সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব ২৫+২৬

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৫
#সুমাইয়া_আফরিন

অনু রাফাতের কথা শুনে দুই পা পিছিয়ে গেল। চোখে হালকা ঝাপসা ঝাপসা দেখতে লাগল সে। বিশ্বাস করতে পারছে না সে রাফাতের কথাগুলো। এই কি সেই রাফাত যে ওই মেসেজগুলো লেখেছিল? এই কি সেই রাফাত যে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল?

অনু নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। রাফাত আরো কিছু কথা বলছে আলি উদ্দিন চৌধুরির সাথে কিন্তু তার কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না অনুর। অনুর চোখ দিয়ে দুই ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। অনু অশ্রুশিক্ত চোখ নিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকেই ডুকড়ে কেদে উঠল সে। বারবার রাফাত তাকে অসহনীয় ধোকা দিচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছে না সে এই ব্যথা। অনু বিছানায় বসে নিজের চোখের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। এক বিদঘুটে অন্ধকার বিতাজ করছে রুমটায়। ভয়াবহ ধরনের নিরবতা চলছে আর সেই নিরবতার মাঝেই শোনা যাচ্ছে অনুর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ।

অনু নিজেকে শক্ত করে চোখের পানি মুছে নিল। এখন যে দুর্বল হলে চলবে না। শক্ত হতে হবে তাকে এবং রাফাত আর তার বাবার পরিকল্পনা ব্যার্থ করতে হবে। দুই হাজার মানুষদের ন্যায় দিতে হবে তাকে। রাফাত আর তার বাবাকে চরম শাস্তি দিতে হবে যাতে দ্বিতীয়বার এমন চিন্তা মাথাতেও না আনে।

আনমনে কথাগুলো ভাবছিল অনু। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেতেই চোখ মুখ ভালো করে মুছে নিল সে। রাফাতকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে সব জেনে গেছে। অনু বিছানা থেকে উঠে প্রানভরে শ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই আরেকটি দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসলো তার কর্ণকুহরে। অনু পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাফাত দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফাতের ঠোটের কোনায় এক অদ্ভুত শয়তানি হাসি বিরাজ করছে। রাফাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। রাফাতের এমন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল না অনু। শরীরের প্রত্যেকটা শীরায় শিরায় এক ঠান্ডা শিহরন বয়ে গেল তার। বুকে এক ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি হলো অনুর।

রাফাত দরজা ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে তার ডান হাত বের করল। ডান হাতের সাথে বেরিয়ে আসল অনুর পরিহিত পায়েলটি। অনু পায়েলটি দেখেই চমকে উঠল। অনুর নুপুর পছন্দ নয় যার কারনে তার মামা রূপার পায়েল বানিয়ে দিয়েছিল তার জন্য। কিন্তু আজকে হঠাৎ পায়েলটি খুলে পড়ে গেল কোথায় আর রাফাতই বা এটা পেল কোথায় সেটাই বুঝতে পারছে না অনু। অনু বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। রাফাত ঠোটের কোণায় ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে পায়েলটি আঙুলের মাঝে ঘুরাতে ঘুরাতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল অনুর দিকে। অনু ওয়াশরুমের দরজা থেকে একটু দূরে চলে এসেছে। শুকনো ঢক গিলে রাফাতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে সে,

‘পায়েলটি কোথায় পেলেন রাফাত?’

রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। যে এত হাসির আর আজব কথা কখনো শোনেনি সে। অনুর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সে। অনুর বেশ অবাক লাগল বিষয়টি। অনু রাফাতের কাছে আসতে না চাওয়ায় এক পা দুই পা করে পিছাতে লাগল সে। পিছাতে পিছাতে এক সময় বিছানার কাছের ছোট টেবিলের সাথে ধাক্কা খেল সে। ধাক্কা খাওয়ায় একটি নোট বুক নিচে পড়ে গেল। রাফাত অনুর অনেকটা কাছে চলে এসেছে। রাফাতের রহস্যময়ী হাসি প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে অনুর ভয়কে। অনু কম্পিত চক্ষুতে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। রাফাত অনুর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আঙুলের মাঝে পায়েল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

‘কোথায় পেলাম পায়েলটা?এটাই জিজ্ঞাসা করলে না তুমি?’

অনু একটু অবাক হলো রাফাতের প্রশ্নে। রাফাতের কথা বলার ভঙ্গিটা কেমন যেন পালটে গেছে। এক ভয়ঙ্কর মানুষের মতো লাগছে তাকে। অনু রাফাতের কথায় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

‘হুম।’

রাফাত মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

‘যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমার আর বাবার কথা শুনছিলে সেখানে পেয়েছি।’

অনু রাফাতের কথায় চোখগুলো বড় বড় করে ফেলে। রাফাত যে বুঝতে পেরে গেছে যে সে সবটা জানে এটা ভাবতেই অনুর বুকটা ছ্যাত করে উঠল। গলা প্রতিনিয়ত শুকিয়ে আসতে লাগল তার। রাফাত মুখ শক্ত করে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনুর রাফাতের রক্তিম চোখগুলোর দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে যে কি করতে হয় সেটাও ভুলে যাচ্ছে সে। অনু দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেছে।

অনু রাফাতের দিকে তাকিয়ে দেখল রাফাত তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ রাফাত এক দড়ি দিয়ে অনুর গলা চেপে ধরল। নিমিষেই গলায় অস্বাভাবিক চাপ অনুভর করতে পারল সে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল তার। অনু হাত পা ছোটাছুটি করতে লাগল। অনুর এক হাত গলায় বিচরন করছে। হাজারো চেষ্টা করছে দড়িটি নিজের গলা থেকে সরানোর কিন্তু কোনোভাবেই রাফাতের সাথে পেরে উঠছে না সে। গোঙানো শুরু করে দিয়েছে অনু। অনু কখনো ভাবতেও পারেনি রাফাত তাকে মারার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রাফাত যে এত নিচেও নামতে পারে এটা জানা ছিল না অনুর। রাফাতকে থামানোর অনর্থক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনু। আর কিছুক্ষন সময় অতিক্রম হলেই হয়তো অনু এ-ই পৃথিবীটাকে বিদায় জানাবে।

অনুর চোখ দিয়ে অঝস্র ধারায় অশ্রুজল বয়ে যাচ্ছে। অনু নিশ্বাস নিতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখনই রাফাত ছেড়ে দিল অনুর গলা। ধাক্কা দিয়ে অনুকে বিছানায় ফেলে দিল সে। অনু নির্বিকারভাবে কাশতে লাগল। রাফাতের চোখে মুখে এক ভয়াবহ কাঠন্যতা বাস করছে। যেন এক মায়াদয়াহীন মানুষ সে। অনু কাশতে কাশতে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে থাকল। গলায় এখনো চিনচিন ব্যাথা করছে অনুর। আচমকা মাথায় ব্যাথা অনুভব করল সে। রাফাত অনুর চুলের মুঠি ধরে শোয়া থেকে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘এবার বুঝতে পেরেছিস, আমার আর আমার বাবার কথা শোনার ফল কি হতে পারে?’

অনু ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। হঠাৎ এক রাশ ঘৃনা ভর করল তার চোখেমুখে। দাঁত খিচিয়ে অনু বলে উঠল,

‘তুই আমার সাথে যাই করিস না কেন তোর মতো শয়তানকে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো আমি।’

‘ওহ প্লিজ, তোর কতটুকু ক্ষমতা তা আমার জানা আছে বুঝেছিস?’

অনু রাফাতের কথায় থুতু ফেলে বলল,

‘চুপ কর তুই।তোর মুখ দিয়ে একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। তোর সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছি আমি এটা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে আমার। হাজার পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করলেও এই ঘৃনা দূর হবে না।’

রাফাত অনুর কথার অসম্ভব পরিমান রেগে যায়। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিজেকে কোনোরকমে সামলিয়ে অনুর হাত পা দড়ি দিয়ে বাধতে শুরু করল সে। অনু অনেকটা অবাক হয়ে গেল রাফাতের হাত পা বাধা দেখে। অনু কোনোকিছু না ভেবে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। কিন্তু রাফাতের মতো শক্তিশালী পুরুষের সাথে তার ক্লান্ত শরীর পেরে উঠছে না। রাফাত খুব সহজেই এবং তাড়াতাড়ি অনুর হাত পা বেধে ফেলল। একটা শক্ত কাপড় দিয়ে অনুর মুখ বেধে দিল যাতে চিৎকার না করতে পারে। অনুকে পাজা কোলে তুলে সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে চিনে নেমে গেল রাফাত। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় অনু সিড়ির দিকদ নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল আলি চৌধুরি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এক প্রকার কাঠন্য বাস করছে তার চোখে মুখে। নিমিষেই বিষিয়ে উঠল অনুর মনটা।

রাফাত অনুকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে লাগল। অনু কোনো উপায় না পেয়ে গাড়ির কাঁচে নিয়মিত আঘাত করতে লাগল। কাঁচটা ভেঙে ফেলার অনর্থক চেষ্টা করতে লাগল সে। রাফাত অনুর ছটফটানি দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল। অনুকে বাধা দিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো প্রিয়তমা? গাড়ির জানালার কাঁচ এত সহজে ভাঙবে না। আর গাড়ির ভেতর থেকে তোমাকে কেউ দেখতেও পাবে না। সো, চুপচাপ বসে থাকো।’

অনু রাফাতের কথায় চুপ হয়ে গেল। কারন রাফাতের কথায় সত্যতা বসবাস করছে। জানালার কাঁচ কখনোই ভাঙা সম্ভব নয়। অনুর চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অপেক্ষা করতে লাগল কখন গাড়িটা এক নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছাবে।

অনুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাফাত এক বড় বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। বাড়িটা আহের বাড়ির থেকে সামান্য ছোট। কিন্তু এ-ই বাড়িও অনুর কাছে প্রাসাদের মতো লাগতে থাকল। অনুকে আবার পাজাকোলে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রাফাত। অনুর মনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাফাতের পরিকল্পনার ছিটেফোটাও বুঝতে পারছে না সে।

রাফাত অনুকে এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে গেল। পুরো বাড়িটাও অন্ধকার দিয়ে ঢাকা ছিল কিন্তু এ-ই ঘরটা একটু বেশিই অন্ধকার। অন্ধকারে অনুর চোখ ব্যাথা করে উঠল। রাফাত আস্তে করে অনুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। ঘরের প্রত্যেকটা অবস্থান যে রাফাতের জানা আছে তা বুঝতে অনুর দেরি হলো না। কারন এত অন্ধকারে কেউ এত ভাবলেশহীনভাবে হাঁটতে পারে না। রাফাত অনুকে চেয়ারে বসিয়ে লাইট অন করে দিল। নিমিষেই চোখ মুখ কুচকে গেল অনুর। ঝাঝিয়ে উঠছে চোখটা। অনু পিটপিট করে রাফাতের দিকে তাকালো। অনু চারিপাশে তাকিয়ে দেখল ঘরটা সম্পূর্ণ ফাকা। কোনো আসবাবপত্রই লক্ষ করা যাচ্ছে না ঘরটায়।

রাফাত অনুর মুখের থেকে বাধন খুলে ফেলল। অনু ঘৃনাভরা দৃষ্টিতে তাকালো রাফাতের দিকে। রাফাত এক নেশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করছে তার মাঝে। কিন্তু রাফাতের এমন দৃষ্টি অনুর ঘৃনাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাফাতের প্রত্যেকটা স্পর্শ মৃত্যুর চেয়েও খারাপ লাগছে তার। অনু রাফাতের থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। হঠাৎ রাফাত অনুর মুখে রুমাল চেপে ধরল। অনু গুঙিয়ে উঠল কিন্তু রাফাতের যেন কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। অনু বুঝতে পারল রুমালে ক্লোরোফ্রম মাখানো আছে। তাই রাফাতের চোখ ধুলো দিতে অজ্ঞান হওয়ার নাটক করল সে। কিন্তু অনুর থেকে রাফাত যেন দুই পা এগিয়ে আছে। অনু নিখুত অভিনয় করার পরেও রাফাত অনেক্ষন নাকের কাছে ক্লোরোফ্রম ধরে রাখল। অনু বেশিক্ষন নিশ্বাস বন্ধ রাখতে না পেরে শ্বাস ছেড়ে দেয়। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।

মাঝরাতে হঠাৎ মআথায় চিনচিনে ব্যাথা করে ওঠে অনুর। ভয়াবহ ধরনের ভারী হয়ে আছে মাথাটা। ঘরটায় জানালা দরজা বন্ধ থাকায় গরম হাওয়া বিরাজ করছে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই অনু বুঝতে পারল বিছানায় হাত পায়ের বাধন ছাড়া শুয়ে আছে সে। বিষয়টিতে অনেকটা অবাক হলেও পরবর্তীতে আরো অবাক হয়ে গেল সে। নিজের পাশে তাকাতেই রাফাতের ঘুমন্ত চেহারা ভেসে উঠল তার চোখে। বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরল অনু। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। এ-ই লোকটা তার শেষ সম্বলটুকুও রাখল না।
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৬
#সুমাইয়া_আফরিন

চোখের কার্ণিশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোটা নোনা জল। অনু রাফাত যে এমন ঘৃনীয় কাজ করবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি অনু। অনুর গায়ে একটা কাপড়ও নেই। কাফনের মতো চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে তার শরীর।

অনু নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে চাদর শক্ত করে নিজের শরীরে পেচিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। রাফাতের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল রাফাত নীল ব্লেজারটা পড়েই শুয়ে পড়েছে। পায়ে মোজা পড়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে।

অনু রাফাতের দিক থেকে ঘৃনায় মুখ সরিয়ে নিল। রাফাত তার সাথে কিছু করেছে কি না তা বুঝতে পারছে না অনু। অনু সবকিছু ভাবা বন্ধ করে নিজের জামাকাপড় খুজতে লাগল। ঘরটা হালকা অন্ধকার যার কারনে খুজতে সমস্যা হচ্ছে না অনুর। পুরো ঘরটায় তন্নতন্ন করে খুজেও নিজের জামাকাপড় খুজে পেল না অনু।

হঠাৎ অনু চোখ গেল আলমারির দিকে। আলমারি আস্তে করে খুলতেই এক রাশ অন্ধকার আকড়ে ধরল তাকে। অনু আলমারির ভেতর হাত দিতেই বুঝতে পারল আলমারিতে ধুলো পর্যন্ত নেই। অনু কোনো উপায় না পেয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বাড়িটায় অনেকগুলো ঘর আছে, অনু একটা ঘরের দরজায় চাপ দিতেই অবাক হয়ে গেল। দরজাটি বন্ধ করা। অনু একে একে সবগুলো ঘরের দরজা চেক করে দেখল বাড়ির সবগুলো দরজাই বন্ধ করা।

অনু সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই মেইন দরজার দিকে লক্ষ্য করে দেখল দরজায় সামান্য ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করা। মুহূর্তেই অনুর উল্লাসে লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই থেমে গেল সে। কি করে বাইরে বের হবে অনু?এ-ই অবস্থায় বাইরে বের হলে তো তার যেটুকু সম্মান আছে তাও চলে যাবে।

অনু হতাশ মনে পুনরায় সেই রুমে চলে গেল। রুমের ভেতরে তাকাতেই দেখল রাফাত মোবাইলে কিছু একটা করছে। অনুর মনটা বিষন্ন রাগে ভরে উঠল। যদি রাফাতকে সে কেটে টুকরো টুকরোও করে দেয় তবুও হয়তো তার শান্তি হবে না। অনু হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলে আলোকিত হওয়া রাফাতের মুখের দিকে।

রাফাত মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনু মূর্তির ন্যায় হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাফাত ঘুম মিশ্রিত হাই তুলে বলল,

‘কোথায় গেছিলে তুমি? এত ছটফট কেন করো সবসময়?’

অনু দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

‘আমার কাপড় কোথায়?’

রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘ওহ আচ্ছা, জামা খুজতে গেছিলে তুমি। সরি গো, আজকে জামাটা পাবে না তুমি।’

‘আমার জামাটা দিয়ে দিন রাফাত নয়তো…..

‘নয়তো কি? কিছুই করতে পারবে না তুমি আমার।’

রাফাতের কথায় অনুর রাগ দ্বীগুন বেড়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে রাগের আগ্নিয়গিরি ফুটছে তার। হাতের মুষ্ঠি বারবার শক্ত হয়ে আসছে তার। কিন্তু এখন রেগে যাওয়ার সময় না যার কারনে অনু শান্ত হয়ে গেল। ক্ষীন স্বরে রাফাতকে বলল,

‘একটা মেয়ের সম্মান এভাবে ছিনিয়ে নিলেন আপনি? কি শান্তি পেলেন এমন কাজ করে?’

রাফাতের ঠোটের কোণা থেকে যেন হাসি সরছেই না। রাফাত মুচকি হাসি নিয়ে অনুকে বলল,

‘তোমার সম্মান আমি কখন ছিনিয়ে নিলাম একটু বলবে প্লিজ? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার হাজবেন্ট। আর তাছাড়া তোমার ভালোর জন্যই খুলেছি।’

‘আমার ভালোর জন্য? সেটা কীভাবে?’

‘উফফফ এ-ই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার বাবাকে শাস্তি দেবে?এই, তোমাদের মেয়েদের মাথায় বুদ্ধি এত কম থাকে কেন?’

রাফাত অনুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। রাফাতের এমন জিজ্ঞাসু চাউনি খুবই বিরক্ত লাগছে অনুর। অস্ফুট বিরক্তিভরা কপ্নঠে অনু বলল,

‘যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দিন।কেন খুলেছেন?’

‘পাগলি মেয়ে, তোমাকে যদি হাত পা বেধে চেয়ারে বসিয়ে রাখতাম তাহলে কি তুমি খুব শান্তিতে ঘুমাতে পারতে? আর তাছাড়া ব্যাথাও পেতে তুমি। আসলে আমার সুন্দরী একটা বউকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না তাই জামা কাপড় খুলে ফেললাম। যার ফলে তুমি এখন পালাতে পারছো না কারন এ-ই অবস্থাতে তুমি বাইরে বের হতে পারবে না। যদি তোমাকে হাত পা খুলে ঘুমাতে দিতাম তাহলে তো তুমি এতক্ষনে পালিয়ে বৃন্দাবন চলে যেতে।’

অনু মুচকি হাসি দিয়ে রাফাতকে বলল,

‘চিন্তা করবেন না রাফাত। আমি বৃন্দাবন যাচ্ছি না।যতক্ষন না আপনাকে আর আপনার বাবাকে শাস্তি দিতে পারছি ততক্ষন আমি যাবো না এখান থেকে।’

‘ওহ তাই নাকি? ভালো কথা। আমিও হারাতে চাই না তোমাকে প্রিয়তমা। আমার বুকটাকে যে ছিন্নবিন্ন করে দিয়েছো তুমি, কি করে যাই তোমাকে ছেড়ে!’

রাফাতের কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝল না অনু। যেন সব কথা মাথার এক হাত উপর দিয়ে চলে গেল। একটা মানুষের কতগুলো যে রুপ থাকতে পারে তা রাফাতকে দেখলে বোঝা এবং জানা যায়।

অনু দরজায় বিরক্তিতে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাফাত বিছানা থেকে উঠে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অনু এ-ই অন্ধকার বাড়িতে একা বসে রইল রুমটায়। বিছানার পাশের ল্যাম্প চালাতেই পুরো রুমটা আলোকিত হয়ে গেল। একা থাকতে অনুর বেশি একটা সমস্যা হচ্ছে না, ডাক্তার হওয়ায় তার মধ্যে ভূতের ভয়টাও নেই। অনু জানালার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সকাল হওয়ার।
_____________

এক মাস পর অনু খোলা আকাশ দেখছে। রাফাত অনুর হাত শক্ত করে ধরে আছে গাড়ির সামনে। এই এক মাস রাফাতের হাতে এক অন্ধকার ঘরে বন্দি ছিল সে। এ-ই এক মাসে রাফাত তাকে শারীরিকভাবে কোনো কষ্টই দেয়নি যা প্রতিনিয়ত অনুকে অবাক করে দিয়েছে। অনুর জন্য প্রতি বেলায় রাফাত খাবার নিতে এসেছে, অনু খেতে না চাইলে জোড় করে খাইয়েছে সে। অনুর যাবতীয় সমস্ত কাজ রাফাত করতে দিয়েছে এ-ই বাড়িতে। কিন্তু রাত হলেই অনুকে এক ঘরে বন্দি করে রেখেছে সে। অনু হাজারো চেষ্টা করেছে এ-ই বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিন্তু কোনোভাবেই সে সফল হতে পারেনি। বাড়ি থেকে বের হতে পারলেও রাফাতের বডিগার্ড আর সিকিউরিটি ধরে ফেলেছে তাকে। হাউমাউ করে ভিক্ষা চেয়েছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু অনুর কান্না যেন তাদের কানেই পৌছায়নি।

রাফাত অনুকে জোড় করে গাড়িতে ঢোকাতে চাইলে অনু রাফাতকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার অনুরোধ করে। এতদিন পর সকালের এই নম্র রোদ গায়ে পড়তেই এক ভালোলাগা কাজ করছে অনুর। অনু কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে। বাড়িটার পার্কের কাছে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। রাফাত অনুর রোদ্রবিলাশ দেখে বিরক্ত হয়ে হাতে হ্যাচকা টান মেরে গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। অনু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাফাতের দিকে। হঠাৎ বিষন্নতায় ভরে উঠল তার মন। এতদিন হয়ে গেল অথচ সেই গরিব মানুষদের জন্য কোনো কাজই বাস্তবায়ন করতে পারল না সে। ন্যায় বিচার দিতে পারল না সেই মানুষগুলোকে। চোখের কোণায় পানি জমে গেল অনুর।

রাফাত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকল। রাফাতের এত স্পিডে গাড়ি চালানোতে হালকা ভয় পেয়ে গেল অনু। অনুনয়ের সুরে রাফাতকে বলল,

‘গাড়িটা একটু আস্তে চালালে হয় না?’

মুহূর্তেই গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল রাফাত। অনু সস্তির নিশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। রাফাত হাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেওয়ায় গাড়ির জানালা খুলে দিল রাফাত। অনু অবাক হয়ে রাফাতের দিকে তাকিয়ে রইল। রাফাতের কোনো ভয় কেন করছে না? সে চিৎকার করে রাফাতকে ফাসাতেও পারে?

অনু সবকিছু বিবেচনা করে আর চিৎকার করল না। কারন হয়তো রাফাতের কোনো পরিকল্পনা আছে যার কারনে জানালা খুলে দিয়েছে সে। অনু চুপ করে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগল। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে তা বুঝতেও পারল না অনু। হঠাৎ রাফাতের ডাকে হুশ ফিরল তার। চোখ মুখ কুচকে তাকিতে রইল রাফাতের দিকে। কিন্তু সাইকেলের হর্ণের শব্দ শুনতেই চমকে উঠল সে। গাড়ি থেকে বের হতেই হতভম্বিত হয়ে গেল সে। রাফাত আর কোথাও না তার গ্রামে তাকে নিয়ে এসেছে। অনু গ্রামের অপরুপ দৃশ্য দেখেই খিলখিল করে হেসে দিল। রাফাত অনুর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল,

‘এত হাসি কোথা থেকে আসে বুঝি না। বাচ্চাদের মতো হাসছে, পাজি মেয়ে। এতদিন সব কাজ একা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি সেটা তো আর মাথায় নেই। সে তো পড়ে ছিল আমার বাগানবাড়িতে কি করে মাথায় থাকবে তার!’

অনুর হাত টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রাফাত। অনু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই থমকে গেল। চোখগুলো রসগোল্লার ন্যায় ধারন করেছে তার। বাড়িতে সবাই আছে, অনুর বাবা,মা, ভাই বোন, আর রাফাতের বাড়ির সবাই। কাকলি সরকার সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। এক প্রকার মলিনতা কাজ করছে তার মধ্যে। অনু খেয়াল করল কাকলি সরকারের চোখের কোণায় পানি জমে আছে। কাকলি সরকারের ঠিক পাশেই ইনারা আক্তার বসে আছেন। কাকলি সরকারের জন্য হৃদয়ভাঙা কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।

অনুর পরিবার এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে আছে। বাড়িতে যেন কোনো প্রান নেই। অনু মুখ বাকা করে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। রাফাত অনুর হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। অনু।কিছুই বুঝতে পারছে না বাড়িতে হচ্ছে টা কি? অনুর মা অনুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

‘কেমন আছিস মা? এতদিন ও-ই বাড়িতে আটকা পড়েছিলি,এখন কেমন লাগছে?’

অনু হতভম্বিত হয়ে তাকালো তার মায়ের দিকে।হাফসা বেগমের কথা শুনে মনে হচ্ছে সবকিছুই জানতেন তিনি। অনু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে হাফসা বেগমের কথায়। অনুর পুরো পৃথিবীটা যখন পুরো অন্ধকার হয়ে আসছিল তখন কাকলি সরকার কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

চলবে,

(আর মাত্র এক-দুই পর্ব আছে গল্পটার। আর বেশিদিন দেব না গল্পটা। কয়েকটা পর্বের মাধ্যমেই শেষ করে দেব। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।)
চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here