সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:৯

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৯.

রিপা চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন কিছু ঘটবে তার আগাম ধারনা ছিলো। তার দাদী সূচীবায়ু টাইপের! কোনো পুরুষ মানুষকে তার আশেপাশে দেখতে পারেন না। এমনকি তার ফুফা এবং ফুফাতো ভাই পর্যন্ত না। শ্যামল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে নির্বাক। বুড়ো বেটি তাকে এমন কিছু বলবে এর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ইতোমধ্যে রুপসী বানুর চেঁচামেচি শুনে উপস্থিত হলেন ঘরের বাকি সদস্যরা। রুবেল সাহেব বেশ ইতোস্ত ভঙ্গিতে রিপার শশুড়বাড়ীর লোকদের ভেতরে আসতে বলে রুপসী বানুকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। যদিও তিনি যেতে চাইছিলেন না তবুও রুবেল সাহেব জোরপূর্বক নিয়ে গেলেন।
রিপা মিনমিন গলায় বলে,

‘ভেতরে আসেন।’

বাকিদের এখনো হতভম্ভ ভাব কাটে নি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হয়ে গেলো তারা সেটা বুঝার চেষ্টায় রয়েছে। রিপার মা বিষয় টা সামাল দিয়ে হাসি মুখে উনাদের ভেতরে আসতে বললেন। তারাও মেকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো। শ্যামল এখনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আছে। নুহাও বেশ রেগে আছে।

ঘরের মধ্যে বেশ জায়গা জুড়ে বাদামি রঙের সোফা সেট রাখা। এটা নিপার পছন্দের। ঘরের বেশিরভাগ আসবাবপত্রই তাদের তিন বোনের পছন্দের। তারা তাদের পছন্দের জিনিসেরও খুব কদর করে। যার যার জিনিস সে সে সামলায়। তাইতো ঘরের প্রতিটা জিনিস চকচক করছে। মধ্যবিত্তদের টান পোড়নের সংসারে সবসময় শৌখিন জিনিসের দেখা মেলে। নির্মলা বেগম বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখছেন। অন্যরা কান সজাগ করে রুপসী বানুর চেঁচামেচি শুনছেন। তাকে রুমে নেওয়ার পর থেকেই তিনি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। নিপা, শিপা মেকি হেসে তাদের এন্টারটেইন করার চেষ্টা করছে। রিপার মা, এক ট্রে শরবত আর পিঠা নিয়ে এসেছেন। মেহমানদের প্রথমেই কীভাবে ভাত খেতে বসিয়ে দিবেন ? তাই এ হালকা পাতলার নাস্তার ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া মেয়ের শশুড়বাড়ীর লোকজন বলে কথা। রিপাও মা কে সাহায্য করছে এটা সেটা এগিয়ে দিতে। রুবেল সাহেব বেশ ব্যস্ত গলায় মা কে থামানোর চেষ্টা করছে। রুপসী বানু থেমে থাকার পাত্র নয়। তিনি খোঁটাতে লাগলেন রিপার বিয়ে নিয়ে। রিপার বিয়ের সময় বড় গাড়ী চলছিলো না, তাই তিনিও আসতে পারেন নি। তাই বলে কি তার জন্য অপেক্ষা করা যায় না? কীভাবে দাদীকে রেখে নাতনির বিয়ে দিয়ে দিলেন? রুপসী বানুর স্বভাব খুবই একরোখা। কোনো বিষয় নিয়ে কথা উঠলে তিনি তার একমাস আগের পুরানো কথা নিয়েও ভেজাল শুরু করে দেন। বাড়ীতে আসার পর তো তিন দিনেও থামেন নি। রুপসী বানু ফোড়ন কেটে বললেন,

‘ হ্যা, থামতে তো বলবিই, আমি এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছি । মেয়ের বিয়ে তে পর্যন্ত আমাকে নিমন্ত্রণ করিস নি। খা তোরা, শান্তিতে থাক। দশ মাস দশ দিন আমি কুমির পেটে ধরেছি। থাকবো না আর, চলে যাবো। এক্ষুনি দিয়ে আয় আমায়। ‘

কথাটা বলেই তিনি ড্রয়িংরুমের দিকে হাটা দিলেন। রুবেল জানে, মা ঘরের বাহিরেও পা দিবেন না। শুধু শুধু যেয়ে রিপার শশুড়বাড়ীর লোকজনের সাথে ঝামেলা পাকাবেন। সে দৌড়াতে লাগলো মা কে আটকে রাখতে। রুপসী বানু আঁচল দিয়ে চোখের জ্বল মুচতেছেন আর ঠোঁটে হাসি ফুটাচ্ছেন। তিনি পৌঁছাবার পূর্বেই কলিংবেল বেজে উঠলো। রিপা দরজা খুলতেই দেখলো ময়নার মা। ময়নার মা হলো কাজের লোক। তার খুব ভালো একটা নাম আছে, আখিঁ। অথচ তাকে সবাই ময়নার মা বলে ডাকে। সে এ কলনিতে বেশ পরিচিত। তাকে ফোন দিয়ে খোঁজ করতে হয়। হাতের পুতলি টা অন্য হাত বদল করে ভেতরে ডুকতেই দেখলো রুপসী বানু এদিকে আসছে। সে তৎক্ষণাৎ বাহিরে চলে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘ তোর দাদী কবে আইলো?’

রিপা মুখ ভার করে বলে,

‘ জানি না। আমিও আজ দেখলাম।’

ময়নার মা নিজেকে আড়াল করে বলে,

‘ আমি যাইতাছি, তোর মা রে বলিস পাশের বাসার বেডি টা অসুস্থ। তার বাসায় এসেছি। আর শুন, দাদীরে বলিস না আমি আইছি যে। নাহলে সে হুদাই তার এটা সেটা খু্জে পাবে না।’

রিপা হতাশ গলায় বললো,

‘আচ্ছা।’

ময়নার মা পা বাড়ানোর পূর্বেই রুপসী বানু চেঁচিয়ে বললেন,

‘কিরে ময়নার মা? তুই আইছোস? তয় এমন চোরের মতো যাইতেছোস ক্যা? দেখি দেখি তোর পুটলিতে কি আছে।’

‘কিছু নাই খালাম্মা। শুধু বাসি পটল তরকারি।’

রুপসী বানু আড়চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘ওহ। আইচ্ছা এদিকে আয় তো। আমার চার গোটা সুপারি খুঁজে পাইতেছি না। তুই দেখছোস? একটু খুঁইজা দে তো।’

ময়নার মা চোখ বন্ধ করে ফেললো। এ নতুন না। একটু পর শুনবে বুড়ির দুইটা পান পাচ্ছে না। তারপর শুনবে কিসের বোতল নাই। আরো আরো কত কিছু শুনবে। বড্ড আফসোস লাগছে, কেনো যে এসেছে? তার ধারনা আজ ঘুম থেকে উঠবার পর ময়নার মুখখানা দেখে নি তাই এমন মুসিবত দেখা দিচ্ছে। কাল থেকে ময়নাকে বেঁধে রাখবে, তারপর ঘুম থেকে উঠে তার মুখ দেখে কাজে আসবে। রিপার মায়ের বারবার ফোন কল আর কাকুতি না শুনলে সে আজ আসতো না। খুনাক্ষরে যদি টের পেতো রুপসী বানু এসেছেন তাহলে সে আজ কেনো আগামি দু-তিন দিনেও এ ত্রি-সীমানায় পা রাখতো না। ময়নার মা যদি এখন ভেতরে না আসে তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে রটে যাবে সে রুপসী বানুর জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে ভেগেছে। তাই অগত্যা ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও ভেতরে ডুকতে হলো তাকে। রুপসী বানু বলেন,

‘বুঝলি ময়নার মা। মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে তার দাম থাকে না। পেটের ছেলেটাও আপন নয় রে। তাইতো নাতনি টারে বিয়া দিছে আমার না জানাইয়া।’

ময়নার মা চুপ করে রইলো। তিনি আবারো বলেন,

-‘ দেখ, দেখ, ছেলে আর ছেলের বউ আজকে দুনিয়াডা রান্না করছে মাইয়ার শশুড় বাড়ীর লোকদের খাওয়াইতে। আর আপন মা রে প্রতিদিন লবণ দিয়া ভাত দিছে। কারে কমু এসব দুঃখ?’

রুপসী বানুর কথা মিথ্যা নয়। সে গত দুইদিন লবন আর পানি দিয়ে ভাত কচলে খেয়েছেন। পেটে গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সেজন্যই এমন খাবার খেয়েছেন। এটা তার স্বাস্থ্যের জন্যই ছিলো। সে নিজেই খেয়েছিলো। সুস্থ থাকলে তো আলবাত তাকে মাছ, মাংস, ডিম এসব দিতেন।

বসার ঘরে বসে সার্কাজমের মতো এসব দেখছে শ্যামলের পরিবার। তাদের মধ্যে হালকা-পাতলা খারাপ লাগা দেখা দিয়েছে। ধারনা করছেন, সত্যি সত্যি বোধহয় রুপসী বানুর সাথে এমন করা হয়। তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। নির্মলা বেগম উঠে রিপার মায়ের হাত ধরে বলেন,

‘বেয়াইন, এসব ঠিক নয়। উনার বয়স হয়েছে বলে কি এসব করবেন? উনি আপনার শাশুড়ি। আজ যদি আপনার মেয়ের সাথেও তার ছেলের বউ এমন করে তাহলে আপনার কেমন লাগতো? এমন কিছু মোটেও আশা করি নি।’

রিপার মায়ের দিকে তাকালে যে কেউ বলবে তিনি আকাশ থেকে পড়েছেন। মুখ ফুটে কিছু বলবার পূর্বেই রুপসী বানু বলেন,

‘ আপনে আমার জন্য কষ্ট পাইয়েন না। এসব অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার তো আপনারে নিয়ে টেনশন হইতেছে। নাতনি টা না জানি আপনার লগেও এমন না করে। একটু সাবধানে থাইকেন।’

নির্মলা বেগম চুপসে গেলেন। তার মনে নানারকম শঙ্কা দেখা দিতে লাগলো। তিনি এক পলক রিপার দিকে চাইলেন। মনকে ঝাড়া দিয়ে বলেন, ছিঃ এসব কি ভাবছেন? রিপা এমন কিছুতেই করবে না। রুবেল মায়ের পাশে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘মা এসব কি বলছো? রিপা তোমার নাতিন।’ রুপসী বানু বলে, ‘ ঠিকই কইছি। আমার ফালাইয়া যে বিয়া দিছোস তখন মনে ছিলো না, হে আমার নাতিন।’

রুবেলের ইচ্ছা করলো নিজের গালে নিজেই চড় দিতে। তার জীবনের জন্য আক্কল হয়ে গেছে। সে জীবনেও আর তার মা কে রেখে ঘরের সামান্য মিলাদ ও করবে না। নিজেদের দুর্নাম পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর যে দেখা দিবে মায়ের কানের চিরুনি পাওয়া যাচ্ছে না, সুপারি চেঁচোনি পাওয়া যাচ্ছে না, পানদানি পাওয়া যাচ্ছে না এমনকি মায়ের বাথরুমের ছেড়া জুতা টা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না তখন কি করবে? রুবেল বেশ চিন্তিত হয়ে উনাদের সামনে বসলেন।

#চলবে…
®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here