সম্পর্ক,পর্ব-২২

#সম্পর্ক
#২২

‘নুসরাত’ নামের মেয়েটির সোফা ঘরে আহ্নি বসে আছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললে বেশি ভালো হয়। একটা ট্রে-তে চা,বিস্কুট, সাথে পুডিং ও দিয়েছেন উনি। কথাবার্তাও বেশ অমায়িক, প্রথম দেখায় অপরিচিত কারো সাথে এরকম ব্যবহার, আহ্নি আশা করেনি। মনে মনে অনেকটা সন্তুষ্ট হয় সে। এই মহিলাটির সঙ্গে ওই বুইড়া পাঠা মফিজুলকে একদমই মানাতো না।

প্রান্ত ফিসফিস করে বলল, ‘মহিলাটি ভালোই মনে হচ্ছে।’
আহ্নি হাস্যজ্বল মুখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘এভাবে ফিসফিস করছ কেন? উনি দেখলে কী ভাববে?’
প্রান্ত এবার স্বাভাবিক তবে নিচু স্বরে বলল, ‘উনি তো এখন নেই। আসুক আগে। কিন্তু আমার কাছে ভালোই লাগলো। প্রতিটা কথার আগে ঠোঁটে হাসি!’
‘হুম, অতিথি পরায়ণ খুব।’

প্রান্ত কিছু বলতে নিচ্ছিলো, তখন নুসরাত রুমে ঢুকলেন। প্রান্ত চুপ করে গেল। নুসরাত ঠোঁটে জ্বলজ্বলে হাসি নিয়ে ওদের সামনের সোফায় বসল। বলল, ‘সরি, একটু অপেক্ষা করালাম। আসলে রান্নাঘরে…’
আহ্নি তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয়, ‘না, না, কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমাদের কোনো প্রবলেম হয়নি। ইটস ওকে।’
নুসরাত হাসি চওড়া করে বললেন, ‘তুমি বেশ চটপটে মেয়ে। আই লাইক ইউ। আমি ফোনে ভেবেছিলাম না জানি কত বড় হবে তুমি। অথচ এখন দেখছি নিতান্তই বাচ্চা!’
‘বাচ্চা বলে কী জোক করলেন?’ হাসিমুখেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল আহ্নি।
‘উঁহু, না না, সেরকম মোটেও না। তুমি বয়সে ছোট হতে পারো কিন্তু বুদ্ধিতে যে নও, আমি দেখেই বুঝে গেছি। নইলে এইটুকুন তুমি একাই কাউকে খোঁজার মতো বিশাল কাজে নেমে পড়তে না।’
আহ্নি চাপা গলায় বলল, ‘যাকে খুঁজছি, সে আমার খুব স্পেশাল।’
‘বোন বুঝি?’
‘তার চাইতেও বেশি কিছু।’

নুসরাত বললেন, ‘তাহলে বলো, কীভাবে তোমার সাহায্য করতে পারি।’
আহ্নি এইবার নড়েচড়ে বসল। চেহারায় সিরিয়াসনেস এনে বলল, ‘আমার কিছুর প্রশ্নের জবাব চাই, ব্যস।’
‘কী বিষয়ে?’
‘মফিজুল আলমের ব্যাপারে।’

মফিজুল আলমের নামটা উচ্চারিত হতেই নুসরাতের চোখজোড়া বিতৃষ্ণা আর বিষন্নতায় ভরে উঠল। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ালো না আহ্নির। সে আরও তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। নুসরাত বাহির থেকে ভালো কথার মানুষ হতে পারে, কিন্তু ভেতরটা হয়তো নোংরামিতে ভরা। কোনোভাবেই তার প্রতিটি কথা যুক্তি ছাড়া বিশ্বাস করা যাবে না।

বিষন্নতা আড়ালে রেখে নুসরাত বললেন, ‘কী জানতে চাও ওর ব্যাপারে?’ গলা দিয়ে ঝরে পড়ছে বিরক্তি।
আহ্নি খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করল। বলল, ‘সে কেমন সেই ব্যাপারে জানতে চাই।’
‘আস্তো লম্পট।’ মুখ ফসকে বলে ফেললেন নুসরাত। প্রান্ত ভ্রু কুঁচকালো, আহ্নির মধ্যে তেমন ভাবান্তর হলো না।
নুসরাত নিজের মুখ সামলে নিলেন, ‘সরি। আসলে ও এত খারাপ যে ওর নাম শুনলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। মেজাজ নষ্ট হয়।’
‘কেন? কী করেছে আপনার সাথে?’
‘কী করে নাই তাই বলো। আমার বাবা বোকাসোকা মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুর সময় আঠার মতোন লেগে থাকতো সবসময়। একসময় বাবাকে পটিয়ে ফেলল। বাবাও এত দারুণ ছেলে পেয়ে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। মৃত্যুর আগে আমার বিয়ে হয়ে গেলে উনার আর চিন্তা থাকবে না। মফিজুল তো এটাই চেয়েছিল মনে মনে। প্রস্তাবটি লুফে নেয়। আমাদের বিয়ে হয়। তখন আমি একজনকে ভালোবাসতাম কিন্তু সে তেমন কোনো আহামরি চাকরি কর‍ত না। তাই বাবাকে বলার পরেও বাবা রাজী হয়নি। আমিও মৃত্যু পথের যাত্রী বাবাকে দেখে আর না করতে পারলাম না। করলাম বিয়ে। বিয়ের পর একবছর মোটামুটি ভালো ছিলাম। এরপর বাবা মারা গেলেন।ব্যস, মফিজুলের আসল রূপ আমার সামনে বেরিয়ে আসে। ও প্রতিনিয়ত আমাকে টর্চার করতে লাগল। শারীরিক, মানসিক, দুই ভাবেই। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে কারো সাহায্য নিব, এই ভেবে ও আমাকে গৃহবন্দী করে ফেলল। রাত দুপুরে মেয়ে নিয়ে চলে আসতো ফ্ল্যাটে। আমাকে একটা রুমে আঁটকে রেখে পাশের রুমে ওই মেয়েদের নিয়ে লীলাখেলা চালাতো। একটা স্ত্রীর জন্য এই দৃশ্য সহ্য করা কতটা কষ্টকর, বুঝতে পারছ তুমি?’

আহ্নি মৃদু মাথা ঝাঁকালো। নুসরাতের চোখ দুটো ছলছল করছে। সেই দৃশ্যের কথা ভেবেই হয়তো কান্না পেয়ে যাচ্ছে আবার। সে আবার বলতে লাগল, ‘বাবার একমাত্র আদরের কন্যা ছিলাম। মা ছিল না। সাতকূলে কেউ ছিল না তেমন। বাবার সব সম্পত্তি আমারই ছিল। একসময় সেসব চেয়ে বসে মফিজুল। আমি রাজি হলাম না। মফিজুল শারীরিক অত্যাচার বাড়িয়ে দিল। একসময় সহ্য করতে না পেরে সব ওর নামে লিখে দিলাম। বিনিময়ে মুক্তি চাইলাম, ও দিল না। উল্টো একদিন কাউকে বলতে শুনলাম, আমাকে মেরে ফেলার পর কোথায় কীভাবে গায়েব করলে ভালো হবে। আমার তখন যে কী অবস্থা! আমি বোঝাতে পারব না তোমাকে। বুঝতে পারছিলাম, ও আমাকে সরিয়ে ফেলবে। মেরে ফেলবে। সেই রাতে আমি খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলি। বলে না, মৃত্যু সত্য জেনেও সবাই মৃত্যুর থেকে বাঁচতে চায়? আমিও চাচ্ছিলাম। ও ঘুমিয়ে পড়লে ওর মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা নেই। তারপর বারান্দা থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে ওই শাড়ি ধরে নেমে পড়ি। কত যে ভয় আর যন্ত্রণার সেই মুহুর্ত! মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পড়ে গেলাম। সব ভেঙে গেল হাত-পা। পায়ের নিচে মাটি পেয়ে আর একদন্ড দেড়ি করিনি। ইচ্ছেমতো দৌড়েছি। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছিলাম জানি না। শুধু দৌড়ে গেছি।’

আগ্রহে চোখজোড়া চকচক করছে আহ্নি, প্রান্তের। দু’জনেই নুসরাতের বলা গল্পে ঢুকে গেছে। এইরকম কিছু বাস্তবেও কারো জীবনে ঘটতে পারে! তাদের জানা ছিল না। নুসরাত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, ‘ তোমরা তো কিছুই খেলে না এখনো! কেন? চা ভালো হয়নি?’
‘না, না, ভালো হয়েছে তো। অনেক ভালো হয়েছে।’ বলতে বলতে নিজের কাপ তুলে নিল আহ্নি। এক চুমুকে সবটুকু ঠান্ডা চা গিলে ফেলল। নুসরাত শব্দ করে হেসে উঠলেন, ‘ভারী মজার মেয়ে তো তুমি।’
প্রত্যুত্তরে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে আহ্নি।
‘এরপর বলবেন না?’
‘এরপর আর তেমন কিছু নেই বলার। রাতটুকু রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে, দিনে ফোন দেই আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের নাম্বারে। ভাগ্যিস ওর নাম্বারটা মুখস্থ ছিল।’
‘কীভাবে ফোন দিলেন? আপনার সঙ্গে তো কোনো ফোন ছিল না।’
‘ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান থেকে।’
‘ওহ…তারপর…’
‘ওকে সব বলি। ও তখন মোটামুটি বেতনের চাকরি করত। আল্লাহর দয়ায়, তখনো আমার জন্য ওর মনে কিছু একটা ছিল। অসহায়, বিধস্ত, একদম শূন্য আমাকে ও ফেরাতে পারেনি। মফিজুল পরে আমাকে খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু বলেছে, আমি যদি ওর বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ না নেই, ও আমার বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো আক্রমণ চালাবে না। আমি ওর কথা মেনে নেই। তখন একটু শান্তিতে থাকতে চাচ্ছিলাম নতুন সংসার, নতুন জীবন নিয়ে। এরপর আর কখনো আমাদের দেখা হয়নি।’
আহ্নি অবাক গলায় বলল, ‘আপনার সমস্ত সম্পত্তি এভাবে ছেড়ে দিলেন?’
‘দিলাম। সম্পত্তির প্রতি কোনো লোভ আমার নেই, আমার হাজবেন্ডেরও নেই। আর আল্লাহ আমাদের প্রতি মুখ তুলে চেয়েছেন বিধায়, আজ এতটা ভালো পর্যায়ে আছি। ও থাকুক ওর সম্পত্তি নিয়ে। ওর শাস্তি একদিন হবেই, আমি জানি।’

‘আপনি যে একটা নতুন জীবন পেয়েছেন, এই জন্যে অনেক অনেক অভিনন্দন। দোয়া করি, আপনি খুব ভালো থাকুন।’ অভিবাদন জানালো প্রান্ত।
নুসরাত খুশি হলেন, ‘তোমরাও। এখন বললে না তোমাদের সাহায্য কীভাবে করব আমি?’
‘আমি নিজেও জানি না আসলে। আমি আপনার কাছে কেন এসেছি তাও জানি না। আসলে, যিনি মিসিং, তিনি আমার ভাবি। মানে এককালে আমার ভাইয়ের ওয়াইফ ছিল,এখন নেই। কিন্তু তার সাথে আমার সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তরের… ভাবি যেই অফিসে কাজ করত, ওটায় মফিজুল আলম ও কাজ করেন। আজকে বেশ কয়েকদিন যাবত ভাবি মিসিং। মিসিং ঘটনা ঘটেছে, ভাবিদের চাঁদপুরে যাওয়ার কথা ছিল, আউটডোরে। ভাবি ঢাকা থেকে রওনাও হয়েছিল রাতের বাসে। সকালে গিয়ে ইনফর্মও করেছিল যে চাঁদপুর পৌঁছেছে। কিন্তু এরপর থেকে ভাবির ফোন অফ। তাকে আর খুঁজে পাইনি আমরা।’

নুসরাত এক গালে হাতের ভর রেখে গোল চোখ তাক করল, ‘বলো কী! এভাবে একটা মেয়ে হাওয়া? কোনো পুলিশি একশন নাও নি তোমরা?’

‘নিয়েছি। মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশও খুঁজে পায়নি৷ আর এখন তারাও হাত গুটিয়ে বসে আছে। তেমন কোনো কসরত করছে না। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে তো হবে না। তাই ভাবলাম আমিই একটু ঘেটেঘুটে দেখি। যদি কোনো ক্লু পেয়ে যাই।’
‘বাহ! তোমার প্রচেষ্টা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। তো আমার কাছে কেন?’
‘ভাবির অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, মফিজুল আলম নাকি ভাবিকে অনেকবার প্রপোজ করেছে। ভাবিকে বিয়ের জন্য অফার করছে। কিন্তু ভাবি এক্সেপ্ট করে নাই। উনি কেমন, সেটার ধারণা আমার ভাবির হয়ে গেছে। কিন্তু খটকা লাগলো এখানে যে, ওই আউটডোরে উনারও যাবার কথা ছিল। অথচ উনি নাকি হঠাৎই ক্যান্সেল করে দিছে আর বলছে যে শরীর খারাপ। উনাকে গতকাল দেখে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষই লাগছে আমার কাছে। শরীর খারাপের কোনো লক্ষণ নেই। হয়ত আমার মনের ভুল বা বেশি ভাবছি আমি। তারপরও ছোট খাটো কোনোকিছুই এড়াতে চাই না। হতে পারে এইসব ছোট ছোট জিনিসই ক্লু। তাই আপনার কাছে এসেছি। উনি কেমন সেটা আরও ভালো মতো জানার জন্য।’

নুসরাত ভাবনায় পড়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘একটা মেয়েকে গায়েব করার পেছনে ওর হাত থাকতে পারে, জিনিসটা বিশ্বাস হয় আবার হয় না। এতটা নিচেও নামতে পারে ও! বুঝতে পারছি না আসলে। ফিফটি ফিফটি চান্স, সে যাই হোক, আমি যতটুকু বলেছি তাতেই আশা করি ধারণা হয়ে গেছে, ও মানুষ হিসেবে কতটা জঘন্য এবং নোংরা।’
‘হুম, আমার লাস্ট একটা ফেবার করবেন?’
‘অবশ্যই আহ্নি, বলো।’
‘ধরেন যদি ভাবির গায়েবের পেছনে উনিই থেকে থাকে, তাহলে আপনার কী মনে হয়? কোথায় নিয়ে রাখতে পারে ভাবি কে বা কী কর‍তে পারে? দেখুন আমি বলছি না যে উনিই আছেন, জাস্ট মনে করতে বলছি। এভাবে ভাবলে আপনি হয়ত কোনো ঠিকানার কথা মনে করলেও করতে পারেন!’
‘ঠিকানা পেলে কী সেখানে গিয়ে গিয়ে চেক করবে আহ্নি?’

আহ্নি মৃদু হাসলো, সে উত্তর দেওয়ার আগেই প্রান্ত বলল, ‘ওর রতি ভাবির জন্য যে কী কী করতে পারবে, আপনার ধারণাই নেই সেই সম্পর্কে। না হলে দেখুন না, এইটুকুন মেয়ে, একা আমাকে নিয়ে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবল না নিজের ক্ষতি হতে পারে!’
আহ্নি চোখ রাঙিয়ে তাকাল, প্রান্ত চুপসে চুপ হয়ে গেল। নুসরাত মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন। পরক্ষণেই চুপ হয়ে গভীর ভাবনাগ ডুবে গেলেন। মফিজুলের সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়েছে অনেক বছর হবে। এই এত বছরে মফিজুলের সবকিছুই পাল্টে গেছে। কোথায় থাকে এখন, নাকি এখনো নুসরাতের বাবার ফ্ল্যাটেই আছে কে জানে? নুসরাত দীর্ঘ সময় ভাবনা চালায়। তারপর একসময় বলে উঠলেন, ‘দেখো, ও এখন কই থাকে সে সম্পর্কে আমার কোনো আইডিয়াই নেই। তবে দুইটা এড্রেস দিচ্ছি,একটা আমার বাবার ফ্ল্যাট যেটা বনানীতে আছে। আর একটা ময়মনসিংহের ওর গ্রামের বাড়ি। একটু ওয়েট, আমি একটা কাগজে ঠিকানা দুটো লিখে দেই।’

ঠিকানা ওয়ালা কাগজটা হাতে আহ্নি, প্রান্ত দু’জনেই বেরিয়ে এলো নুসরাতের বাসা থেকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে ধীর পায়ে হাঁটছে আকাশ, আকাশের নিচে পিচ ঢালা পথের ফুটপাত পেরিয়ে একটা ওভার ব্রিজের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আহ্নি। প্রান্তও দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, ‘কী ভাবছো?’
‘ঠিকানা তো পেলাম। কিন্তু এইসব জায়গায় গিয়ে কী পাব ভাবি কে?’ ভাবতে ভাবতে জবাব দিল আহ্নি।
প্রান্ত বলল, ‘গ্রামের বাড়িতেও যাবা?’
‘যাব, যদি বনানীর ফ্ল্যাটে কিছু না পাই তাহলে। আগে ফ্ল্যাটে যাব। চেক করব। আল্লাহ যেন দয়া করে প্রান্ত। আর ভালো লাগছে না।’ বড্ড করুণ শোনালো আহ্নির কণ্ঠটা।
প্রান্ত আহ্নির একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘আল্লাহ ভরসা। তুমি চিন্তা করো না।’

_________
ছাদের দরজায় পা রাখতেই মৌনির উঁচু কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল প্রান্ত। এমনিতেই চতুর্দিকের ঝামেলার কারণে উদাসীন থাকে সবসময় তাই মৌনিকে সে একদমই খেয়াল করেনি প্রথমে। যখন করল, তখন বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইল। মৌনির পরনে থ্রি-কোয়াটার জিন্স, বাম পায়ে একটা কালো ধাঁগা বাধা। টকটকে লাল শার্টের মাঝে কালোর স্টেপ দাগ, কলারটাকে উঁচু করে রেখেছে। হাতাগুলো কনুই অবধি গুটানো, একহাতে আচারের বাটি, অন্য হাতে একটুকরো আচার, যেন অমৃত — এমন মুখোভঙ্গি করে মুখে পুরছে সেগুলো মৌনি। প্রান্ত বিষম খাওয়া গলায় বলল, ‘এসব কী মৌনি? এরকম পাগল সেজে আছো কেন?’
মৌনির মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে নির্বিকার, দায়সারাভাবে বলল, ‘এসবই তো ফ্যাশন, আর আপনি পাগল বলছেন। ব্যাকডেটেড আপনি।’
‘এসব নায়িকাদেরই মানায়। আমাদের মতো সাধারণ পাবলিকের না।’
‘নায়িকারাও সাধারণ মানুষই হয় স্যার। ওদেরকে আমরাই ভিন্ন চোখে দেখি। আর আমি যা ইচ্ছা তাই পড়ব,আপনার কী?’

এইবার প্রান্ত চুপ হয়ে গেল। বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। পেছন পেছন মৌনিও এলো। তাকে দেখে প্রান্ত বলল, ‘এখন ডিস্টার্ব করো না প্লীজ। আমার মন মেজাজ এমনিতেই অনেক খারাপ আছে মৌনি।’
মৌনি ভ্রু কুঁচকে ফেলল, ‘আপনাকে ডিস্টার্ব দেওয়ার জন্য তো আসি নাই স্যার। আপনি আমার টিচার, আপনাকে জ্বালাবো কেন আমি? আসছি জিজ্ঞেস করতে যে আজকেও পড়াবেন নাকি পড়াবেন না? গত দুইদিন ধরে আপনি পড়াচ্ছেন না আমাকে।’

‘আজকেও পারব না বোধহয়। আমি ঝামেলায় আছি কিছু।’
‘এটা কেমন কথা! আপনার ঝামেলা আপনার থাক, তাই বলে আমাকে পড়াবেন না? সামনে আমার এক্সাম তো নাকি! আর একটা বলি স্যার, ডোন্ট মাইন্ড, আমার বাবার উপর আপনার অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আফটার অল…’
মৌনি বাকি টুকু বলল না, থেমে গেল। প্রান্ত চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল। এইসব কথা কে বলছে তাকে? মৌনি? সেই মৌনি যে একসময় প্রান্তের জন্য পাগল পাগল ছিল? প্রান্তের উপস্তিতি যাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতো? প্রান্তের সামনে নিচু গলায় কথা বলতেও যার কণ্ঠ কাঁপতো? সেই মৌনির মুখে আজ এত বড় কথা!
প্রান্তের অনেক খারাপ লাগল, অনেক। সে এতিম, তার বিপদের সময় মঈনুল হোসেন সাহায্য করেছেন, এই জন্যে তাকে আজীবন সব লাঞ্চনা,গঞ্জনা সহ্য করে নিতে হবে মাথা পেতে? মৌনির মা তো তাকে একদমই পছন্দ করে না। সবাই খায় গরম তরকারি, তাকে বাসী-আগের দিনের তরকারি দিয়ে চালিয়ে দিতে হয়। তবুও সে কখনো বলেছে কিছু?
আর আজ এইটুকুন মৌনি, কত্তবড় কথা বলল!
প্রান্ত গমগম স্বরে বলল, ‘তুমি নিচে যাও মৌনি। আর স্যার কে বলে নতুন টিচার খুঁজে নাও। আই এম সরি। তোমাকে পড়াতে পারব না আর। না, থাক, তোমার বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলে দিবো স্যারকে। আর এখানে থাকা নিয়েও কয়টা কথা আছে আমার উনার সাথে।’
‘আপনি কী আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যাবেন?’
‘সেটা তোমার জেনে কোনো লাভ নেই।’
গর্জে উঠল প্রান্ত। খুব রাগ হচ্ছে তার৷ কাউকে উপকার করে, সেই উপকারের রেশ ধরে তাকে বারবার ছোটো করা কোন ধরনের সভ্যতা, মঈনুল হোসেন কে জিজ্ঞেস করবে প্রান্ত। আর রতি ভাবিকে খুঁজে পাক আগে, তারপর সে এই বাসা ছেড়ে কোথাও একটা চলে যাবে। এখন তার ভয় নেই আর। আহ্নির মতো সাহসী, সাপোর্টিভ মেয়ে আছে তার পাশে।

মৌনি চলে আসতে আসতে বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনার উপর থেকে সমস্ত অনুভূতি মুছতে হলে আপনাকেই এই বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে স্যার। চোখের আড়াল হলে, আমার মনেরও আড়াল হয়ে যাবেন, আমি নিশ্চিত।’

___________
মিলা নিচে এসেছে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল,আহ্নির নজর গেল মিলার উপর। নজর যাওয়ার কারণ, মিলার গায়ে যেই সুতির থ্রিপিস টা এরকম সেম একটা থ্রিপিস রতিরও আছে। একই রকম থ্রিপিস অনেকেরই থাকতে পারে, কিন্তু গভীর ভাবনার আহ্নি সজাগ চোখ রাখলো। একটু দূরে প্রান্তকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘড়িতে সময় এগারোটা। মফিজুল আলম এই টাইমে অফিসে থাকেন। এই জন্যে আহ্নি এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে। যাতে করে খালি ফ্ল্যাটটা একটু চেক করার কোনো না কোনো উপায় বের করা যায়।

একটু পর দোকান থেকে বের হয় মিলা। আহ্নিদের পাশ দিয়েই হেঁটে চলে গেল। একবারও খেয়াল করল না আহ্নি কে। রাস্তায় তো কত লোকই দাঁড়িয়ে থাকে! আর সে চেনেও না আহ্নিকে। কেউ যে রতিকে খুঁজতে আসতে পারে, সেটা একবার মাথায়ও আসেনি মাথামোটা মিলার।

মিনিট তিনেক হাঁটতেই বিল্ডিং-এর সামনে চলে এলো এবং ঢুকে পড়ল। আহ্নিও তাকে ফলো করতে করতে বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামলো। বিল্ডিং এর পাশেই নেইম-প্লেট। সেখানে রোড নাম্বার, বাড়ির নাম্বার দেখে আহ্নির সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়। নুসরাতের দেওয়া বনানীর ফ্ল্যাটের এড্রেসের সাথে এই বিল্ডিং-এর ঠিকানা মিলেছে আবার ওই মহিলার গায়ে রতির মতোই জামা। সামথিং ইজ রং….

প্রান্তকে রাস্তায় রেখে বিল্ডিং এ ঢুকলো আহ্নি। দারোয়ান তাকে দেখে এগিয়ে এলো। আহ্নি অত্যন্ত বিনীত গলায় প্রশ্ন করল, ‘আংকেল, এই মাত্র একজন আন্টি ঢুকলো না,উনার নাম কী শিউলি?’
দারোয়ান সন্দিহান চোখে তাকাল, ‘কেন?’
‘না মানে, আমি একজন কে খুঁজছি। এই আন্টিটা একদম আমার খোঁজা আন্টির মতোন। তাই।’
‘ওহ। না, না, উনার নাম তো মিলা। মফিজুর আলম ছারের বউ লাগে।’
‘মফিজুল আলমের বউ?’ অবাক আহ্নি। মফিজুল আলমের তৃতীয় বউ আছে? কই কেউ তো এই খবর তাকে দিল না!
‘আপনি শিউর আংকেল?’
‘হ, ছিউর।’

আহ্নি বেরিয়ে এলো। তার মুখ থেকে বিস্ময় ভাব এখনো সরছে না।
.
ফ্ল্যাটের দরজা আঁটকে ফ্যান ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে টুলে বসল মিলা। এই একটুতেই ঘেমে-নেয়ে গেছে। বাইরে কী রোদ! বাবা রে…
ওড়নার আঁচল দিয়ে কপাল, গলা মুছতে লাগল মিলা। তারপর বাজারের ব্যাগ থেকে একটা রামদা, দুইটা ছোট তবে ধারালো ছুরি, আর অনেক গুলো কালো পলিথিন বের করল মিলা। মফিজুল আলম এসব কিনে রাখার আদেশ দিয়ে গেছেন। বোধহয় আজকে ওই অসহায় মেয়েটির শেষ রাত হবে। মফিজুল আলম বলেছেন, বডি একদম টুকরো টুকরো করে পলিথিনে ভরে একেক জায়গায় নিয়ে ফেলবেন, এভাবেই চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলবেন রতির চিহ্ন!

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here