটা সহ্য হচ্ছে না?’

–‘তুমি এই যুগের ছেলে হয়ে এসব বলছ? এখনকার ছেলেরাও চায় তাদের ওয়াইফ সাবলম্বী হোক। আর তুমি…’

–‘সবার মন মানসিকতা এক? আমি চাই না আমার স্ত্রী বাহিরে পুরুষের সাথে হেসেখেলে নাটক করুক! আর সমাজের লোক আমাকে এসে ছিঃ ছিঃ করে যাক। তোমার কাজ হেঁসেল সামলানো, ওটাই সামলাও। এসব চাকরি-বাকরির ভূত মাথা থেকে নামাও। আর একান্তই যদি করতে ইচ্ছে করে তবে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে করো। যত্তোসব…’

আরাফ বারান্দা ছাড়ে, রতি একলা আকাশ দেখে আর নোনাজল ঝড়ায়। এটা তো কথা ছিল না! আরাফ বলেছিল, পৃথিবীর সব সুখ রতির পায়ের তলায় এনে দিবে, কই? আরাফ তো তার কথা রাখেনি..
ছেলেরা এমনি। বিয়ের আগে দেওয়া শত সহস্র কথা, বিয়ের পর এক নিমিষেই ভুলে যায়। অথচ মেয়েরা যদি একটু উনিশ-বিশ করে তবে কথায় কথায় বলবে, ‘তোমাকে বিয়ে করা আমার লাইফে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তোমার কারণে আজ আমার জীবন শেষ।’ মেয়েরা তা বলতে পারে না! মেয়েদের জবান থাকতেও তারা মূক, বোবা!
___________
প্রান্ত ডিনারের জন্য মৌনিদের বাসায় এসেছে। যতদিন প্রান্ত কোনো টিউশনি না পাচ্ছে ততদিন বিনামূল্যেই মঈনুল হোসেনের বাড়িতে তিনবেলা খাবে সে৷

মঈনুল হোসেন বললেন, ‘তা কবে থেকে পড়াবে মৌনিকে?’

–‘আগামীকাল থেকে আংকেল।’

–‘দেইখো কিন্তু, ও হচ্ছে দুনিয়ার ফাঁকিবাজ। যতসব ধান্দামি ওর ভেতরে, পড়ালেখার প্রতি কোনো মন নেই।’

প্রান্ত মৌনির দিকে তাকায়। মৌনির গলায় ভাত আঁটকে গেছে।

–‘আপনি চিন্তা করবেন না আংকেল। আমিও জানি কীভাবে বাঁকা লাঠিকে সোজা কর‍তে হয়।’

মৌনি দাঁত দিয়ে দাঁত ঘষে। একবার সুযোগ পেলে ভাতের মতো প্রান্তকেও চিবিয়ে খেয়ে নিবে সে… পানি ছাড়াই, হুহ!

(চলবে)
*গল্পটা প্রতিদিনই দেওয়ার চেষ্টা করব। তাই সবগুলো পর্ব একটু ছোটো ছোটো হবে। আপনারা মানিয়ে নিয়েন💜আর হ্যাঁ, দুপুরের দুর্দশা শুরু হতে যাচ্ছে🥱।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here