‘যেই মেয়ে বিয়ের সাত বছর পরেও শশুর বাড়িতে পা রাখেনি সেই মেয়ের চরিত্র কেমন তা আমার জানা আছে।’
‘একদম তাই। তুই কি রে অনু, বিয়ের সাত বছর হয়ে গেল একটা বাচ্চাও তো জন্ম দিতে পারলি না।’
আরেকজন বলে উঠল,
‘তোর অন্য কোথাও আবার কিছুটিছু আছে নাকি রে?’
মানুষজনের এমন কথা শুনে অনু মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেল।চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার। তার জন্য তার বাবা মাকে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হতে হচ্ছে। আজ যদি সে তার শশুর বাড়িতে থাকতো তাকে আর তার বাবা মাকে হয়তো এতো অপমানিত হতে হতো না। কিন্তু কি করে যাবে সে ওই বাড়িতে, যেই বাড়িতে অনুকে কেউ সহ্যই করতে পারে না। যেখানে প্রতি মুহূর্তে তাকে অত্যাচারিত হতে হবে। যেখানে তার স্বামী তাকে তার আশে পাশেও দেখতে চায় না। কোন স্বামীর সাথে সংসার করবে সে, যেই স্বামী অন্য মেয়ে ভালোবাসে।
বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে অনু। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে তার মা ঘরে ঢুকে পড়লেন। অগ্নিদৃষ্টি অনুর দিকে নিক্ষেপ করে বললেন,
‘তোর জন্য আর কতো অপমান সহ্য করতে হবে বলতে পারিস অনু। আমি আর পারছি না রে। সাত বছর হয়ে গেছে আর কতোদিন অনু আর কতোদিন।’
অনু কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘মা আমি ওই বাড়িতে কিছুতেই যাব না। আমি একজন ডক্টর, নিজের খেয়াল রাখতে পারি। আর আমি ওকে কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স দিতে দেব।’
‘এই কাজ করলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।’
এই কথা বলে আমেনা বেগম ঘর থেকে চলে গেলেন। অনু ছলছল চোখে তার মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। অনু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। আজ তাদের বাড়িতে তার ফুফাতো বোনের ছেলের সুন্নাতে খতনা ছিল। অনুর ফুফাতো বোন সুইজারল্যন্ডে থাকে। অনুর ফুফাতো বোন মানে আরশির শাশুড়ির অনেক ইচ্ছা ছিল তার নাতির মুসলমানি তার নিজের দেশে হবে। যার জন্যই তারা এসেছে অনুদের বাড়িতে।
অনুর ভালো নাম মাহিয়া জান্নাত অনু। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল দেশের টপ বিজনেস ম্যান আতীব চৌধুরির একমাত্র ছেলে রাফাত চৌধুরির সাথে। তখন মাত্র কয়েকদিনের জন্য রাফাত দেশে এসেছিল আর তার মধ্যেই বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় অনু আর রাফাত। রাফাত অনুকে কখনো বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু নিজের বাবার অপকর্মের ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছিল। অনু আর রাফাতের বিয়েটা ধুমধাম করে হয়নি। অনুর বাড়িতে রেজিস্টার পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল চৌধুরি ফ্যামিলি যেখানে রাফাতের সাইন করা ছিল। রাফাত এই বিয়ে কিছুতেই মানে নিতে পারেনি যার কারনে সে আবার লন্ডনে ফিরে যায়।
নিজের ঘরের সবকিছু গোছাচ্ছিল অনু। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে অনুর তিন বান্ধবী তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়ল। অনু কিছু বলবে তার আগেই ইরা অনুর হাত চেপে ধরে বলল,
‘অনু এইসব কি শুনছি? তোর বিয়ে হয়েছে তাও আবার সাত বছর আগে?’
আরেকজন জিজ্ঞাসা করল,
‘তোর বয়স তো এখন পচিশ বছর তাহলে তোর বিয়ে হয়েছে আঠারো বছর বয়সে?তুই তো আমাদের এই বিষয়ে কিছুই বলিসনি রে।’
অনুর তিন বান্ধবী অনুর দিকে তাকিয়ে অনুর উত্তরের অপেক্ষা করছে। অনু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে তার বন্ধবীদের জিজ্ঞাসু চেহারার দিকে। অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানা গোছাতে শুরু করল। অনুর আরেক বান্ধবী মিমি অনুকে ঝাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি রে কিছু বলছিস না কেন?আমরা কি তোর এতই পর যে আমাদের বলা যাবে না?’
অনু এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। ডুকড়ে কেঁদে দিল সে। নিজের হৃদয়ের সব কষ্ট যেন এখন এই কান্নার মাধ্যমে বের হয়ে আসছে। অনুর এই অবস্থা দেখে তার বান্ধবীরা চুপ হয়ে গেল। অনু কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। মিমি, ইরা আর লারা অনুর পাশে বসে পড়ল।লারা অনুর কাধে হাত রেখে বলল,
‘অনু কাঁদিস না প্লিজ। কি হয়েছে আমাদের বল।দেখি আমরা কিছু করতে পারি কি না।’
‘কি বলবো তোদের? যা শুনেছিস তাই সত্যি।’
‘কি করে বিয়েটা হলো সেইটা তো বল।’
‘সব পরে বলবো তোদের। এখন না প্লিজ।’
সবাই চুপ হয়ে গেল। অনু চোখ মুছে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ইরা, মিমি, লারা আর অনু এরা সবাই ডিএমসি র ডক্টর। মাত্র দুই বছর আগে অনু ডক্টর পাস করেছে। অনুর যখন আট বছর তখন তার মামা তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছিল। সেখানেই তার মামা তার পড়াশোনার ব্যাবস্থা করে দেন। অনু টেন পাস করার পরপরই তার পড়াশোনার খরচ তার মামাকে বেশি একটা বহন করতে হয়নি। অনুর পরিবারের অবস্থা বেশি একটা ভালো নয় যার কারনে তাদের পক্ষে অনুর পড়াশোনার খরচ ওঠানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে তাদের পরিবারের অবস্থা খুব সচ্ছল।
__________
রাতে অনু আর তার বান্ধবীরা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ অনুর ফুফাতো বোনের ননদ এসে হুমরী খেয়ে পড়ল ছাদের উপর। অনুর ফুফাতো বোনের ননদ রিয়া অনুকে বেশি একটা পছন্দ করে না। ইভেন তার থেকে বেশি স্মার্ট কোনো মেয়েকেই সে পছন্দ করে না। অনু দৌড়ে গিয়ে রিয়াকে উঠতে সাহায্য করল। রিয়া উঠে দাড়াতেই অনুর হাত থেকে নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। অনু একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
‘রিয়া সারাদিন এভাবে ফোনের মধ্যে নিজের চোখ কেন গুজে রাখো বলো তো। দেখলে তো আমার সামনে কীভাবে পড়ে গেলে তুমি।’
‘লিসেন অনু, আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি বুঝেছো। তাই তোমার সাথে কথা বলে আমি আমার মুড নষ্ট করতে চাই না।’
‘মি টু।’
অনু কথাটা বলেই আবার বসে পড়ল তাদের সাথে। রিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। কিন্তু অনুর এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সে তো তার ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।
প্রায় আধাঘন্টা পর আচমকা রিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু এই চিৎকার ভয়ের নয়, উল্লাসের। অনু আর তার ফ্রেন্ডরা রিয়ার দিকে ঘুরে তাকালো। রিয়া আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। মিমি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এই তুমি কি পাগল নাকি। এভাবে লাফাচ্ছো কেন? তোমার স্কার্টটা এমনিতেই অবেক ছোট যার কারনে তোমার পা সম্পুর্ন দেখা যাচ্ছে। লাফালাফি করে আরো দেখানোর কি দরকার?’
রিয়া ক্রুদ্ধ চোখে মিমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মিমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্য দিকে নিজের চোখ আবদ্ধ করে নিল। রিয়ার চিৎকার শুনে নীচ থেকে রিয়ার মা চলে এলেন।
চলবে,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
সূচনা পর্ব
#সুমাইয়া_আফরিন