সম্পর্ক,পর্ব-১৭+১৮

#সম্পর্ক
#১৭

মৌনির খালার বাসাটা তিন তলা। খালা দো-তলার একটি ইউনিটে থাকেন, বাকি সব ইউনিট গুলো ভাড়া দেওয়া। ছোট ছোট তিনটি রুম, ড্রয়িং, ডাইনিং মিলিয়ে এক একটি ফ্ল্যাট। রুম ছোট বলে মৌনির তেমন একটা ভালো লাগে না। আবার এই এলাকাটা কেমন যেন গিঞ্জি…মৌনিদের এলাকা অনেক ফাঁকা ফাঁকা। মৌনির এখানে আসলেই সারাক্ষণ দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ছাদটা। মৌনির খালা ছাদে কোনো ভাড়াটিয়াকে দড়ি টানাতে এলাউ করেননি। পুরো ছাদ তাই ফাঁকা, রেলিং ঘেঁষে ফুলের টব সারি সারি…
মৌনি মনে মনে ভাবলো, এবার বাড়ি ফিরে সে নিজেও তাদের ছাদটাকে এভাবে সাজাবে।

মৌনি খালে পায়ে টব গুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যে গাছটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ হচ্ছে, সেটাকে নিচু হয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এমন সময়ে অচেনা একজনের কণ্ঠস্বরে মৌনির পা-জোড়া থমকে গেল।
অচেনা লোকটি মৌনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনিই তানিয়ার বোন, মিস?’
মৌনি ঘুরে তাকাল, এবং দেখল, বয়সে তারচেয়েও আট-নয় বছরের বড় একজন ভাইয়া উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ পায়ে পায়ে হেঁটে মৌনির দিকে এগিয়ে এলো। শ্যামলা চেহারার লোকটির থুতনিতে গর্তমতো, যেটি চেহারায় আরও সুন্দর ভাবে মানিয়ে গেছে।

মৌনির দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকা ফায়াজকে দেখে মৌনি হালকা মাথা ঝাকালো, বলল, ‘জি, আমি তানিয়াপুর বোন। কিন্তু আপনি কে?’
‘আমি…’ ফায়াজ তার দৃঢ় পুরুষালি কণ্ঠে জবাব দিতে গিয়েও থেমে যায়, কেননা ততক্ষণে তানিয়া নিজেই ছাদে উঠে এসেছে। তার একহাতে ফ্ল্যাক্স, অন্য হাতে তিনটে কাপ। তানিয়া নিজে থেকেই জবাব টা দিয়ে দিল, ‘ও আমার হবু… বুঝেছিস?’

মৌনি চোখ বড় বড় করে তাকাল। যদিও খালার বাসায় আসার পর একদিন কেটে গেছে, তবুও তানিয়ার সাথে তার এত একটা মেশা হয়নি, কথাও হয়নি। শুধু তানিয়াই না, খালা, খালু, কারো সাথেই ভালো করে কথা বলেনি মৌনি। একদম চুপচাপ নিজের মতো সময় কাটিয়েছে সে। তার মন মেজাজ কোনো কারণে ভালো নেই দেখেই তানিয়া হুট করে বিকেলে ছাদে একটা চায়ের আয়োজন করে নিয়ে এসেছে ছোটখাটো ভাবে। এই আড্ডায় কথার ছলে মৌনির থেকে জেনে নিতে হবে, কী সমস্যা ওর।

‘তুমি যে কাল রাতে ফোনে গুনগুনিয়ে কথা বলছিলা, এই ভাইয়ার সাথেই?’ প্রশ্ন করে মৌনি। তানিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তো কী আরেক ছেলের সাথে! কী ননসেন্স মার্কা প্রশ্নরে মৌ। তোর মাথা দেখছি দিনকে দিন গোবর দিয়ে ভরে যাচ্ছে।’
মৌনি ভ্যালকার মতো হাসে, মাথা চুলকায়। তানিয়া মৌনিকে আদেশ করল, ‘দৌড়ে যা, পাটিটা নিয়ে আয়। গো…’
‘আমি?’
‘না, এখানে তো তোর ভূত আছে, তাকে বলছি। ননসেন্স মেয়ে!’

মৌনি রাগ আড়ালে রেখে দ্রুত নিচে নেমে আসে। একটা আননোন ছেলের সামনে এভাবে বারবার তাকে কেন ননসেন্স বলছে তানিয়াপু! আবার ক্যাটক্যাট করে কথা বলছে! সমস্যা কী তার? হোক না হবু বর, মৌনি তো এই প্রথম দেখল, নাকি?
মৌনি মনে মনে বলল, ‘আগের সেই মৌনি যদি আজ থাকতো তবে তোমাকে এই ক্যাটক্যাটানির উচিত জবাব দিতো, হুহ।’

পাটি নিয়ে ফিরে আসতেই আবার ধমকালো তানিয়াপু, ‘এতক্ষণ লাগে! দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেছে। দে পাটি দে, লেট লতিফা!!’
ফায়াজ নামক লোকটি ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরোপুরি সক্ষম হতে পারছে না। একটা সূক্ষ্ণ হাসি পুরো ঠোঁটেই ফুঁটে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়েই মৌনির মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে অভিমানী স্বরে কাটাকাটা করে বলল, ‘জানোই যখন আমি লেট লতিফা তাহলে আমাকে দিয়ে কাজ করাও কেন? নিজে গিয়ে আনতে… আর সারাক্ষণ এতো ক্যাটক্যাট করছ কেন? তোমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি বলে? ঠিক আছে, চলে যাব আজ।’

তানিয়া ততক্ষণে পাটি বিছিয়ে ফ্ল্যাক্স, চায়ের কাপ গুলো গুছিয়ে রেখেছে। মৌনির কথা শুনেও সেও বহুত কষ্টে নিজের হাসি আঁটকালো। ছদ্ম গম্ভীর ভাব করে বলল, ‘গেলে যাস। এখন এখানে বস। কথা আছে।’
‘আমি তোমার কোনো কথা শুনব না।’
‘লাগাবো থাপ্পড়… বস,এদিকে আয়।’
মৌনি না শোনার বাহানা করে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তানিয়া কিছু বলতে নিচ্ছিলো, ফায়াজ চোখ ইশারায় তাকে থামতে বলল। তারপর সে নিজে মৌনির কাছে গেল।

‘তোমার আপু এরকমই বুঝছ? আমাকেও সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখে। একে নিয়ে কীভাবে যে লাইফ পার করব, কে জানে!’
মৌনি তৎক্ষনাৎ বলল, ‘তাহলে বিয়ে করছেন কেন? ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করুন, যে কটকট করবে না।’
‘ভালোবাসি তো…’
‘তাহলে বউয়ের নামে আমার কাছে অভিযোগ দিতে আসলেন কেন? যাকে ভালোবাসা যায় তার নামে অভিযোগ করা যায় না, জানেন না?’
‘বাব্বাহ! সরি মহারানী, জানতাম না। এই যে আজ জানলাম। আর কক্ষনো এই ভুল হবে না। তো ডিয়ার মহারানী, আপনি কী এই অধমের চায়ের আসরে আপনার মূল্যবান সময়ের একটুক্ষণ দিবেন? প্লীজ..’
ফায়াজ এমনভাবে আবদার করল যে মৌনি হেসে ফেলল। ওদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া। সেও যখন রাগ করে বা অভিমান করে, ফায়াজ এভাবেই আবদার করে তার রাগ ভাঙায়। ছেলেটা এত জোস!
তানিয়ার মনটা খুশিতে বাক-বাকুম করে উঠল। ফায়াজের মতো জীবন সঙ্গী পেতে যাচ্ছে, এই ভেবে সে ধন্য…

মৌনি ফায়াজের মিষ্টি আবদার টলাতে না পেরে পাটিতে এসে বসলো। তানিয়া চায়ের কাপগুলো চা ভর্তি করে একে একে সবার হাতে তুলে দিয়ে নিজে পায়ের উপর পা তুলে আসন করে বসল। এরপর শুরু হলো, তিন জনের গল্পের আসর…
মৌনিও কিছুক্ষণের জন্য প্রান্তের কথা ভুলে গিয়ে সেই আসরে মনোযোগ দিল এবং অনেকদিন পর সে প্রাণ খুলে কথা বললো। শেষে এমন হলো যে, মৌনিই বকবক করে চলেছে, তানিয়া, ফায়াজ চুপচাপ তার কথা শুনছে।
ব্যাপারটা যখন মৌনির দৃষ্টিগোচর হয়, সে চুপ হয়ে গেল।লজ্জিত গলায় বলল, ‘সরি… আমি এত বকবক করতে পারি!’
‘এই বকবক মৌনিকেই আমাদের খুব ভালো লাগে। কেন গম্ভীর হয়ে থাকিস শুধু শুধু, বল দেখি..’
মৌনি কথা বলতে পারল না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
তানিয়া চায়ের কাপ পাশে রেখে সিরিয়াস গলায় বলল, ‘খালামনি ফোন দিয়ে বলেছে সব। তুই কীভাবে পাল্টে গেছিস, কতটা চুপচাপ হয়ে গেছিস, আমরা তো প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। সব খালাদের সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল তুই কীনা! আর সেই মৌনি চুপচাপ? এ তো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু যখন চোখে দেখলাম আসলেই তুই আগের মতো নেই, একদম পাল্টে গেছিস, তখন কষ্ট হলেও মানতে হয়েছে। এই যে আজকের এই চায়ের আসর, এটা শুধু তোর জন্য মৌনি। তুই আমাদের অনেক প্রিয়, জানিস?
খালামনির ধারণা এমনকিছু ঘটেছে তোর জীবনে যেটা তুই তাকে সাহস করে বলতে পারছিস না বা লজ্জা পাচ্ছিস বলতে। কিন্তু আমাকে বলতে তো লজ্জা নেই। আমাকে প্লীজ খুলে বল, হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ…প্লীজ মৌনি।’

ফায়াজ বলল, ‘জানো মৌনি, তোমার এই তানিয়াপু ভীষণ স্বার্থপর। দুনিয়া চুলোয় যাক, সে কিন্তু সহজে কারো জন্য চিন্তিত হয় না, ব্যথিত হয় না। সেই সে যখন তোমার জন্য চিন্তা প্রকাশ করল আমার কাছে, আমি নিজেও শকড হলাম। বুঝতে পারছ তো তুমি কতটা প্রিয় এদের কাছে?’
মৌনি মাথা কাত করে বুঝালো, সে বুঝতে পারছে কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছুই বলল না।
তানিয়া ফের বলল, ‘তোর জীবনে যত পার্সোনাল ব্যাপার থাকুক, আই প্রমিস, তোকে কেউ বকবে না। কেউ কিচ্ছু বলবে না। শুধু সমাধান করব সবাই মিলে। আমরা তোকে আবার আগের মতো দেখতে চাই…’

মৌনি তবুও বলল না।
নিজের বোকামি প্রকাশ করতে কার বা ভালো লাগে? বলার মতো তেমন তো কিছু নেই। একটা ছেলে যে তাকে চার আনার পাত্তাও দেয় না, অন্য কারো সাথে যার সম্পর্ক,সেই ছেলের জন্য মৌনি দমবন্ধ করে বসে থাকে। নির্ঘুম রাত কাটায়। খেতে বসলে তার কথা মনে করে খাবারটাকে ছানাছানি করে ফেলে দেয়। এসব বলার মতো কিছু? উল্টো এগুলো যদি মা শোনেন, ভেবে নিবেন নিশ্চয়ই প্রান্ত উল্টোপাল্টা কিছু করেছে। তার জন্য প্রান্ত হেনস্তা হোক, এই বাসা ছেড়ে চলে যাক, সে চায় না।

মৌনির নিশ্চুপতা দেখে তানিয়া পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে ফায়াজ চোখ ইশারায় থামতে বলল। তারপর মৌনিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, ‘ব্যাপারটা খুব পার্সোনাল?’
মৌনি ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল, ‘একটু..’
‘ঠিক আছে। বলতে হবে না। কিন্তু আমি একটা উপদেশ দিতে চাই, শুনবে?’
‘বলুন…’
‘তুমি যে কারণে এভাবে থমকে গেছো, সেই কারণ গুলো একদম ভেঙে ভেঙে একটা কাগজে লিখবে। তারপর সেই কাগজটা একটা বাক্সে ভরে তালা দিয়ে খাটের নিচে একদম চিপায় ফেলে রাখবে।’
‘এতে কী হবে?’
‘তোমার দুঃখ কমবে। এমনও করতে পারো, তুমি পশু পাখি বা গাছের সঙ্গে তোমার দুঃখ গুলো শেয়ার করতে পারো। আমার কী মনে হচ্ছে জানো? তোমার দুঃখ গুলো খুবই সাধারণ, উঠতি বয়সে যা হয় আর কী! কিন্তু এগুলো তোমার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে কারণ তুমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারছো না তাই… কথাগুলো ভেতরে জমে জমে তোমার ফুসফুস টাকে ভারী করে তুলেছে। এই জন্যে তোমার দম নিতেও কষ্ট হয়। গাছ, পশু, পাখি, এরা নির্বাক শ্রোতা। এরা শুধু শুনবেই, কোনো জবাব দিতে পারবে না। তাই অন্য কেউ জানাজানি হওয়ার ভয়ও তোমার থাকবে না। উল্টো একটা ফ্রেন্ড হবে যার কাছে সব শেয়ার করতে পারছো তুমি৷ বুঝেছো? আবার কাগজে লিখেও মনের চাপ কমানো যায়। এবার কোনটা করবে, ইউর ডিসিশন। বাট ইউ হ্যাভ টু ডু… লাইফ ইজ ভেরি বিউটিফুল এন্ড সো লং টার্ম…বয়স কতই বা তোমার? এখনি যদি থেমে যাও, বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাবা বলো তো…’

মৌনির কাছে ফায়াজের প্রতিটি কথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। তার মন ভালো লাগছে এখন৷ সে চট জলদি সিদ্ধান্ত নিলো, আর দু’দিন পরই বাড়ি ফিরে যাবে এবং গিয়েই কতগুলো গাছ কিনে নিয়ে আসবে। এরপর তার সখ্যতা গড়ে উঠবে গাছের সঙ্গে…
ফায়াজ ভাইয়াকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত এত সুন্দর বুদ্ধি দেওয়ার জন্য। কিন্তু মৌনি এখন ধন্যবাদ দিবে না। যখন তানিয়াপুর সঙ্গে তার বিয়ে হবে, তখন চমৎকার একটা গিফট দিবে সে ফায়াজ ভাইয়াকে…

________
‘এই ছেলেটা কে আহ্নি?’

আহ্নির কলেজ শেষ হয় দুপুর দুইটায়। এই সময়টা রাস্তা প্রায় ফাঁকাই থাকে। দোকানগুলোও বন্ধ থাকে। সেই ঝিল পাড়ে দেখা হয়েছিল তার প্রান্তের সাথে, এরপর আর হয়নি। পড়াশোনায় ডুবে ছিল দু’জনেই। আজ হুট করে আহ্নির কলেজের সামনে আসে প্রান্ত, আহ্নিকে সারপ্রাইজ দিতে। আহ্নি খুব খুশি হয়। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে দুই গলির পর একটা চিপা গলি আছে, সেখানে আবার বসার প্লেসও আছে,সেই জায়গায় গিয়ে বসলো। প্রান্ত তার স্বভাবমতোই আহ্নিকে এটা ওটা বলে হাসাতে লাগে, তখনি আরাফের কণ্ঠটা আহ্নিকে বিদ্যুতের শক দিল যেন..

হাসি থামিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সে, অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ভা-ই-য়া।’ এরপর অপরাধী মুখ করে মাথা নিচু করে। প্রান্ত আরাফকে চেনে, আহ্নির ফোনে সে আরাফের ছবি দেখেছে। বাস্তবে দেখা এই প্রথম। প্রান্ত নিজেও উঠে দাঁড়াল। কী করবে বুঝতে পারছে না…
জাদু জানলে এক্ষুনি এখান থেকে গায়েব হয়ে যেতো প্রান্ত। সে আড়চোখে আহ্নিকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এমনিতে তো বলে, আমি কাউকে ভয় পাই না আর এখন ভয়ে কাঁপছে…
প্রান্ত এরকম একটা মোমেন্টেও বিড়বিড় করে বলে ফেলল, ‘ভীতুর ডিম, মুখেই যত ফটর ফটর…’

আরাফ এগিয়ে আসে। একবার প্রান্তের দিকে তাকায়,আরেকবার আহ্নির দিকে তাকাল। আহ্নির শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে গেছে, কিছু একটা দৌড়াদৌড়ি করছে শিরায় শিরায়, মাথা ঘুরছে।
আহ্নি মনে মনে জিকির করে, ‘অজ্ঞান হবো, অজ্ঞান হবো, আল্লাহ বেহুশ করে দাও।’

আরাফ স্থির দৃষ্টিতে, শক্ত-শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী নাম তোমার?’
‘জি…জি…’ প্রান্ত উত্তর দেওয়ার আগেই আহ্নির মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, ‘প্রান্ত।’
দ্রুত সে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। আরাফ খেঁকিয়ে উঠল, ‘তোকে জিজ্ঞেস করছি? পড়ালেখার নাম করে এসব? হ্যাঁ? বাসায় চল… বাসায় চল।’
আহ্নির হাত ধরে টান দেয় আরাফ, আহ্নি অনুনয় করে, ‘ভাইয়া প্লীজ কিছু বলো না। আই ক্যান এক্সপ্লেইন। ও ভালো ছেলে.. ডিইউর ছাত্র।’
‘আগে বাসায় চল। এতোদিন অনেক শেয়ান গিরি করছিস। আজকে তোর পালা..’
আরাফ হাত তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তোমাকে যেন ফারদার আহ্নির আশেপাশেও না দেখি। নইলে যে কী করব, ভাবতেও পারবে না।’

তারপর আহ্নিকে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় আরাফ। প্রান্ত তখনো থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হুট করে একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল!
আরাফ সকালে অফিস যায়, সন্ধ্যায় আসে। আজকে শরীর খারাপ লাগছিল দেখে হাফবেলা কাজ শেষে ছুটি নিয়ে চলে আসে। ভাগ্যিস এসেছিল, নইলে এই মেয়ের কীর্তি কাহিনী ধরতেই পারতো না…
আরাফের মাথা একশোতে একশো হয়ে আছে। যেদিন রতিকে ফিরিয়ে আনতে না পেরে একা ব্যর্থ ভঙ্গিতে বাসায় ফিরেছিল আরাফ, সেদিন আহ্নিও অনেক কথা শুনিয়েছিল, রতির হয়ে ওকালতি করার ফল আজ তাকে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবে আরাফ…
আরাফের কপালের প্রতিটি শিরা দপদপ করছে।

__________
আহ্নির সাথে একবার দেখা করে যেতে চেয়েছিল রতি। আহ্নিকে অনেকবার ফোন করেও পেল না। ওর ফোন সুইচ অফ বলছে বারবার। রতির মন খারাপ হলো। সে পনেরো দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছে কাজে। যাওয়ার আগে একবার আহ্নির সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। আহ্নি টাকে ভীষণ মিস করে রতি।

আবিরের বাবা কে বারবার মানা করার পরও ভদ্রলোক রতিকে বাসে উঠিয়ে দিতে এসেছেন। রতির মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে এত ভালো পরিবারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে এই জন্য…
আবিরের বাবা বারবার জিজ্ঞেস করলেন, সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছো কীনা, মনে করো কিছু বাদ পড়ল কীনা। ঠিক মতো খাবে দাবে। কাজেই ডুবে থাকলে চলবে না, শরীরের যত্ন নিতে হবে। শরীর তো আর ইঞ্জিন না!
এবং বাস ছাড়ার আগ অব্দি তিনি রতির পাশের সিটে বসে রইলেন। আনন্দে রতির চোখ ভিজে উঠছিল বার বার। বাস ছাড়ার আগে হেল্পার ঘোষণা করল, যাত্রী বাদে বাকিরা নেমে যায় যেন, বাস দুই মিনিটেই ছেড়ে দিবে। আবিরের বাবা এবার উঠে দাঁড়ালেন, রতির চোখ তখন পানিতে টলমল। কিছু দিনেই ভীষণ মায়া পড়ে গেছে এই পরিবারের উপর…

আবিরের বাবা বললেন, ‘ঠিকমতো খাবে কিন্তু.. যদি দেখি শুকিয়ে গেছো তাহলে আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না আর। আর হ্যাঁ, প্রতিদিন কল করবা।’
রতি হাসল, ‘আপনি না খুব বাচ্চা আংকেল!’
‘মায়ের কাছে সবাই-ই বাচ্চাবনে যায়।’
‘আমি আপনার মা?’
‘হ্যাঁ, তুমিও আমার মা।’
রতি ঢোক গিলে খুশির কান্নাটুকু লুকালো। আজ পর্যন্ত তার নিজের বাবা কখনো তাকে মা বলে সম্বোধন করেনি!

‘সাবধানে যাবেন আংকেল। আমি পৌঁছে কল করব।’
‘রাতেই কল দিবা।’
‘আচ্ছা দিব।’

আবিরের বাবা নেমে গেলেন। বাস ছাড়লো, রতি দেখলো তিনি হাত ইশারায় রতিকে বিদায় জানাচ্ছেন। রতি বিড়বিড় করে বলল, ‘হে পরম করুণাময়, এই লোককে এবং এদের পরিবারের সবাইকে আপনি সবসময় খুশি রাইখেন। এদের উপর আপনি নেক হায়াত বর্তান..’

রতি আরেকবার আহ্নিকে ফোন করল, সুইচ অফ বলছে এখনো। রতি ফোন রাখতে যাবে তখনি আবির কল দিল ইমোতে।
রতি খুশিমনেই ধরল, ‘হ্যালো আবির ভাই, বলেন।’
রতির কণ্ঠটা কানে আসতেই আবিরের দুনিয়া আবার উলোটপালোট হয়ে গেল। সে ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘আপনি নাকি ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন।’
‘হ্যাঁ, অফিস থেকে।’
‘ওখানে কাজ কেমন চলছে? সব ঠিকঠাক তো?’
‘হুম, সব ভালো।’ ক্ষীণ স্বরে বলল রতি। মফিজুল আলম নামের একজন ভদ্র চেহারার খারাপ লোক, আজ কতদিন যাবত রতিকে প্রচন্ড ডিস্টার্ব করছে, সে কথাটা বলল না রতি, লুকিয়ে গেল।
অফিসে বিচার দেওয়ার মতো কোনো প্রুভ নেই দেখে রতির এসব সহ্য করতে হচ্ছে। রতিকে দেখলেই তিনি ইনিয়েবিনিয়ে পছন্দের কথা বলেন, রতিকে বিয়ে করতে চান, এরকমটা বোঝান। রতিও অনেকবার বুঝিয়েছে কথার ছলে যে এসব তার পছন্দ নয় এবং সে সেকেন্ড ম্যারেজের প্রতি আগ্রহী না… তবুও এই লোক দমে না।
কী যে অবস্থা!! রতি অন্যদের থেকে খবর নিয়ে জেনেছে, মফিজুল আলম এর আগে দুই বিয়ে করেছেন এবং তার একটা বউও টেকেনি। বর্তমানে তিনি ডিভোর্সি সিংগেল…
অবশ্য এরকম ক্যারেক্টার যার, তার সাথে কেইবা সংসার করবে? রতি মনে মনে মফিজুল আলম কে উদ্দেশ্য করে ভয়াবহ দুটি গালি দিলো…

‘বাসে উঠিয়ে দিতে বাসা থেকে কেউ এসেছিল?’ আবিরের প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, আপনার বাবা এসেছিলেন।’
‘ওহ… ঠিক আছে। ভালো থাকবেন ভাবি। আর যেকোনো সমস্যায় মনে করবেন আমার কথা। এই বান্দা অলওয়েজ হাজির আপনার সেবায়…’
রতি হেসে উঠল, ‘আমার এত সেবা লাগবে না ভাই। আপনি একটা বিয়েটিয়ে করুন। কতদিন বিয়ে খাই না।’
‘আপনাকে বিয়ে খাওয়ানোর জন্য আমি আবার গলায় ছাগলের দড়ি পড়ব?’
‘বিয়ে করা মানে গলায় ছাগলের দড়ি পড়া?’
‘তা নয়ত কী? আপনার এক্স ননদ কী নাচান টাই না নাচালো আমাকে.. এখন আবার অন্য মেয়ের ইশারায় এভাবে নাচতে পারব না৷ দুঃখীত।’
‘সব মেয়ে এক হয় না আবির ভাই।’
‘জানি, তবুও… এক হতে কতক্ষণ? না বাবা, নো চান্স… আমি আপাতত বিয়ে টিয়ে করছি না।’
রতি ক্ষীণ হেসে বলল, ‘আন্টি এবার বাংলাদেশ এসে আপনাকে বিয়ে দিয়ে ছাড়বে। আমাকে বলেছে।’
‘আমি দেশেই আসবো না।’
‘ওখানে গিয়ে দিবে।’
‘আমি পালাবো।’

রতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, ‘আচ্ছা, পালাইয়েন। দেখব কত পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারেন।’
‘আচ্ছা, দেইখেন।’ আবিরকে কেউ ডাকলো, আবির বলল, ‘একটু পরে কল দেই? আমার রুমমেট ডাকছে।’
‘আচ্ছা, যান।’
‘সাবধানে থাকবেন। রাখছি ভাবি।’

ফোন রেখে রতি কানে হেড ফোন গুঁজে দিল। ঠান্ডা একটা সং প্লে করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। রাতের আকাশের বুকে চাঁদ নেই, তারা নেই, তবু কত সুন্দর…
অদ্ভুত সুন্দর। রতি মনে মনে বলল, ‘আপনি কী চান, আমি স্পষ্ট বুঝি আবির ভাই। কিন্তু সেটা যে কোনোদিনই সম্ভব না।’
গানটা আর ভালো লাগছে না রতির, তাই গান অফ করে আহ্নির নাম্বারে কল করল সে কিন্তু ফোন বন্ধ!

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি

#সম্পর্ক
#১৮

আসমানে থালার মতো গোল চাঁদ, প্রকৃতিতে আলো থইথই করছে। প্রান্ত দাঁড়িয়ে আছে ছাদের একটা কোণায়, মৃদুমন্দ বাতাস এসে একটু পর পর তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এত সুন্দর রাতে আহ্নি, আর তার আলাদা আলাদা জ্যোৎস্না বিলাস করার কথা ছিল। প্রান্ত তো চাঁদের তলায়-ই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আহ্নি কই? সন্ধ্যার পর থেকে এই পর্যন্ত পাঁচ মিনিট পর পর আহ্নির নাম্বারে ডায়াল করেছে প্রান্ত, ফোন সুইচ অফ। টেনশনে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে প্রান্তের। একবার মন চাচ্ছে, ভয়ডর সাইডে ফেলে আহ্নির বাসায়ই চলে যেতে।কিন্তু এমনটা করলে আহ্নির সমস্যা আরও বাড়বে। তাই নিজের ইচ্ছা দমন করে প্রান্ত।

আবছায়া অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে দিল প্রান্ত। ঠিক তখনি প্রান্তের ফোন বেজে উঠে…
আহ্নির নাম্বার দেখে উত্তেজিত প্রান্ত দ্রুত ফোন রিসিভ করে, তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলল, ‘হ্যালো, হ্যালো, কে আহ্নি? শুনতে পাচ্ছো? তুমি ঠিক আছো তো? সব ঠিকঠাক আছে? তোমার ভাইয়া…’
আহ্নি মৃদু শব্দে হেসে উঠল, ‘হেই, আস্তে.. একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কেমনে?’
প্রান্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, ‘কতটা ভয়ে ছিলাম, শুকরিয়া আল্লাহকে, তুমি ঠিক আছো যে…’
‘ভয় পাইছিলা? ভাবছো আমাকে মেরেধরে রুমে আঁটকে রাখছে। ফোন নিয়ে গেছে?’
‘এটা ভাবাই কী স্বাভাবিক নয়?’
‘আমি অত সোজা মেয়ে নই প্রান্ত। রাস্তায় তেমন কিছু বলিনি, সিন ক্রিয়েট হবে তাই। কিন্তু বাসায় আসার পর এক চুল ছাড় দেইনি।’
‘তারপর?’
‘তারপর কী.. আমাকে ডাইরেক্ট মানা করে দিছে, আর যেনো রিলেশন কন্টিনিউ না করি। আমিও সোজা বলে দিছি, আমার যা ইচ্ছা তাই করব। আর আমার তো আঠারো পূর্ণ হয়েছে। সে হিসেবে আমি এই দেশের নাগরিক এবং আমার লাইফে কী হবে না হবে সেটা ডিসাইড করার স্বাধীনতা আমার আছে। আমি সোজাসুজি বলে দিছি, যদি আমাকে আঁটকানো হয় বা বাধা দেওয়া হয়, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব এবং সর্ব প্রথম আমি থানায় যাব। দুপুরের ডিভোর্সের কাহিনী, আবার আরাফ ভাইকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেসব এখনো সমাজে হট নিউজ। এখন যদি আমিও ঘর ছেড়ে বের হই, তাহলে আগুনে ঘি ঢালা হবে। এই ভয়ে সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে।’

প্রান্ত অবাক, বিড়বিড় করে বলল, ‘তুমি এত সাহসী! আমি তো ভাবছিলাম মুখেই যত ফটর ফটর.. কীভাবে ওদের দুর্বল জায়গায় কোপ মেরে দিলা!’
আহ্নি হেসে গর্ব মিশ্রিত গলায় বলল, ‘আমি শুধু বলিই না, করেও দেখাই।’
‘আচ্ছা, মানলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল কেন?’
‘এই যে এসব ক্যাঁচাল চলছিল তাই ইচ্ছে করেই অফ করে রাখছিলাম। তুমি আবার ফোন দিতা বারবার, তখন আমি চুটিয়ে মনোযোগ দিয়ে ঝগড়া করতে পারতাম না৷ বুঝছো? আর রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম হুট করে, তাই এখন ঘুম ভাঙতেই কল করলাম। আমি জানতাম, আমার সাথে কথা না হলে আজকে সারারাত তুমি জেগে থাকতা।’

প্রান্ত বিস্ময় লুকিয়ে বলল, ‘ঝগড়া করতেও মনোযোগ লাগে?’
‘ইয়েস, লাগে৷ নইলে ঝগড়ার সময় ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট গুলো ভুলে যাবো তো।’
প্রান্ত শব্দ করে হেসে উঠল, ‘তোমার মতো পাগল আমি আর দুইটা দেখিনি।’
‘এই.. কয়টা মেয়ের সাথে মিশছো লাইফে? হু?’
‘উঁহু, না, না। ওই মাইন্ডে নিয়ো না। মানে এমনিতে তোমার মতো এরকম সাহসী মেয়ে আর আছে কীনা সন্দেহ। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়তো। ভেঙে যেতো একদম। আর তুমি… খেয়েদেয়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলে… কী শান্তি।’

‘এই সমাজে সাহস না থাকলে টেকা যায় না। আর যে যত নরম, তাকে সবাই ওতই টেপাটেপি করে। বুঝছো?’
‘বুঝলাম। আহ্নি, আজকে জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে। দেখেছো?’
‘হুঁ… আমি ছাদে।’
‘ইতিমধ্যে ছাদেও চলে গেছো! বাহ!’
আহ্নি জবাব না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। প্রান্তকে মুগ্ধ করতে তার ভালো লাগে। কতদিনের সম্পর্ক আর, অথচ কত সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দু’জনার মধ্যে। মনে হবে, জন্ম জন্মান্তরের পরিচিত…
আহ্নি আকাশের দিকে তাকিয়ে সুন্দর জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে মাখতে মনে মনে প্রার্থনা করে, যাই হয়ে যাক জীবনে, এই ছেলেটি যেন তার হাত ছেড়ে কখনো না যায়…
কখনো না…..

___________
গায়ের ভেতর কারও হালকা স্পর্শ লাগলো। রতির ঘুমটা ঢিল হয়ে এলো। জানালার পাশে মাথা রেখে বাহির দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, নিজেও বলতে পারবে না। রতি চোখ মেললো না, অবচেতন অবস্থায় আছে। একটু পর সেই স্পর্শ টা রতির হাত বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে কাঁধে গিয়ে ঠেকলো। রতির ঘুম এবার পুরোপুরি ছুটে গেল। সে দ্রুত চোখ খুললো, এবং অবাক হয়ে গেল।

মফিজুল আলম তার পাশের সিটে হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। রতি দ্রুত সোজা হয়ে বসে। নিজের গায়ের কাপড় ঠিকঠাক করতে কর‍তে মনে করল, সে যখন ঘুমিয়ে গেছিল, তখনো তার পাশের সিটে কেউ ছিল না। হেল্পার টিকিট চেক করতে আসার সময় সে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন হেল্পার বলেছে, সামনের স্টেশন থেকে এই সিটের যাত্রী উঠবে। এরপরই রতি ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে কী মফিজুল আলম সামনের স্টেশন থেকে উঠেছে? সে কীভাবে জানলো রতি কোন বাসে যাচ্ছে, কোন সিটে যাচ্ছে?
সে কী লুকিয়ে ফলো করে রতির সব কর্মকাণ্ড?

বিরক্তি আর রাগে রতির ভেতরটা তেতো হয়ে উঠল। মফিজুল আলম তখনো তাকিয়ে, ঠোঁটে বিষাক্ত এক হাসি। রতি তার দিকে চেয়ে প্রত্যুত্তরে জোরপূর্বক একটা হাসি ছুঁড়ে দিতেই তিনি হইহই করে উঠলেন, ‘দেখেছো কী অবস্থা! আমি তো তোমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। কীভাবে কীভাবে আমাদের বাস মিলে গেল, সিট মিলে গেল! আমার কী মনে হয় রতি, জানো? আমাদের ভাগ্য আমাদের ইচ্ছা করেই বারবার মেলাচ্ছে। বুঝছো তো?’

রতি তেতো হাসিটা চওড়া করে মনে মনে বলল, ‘শালা খোঁজখবর নিয়ে ইচ্ছে করে আমার পাশের সিট দখল করছিস আর ভাবখানা এমন যেন কিচ্ছুটি জানে না। হাতির বাচ্চা। সুযোগ পাই একবার৷ তোর চোখ দুটো তুলে মারবেল খেলবো।’
মুখে বলল, ‘এখানে ভাগ্যের কোনো কিছু নেই আলম ভাই। হুট করে এরকম কতই না ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে!’

‘তুমি মানলে না মানো, কিন্তু আমি একশোভাগ শিউর, তোমার আমার কোনো একটা কানেকশন আছে।’

রতি জবাব দিল না। কানে হেডফোন লাগাল। জানালার দিকে চেপে বসে বাইরে চোখ মেললো। তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রাগে। এই শয়তানের বাচ্চা বলদের সাথে পাশাপাশি সিটে পুরো রাতটা জার্নি করতে হবে, এই ভেবে ভেবে অশান্তি হচ্ছে খুব। উফ!
রতি দাঁড়িয়ে সামনে পেছনে সবগুলো সিট দেখলো, সব বুকড…
রতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসলো। যেকোনো একটা সিট খালি থাকলে সে এক্ষুনি চেঞ্জ করে নিতো।

মফিজুল আলম বললেন, ‘কী দেখলে?’
‘কিছু না।’ বলে একটা গান ছাড়লো রতি। এই বদের বাচ্চাকে ইগনোর করার চেষ্টা…
কিন্তু এই মুহূর্তে গানও ভালো লাগছে না অযথাই মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে। রতি গান অফ করে আহ্নির নাম্বারে কল করল, আহ্নির নাম্বার ব্যস্ত বলছে। রতি স্বস্তি পেল ফোন খোলা দেখে, ভাবলো হয়তো প্রান্তের সাথে কথা বলছে। তাই কল কেটে দিল। সেকেন্ড না গড়াতেই আহ্নির নাম্বার থেকে ফোন এলো।

‘হ্যালো, ভাবি, এত রাতে?’
‘আমি জার্নি করছি আহ্নি।’
‘মানে! কোথায় যাচ্ছো?’
‘চাঁদপুর। অফিসিয়াল প্রজেক্ট।’
‘ও… ইশ আগে জানালে আমি তোমাকে সী-অফ করতে আসতাম।’
‘কতবার ফোন দিছি.. ফোন অফ ছিল তোমার।’
আহ্নি মুখ দিয়ে যন্ত্রণা সূচক একটা আওয়াজ তুলে বলল, ‘আর বইলো না। আজকে আমাকে আর প্রান্ত কে হাতেনাতে ধরছে আরাফ ভাই।’
‘বলো কী! তারপর? তোমাকে মারছে ও?’ রতি অস্থির হয়ে উঠে।
‘না, না। তুমি তো চেনো আমায়। আমি দমি নাই। একদম কোপ কোপ কথা বলছি। আর বলে দিছি, যদি আমাকে বাধা টাধা দেয়, তো আমি এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবো।’

রতি স্বস্তি পেল, ‘আমি এবার ঢাকা ব্যাক করলে তোমাকে নিয়ে আলাদা রুম নিবো ভাবছি। আর কতদিন আবির ভাইয়ের বাসায় থাকব বলো? আর এখন তো একটা হিত হইছে আমার। যে টাকা আসে জব থেকে, তা দিয়ে কোনোরকমে হয়ে যাবে আহ্নি। তুমি কী আসবে যদি বাসা নেই?’
আহ্নি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘আল্লাহ, এটা আবার জিজ্ঞেস কর‍তে হয়! তুমি খালি বাসা নাও, গাট্টিবোস্তা সব নিয়ে আমি হাজির হয়ে যাব।’
‘হা হা হা… ‘

‘ভাবি সিরিয়াসলি তুমি আলাদা বাসা নিবা?’
‘ভাবছি।’
‘ফিরবা কবে?’
‘দিন পনেরো..’
‘আচ্ছা, আমি অপেক্ষা করি। এই এক কাজ করি ভাবি? আমি আর প্রান্ত মিলে ফ্ল্যাট দেখতে থাকি। তারপর যেগুলো পছন্দ হবে সেগুলো তুমি গিয়ে দেখবা। এতে সময় বাঁঁচবে তোমার।’
‘হুম, ভালো আইডিয়া। আচ্ছা তোমরা দেখে সিলেক্ট করে রাখো। আমি এসে দেখবো।’
‘ওকে ভাবি।’
‘রাতে খাইছো?’
‘হু…’
‘রাখি তবে। ঘুমিয়ে যেও দ্রুত। আল্লাহ হাফেজ, শুভ রাত্রি।’
‘শুভ রাত্রি ভাবি।’

ফোন রেখে আড়চোখে পাশে তাকাতেই রতি চমকে উঠল। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মফিজুল আলম তাকিয়ে আছে, এক ধ্যানে…
রতি এবার নিজেকে সামলাতে পারল না। তার ক্রোধ, মাথায় চড়ে গেছে। ঠাটিয়ে দুটো না দেওয়া অবধি সে শান্তি পাবে না।

‘আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’ বেশ শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল রতি।
প্রত্যুত্তরে মফিজুল আলম তার সবকটি দাঁত বের করে হাসলেন, ‘তোমাকে দেখছিলাম। আমি আজ পর্যন্ত তোমার মতো সুন্দর নারী দেখিনাই।’
রতির গা গুলাচ্ছে। বমি বমি পাচ্ছে।
‘আপনি জানেন আমার বয়স কত? আপনি কী করে এধরনের নোংরা কথা বলেন তাও আমাকে?’
‘প্রেম ভালোবাসায় বয়স কিছু না রতি। আর যে সুন্দর তাকে সুন্দর বললাম, এতে নোংরা জিনিসের কী দেখলে?’
মফিজুল আলম একটু এগিয়ে বসলেন এবং রতিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে রতির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন, ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন, ‘ও রতি… আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। আমার দুই বিয়ে ছিল, তাতে কী? তোমাকে ওদের থেকেও অনেক বেশি ভালো রাখবো। একবার মেনে নাওয়া না… তোমার আর এই চাকরি টাকরি করতে হবে না। আমার এত টাকা আছে যে তুমি বসে বসে খাবা পায়ের উপর পা তুলে। টাকার বিছানায় ঘুমাবা। তাতেও সমস্যা নাই। প্লীজ, মেনে নাও… ‘

পাথর হয়ে চেয়ে আছে রতি। এই লোক এত নিচে নামতে পারবে, রতি কল্পনাও করেনি। সাহস কত! রতির হাত ধরে!
রতি পাথর হয়ে যাওয়া গলায় টেনে টেনে বলল, ‘হাতটা ছাড়ুন।’
তারপর নিজেই নিজের হাত টেনে সরাতে চেষ্টা করল, পারল না। মফিজুল আলম আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন।
‘ইশ,এত অবুঝ কেন তুমি? মেয়েরা টাকা ওয়ালা জামাই খোঁজে আর আমি তোমাকে এত সাধাসাধি করছি, তুমি মানছোই না। ও, আমার বয়স একটু বেশি বলে ভাবছো বিছানায় সুখী করতে পারব কীনা? আরেহ, তুমি টেনশন নিও না। আমার এখনো যে জোর আছে না, তোমাকে বিছানায় কাত করে ফেলতে পারবো…’

মফিজুল আলমের কথাটি মাটিতে পড়তে পারল না, তার আগেই রতির হাতের শক্ত চড়ে তার কান ঝিন ঝিন করে উঠল। মাথা ঘুরে গেছে। তিনি দ্রুত এক হাত দিয়ে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে চোখ খুলে তাকাল। আগুন দৃষ্টিতে রতির দিকে তাকাতেই রতি আরেকটা চড় বসিয়ে দিল। তৃতীয় চড়টা বসানোর আগ মুহূর্তে মফিজুল আলম রতির হাত ধরে ফেললেন।
রতি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সাহস হয় কী করে আমাকে এসব বলার? তুই ম্যানেজার দেখে আমি তোকে ভয় পাব? তোর সব কথা শুনবো? শালা ঘুষখোর, শয়তানের বাচ্চা… এটা যদি বাস না হয়ে অন্য প্লেস হতো, তোকে বুঝিয়ে দিতাম। অনেকদিন যাবত ভালো মতো বুঝাচ্ছি, কানেই ঢোকে না। এবার ঢুকছে কানে? ছাড় হাত, ছাড় বলছি।’

পাশের সিট থেকে দু’জন যাত্রী ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনের সিট থেকে কয়েকজন দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে। মফিজুল আলম কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রতি হ্যাঁচকা টানে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আর একটা শব্দ বের হলে তোর জিভ ছিঁড়ে ফেলব। বাকি রাস্তায় চুপচাপ থাকবি। আর ওদিকে চেপে বস। একদম আমার দিকে তাকাবি না। জানোয়ার…
বেশি তেড়িবেড়ি করলে একদম লোক ডেকে গন পিটুনি খাওয়াবো। আর হ্যাঁ, ফারদার আমার সাথে কথা বলতে আসবি না, এসব নোংরা প্রস্তাব তোর কাছেই রাখ। নোংরা কীট!!’

রতি জানালার দিকে চেপে বসল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শ্বাস ফেলল। ঘন ঘন দম বের হচ্ছে। রাগে ভেতরটা এখনো ফুঁসছে। কিছুক্ষণ ইচ্ছেমতো লাথি মার‍তে পারলে তার মন মেজাজ শান্ত হতো।
মফিজুল আলম আর কিছু বলার মতো সাহস পেলেন না। লজ্জায় মাথানত করে চুপচাপ ঘুমের ভাব ধরলেন। কোনোরকমে জার্নিটা শেষ হলেই হয়।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি
*সাইলেন্ট পাঠকরাও এই পর্বের পর কী হতে পারে, তা মন্তব্য করে যাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here