সম্পর্ক,পর্ব-১৬

#সম্পর্ক
#১৬

মাহতাব বাড়িতে সবাই একত্রে খেতে বসেছে। শুধু ঝিলম আসেনি, তার নাকি মাথা ব্যথা। সে নিজের ঘরে শুয়ে আছে। দুপুর এই নিয়ে যথেষ্ট মেজাজ খারাপ করে আছে। সে জানে, মাথা ব্যথা ট্যথা কিচ্ছু না, এলে সবাইকে বেড়ে বেড়ে খাওয়াতে হবে, তাই নাটক করে শুয়ে আছে। অথচ সন্ধ্যার খানিক পর পরই ঝিলম রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। দুপুর নিজ চোখে দেখেছে।

লিলি বেগম, নাছির মাহতাব, আহ্নি, আরাফ, তাশরিফ, সবাই খেতে বসলেও দুপুর বসতে পারল না। ও সবার খাওয়ার তদারকি করছে। আহ্নি আয়েশ করে খাচ্ছে আর একটু পর পর দুপুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে, যা দুপুরের সমস্ত শরীর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।

দুপুর কটমট করে বলল, ‘এই একটু জলদি খা।’
‘কেন?’ গোশতের আর একটি টুকরো পাতে নিতে নিতে বলল আহ্নি।
‘কেন মানে? আমি এখনো খাইনি, চোখে দেখিস না? তুই একটু জলদি খেয়ে এদের তদারকি কর, আমি খেতে বসি।’
আহ্নি শান্ত, শীতল, তবে দৃঢ় স্বরে জবাব দিল, ‘পারব না।’
‘লাগাবো এক চড়, বেয়াদব! একটা কাজও ধরিস না। আমার একা দশদিকে খেটে খেটে জান যাচ্ছে।’
আহ্নি পাল্টা জবাব দেওয়ার আগেই তাশরিফ খেঁকিয়ে উঠল, ‘তুই তো আর পড়াশোনা করিস না। ও তো পড়ে। আর ও সবার ছোট। ওর দরকার কী কাজ করার? তুই আছিস, আম্মা আছে…’
‘আর নিজের বউ নাই? সে গায়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াতে আসছে এখানে? এটা কী হাওয়া খাওয়ার জায়গা?’ রাগ চেপে না রাখতে পেরে বলেই দিল দুপুর।
তাশরিফ প্লেট ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘তোরা কেউ আমার বউকে দেখতে পারিস না। তোদের পেটে এত হিংসুটামি! আসলে ঝিলম ঠিকই বলছে, তোদের ভেতরে নাড়িভুড়ি কিছু নাই। সব হিংসায় ভরা। ঝিলম ক’দিন হলো এ বাড়িতে এসেছে? নতুন বউরা এত কাজ করে নাকি?’
‘না, করে না। দুনিয়াতে আপনার একারই বউ, আর মানুষের বউ নাই। রতি ভাবিও তো যেদিন এই বাড়িতে আসছে, সেদিন থেকেই কাজ করছে। সব একা করছে। তবুও কখনো কিচ্ছু বলে নাই। আর আপনার বউ এতদিন হইছে আসছে, এখনো নতুন? তো যান, তুলু তুলু করেন গিয়া। কোলে নিয়া বইসা থাকেন।’ দুপুর তাশরিফের প্লেটে পানি ঢেলে দিল। তাশরিফ উদ্যত হলো, মারবে বলে.. আরাফ আঁটকালো, ‘তুমি ঘরে যাও ভাইয়া। ঝামেলা করো না।’
‘ওর কথাগুলা শুনছিস? এইটুকুন মেয়ের কী পাঁকা পাঁকা কথা!’
‘থাক বাদ দাও। তোমার বউয়ের অনেক মাথা ব্যথা না? যাও, গিয়ে দেখো তার কী অবস্থা। বেশি ব্যথা হলে মাথায় পানি ঢালো। এত রাতে তো ডাক্তার পাবা না, নইলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলতাম।’

আরাফের কটাক্ষ কথা, দুপুরের আগুন লাল চোখের চাহনি, আহ্নির মিটিমিটি হাসি, সব মিলিয়ে তাশরিফকে বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দিল। সে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল, কাউকে কিছু বলল না। দুপুরকে টেনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল আরাফ। দুপুর ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল, গাল ফুলিয়ে, ঠোঁট উলটে নালিশের সুরে বলল, ‘এই বাসায় আমার কী কোনো দাম নাই? কোথাকার কোন মেয়ে এসে এই ঘরে রাজত্ব চালাবে আর আমি কামলা খাটবো? কেন? আমি কী এই বাসার চাকর?’

আহ্নির মুখ বরাবরই ভীষণ পাতলা, সব জায়গায় কথা না বললে তার চলে না। এবারেও দুপুরের কথা শুনে সে কিছু না বলে থাকতে পারল না। আহ্নি কটাক্ষ করে বলল, ‘এখন কেমন লাগে আপা? রতি ভাবিও এভাবেই তোমাদের চাকরগিরি করে গেছে দুইটা বছর, আর তোমাদের এই ক’টা দিন সহ্য হয় না?’

আহ্নি ভেবেছিল, তার এই কথার পিঠে সবাই খেঁকিয়ে উঠবে তার উপর, কিন্তু আহ্নিকে পুরোপুরি ভাবে অবাক করে দিয়ে দুপুর চুপ হয়ে গেল, লিলি বেগম প্লেটের ভেতর অন্যমনস্ক হয়ে আঁকিবুঁকি করতে লাগলেন, আর সবচেয়ে বড় কথা, আরাফ খাওয়া ছেড়েই উঠে চলে গেল।
এই রতি নামটা এখন ভীষণ ভারী তার জন্য, এই নামটা শুনলে আগে রাগে গা রি রি করতো, আর এখন অদ্ভুত এক দহনে মন, প্রাণ সব পুড়ে যায়!
রতিকে কতটা কষ্ট দিয়েছে সে!কত স্বপ্ন দেখিয়ে মেয়েটাকে এনেছিল এই বাড়িতে, আর তার পরিবর্তে সবসময় কী দিয়েছে আরাফ? বাকি সবাই তার সাথে খারাপ আচরণ করলে, রতি আসতো তার কাছে, তার উষ্ণ বুকে মাথা রেখে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি মুছতে আসতো, আর তখন আরাফও ‘নাটক করো না’ অথবা ‘এসব ক্যাঁচক্যাঁচ আমার কাছে এসে করবা না’ বলে মেয়েটাকে বুকে তো দূর,নিজের বাহুডোরেও জায়গা দেয়নি।

এরপর কখন, কীভাবে, কতটা আস্তে আস্তে, রতি আরাফের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল, আরাফ কখনোই টের পায়নি। নিজের দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান সবকিছু নিজের ভেতর জমা করে পাথর হয়ে যাওয়া মেয়েটাকেও কম আছড়ায়নি সবাই…
তবুও কোনোদিন কাজের প্রতি অবহেলা করেনি রতি, না কারো মুখের উপর একটা শব্দ উচ্চারণ করেছে। বিপরীতে কী পেল? আরাফের থেকে তালাক শব্দটি?
আসলে, আরাফের তখন মাথা ঠিক ছিল না যখন আবিরের সাথে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলো রতি। এখন আরাফ বুঝতে পারছে, রতি আবিরের সাথে কোনো সম্পর্ক গড়তে এই ঘর ছাড়েনি, বরং একটু বাঁচার জন্য একটা ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল। পানিতে পড়লে বাঁচার জন্য খড়কুটো যাই পায়, তাই যেভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় ডুবন্ত মানুষটি, ঠিক সেভাবেই রতিও বাঁচতে চেয়েছিল বলেই আরাফকে ছেড়ে চলে গেছে।

আরাফের বুক হঠাৎ করেই খুব জ্বলতে শুরু করল। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। পৃথিবীতে তার জন্য বরাদ্দকৃত অক্সিজেন কী শেষ তবে? আরাফ পায়ে পায়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল, তখন মনে পড়ল, এই বারান্দায় একটা ছোট্ট বাগান করার জন্য কতই না আকুতি মিনতি করেছিল রতি। অথচ আরাফ পাত্তাই দেয়নি।রতির যে ইচ্ছা, শখ, আহ্লাদ বলে কিছু থাকতে পারে, তা যেনো একদম ভুলেই গিয়েছিল সে৷ একসময় শারীরিক টানেই রতির কাছে যেতো, কোনোকিছুর প্রয়োজন পড়লে রতির নামটি তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো। এছাড়া রতির সাথে তার কীসের প্রয়োজন? সব প্রয়োজন, সব কথা, ফুরিয়ে গিয়েছিল!

আরাফের বুকের পাড় ধক ধক শব্দে ভাঙতে লাগল। হঠাৎই রতির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তার। আচ্ছা, আবার কী ফিরিয়ে আনা যায় না রতিকে? দরকার পড়লে এই বাসা ছেড়ে চলে যাবে সে। রতিকে নিয়ে আলাদা সুখের জীবন গড়ে তুলবে তারা..
রতির সঙ্গে যতটুকু অন্যায় করেছে, তারচেয়েও বেশি ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে…
তবে কী তার প্রতিটি ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে না? হবে, নিশ্চয়ই হবে। আরাফের মন বলছে, রতি তাকে এখনো ভালোবাসে। একদম আগের মতো, তার ভালোবাসায় অমাবস্যার আঁধার নামলেও, রতির ভালোবাসা সবসময় জ্বলজ্বলে সূর্যের ন্যায় ছিল। সেই উজ্জ্বল ভালোবাসায় কোনোদিন কুয়াশার জালটাও ফেলতে দেয়নি রতি…
আরাফ যদি একবার, নিজের অনুতপ্ত অন্তর নিয়ে রতির সামনে দাঁড়ায়, তবে নিশ্চয়ই রতি তার সঙ্গে ফিরে আসবে। আসবেই…
রতির সাথে একবার কথা বলা উচিত। ওর নাম্বারটা কই পাবে?

আরাফ চটজলদি আহ্নির ঘরে এলো। আহ্নি তখন পড়ছিল,শব্দ করে করে, মাথা ঝাকিয়ে। আরাফ আহ্নিকে ডিস্টার্ব না করে চুপচাপ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ একসময় আরাফকে খেয়াল হলো আহ্নির। সে পড়া থামিয়ে বই বন্ধ করে আরাফের দিকে ঘুরে তাকালো, ‘কী ব্যাপার ভাইয়া? ওভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো।’
আরাফ আহ্নির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে, ভণিতা ছাড়া সরাসরি বলে উঠল, ‘তোর কাছে রতির নাম্বার আছে? মিথ্যে বলিস না। আমি জানি রতির সাথে তোর ঠিক ঠিক যোগাযোগ হয়।’
আহ্নি একটুও চমকালো না। বরং স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আছে কিন্তু ভাবিকে ফোন না দিয়ে তার সাথে সামনাসামনি কথা বললে ভালো হবে।’
আরাফ চমকালো, ‘তুই অবাক হোসনি?’
আরাফ চেয়ার টেনে বসল।

‘উঁহু, অবাক হইনি। আমি জানতাম, একদিন তুমি আমার কাছে আসবে, রতি ভাবির জন্য।’
‘কীভাবে?’ একটু ভড়কে গেলো আরাফ, প্রকাশ করল না। চোখমুখ শক্ত করে জবাবের আশায় চেয়ে রইলো।
স্মিতহাস্যে আহ্নির উত্তর, ‘কারণ পৃথিবীতে পালাবদল হয়। যে যেটাকে নিন্দে করে, সে সেটাকেই গলায় জড়ানোর জন্য একসময় পাগল হয়ে যায়। একসময় রতি ভাবি তোমার জন্য পাগল ছিল, আজ তুমি তার জন্য। এটাই তো স্বাভাবিক! আর যদি এমনটা না হতো, আমি ভাবতাম, তুমি তাহলে কোনোদিন ভাবিকে ভালোই বাসোনি। ভালোবাসার মানুষের প্রতি একটু হলেও টান আসবে, একদিন না একদিন! মায়া বলেও তো কিছু আছে নাকি?’

আরাফ অবাক চোখে পিচ্চি আহ্নির ওই বড় বড় কথাগুলো গিলছিলো। আর আহ্নি? সে তার মতো করে কথার রেলগাড়ি ছুটিয়ে চলছিল, ‘বুঝলে ভাইয়া, ভালোবাসায় মাঝে মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করা দরকার। কতেক বলে, চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়! আরে, যে সত্যিকারভাবে মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তাকে তুমি পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দিলেও, তোমার মনের আড়াল তো দূর, উল্টো তার জন্য পরাণ পুড়বে। আর এটাই ভালোবাসার নিজস্বতা! যদি এমন না হতো, তবে লাইলি মজনু, শাহজাদী মমতাজের মতোন বিশ্ব প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাহিনী আমরা কোনোদিন শুনতাম না!
কে বলে সত্যিকারের ভালোবাসা বেঁচে নেই? আছে, এখনো আছে। নয়তো, যে মেয়েটা বাসা থেকে বেরিয়ে মেইন রোড অবধি যেতে ভয় পায়, যে মেয়েটা রাতের বেলা একা বাথরুম যেতে ভয় পায়, যে মেয়েটা বজ্রপাতের আওয়াজে চমকে উঠে, সেই মেয়েটা কী করে কয়েকদিনের পরিচয়ে কারো হাত ধরে সম্পূর্ণ অজানা পরিবেশে, অজানা ভবিষ্যতের স্রোতে নিজের গা ভাসাতে পারে, বলো? আমার কথাগুলো খুব বেশি অযৌক্তিক লাগছে ভাইয়া? যেদিন তুমিও সত্যিকারের ভালোবাসায় পড়বে, সেদিন তুমি বুঝবে আমি মোটেও অযৌক্তিক কথা বলছি না।’

‘মানে কী! আমি রতিকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি না? আমার জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা আসেনি?’ আরাফের চোখ জোড়া গোল গোল হয়ে গেছে।
আহ্নি পূর্বের ন্যায় স্মিতহাস্যে উত্তর দিল, ‘হুম। তুমি রতি ভাবিকে ভালোবাসো, তবে অল্প সল্প। অল্প বিদ্যা যেমন মানুষের জন্য ভয়ংকরী, তেমন অল্প ভালোবাসাও মানুষের জন্য ভয়ানক হয়। যেমন রতি ভাবির কপালটাই দেখো! কত আশা, ভরসা নিয়ে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ, সুন্দর জীবন, আর সুন্দর সংসারের স্বপ্ন এঁকে তোমার হাত ধরেছিল, বিনিময়ে তুমি তাকে কী দিয়েছো? আজ অন্যের বাড়ি থাকে, নিজে উপার্জন করে খায়! যদি তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে, তবে কী এত কষ্টের মুখে তুমি তাকে ঠেলে দিতে পারতে? পারতে না, বরং তাকে বুকে আগলে তুমি আগুনের দিকে পিঠ করে দিতে। সব আগুন এসে তোমার পিঠে লাগলেও, ভাবির গায়ে যেন একটা গরম আঁচ ও না লাগে, সেই জন্যে..’

আরাফ নিশ্চুপ, নিরুত্তর, আহ্নির কথার পিঠে উত্তর দেওয়ার মতো যুতসই কিছু সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু একটা কথা তার মাথায় ঘুরতে লাগলো, ‘উপার্জন করে খায়’, তবে কী রতি চাকরি নিয়েছে?

আরাফ মিনমিনিয়ে বলল, ‘ও কোথায় চাকরি করে রে?’
‘কেন, তুমি কী করবা? ওখানে গিয়ে দেখা করে আসবা?’
আরাফ চুপ থাকে, আহ্নি মেয়েটা ভীষণ অদ্ভুত, সবকিছু এত আগে আগে বুঝে যায় কী করে!
আহ্নি হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আরাফ চমকে তাকাতেই আহ্নি স্থির হয়ে গেল, তবে তার চমৎকার হাসির রেখা ঠোঁটেই রয়ে গেল।

‘কোথায় চাকরি করে তা ভাবির থেকেই জেনে নিয়ো না হয়। আগামীকাল সকাল নয়টাউ ভাবি ঝিল পাড়ের সামনে দিয়েই বাস স্ট্যান্ডে যাবে। মনে রেখো, একদম নয়টায়। এর আগে পরে হলে…’ আহ্নির কথা শেষ হয় না, তার আগেই আরাফ তড়িঘড়ি করে বলল, ‘হবে না,হবে না। আমি সাড়ে আটটায় গিয়েই দাঁড়াবো।’
আহ্নি হাসি চাপিয়ে রাখতে পারে না, খলখল ধ্বনিতে হেসে উঠে। আরাফ লজ্জা পায়। উঠে চলে যেতে নেয়। আবার কী যেনো মনে হলে থামলো। আহ্নির কাছে এসে আহ্নির মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তুই অনেক ভালোরে আহ্নি। তোর জীবন টা খুব সুন্দর হোক।’
আহ্নি বই খুলতে খুলতে জবাব দেয়, ‘কারো জীবন সুন্দর হয় না ভাইয়া। জীবন কে সুন্দর করে তুলতে হয়।’
আরাফ চলে যেতে যেতে বিড়বিড় করে, ‘আমার জীবনের মূলধ্বন পেয়ে গেছি। এবার আমার জীবনটাও সুন্দর হবে।’

আহ্নি কথাটুকু শুনে,তার বুকে প্রশান্তির ছোঁয়া। সে বই বন্ধ করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলল, ‘হে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা, ভাইয়া আর ভাবির জীবনটাকে আপনি সুন্দর করে দিন।’

কিন্তু, আফসোস, আহ্নি বেচারিটা যদি তাদের ভবিষ্যৎ টা জানতো!

__________
মাধুরি হুট করে একটি বিষয় খেয়াল করলেন, তার চঞ্চল, উৎফুল্লতায় ভরা মেয়ে কেমন যেন মিইয়ে গেছে। আগের মতো দৌড়োদৌড়ি, হুড়োহুড়ি নেই। ছাদেও তেমন একটা যায় না মৌনি। অথচ এই মেয়ের আগে অর্ধেক বেলাই কাটতো ছাদে টইটই করে। আর এখন রুম থেকেও বের হতে চায় না। মাধুরির কাছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে এসে এটা ওটা আবদার করে না। মাধুরি খুবই চিন্তিত মৌনিকে নিয়ে৷ মৌনির এই হঠাৎ পরিবর্তন তাকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দিয়েছে।

মৌনি উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। তার দু’চোখে ঘুম নেই। দুইদিন আগে প্রান্তকে দেখেছে আহ্নি নামের ওই মেয়েটার সাথে। আহ্নি একটা দোকান থেকে বের হলো, প্রান্ত দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর আহ্নি বের হলে, প্রান্ত হেটে হেটে তার পাশে গিয়ে উপস্থিত হয়। এরপর দু’জনে হাসি হাসি মুখে গল্প করতে করতে এগিয়ে যায়। আর মৌনি তখন একটা গাছের আড়ালে, নিজেকে আড়াল করে ‘হা’ হয়ে প্রান্তের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ছিল।

বুক চিনচিনে ব্যথাটা তখন থেকেই হচ্ছে। একদম বুকের বাম দিকে, একটু পর পর শ্বাস কষ্টের মতো কেমন যেন লাগে। তখন হা করে নিঃশ্বাস নিতে হয়। আবার হুটহাট, চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসে।
প্রান্ত কে নিয়ে যতটা না বিরক্ত সে, তারচেয়েও বেশি বিরক্ত নিজেকে নিয়ে। যেখানে প্রান্তের তার প্রতি কোনো টান ছিল না, অনুভূতি ছিল না, কোনো নূন্যতম সম্পর্কও ছিল না, তারপরও তার প্রতি মৌনির এই উথলানো টান, মৌনির সহ্য হচ্ছে না। দিন দিন, সে নিজেই নিজের বিরক্তের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতকাল রাতে টয়লেটে ঢুকে সে নিজেকে নিজেই চড় মেরেছে অনেকগুলো। বারবার নিজেকে শক্ত করেছে, বুঝিয়েছে, অথচ এই খারাপ অসুখটা সারছেই না। বরং আরো কঠিন হচ্ছে আবেগ।

এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মৌনির বুক চিঁড়ে। মাধুরি রুমে ঢুকলেন, লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। মৌনি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে। কাঠ কাঠ ভাব নিয়ে পড়ে রয়। মা’কে কিছুতেই কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। রাত বাজে একটা, এখনো সে ঘুমোয়নি দেখলে মা হাজারটা প্রশ্ন করে তাকে মেরে ফেলবে!!
কিন্তু এত রাতে মা-ই বা কেন এলো? মৌনি ঠোঁট কামড়ে ভাবে,চোখ বন্ধ।

মাধুরি মেয়ের শিয়রের কাছে বসলেন। এরপর নিশ্চুপ হয়ে শুধু মেয়েকেই দেখতে থাকেন। মৌনির অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ জোরজবরদস্তি ভাবে চোখ বন্ধ রাখা যায়? চোখ খোলার জন্য মনটা উশখুশ লাগিয়ে দিয়েছে। একসময় না পেরে মৌনি পিটপিট করে চোখ মেলে। ভাব খানা এমন, যেন লাইটের আলোয় হুট করে ঘুম ভেঙে গেছে। এরপর মাধুরিকে দেখে, অবাক হওয়ার অভিনয় করল, বলল, ‘তুমি এখানে! সব ঠিক আছে তো মা?’
বলতে বলতে উঠে বসল মৌনি। মাধুরি হেসে ফেললেন, ‘অভিনয়ে যে এত ভালো তুই! কবে থেকে হলি? বড় হয়ে মিডিয়ায় ঢুকার ইচ্ছে টিচ্ছে আছে নাকি?’
মৌনি জবাব দিল না। সে ধরা পড়ে গেছে। চুপচাপ মায়ের কোলে একটা খরগোশের বাচ্চার মতো গুটিয়ে ঢুকে পড়ল। মাধুরি মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন।

‘মা রা বুঝি এমনই হয়? সবকিছু বুঝে যায়!’
‘যেদিন তুই মা হবি, সেদিন বুঝবি।’
‘ইশ, আমি কোনোদিন বিয়ে করব না মা।’
‘কেন, কেন করবি না? চিরকুমারী থাকার ব্রত করেছিস নাকি?’
‘করতেও পারি, যদি ইচ্ছে হয় আর কী। মানুষের মন তো, কখন বদলে যায় কে জানে। তবে এখন ইচ্ছে নেই মা।’
‘এখন তোর বিয়ের কথা কে ভাবলো!’ মাধুরি ভ্রু কুঁচকালেন, ‘আগে অনেক বড় হ, লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়া। তারপর দেখা যাবে।’
‘হুঁ..’ মাধুরির কোলের মধ্যে আরেকটু ঢুকে পড়ল মৌনি, আদুরে গলায় বলল, ‘তুমি এত রাতে এখানে কেন? ঘুমোয়নি?’
‘তুই ঘুমোসনি। কিছু একটা চিন্তায় আমার মেয়ে ছটফট করছে আর আমি শান্তিতে ঘুমাবো? আমি কী স্বার্থপর মা?’
মৌনির বুক ভিজে এলো। তার মা এত ভালো কেন? যদিও একটু একটু বকে, তাতে কী? যে ভালোবাসে সেই তো শাসন করবে না-কি?

‘তোর কী হয়েছে বল তো। কেন এরকম চুপচাপ হয়ে গেছিস? আমাকে খুলে বল।’
‘আমার একটা অসুখ করেছে মা। খুব খারাপ অসুখ। সেই অসুখের অসুস্থতায় আমি মরে যাচ্ছি মা, মাঝে মাঝে আমার দম টানতেও কষ্ট হয়।’ ফিসফিসিয়ে বলল মৌনি। মাধুরি শুনতে পেলেন না ঠিকঠাক, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কীরে, কী বলিস? কী হয়েছে?’
মৌনি কোলের ভেতর থেকে মাথা বের করল, চমৎকার হাসি ঠোঁটে ফুঁটিয়ে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। এমনিতেই খুব চিন্তায় আছি। সামনে এক্সাম কীনা! ভালো রেজাল্ট না করলে বাবা কী করবে, জানোই তো।’
‘সত্যি এই জন্যে তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস?’
‘হুঁ.. পরীক্ষার প্যারাহ ভালো লাগে না। মা, আমি কয়টা দিন বড় খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসি?’
‘সামনে পরীক্ষা, আর এখন বেড়াতে যাবি? তোর বাবা কী যেতে দেবে?’
‘সে আমি জানি না, তুমি ম্যানেজ করবে। প্লীজ মা, হাওয়া বদল হলে আমার মনটা চাঙা হয়ে যাবে। তখন ফিরে এসে পড়ালেখায় দারুণ ভাবে মন বসাতে পারব। আর বেশিদিন তো না, দু-চারদিন..’

মা উঠে দাঁড়ালেন, ‘দেখি, তোর বাপের সঙ্গে কথা বলি.. নে শো এবার। কাল ক্লাস আছে না?’
‘তুমি বাতি নিভিয়ে চলে যাও মা। আমি ঘুমালাম। অনেক ঘুম পাচ্ছে।’
মৌনি কম্বলের তলে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল, চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস ফেলে বোঝালো, সত্যি তার ঘুম পাচ্ছে। মাধুরি মেয়ের কপালে চুমু এঁকে লাইট নিভিয়ে চলে গেলেন। সেই সারারাত মৌনির ঘুম হলো না। কিশোরী আবেগে দগ্ধ হওয়া মনের যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে কাঁদলো মৌনি। একবার ইচ্ছে করল, এক দৌড়ে ছাদে চলে যায়, প্রান্তের পা ধরে বলে, ‘আমায় একটু ভালোবাসুন না.. এই দেখুন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই যে এদিকটায়, এদিকটায় কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। উফ, কী যন্ত্রণা…’
পরক্ষণেই মাথা থেকে এসব পাগলামি চিন্তাভাবনা সরিয়ে নেয় মৌনি। মনকে শুধায়, কালকেই খালামনির বাসায় চলে যাব। এই বেহায়া, বজ্জাত মনকে পিটিয়ে সোজা করে তবেই এই বাড়ি ফিরব।
ওই প্রান্তের ভালোবাসা আমার চাই না!!

__________
‘আফা, যাইবেন?’

রতি বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম হাঁটতেই একজন রিকশাওয়ালা তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল। রতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, মৃদু হেসে উত্তর দিল, ‘না চাচা, এই সামনেই বাস স্ট্যান্ড। হেটে যেতেই পারব। লাগবে না।’

রিকশা ওয়ালা চাচা টুংটুং বেল বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন। বাম হাতে পরা ছোট ডায়ালের হাতঘড়িটার দিকে তাকাল রতি, সময় আটটা পঞ্চাশ। বাসে উঠলে আধাঘন্টার মধ্যেই পৌঁছানো যায় অফিসে। তাই রতি ধীরস্থির ভাবেই হাটতে লাগল। কোনো তাড়া নেই তার।

ঝলমলে আকাশ, নীল সমুদ্রে সাদা ভেলা ভেসে যাচ্ছে – এমন লাগছে দেখতে। মৃদুমন্দ বাতাস, রাস্তাঘাটে এখনো তেমন লোকজন নেই। ঝিল পাড়ের রাস্তা দিয়ে খুব কম লোকই বাস স্ট্যান্ডে যায়। আবিরদের বাসা থেকে এই পথে বাস স্ট্যান্ডে যেতে কম সময় লাগে বিধায় রতি এই পথে যাতায়াত করে।

ঝিলের পানিগুলো টলটলে সবুজ, দেখলে মনে হয়, সবুজ ঘাসের স্থির মাঠ। রতি সেদিকে তাকিয়ে হাটছিল, ঠিক তখনি একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর তার নাম ধরে ডেকে উঠল। রতির পা জোড়া আচমকা থেমে গেল। এই কণ্ঠস্বরের মালিককে সে চেনে। কিন্তু সে এখানে কেন? আর তাকেই বা কেন ডাকলো!

কতদিন পর দেখবে! রতি আড়ষ্টতা আর অস্বস্তিতে মেখে গেল। ঘুরে তাকাল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এক জোড়া পা এসে তার দাঁড়াল, রতি কেঁপে উঠল ভেতরে ভেতরে।প্রকাশ করল না…
বাহিরে তার চোখমুখ ভীষণ শক্ত!

‘আমার দিকে তাকাতে ঘৃণা লাগছে?’ বলে উঠল আরাফ।
রতি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকাল, এবং ভীষণ রকমের ঝটকা খেল। উসকোখুসকো বাউন্ডুলেদের মতো চুল, কতদিন কাটে না কে জানে। চুলে চিরুনিও লাগায় না বোধহয়। শার্ট কুঁচকে আছে, আবার অপরিষ্কার! চোখ দুটো গাঢ় লাল, সারারাত কী ঘুমায়নি? আর সবচেয়ে বড় কথা, আরাফ এই কয়দিনে এত শুকিয়ে গেছে কেন? ছেলেটা কী খায় না?
নাকি রান্না করার মতো কেউ নেই?
হাজারটা প্রশ্ন রতির মাথায় এক ধাক্কায় ভীড় জমায়। রতি কোন প্রশ্ন রেখে কোনটা করবে ভেবে না পেয়ে চুপ থাকে।
আরাফ নিরবতা ভাঙতে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ?’
রতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। প্রিয় মানুষ গুলো কেমন আছো বললে উত্তরে কী বলতে হয়? নাকি বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে?
রতি জান না, তবে সে অনুভব করছে তার বুকটা মোচড়ামুচড়ি লাগিয়ে দিয়েছে।

রতি খুব কষ্টে উচ্চারণ করে, ‘ভালো আছি। আপনি?’
এতদিনকার ‘তুমি’ বলার অভ্যাস কয়দিনেই ‘আপনি’তে রূপান্তরিত হয়ে গেল? আরাফ অবাক হয় না। সে যা যা করেছে রতির সাথে তাতে এইটুকু তো প্রাপ্য!

‘আছি ভালো। এভাবে তোমার পথ আটকালাম বলে রাগ করোনি তো?’
‘না, রাগ করিনি। তবে অস্বস্তি হচ্ছে। আপনি জানলেন কী করে আমি এই রাস্তায় যাতায়াত করি? ফলো করছেন?’
‘না, আহ্নির থেকে জানলাম।’
‘কেন? জানার দরকার আছে কোনো?’

আরাফ ক্ষণকাল চুপ থেকে বলল, ‘আছে।’
‘কী দরকার?’
‘তোমার মনে আছে রতি, যখন আমরা চট্টগ্রাম ছিলাম। ওই যে বন্ধুর বাসায়। একদিন আমি লেট করে ফিরেছিলাম, তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে করতে বিরক্ত বানিয়ে ফেলেছিলে তাই আমি ধমক দেই, রাগারাগি করি? তুমি ছাদে উঠে একলা বসে কাঁদো? তখন আমি কী করেছিলাম? নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছাদে যাই। তারপর কান ধরে উঠবস করি,তোমাকে সরি বলেছিলাম, মনে আছে তোমার?’

রতির পাজরে পাজরে কাঁপন ধরেছে, এসব কেন বলছে আরাফ! এসব বলে কী বোঝাতে চাইছে সে! পুরোনো স্মৃতি মনে করেই বা কী লাভ! রতি প্রশ্ন করতে যায়, তার আগেই আরাফ দু’হাতে কান চেপে ধরে, উঠবস করতে কর‍তে বলতে লাগল, ‘আমি সরি বউ… আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করা যায় না? প্লীজ ক্ষমা করে দাও। অপদার্থ আমি! তোমার সম্মান দেইনি, তোমার কদর বুঝিনি। আজ যখন তোমাকে হারালাম, তখন বুঝলাম তুমি আমার কাছে কী! তুমি ছাড়া আমি যে কতটা অচল,তা বলে বোঝাতে পারব না। এই যে কান ধরছি,উঠবস করছি, আর কক্ষনো কোনো ভুল করব না। আর যদি করিও, তুমি শুধরে নিয়ো। সরি জান, প্লীজ সরি.. আমরা আবার বিয়ে করব, ধুমধাম করে বিয়ে করব। ক্ষমা করে দাও।’

রতি হতবাক, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
কী বলা উচিত, বা কী করা উচিত, রতি ঠাওর করতে পারছে না। আশেপাশের কয়েকজন উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। রতি ক্ষীণ গলায় ধমকের মতো করে বলল, ‘হচ্ছেটা কী? প্লীজ অফ করুন এইসব তামাশা। সবাই দেখছে।’
আরাফ উঠবস অফ করলেও কান থেকে হাত সরায় না। কানে হাত চেপেই বলে, ‘তাহলে তুমি আমাকে ক্ষমা করছো?’
‘কক্ষনো না। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই, বাট আই এম সরি, ওই পরিবারে বা আপনার জীবনে, আমার জড়ানোর শখ আর নেই। আমি আমার জীবনটাকে নিজের পরিকল্পনা ও ইচ্ছানুযায়ী গুছাতে চাই। আর শুনুন মিস্টার আরাফ,বিয়ে কোনো তামাশা নয়! মন চাইলো তালাক, মন চাইলো আবার কবুল! আপনার বিয়ে করার সাধ জাগলে আপনি নতুন কাউকে খুঁজে নিন, আই ডোন্ট কেয়ার। এন্ড আমার তরফ থেকে কোনো ধরনের প্রবলেম হবে না। বাট আপনার জীবনে প্লীজ আমাকে ব্যাক করতে বলবেন না। আই কান্ট, রিয়েলি সরি।’

আরাফ এগিয়ে এসে রতির হাত মুঠোয় তুলে নিল, দৃঢ়ভাবে বলল, ‘আমরা আলাদা বাসা নিবো রতি, তোমাকে ওই ফ্যামিলিতে যেতে হবে না।তারপরও প্লীজ ফিরে চলো। আমার উপর রাগ তুমি, আমি জানি। আমাকে যত ইচ্ছা শাস্তি দাও, আমি সব মাথা পেতে নিবো। তবুও বলছি, প্লীজ ফিরে চলো.. তোমাকে ছাড়া অনেক নিঃস্ব লাগছে।’
‘লাগুক..’ গমগমে আওয়াজে বলে উঠল রতি, আরাফের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো, ‘একটা প্রবাদ বাক্য আছে, নাইড়া একবারই বেল তলায় যায়,বারবার যায় না। বিয়ের মধু যে একবার পান করছে, সে আর কোনোদিন পান করতে চাইবে না। আমি আপনাকে হাতজোড় করে রিকোয়েস্ট করছি,আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। আমি আমার একলা জীবনে ভাল আছি। নিজের জীবনটাও গুছিয়ে নিয়েছি। আমাকে আমার মতোই থাকতে দিন। প্লীজ..’

আরাফের রাগ হলো, তবুও প্রকাশ না করে ঠান্ডা মাথায় রতিকে বুঝাতে লাগলো, ক্ষমা চাইলো বারবার, কিন্তু রতি কোনোভাবেই মানতে রাজী না। সে কিছুতেই আর ম্যারিড লাইফে ব্যাক করবে না।

শেষমেশ আরাফের ধৈর্য্যচ্যুত হয়, সে বলে উঠল, ‘তোমার জীবনে কে এসেছে, যার জন্য তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো?’
রতি হতভম্ব, ‘কে আসবে আমার জীবনে?’
‘মিথ্যে বলো না। কেউ না আসলে এত জোর কোথায় পেলে?’
‘আমাকে সেই আগের রতি ভেবে ভুল করবেন না৷ এটা নতুন রতি, যাকে নতুন জীবন আর মনের জোর সবটাই দিয়েছে আবির ভাই।’
‘ও… এই তাহলে কাহিনী! তা কতদিন চলছে তোমাদের?’
আরাফের এমন নিচু মানসিকতার কথায় রতির মেজাজ বিগড়ে গেল।
‘ফালতু কথা বলবেন না৷ সবাইকে এক পাল্লায় ওজন দেওয়া বন্ধ করুন৷ উনি আমার ভাইয়র মতো..’
‘ভাই তো আর না… আর বর্তমানে ভাইয়া থেকে ছাইয়া হওয়ার ঘটনা অহরহ।’

রতির গায়ের প্রতিটা পশম রাগে খাঁড়া হয়ে গেছে। মনে পড়ছে, সেই দিনটির কথা, যেদিন আরাফের গালে সে চটাস চটাস করে থাপ্পড় বসাতে পেরেছিল। আজকেও সেদিনের মতো দু’টো লাগাতে পারলে ভালো হতো কিন্তু রাস্তায় তামাশা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে রতির নেই। রতি চুপচাপ হাটা ধরে। আরাফের পক পকে এমনিতেই দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।
আরাফও পিছু পিছু আসতে লাগলো।

‘দেখো রতি, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ এখন৷ আমি মানলাম আমি দোষ করছিলাম, কিন্তু ক্ষমাও তো চাচ্ছি। সব ঠিক করে তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি, সুন্দর একটা সংসার সাজাতে চাচ্ছি আবারও আর তুমি ভাব দেখাচ্ছো! রতি যদি আবিরের সাথে তোমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নাই থেকে থাকে তাহলে এত তেজ কোথা থেকে সাপ্লাই হচ্ছে নিজের ভেতর? হুঁ? এর মানে কী আবির না, অন্য কাউকে ধরছো? তোমার অফিসের কেউ?’

রতি ঝট করে থেমে গেল এবং ঘুরে আরাফের দিকে তাকাল। কাটাকাটা ভাবে বলল, ‘আপনি নিজে অফিসে রিলেশন করে বেড়াতেন বলে কী সবাইকে আপনার মতোই ভাবেন?’
আরাফ থমকে গেল। বিস্ময় সে, রতি এত ভেতরের খবরও জানে!
‘অবাক হচ্ছেন? কীভাবে জানলাম? সত্য কিন্তু বেশিদিন চাপা থাকে না। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আপনার কাপড় গুলো আমিই ধুঁইতাম৷ টাকা রেখে দিছেন কীনা মনের ভুলে এই দেখার জন্য চেক করতাম পকেট গুলো আর প্রায় সময় রঙিন ছোট্ট ছোট্ট কাগজে দু, তিন লাইনের লাভ চিরকুট পেয়ে যেতাম। প্রথম প্রথম মানতে পারিনি ব্যাপারটা, পরে বুঝলাম আপনি আর আমার মধ্যেই নেই। আপনার আমার রাস্তা আলাদা হবেই….
কাউকে জানায়নি, আহ্নিকেও না। একজনের কূ-কীর্তি অন্যজন কে শুনিয়ে স্বান্তনা নিতে চাইনি আমি, আর না করুণা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। আমার একটা শক্ত জায়গা লাগতো, সাপোর্ট দেওয়ার। সেটা ছিল না বিধায় চুপচাপ সব সহ্য করেছি, বুকে পাথর বেধে। নইলে কোন মেয়ে তার স্বামীর ভাগও সহ্য করে? যখন আবির ভাইয়া সেই শক্ত সাপোর্টার হলো, সুযোগ হারালাম না। চলে এলাম। এতে কারা কী ভাবে আই ডোন্ট কেয়ার! আমি যখন এত এত মানসিক, শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করছিলাম, তখন তো কেউ ছিল না আমার পাশে! তাহলে এদের কথা কেন শুনবো আমি? হোয়াই? শুনবো না কারো কথা, যেটা ইচ্ছা হয় সেটাই করব৷ এখন আমার আমিটাই আগে। নিজের সেল্ফ হ্যাপিনেসের জন্য যা যা করতে ইচ্ছে করবে সব করব…
আই হোপ, আজকের পর আর কক্ষনো আপনার সাথে আমার দেখা না হোক। বাজে স্বপ্ন কেইবা বারবার দেখতে চায়? খবরদার পিছু নিবেন না, কক্ষনো সামনে আসবেন না। আই উইল কমপ্লেইন… মাথায় রাখবেন। আর ও হ্যাঁ, মেয়েটার নাম পুষ্প না? ভালো মেয়ে হলে বিয়ে করে নিন না, শুধু শুধু বৈরাগী জীবন কাটিয়ে লাভ কী! এনজয় ইউর লাইফ…. গুড বায়।’

রতি থামে, দম নিল, এরপর গটগট করে হেটে চলে গেল। আরাফ দাঁড়িয়ে রইল, ওখানেই.. ওর চলার মতো শক্তিটুকু নেই। অফিসে প্রথম যখন পুষ্প এসেছিল, সে ফুলের মতো সফট, কোমল আর সুন্দর ছিল। সবাই-ই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, আরাফও বাদ যায়নি। আর পুষ্প সবাইকে বাদ দিয়ে বেছে বেছে আরাফের সঙ্গেই নিজের ডেটিং চালিয়ে গেল। আরাফ ম্যারিড সেটা জানার পরেও…
এমনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, আরাফ রতিকে ডিভোর্স দিয়ে পুষ্পকে বিয়ে করবে,এতটাই ডুবে গিয়েছিল তারা। কিন্তু তার আগেই আরাফ জানতে পেরেছিল, পুষ্প একই সাথে চারটে ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। সে বাদে আরও তিনটে ছেলে কলের পুতুলের মতো নাচছে..
আরাফ মেনে নিতে পারল না। পুষ্প’র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের ইতি টানলো। আর তার ক’দিন বাদেই রতি চলে গেল।

আরাফ ভেবেছিল, তার এই গোপন কালো অধ্যায়ের কথা যেহেতু কেউ জানে না, কাউকে জানানোর প্রয়োজনও নেই৷ কিন্তু রতি যে ভেতরে ভেতরে সব জানতো, সেটা আরাফ কখনোই বুঝতে পারেনি। মেয়েটার ভেতর কতটা গভীর!
এজন্যেই কী বলে, গোপনীয় সিক্রেট গুলো জমে থাকে মহাসমুদ্রের মতো গভীর প্রতিটি মেয়ের হৃদয়ে…. সেখানে পৌঁছোতে হলে ডোবা লাগে, তবুও পৌঁছানো যায় না!

আরাফ উল্টো পথে হাটা ধরল, বড় ক্লান্ত ভঙ্গিতে। ঠেলতে ঠেলতে শরীরটাকে নিয়ে চলল, বাসার দিকে। যাক, রতি ভালো জীবন চাইছে, ওর জীবনটা ভালো হউক, আর কখনোই যেন রতির সামনে না পড়ে, এই দোয়া করতে লাগলো আরাফ।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here