সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:৭+৮

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৭.

রিপার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই দেখবে মেয়েটা তার উপর উপহাস করছে। কি দরকার যেচে যেচে লজ্জা পাওয়ার? সে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
রিপা কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না। তার মুখশ্রী দেখে বুঝবার জো নেই সে কী ভাবছে? শ্যামলের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘ আপনার লক্ষ্য কি?’

শ্যামল ভ্রু কুচকালো। সে বুঝতে পারছে না রিপা কি বলছে? তার আবার কিসের লক্ষ্য? মেয়েটা বোধ হয় আধা পাগল-টাগল হয়ে গিয়েছে তাই হাবিজাবি বলছে। সে জোর গলায় বললো,

‘আমার কোনো লক্ষ্য-ফক্ষ্য নেই। আপনাকে সত্যি ভালো লাগে আমার সেটাই বলেছি। ‘

‘আরে দূর, আমি বলতে চাইছি, কোন উদ্দেশ্যে আমাকে সব বলেছেন। অর্থাৎ আমাকে দিয়ে কি করাতে চান?’

শ্যামল কথাটির অর্থ ধরে ফেলতেই অকপটে জবাব দিলো,

‘ আপনার আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি প্রমাণ ছাড়া পীরের কিছুই করতে পারবো না।’

‘কেমন সাহায্য?’

শ্যামল সিরিয়াস ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলা শুরু করলো,

‘ প্রথমত আমাদের খুবই সাবধান থাকতে হবে। নাহলে গতবারের মতো মা আমাকে অবিশ্বাস করে অন্য কোথাও শিফ্ট করবে। ওহ,আপনি তো জানেন না। আমি শর্টকাট বলছি, গতবার ভাবীর মরার পরেই আমি অনেক ঝামেলা করেছিলাম, পুলিশ নিয়ে এসেছিলাম। তখন উনারা কোনো প্রমান না পেয়ে উল্টো আমার থেকে জরিমানা নিয়েছিলেন। মা রাগ করে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কয়েকমাস আমি ব্যাচেলর হোস্টেলে ছিলাম। শেষে, পীরের ভক্ত হওয়ার নাটক করে মায়ের বিশ্বাস অর্জন করেছি। এবং মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো আচরণ করছি। ‘

রিপা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

‘ওরে বাবারে, এত ক্লাইম্যাক্স। ‘

‘ আরো কত কি যে দেখেছি। আচ্ছা বাদ দেন। শুনেন, আমার কাছে খুবই দূরদান্ত প্ল্যান আছে। প্ল্যান হলো……’

রিপা মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে। শ্যামলের প্রতি কথায় সায় দিচ্ছে, যেনো সে খুব বুঝেছে। শ্যামলও তালে তালে তাকে বুঝাতে লাগলো।

-রাতের শেষ প্রহর চলছে। চারপাশে থমথমে নিরবতা। কোথাও কোনো সাড়া নেই। সবাই বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। শুধু ঘুম নেই দুজোড়া চোখে। একে অপরের সাথে বিস্তৃত আলোচনা নিয়ে বসেছে। যেনো আজ রাতেই সবকিছু জেনে নিবে। কথাবার্তা শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ রিপার মনে পড়লো সে ইমনের থেকে শুনেছে, নুহা প্রতিরাতে শ্যামলের ঘরে যায়। মনটা ভীষণ তেতে উঠলো। রাগি রাগি ভাবে শ্যামলের বাহুতে খোঁচালো। শ্যামল তাকাতেই
রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

‘ ওই নার্স প্রতিরাতে আপনার ঘরে যেতো কেনো? অস্বীকার করার ভুলেও চেষ্টা করবেন না।’

মেয়েরা বড়ই অদ্ভুত। কারণবিহীন হুটহাট তাদের মুড বদলে যায়। এদের বুঝা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে। কথাটা ভেবেই চোখ মেলে তাকালো শ্যামল। অস্বীকার করতেই নিচ্ছিলো, কিন্তু রিপার শাসানো রুপ দেখে থেমে গেলো। শ্যামল দুষ্টু হেসে বলে,

‘কেনো আবার বুঝো না?’

কথাটা শেষ করে পলক ফেলবার সময় পেলো না শ্যামল। রিপা ঝট করে ওকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। গলায় এক হাত দিয়ে চেপে বললো,

‘ ঢং করছেন?ঢং? মজার ছলে বললেও, আমার কেনো মনে হচ্ছে এমন কিছুই হয়েছে।’

শ্যামল হাত সরিয়ে কাশতে লাগলো। কাশতে কাশতে থেমে থেমে বললো,

‘ আ আরেহ! ও আসতো, আ আমি কি যেতাম নাকি? আমি তো বারণ করতাম। কিন্তু সে আমাকে ইম্প্রেস করতে আসতো। ‘

‘তো আপনিও নাচতে নাচতে গলায় ঝুলে যেতেন?’

‘না,না। বকাঝকা করে বের করে দিতাম। এরপরেও বেহায়ার মতো প্রতিদিন আসতো। কসম, আমাদের ভেতর তেমন কোনো রিলেশন নেই। বিলিভ মি।’

‘ আমার দাদী বলে, পুরুষ আর বিড়াল এ দুই জিনিসকে বিশ্বাস না করতে, কারন এরা যেখানে সেখানে মুখ দেয়। ‘

রিপার ভ্রু নাচানো কথায় বেকায়দায় পড়ে গেলো শ্যামল। এখন কীভাবে বিশ্বাস করাবে সে সত্যিই নুহার সাথে কিছু করে নি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকলো তাকে সাহায্য করতে। এজন্যই চালাক বউ বিয়ে করতে নেই। বউ হবে সিদাসাদা গাঁধার মতো। তাকে যেভাবে বলবে সেভাবেই চলবে। তাহলে সংসারে অশান্তি, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব দেখা দিবে না। শ্যামল বড্ড ভুল করেছে। তার উচিত ছিলো, সাদাসুন্দর গোলগাল আর কান্ডজ্ঞানবিহীন মেয়েকে বিয়ে করা। তাহলে তার সংসার স্বর্গ হতো। শ্যামল নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো মুখ বানিয়ে রিপার পানে চেয়ে রইলো। রিপা তার কাছ থেকে সরতে সরতে বললো,

‘ সময় শেষ হয় নি,এখনো অনেক সময় রয়েছে। কখনো যদি কানে আসে আপনাদের মধ্যে কিছু ছিলো, মনে রাখবেন সেদিন আপনার জীবনের শেষ দিন করে ছাড়বো। সাবধান করে দিলাম! ভালো হয়ে যান।’

শ্যামল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার মনে হচ্ছে, এতক্ষণ তার মাথার উপর বস্তা,না না বস্তার পুরো গোডাউন ছিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো। আপাতত সবকিছু ঠিক হয়েছে। নিজেকে ধাতস্ত করে শাঁসালো নুহা থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে। শুধু দূরে নয় মহাদূরে। নাহলে কখন কোন কেলেঙ্কারি ঘটবে কে জানে? মেয়েরা হলো এটম বোম্ব। এরা তুচ্ছ কারণেও ফেটে যায়। পুরুষদের খুবই সাবধান থাকতে হবে নাহলে পলকেই ছাড়খার হয়ে যাবে। ভেবেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো শ্যামল।


চৈত্রমাস। চারপাশ রোদের উত্তাপে গরম হয়ে আছে। ঘর থেকে পা ফেলতেই মনে হচ্ছে চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। এ অতিরিক্ত গরমের কারণ কি? চারদিকে গাছপালা কেটে ফেলায় এত গরম পড়ছে নাকি জ্বালানি হতে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে? শ্যামল ভ্রু কুচকে ভাবছে। তার ভাবনা-চিন্তার পরিসর বিস্তৃত। তার সবকিছুতে যুক্তি লাগে। যুক্তি না থাকলে সে ওই জিনিস নিয়ে ভাববে না। কাঠফাটা গরমের মধ্যে মাজারের বাহিরে বসে থাকতে বড্ড বিরক্ত হচ্ছে শ্যামল। সকাল না হতেই নির্মলা বেগম তাদের সবাইকে নিয়ে পীরের দরবারে হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো রিপার জন্য পীরের আশীর্বাদ। এই পীর সাহেবের আগে কিছুই ছিলো না, অথচ এখন কত কি। তার সেবায় পাঁচ ছয়জন নিয়োজিত। তারউপর সে বিশাল এক মাজার বানিয়েছে। রাস্তা দিয়ে যে পথচারী যায়, সে এসে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে কতগুলো চকচকে নোট দানবাক্সে ঢুকিয়ে যায়। শ্যামল ভীষণ চিন্তিত, এ লোকের তো বিরাট ধান্ধা হয়েছে। খুবই জোরালো প্রমান না পেলে এসব অন্ধভক্ত তাড়ানো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

রিপা ইমনের দ্বিতীয় স্ত্রী সেজে পীরের এক কক্ষে বসে আছে। নিখুঁত ভাবে সে অভিনয় করে যাচ্ছে। পীরের কক্ষের দরজা লাগানো। নির্মলা বেগম সহ বাকিরা বাহিরে দাড়ানো। পীর সাহেব এখন ধ্যান করছেন। উনি ইমনের প্রথম স্ত্রীকে আহ্বান করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আসবে। হঠাৎ করে রুমের বাতি নিভে গেলো, এক দমকা বাতাস এসে গা ছুঁলো। রিপার শরীর চমচম করে উঠলো। পীর হুংকার দিয়ে ইমনের প্রথম স্ত্রীর রুপ ধারন করে নিলেন। তিনি মোটা স্বরে বললেন, ‘ কেমন আছো রিপা?’

রিপা বললো, ‘ ভ্ ভালো আছি।’

পীর নাটকীয় ভঙ্গিমায় রিপার সাথে কথা বলতে লাগলো। রিপাও দক্ষতার সহিত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে এমন ভান ধরলো। পাঁচ মিনিট না যেতেই পীর সাহেব আবারো শরীর ঝাঁকিয়ে নিজের অস্তিত্বে ফিরে এলেন। বাহির থেকে এক রক্ষী দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে রিপার পরিবার ডুকে পড়লো। তারা তাকে একে একে এ প্রশ্ন, সে প্রশ্ন করতে লাগলেন। রিপা উচ্ছ্বাসের সহিত বললো,

‘মা,মা আমি আপুর সাথে কথা বলেছি।’

নির্মলা বেগম পীরের দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

‘এ সবই উনার কান্ড। আমি তোকে সকালে বলেছিলাম না উনার কত ক্ষমতা। এবার নিজের চোখে দেখলি তো।’

‘হ্যা, মা। ‘

নির্মলা বেগম ফিসফিস করে বললেন,

‘এবার হাতের ওই বালাজোড়া খুলে দে। সাহেব খুবই খুশি হবেন। উনি না করবেন,তুই জোর করে দিস।’

পীরের কানে স্পষ্ট কথাটা ডুকেছে। রিপা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কিন্তু মা, আপু তো বলেছে আমার শরীরে সবসময় এইসব অলংকার রাখতে। তিনি এগুলোতে ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন, এখন নাকি কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমি কি দিয়ে দিবো?’

‘সত্যি বলছিস? না, না, বাপু তাহলে দরকার নেই।’

‘হ্যা,সত্যি। সাথে এটাও বলেছেন উনার অলংকার গুলো যেনো সাহেব-বাবা থেকে নিয়ে যাই। ওগুলা নাকি তিনি আমার জন্য রেখেছেন। আমি কতবার না না বলেছিলাম, কিন্তু উনি কঠিন আদেশের সুরে বলেছেন আমি যদি এসব না নেই তাহলে নাকি কখনো ইমন সুস্থ হবে না। ওরা নাকি উনার পিছন ছাড়বেন না।এখন আপনি বলেন আমি কি করবো?’

সাহেব-বাবা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। তার মুখশ্রী দেখলে যে কেউ বলবে সে তার জীবনে এ প্রথম এতটা আশ্চর্য হয়েছে। এবং এমন আশ্চর্য সে আর কোনোদিন হবে না। সে তৎক্ষণাৎ ঘাড় হেলিয়ে বললো,

‘মিথ্যা বলছে এই মেয়ে। আমি এসব কিছুই বলি নি।’

কথাটা বলেই জিভ কাটলো সে। মুখ ফসকে কি বলে ফেললো। তারা তাকাতেই সে কথাটা ঘুরিয়ে বললো,

‘আমার কথার অর্থ হলো প্রিতী এসব কথা কেনো বলবে? এত দিনেও তো কখনো বলে নি।’

রিপা বলে,

‘ এতদিন বলে নি, আজ বলেছে। আপনি না দিলে আমার কি? ইমন সুস্থ হবে না এটুকুই তো?
আচ্ছা এটা বলেন তো,আপনি কীভাবে জানলেন মিথ্যা? তখন তো আপনার মধ্যে আপু ছিলেন। তাহলে উনি কি বলেছেন সেসব তো আমার জানার কথা। তাই না?’

পীর থতমত খেয়ে গেলো। কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। নির্মলা বেগম খুশি খুশি মুখে বলে,

‘ বলেছে বলেছে পীরসাহেব। বউটা ছিলোই এমন উদার। আপনি দিয়ে দেন। ওসব সে পড়ে দিয়েছে। এগুলো পরলে আমার ছেলের মঙ্গল হবে, সে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে।’

সাহেব-বাবা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন রিপার দিকে। তার দৃষ্টি দেখে রিপার মনে হলো, লোকটা তাকে একা পেলে না চিবিয়ে গিলে খাবে। রিপা না দেখার মতো নির্মলা বেগমের সাথে বানিয়ে বানিয়ে এটা সেটা বলতে লাগলো। পীর যা বলেছিলো তার একটা শব্দ ও বললো না। তা দেখে পীর আরো ক্ষুব্ধ হলো। খুবই কষ্টের সহিত তিনি রিপার হাতে জিনিসগুলো এগিয়ে দিলেন। রিপা নিতে যেয়ে দেখলো, তিনি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। রিপাও জোর করে টেনে নিয়ে নিলো। পীর সাহেব কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাথে সাথে রিপা চোখ টিপে তার দিকে হাসি ছুড়ে দিলো।

#চলবে….

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৮.

সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত পৃথিবী। জ্বলসে যাচ্ছে গাছগাছালির পাতালতা। পিচ ডালা রাস্তাঘাট আগুনের ন্যায় গরম। পা ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। দূরদূরান্তে বাতাসের কোনো লেশ দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে গরমে আধসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে শ্যামল। সে ভীষণ হতাশ প্রকৃতির উপর। এত গরম কেনো? তার জন্য একটু শীতল হলে কি হতো? এদিকে বার বার তৃষ্ণা পাচ্ছে। এতবার অন্যের কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে খাওয়া টা তার নিকট বেমানান লাগছে। সে ঠিক করেছে আরেকবার পিপাসা পেলে বোতল টা আর দিবে না, সোজা গলায় ঝুলিয়ে নিবে। তাহলে আর খুঁজতে হবে না, ফটাফট খেয়ে নিবে। সাহেব-বাবার বাড়ী থেকে বেশ খানেক পথ হাটতে হয়। ওইটুকু কাঁচাপথে গাড়ী চলে না। সেজন্য সবাই হেটে আসছে। শ্যামলের ধারনা হচ্ছে বাকিরা হাটছে কম, গল্পগুজব করে হেলেদুলে পড়ছে বেশি। মেয়ে মানুষ মানেই কথাবার্তা। সে হিসেব করেছে এটুকু পথে কম না হলে ১০০০ টা কথা বলেছে। শ্যামল ভেবে পায় না এত কথা কই থেকে আসে? গরমে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে ওদিকে মেয়েরা খুশি খুশি হয়ে গল্প করছে। তাদের দেখলে মনে হবে না আদৌ কোনো গরম পড়ছে কি না? একাধিক মেয়ে মানুষ একসাথে আর সেখানে কথা হবে না এটা দুঃস্বপ্ন বৈ কিছুই নয়। শ্যামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের তাড়া দিয়ে হাটতে লাগলো।

বাড়ীতে আসার পর ইমনের বউয়ের গয়নাগাটি দেখে হতবাক হয়ে গেলো শ্যামল। বারবার হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো সে। এসব স্বপ্ন-টপ্ন নয় তো? তার আবার দিনে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রিপাকে প্রশ্ন করে,

‘ এসব কই পেলে?’

রিপা মুচকি হাসলো। কিছু বললো না। সে পণ করে নিয়েছে কিছু বলবে না। পীরের দরবার থেকে বেরোনার পর সে কতবার চেষ্টা করলো এই সংবাদ শ্যামলকে শুনাতে। কিন্তু শ্যামল শুনলো কই সে তো রেগে ছিলো। রিপাকে পীরের ভক্তের মতো কান্ড করতে দেখেই সে ঘুরে গিয়েছিলো। বারবার তাকে ইশারায় বুঝালো যে এসব সত্য নয়। রিপা বুঝেও না বুঝার মতো রইলো। পরে শেষে সে রেগে বলতেই রিপা তাকে উল্টো ঝারি দিয়ে দেয়। তখন থেকেই শ্যামলের রাগ রিপার উপর। আবার পুরো রাস্তায় পীরের গুণগান গাইতে গাইতে এসেছিলো রিপা। যাতে সে পীর আর তার শাশুড়ির বিশ্বস্ত হতে পারে। কিন্তু শ্যামল তার এমন বিহেভ দেখে উল্টো ধারনা করে নিয়েছিলো। সে থেকেই দুজনের ভেতর মনমালিন্য চলছে।

‘আশ্চর্য! এমন সং হয়ে আছো কেনো? বলো তো এসব কই পেলেন? এগুলো আমার ভাবীর।’

‘প্রথমে ঠিক করেন, আমাকে কি বলবেন? একবার আপনি বলছেন আরেকবার তুমি বলছেন।’

শ্যামল থতমত খেলো। আসলে সে কনফিউজড।কোনটা বলবে ঠিক করে পায় না। তাড়াহুড়োয় তুমি চলে আসে আবার যখন ঠিকঠাক কথা বলে তখন আপনি বলে। শ্যামল স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বললো,

‘আপনি বলুন কি বলবো?’

‘তুমি করেই বলেন। আপনে আমার অনেক বড়। আপনি শুনতে কেমন অড লাগে।’

‘তুমি কি বয়সের গ্যাপ বুঝাতে চাইছো? ‘

‘আশ্চর্য আমি সেটা কেনো বুঝাতে যাবো? আমি শুধু বলেছি, আমাকে ‘আপনি’ ডাকলে অস্বস্তি লাগে।’

শ্যামল কথা বললো না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রিপা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কথার এমন অর্থ কেউ ধারনা করবে এটা সে নিজেই ভাবে নি। তার মনে এমন কিছুই ছিলো না, শুধুমাত্র কথার স্বার্থে বলেছে। লোকটার এমন অভিমানী রুপ মেনে নিতে পারলো না সে। নিজের মনের মধ্যে খচখচ শুরু হয়ে গেলো। মন বলছে, তার এমন বলা উচিত হয় নি। কিন্তু সে তো এমন কোনো ধারনা থেকে বলে নি। রিপা এক পলক বাহিরে উঁকি দিয়ে দরজা টা ভিড়িয়ে দিলো। শ্যামলের পাশে বসে নরম কন্ঠে বললো,

‘ আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন। এখানে রাগ করার কোনো বিষয় ই নেই। স্বামীরা তো স্ত্রীদের থেকে বয়সে বড়ই হয়। আপনি, আমার আম্মু আর আব্বু কে দেখেন। উনাদের বয়স কত পার্থক্য। আশেপাশে দেখেন সবার একই জিনিস দেখতে পাবেন। উল্টো আমি এমন বললে, লোকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কারণ এটা স্বাভাবিক, সচরাচর বিষয়। সত্যি আমি এমন কিছুই মিন করি নি।’

রিপা করুণ মুখে তাকিয়ে রইলো। লোকটার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না। কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ধীর কন্ঠে বলে,

‘ আচ্ছা, সরি। আর এমন বলবো না।’

শ্যামলের মন গললো। সে রিপার হাত দুটো নামিয়ে বললো,

‘ সরি বলতে হবে না, আমি রাগ করি নি।’

রিপা একটুখানি হাসলো। স্বামীর সাথে সংসার করা খুবই সহজ। কিন্তু মানুষ তা সহজ হিসেবে নেয় না, তারা জটিল থেকে জটিল করে ফেলে। তার মা আর বাবার যখন কোনো কারণে মনমালিন্য হয় তখন তারা একে অপরের সাথে দীর্ঘসময় কথা বলে না। কেউ বিষয় টাকে মিটিয়ে নেয় না । তারা তিন বোন, কেউ মা আবার কেউ বাবাকে বলে কথা বলে নিতে। তখন তাদের হাজারো অভিযোগ বেরিয়ে আসে। কেউই কারো নিকট ছোটো হতে চায় না। তার মা-বাবার ধারনা সরি বলা মানেই ছোট হওয়া, ইজ্জত চলে যাওয়া, ইগো হার্ট হওয়া। সেজন্যই দীর্ঘসময় তাদের মনমালিন্য এবং সংসারে অশান্তি চলে। রিপা এসব ভাবে না, অপরপক্ষ ক্ষমা চাইবে না বলে কি সে ও চাইবে না। তাহলে তো কারোই চাওয়া হবে না উল্টো সম্পর্কের দূরত্ব বাড়বে। আজ সে আগ বাড়িয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে কাল দেখা যাবে তার স্বামী মিটিয়ে নিবে। একেই তো বলে সংসার। রিপার ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে শ্যামলের বারংবার করা প্রশ্নে। শ্যামল উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করছে গয়নাগাটির ব্যাপারে। রিপা খানিক হেসে, সেখানের ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করলো। সব শুনে শ্যামল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

‘ও মাই গড! সিরিয়াসলি রুপু, তুমি এমন কান্ড করেছো? তুমি দেখি আমার ধারনার একধাপ আগে।’

রুপু ডাক শুনতেই শরীর শীতল হয়ে উঠলো রিপার। সে হাসি থামিয়ে দেয়। এই ডাক টা খুবই পুরানো। দাদাজান ছাড়া কেউ তাকে এ নামে ডাকে নি কখনো। আজ শ্যামলের হঠাৎ বলায় তার ভেতর কিছুটা নড়েবড়ে উঠলো। শ্যামল ভ্রু কুচকে তাকে ইশারায় প্রশ্ন করলো কি হয়েছে? রিপা মাথা নাড়িয়ে বললো কিছু না। শ্যামল পাত্তা না দিয়ে হাসতে লাগলো।

নির্মলা বেগম আয়নার সামনে দাড়িয়ে তৈরী হচ্ছেন। মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি বেজায় খুশি। খুশির হবার কথা নয় কি? আজ এত বড় এক কান্ড ঘটেছে। মনে মনে রিপার উপর বেশ গর্ভ করলেন। যাক তিনি ভুল মেয়ে আনেন নি। গত এক বছরে এতটা খুশি হতে তাকে আর দেখা যায় নি। তিনি ঠিক করেছেন, ভালোয় ভালোয় ছেলেটা সুস্থ হয়ে গেলে রিপার মা -বাবার কাছে যেয়ে সব টা বলে ঠিক করে নিবেন। আজ গেলে এসব কিছু বলবেন না। শ্যামলের বউ বলেই পরিচয় করাবেন। রিপাকে নিয়েও টেনশন নেই। মেয়েটা সব মেনে নিয়েছে বরংচ রিপাকে আরো খুশি দেখাচ্ছে। শ্যামলের প্রতি রিপার রাগ দেখেছেন, তার ধারনা রিপার বাবা চাইলেও রিপা শ্যামলকে মানবে না। রিপা আর ইমনের সব ঝামেলা মিটে গেলে, নুহা আর শ্যামলের বিয়ে টা দিয়ে দিবেন। এরপর তিনি আদায়মুক্ত হবেন। মা-বাবার ঘাড়ে সবচেয়ে বড় বোঝা থাকে ছেলেমেয়েদের বিয়ে। এ দিকটা সেরে ফেলতে পারলেই তারা আদায় পেয়ে যান। নির্মলা বেগম তৈরী হয়ে ঘড়ি দেখলেন। এখনো ২ টা বাজে নি। তাদের ২ টা পূর্বে বেয়াইদের বাড়ী পৌঁছাতে হবে। রিপার বাবার বাড়ীতে আজকে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। সকালে রিপা তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার পর তারা জেদ করেছেন আজই মেয়ে কে নিয়ে যেতে। আদরের মেয়ে কখনো একা কোথাও যেতে দেয় নি, আজ এতটা দিন তাদের থেকে দূরে মন তো কাঁদবেই। তাছাড়া রিপার ওইটুকু মুখ দেখে তিনিও বারণ করেন নি। ঠিক করে নিলেন দুপুরের খাবার সেখানে খাবেন। এরপর বিকালের দিকে তারা চলে আসবেন এবং রিপাকে কিছুদিনের জন্য রেখে আসবেন।

যথাসময়ে রুবেল সাহেবের বাড়ীতে এসে পৌঁছায় রিপার শশুড়বাড়ীর লোকজন। সবাই বেশ সেজেগুজে এসেছে। নুহা, আজ লাল রং এর জামা পরেছে। তাকে দেখতে একদম নায়িকা নায়িকা লাগছে। সে বেশ ভাব নিয়ে শ্যামলের পাশে দাড়িয়ে আছে। রিপা ভারী শাড়ী পরেছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ীতে প্রথমবার আসছে, দামী শাড়ী তো পরতেই হবে। নুহাকে শ্যামলের এত কাছে দেখে, সহ্য করতে পারছে না সে। একটু পর পর চোখ কটমট করে শ্যামলের দিকে তাকায়, শ্যামল তখন অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে রিপা খুব জোরে জোরে চিমটি কাটে তাকে। শ্যামল দাত মুখ খিঁচে নিজেকে সংযত করে। সে পড়েছে বেকায়দায়। কোনোরকম শব্দ করলেই বাজবে ভেজাল। নিজের রাগ টা কলিং বেলের উপর দেখাতে লাগলো সে। দ্রুত দরজা না খুললে তাকে আর পাওয়া যাবে না। দু সেকেন্ডের মাথায় চেঁচাতে চেঁচাতে দরজা খুলে দিলেন বুড়ি মহিলা। সম্পর্কে তিনি রিপার দাদী।

‘ কি গো বাপুরে। কান ফাটিয়ে দিবে নাকি? দরজা খোলার জন্য সময় তো লাগে। এতবার যে বাজাইতেছো এটা নষ্ট হইলে আবার কিনে দিবা নি?’

শ্যামল লজ্জতি ভঙ্গিতে বললো,

‘দুঃখিত। ‘

রিপা হা করে দাদীর দিকে তাকিয়ে আছে। দাদী কখন আসলো? দাদী তো ফুফির বাড়ীতে ছিলেন। সে বিরবির করে বললো, ‘ইয়া আল্লাহ মাবুদ, তুমি বাঁচাইয়ো।’ রিপা দ্রুত মাথা নিচু করে দাদীর পা ধরে সালাম করে বললো,

‘ আসসালামু আলাইকুম, দাদী। ভালো আছেন নি? ‘

রুপসী বানু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছি ভালো আছি ভালো আছি বললেন। শ্যামল ও রিপার দেখাদেখি রুপসী বানুর পায়ের দিকে ঝুঁকলো সালাম দিতে। সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে সরে গেলেন তিনি । শ্যামল হকচকিয়ে তাকালো। কি হলো বুঝতে পারছে না সে।

‘নাউজুবিল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! এ কি কান্ড। ও নিপা,ও শিপা, তাড়াতাড়ি জমজম কূপের পানির বোতল টা নিয়া আয়। ‘

শ্যামল অবাক হয়ে বললো,

‘কি হয়েছে? ‘ তার ধারনা উনার পায়ে কিছু হয়েছে। সে রুপসী বানুর পা দেখতে যেতেই তিনি চেঁচিয়ে বললেন,

‘ একদম কাছে আইবি না। নাহলে মাথা ফাটিয়ে দিবো। পুরুষ আর বিড়াল এই দুই জাতকে বিশ্বাস করতে নেই, এরা যেখানে সেখানে মুখ দেয়।’

রিপা চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন কিছু ঘটবে তার আগাম ধারনা ছিলো। তার দাদী সূচীবায়ু টাইপের! কোনো পুরুষ মানুষকে তার আশেপাশে দেখতে পারেন না। এমনকি তার ফুফা এবং ফুফাতো ভাই পর্যন্ত না। শ্যামল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে নির্বাক। বুড়ো বেটি তাকে এমন কিছু বলবে এর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

চলবে!
®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here