সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব ২১+২২

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২১
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাত অনুর প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মুখে চিন্তিত ভাব এনে বলল,

‘অনু তুমি এসব কি বলছো? তোমার আমি কতো বড় উপকার করেছি তুমি জানো?’

অনু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করল,

‘কি উপকার?’

রাফাত চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,

‘আমি দেখি আমার মামি তোমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনি এসব মানুষদের পছন্দ করে না যারা বিয়ের পর স্বামীর সাথে থাকে না। উনি তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছিলেন ঠিক ওই সময় আমি এসে বললাম যে,আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে যেন না মারে। মামির আমার কথা অর্ধেক বিশ্বাস করেছেন আর অর্ধেক করেননি। তাই তিনি পরীক্ষা করার জন্য আমাকে বললেন তোমার কপালে কিস করতে তাই আমি করলাম।’

অনুর রাফাতের কথায় রাগ দ্বীগুন বেড়ে গেল। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। অনু নিজের রাগকে সামলাতে না পেরে দাঁত খিচিয়ে মুখ ভেংচে বলল,

‘ফালতু কথা বলার জায়গা পান না তাই না?কোথায় আপনার মামি, ডাকুন তাকে।’

‘ওই তো তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।’

অনু তার চারপাশে চোখ বুলালো। কোথাও কোনো মানুষকে দেখতে পেল না। অনু বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,

‘কোথায়?এখানে তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’

রাফাত ঠোটের কোণায় ফিচেল হাসি এনে বলল,

‘ওহো….. আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আমার মামিকে আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। উনি তো আমার আট বছর বয়সেই মারা গেছেন। আর……

আর কিছু বলতে পারলো না রাফাত। অনু রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘রাফাত খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। বানিয়ে কথা বলার একটা লিমিট আছে। বিরক্তিকর।’

রাফাত কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু অনু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। অনু রাফাতের থেকে জানতে পেরেছে কালকে তার বাবা আসবে। এতে অবশ্য অনু অনেক খুশি হয়েছে। তার কাজটা অনেক তাড়াতাড়ি ও দ্রুত হয়ে যাবে। অনু যেন আর অপেক্ষা করতে পারছে না রাফাতের বাবার আসার৷

পাঁচ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে অনু বাইরে বেরিয়ে এলো। রাফাত বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। অনুকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে গেল সে। অনু রাফাতের দিকে নজর না দিয়ে আয়নার সামনে চলে গেল। নিজেকে ভালো করে আয়নায় পরখ করে নিল সে। রাফাত অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় রাফাতের প্রতিচ্ছবি পড়ায় খুব ভালোভাবেই রাফাতকে দেখতে পাচ্ছে অনু। অনু খেয়াল করল রাফাত গভীর মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অনু যদিও বিরক্ত হচ্ছে না তার এই ব্যবহারে কিন্তু কোনোকিছু বলছে না। অনু মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করছে কয়েকটা কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু তাও করছে না। এমন করার কারন অনুর বোধগম্য নয়।

অনু বারবার রাফাতের দিকে তাকাচ্ছে। রাফাত যেন খুব মজা নিচ্ছে অনুর এভাবে তাকানোতে। রাফাতের ঠোটের কোণে অস্ফুট হাসি বিরাজ করছে। অনু এবার আর নিজের রাগকে সামলাতে পারলো না। অনু হিংস্র চোখে রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সমস্যাটা কি?কি দেখছেন তাকিয়ে তাকিয়ে?রুপ জ্বালিয়েছে আমার যে এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে।’

রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অনুকে উদ্দশ্য করে বলল,

‘এটা কেমন কথা?তোমার রুপ তো অনেক আগেই জ্বালিয়েছে। এখন হতে যাবে কেন?’

অনু রাফাতের কথায় আরো রেগে গেল। রেগে গিয়ে কিছু বলার উদ্যোগ নিল কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও বলল না৷ কারন সে ভালোই বুঝতে পারছে এই লোকের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না।

অনু নাক দিয়ে গরম হাওয়া বের করতে করতে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। অনুর এমন আচরন দেখে রাফাত ফিক করে হেসে দিল। ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। অনু নিচে নামতেই দেখল ড্রয়িং রুমে রাফাতের চাচি বসে আছে। অনুকে দেখেই মুচকি এক হাসি দিলেন ভদ্রমহিলাটি। অনু হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। অনু ঠোটের কোণে বিষ্ময়ের হাসি ঝুলিয়ে তার কাছে চলে গেল।

অনু মহিলাটির কাছে যেতেই মহিলাটি অনুর মাথায় হাত দিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

‘কেমন আছো তুমি?’

‘জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

‘বড় ভাবী তোমাকে যা বলেছে তা নিয়ে তুমি কিছু মনে করো না। বড় ভাবী ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসেন তাই তার কোনো অপরাধই চোখে পড়ছে না তার। বুঝতেই৷ তো পারছো?’

অনু কিছু বলল না। এখানে কিই বা বলার আছে তার! অনু এই একজন মানুষকেই পেল যে তার বিষয়টা বুঝতে পারছে, তার কথা শুনতে চাইছে। অনু তার দৃষ্টি নিচের দিকে আবদ্ধ করে রেখেছে। ভদ্রমহিলাটি অনুকে ডাক দিয়ে বললেন,

‘অনু কি হয়েছে?’

‘না আন্টি কিছুই হয়নি।’

অনু কথায় মহিলাটি শব্দ করে হেসে দিলেন। অনু মহলাটির হাসির কারন খুজে পেল না। চোখ কুচকে তাকিয়ে রইল তার হাস্যজ্জল মুখস্রির দিকে। মহিলাটি হাসতে হাসতে বললেন,

‘তোমরা আজকাল ছেলেমেয়েরা সবাইকে আন্টি বলো। কিন্তু জানো, রাফাত এতো মডার্ন ছেলে কিন্তু তবুও আমাকে কাকিমনি বলে ডাকে। তাই তুমিও যদি আমাকে কাকিমনি ডাকো আমার খুব ভালো লাগবে।’

অনু মহিলাটির কথায় সস্তি পেল। কারন আন্টি বলতে তারও ভালো লাগছিল না। অনু ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,

‘আসলে কাকিমনি,এই বাড়িতে রাফাত হঠাৎ নিয়ে এসেছে। সবাইকে আপন করে নিতে চাচ্ছি কিন্তু এই বাড়ির মানুষজন আমাকে কতটা আপন করে নিতে চাইছে সেইটা বুঝতে পারছি না। তাই প্রথমে আন্টিই বললাম।’

রাফাতের কাকিমনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক মেয়েলি কৌতুহলি কন্ঠেস্বর ভেসে আসল,

‘তাহলে তুমিই আমার ডেলিভারী করেছিলে?’

অনু পেছন ফিরে তাকাতেই কাকলি সরকারের দ্বিতীয় সন্তান স্নেহাকে আবিষ্কার করল। কাকলি সরকারের দুই ছেলে দুই মেয়ে। তার প্রথম সন্তান হলো রাফাত এবং দ্বিতীয় সন্তান স্নেহা। আর ফাইজা আর ইফতী জমজ ভাইবোন। ইফতবড় ফাইজা ছোট।

স্নেহার পেটে বেল্ট পড়া। সে যে এত কষ্ট করে এসেছে এটা ভাবতেই অনুর শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। অনু স্নেহার কাছে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,

‘স্নেহা তুমি কেন উঠে এসেছো? তোমার এখন বিছানা থেকে ওঠাও ঠিক না।’

স্নেহা মুখ নিমিষেই বিষন্নতায় ভরে উঠল। মুখে অঝস্র কষ্ট হানা দিয়েছে তার। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

‘ভাবী প্লিজ, খুব বোরিং লাগছে ওই বিছানায় শুয়ে থাকতে। জানো ভাবী আমার একটা বজ্জাত স্বামী আছে,সে তো পারে আমার পাশে একটু বসে থাকতে। কিন্তু নাহ,,তার এত কাজ যে আমার দিকে ঘুরেও তাকানো যাবে না।’

কথা বলার এক পর্যায়ে পেটে হাত দিয়ে স্নেহা হালকা আর্তনাদ করে উঠল। রাফাতের কাকিমনি ভয় পেয়ে দৌড়ে স্নেহার কাছে চলে আসলো। স্নেহা অনুর হাত শক্ত করে ধরে আছে। চোখ মুখ কুচকে গেছে তার। অনু দেরি না করে স্নেহাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। স্নেহার প্রেগনেন্সির কারনে কাকলি সরকার স্নেহার রুম উপর থেকে নিচে শিফট করে দিয়েছে। যার কারনে স্নেহাকে নিয়ে যেতে বেশি দেরি হলো না অনু।

অনু স্নেহাকে চেক আপ করে বুঝতে পারল স্নেহার কিছুই হয়নি। একটু হাঁটার কারনে পেটে পেইন উঠেছিল তার। অনু স্নেহাকে না হাঁটার জন্য কড়া আদেশ দিল। অনু স্নেহাকে পেইন কমার ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
_____________

‘এইটা হতে পারে না খালামনি।আজকে ওই মেয়েটা রাফাতের সাথে একই রুমে একই খাটে ঘুমাবে? না না, এটা হতে পারে না।’

সায়মার চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। নোনা জলগুলোতে মিশে আছে অঝস্র প্রতিহিংসা ও রাফাতকে না পাওয়ার ভয়। কাকলি সরকার মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছেন। কিছুক্ষন আগে কি হয়ে গেল কিছু তার বোধগম্য নয়। সে শুধু এইটুকুই জানে অনুকে যে করেই হোক বাড়ি থেকে বের করতে হবে।

সায়মার এমন ন্যাকা কান্নায় বিরক্ত হয়ে কাকলি সরকার চিৎকার করে বলল,

‘তুই থামবি? একটু ভাবতে দে আমায়।’

সায়মা তার ন্যাকা কান্না থামিয়ে দিল। অশ্রু ভেজা চক্ষুতে তাকিয়ে আছে কাকলি সরকারের দিকে। কাকলি সরকার কিছুক্ষন চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলেন। হঠাৎ তিনি উল্লাসে সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন। তার ঠোটের কোণায় ক্রুর হাসি বিরাজ করছে। কাকলি সরকার সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সায়মা তুই দেখ এবার, রাফাত অনুকে বের করে দিতে বাধ্য হবে।’
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২২
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাত সোফায় কোনো রকমে খুশেমুশে শুয়ে আছে। সোফায় শোয়ার অভ্যাস তার নেই যার কারনে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। রাফাত অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনু অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে বিভোরে ঘুমাচ্ছে। অনুর এমন ব্যাবহার দেখে রাফাত হালকা রাগান্বিত অনুভব করছে।

‘এই মেয়েটার কি কোনো মায়া মমতা নেই নাকি?নিজের স্বামীকে কেউ সোফায় শোয়ায়?এই শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে করলে এই একটা ঝামেলা।এরা শুধু নিজেদের স্বার্থটা বোঝে। একটা ঘরোয়া মেয়ে হলে লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলতো,আপনি বিছানায় ঘুমান আমি সোফায় শুচ্ছি। কিন্তু এটাকে এক প্রকার ন্যাকামি বলে। অবশ্য ঘরোয়া মেয়েরা ন্যাকামি ভালোই করতে পারে। ওদের কাছে তো ওটা ন্যাকামি না স্বামীর প্রতি ভালোবাসা।’

কথাগুলো আনমনে বলছিল রাফাত। মনে হাজারো অশান্তি নিয়ে শুয়ে আছে সে। হঠাৎ সোফা থেকে ধপ করে উঠে গেল রাফাত। ঘরটা অন্ধকার হলেও অনুর প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখতে পাচ্ছে রাফাত। নিজেকে সোফায় আটকে রাখতে না পেরে বিছানায় আস্তে করে শুয়ে পড়ল সে। অনু পেছন ঘুরে তাকাতেই রাফাত চমকে লাফিয়ে উঠল। অনু রাফাতের এভাবে চমকানোতে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

রাফাত শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। অবাক চক্ষুতে তাকিয়ে আছে অনু দিকে। অনু বিরক্ত হয়ে বলল,

‘একি আপনি এখানে কেন? আর এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন সবসময়?যেন আমি একটা ভূত।’

রাফাত কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই তার ছোট বোন ফাইজার চিৎকার ভেসে আসলো তার কর্ণকুহরে। চিৎকারের শব্দ অনুও পেয়েছে যার কারনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। দুইজন দুইজনের দিকে একবার তাকাতাকি করে যত দ্রুত সম্ভব ফাইজার কাছে চলে গেল। ফাইজা রাফাতের রুমের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রাফাতকে দেখতে পেয়েই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। রাফাত খেয়াল করল ফাইজা থরথর করে কাপছে।

ফাইজা রাফাতের টি শার্ট খামচে ধরে আছে যেন আর একটু টান দিলেই ছিড়ে যাবে টি শার্টটি। এতক্ষনে ফাইজার চিৎকারে সবাই নিজেদের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। কাকলি সরকার নিজের মেয়ের অবস্থা দেখে ভড়কে গেলেন। কাকলি সরকার ফাইজার কাছে যেতেই ফাইজা রাফাতকে ছেড়ে কাকলি সরকারকে জড়িয়ে ধরল। মা বলে কাঁদতে লাগল সে। বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে ফাইজার এমন অবস্থা দেখে। হঠাৎ ফাইজা এমন কেন করছে এই প্রশ্ন সবার মনের ভেতরেই দানার মতো বিধছে।

ফাইজাকে শান্ত করে সোফায় বসালো কাকলি সরকার ও রাফাতের চাচি ইনারা বেগম। অনু ফাইজার দিকে পানি এগিয়ে দিল। ফাইজা কম্পিত হাতে পানি গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে ফেলল। বাড়ির সবার মাথায়ই চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। কাকলি সরকারের চোখে পানি টলমল করছে। নিজের মেয়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারছেন না তিনি।

রাফাত ফাইজার পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। ফাইজার হাত ধরে হালকা স্বরে বলে উঠল,

‘কি হয়েছে ফাইজা? এতটা ভয় পেয়ে আছিস কেন?’

ফাইজা মাথা নিচু করে বসে আছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে সে। কিছুক্ষন চুপ থেকে কম্পিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ভাইয়া, ওখানে কেউ ছিল। আমাকে দেখে ফেলেছিল তাই আমার ওড়না দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমি কোনোরকমে নিজেকে ওই লোকটার থেকে ছাড়িয়ে চিৎকার করেছি। আমি চিৎকার করায় লোকটা পালিয়ে যায়।’

সবাই ফাইজার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফাইজা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। অনু নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে ফাইজার কান্নামিশ্রিত মুখস্রির দিকে। অনু এবং বাড়ির সবাই বুঝতে পারছে না তাদের বাড়িতে কে ঢুকতে পারে। এত সিকিউরিটির মধ্যে কেউ কীভাবে ঢুকতে পারে?

ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে একেকজনের মধ্যে। সিকিউরিটিকে ডাক দিয়ে কিছুক্ষন ধমকাধমকি করল কাকলি সরকার। সিকিউরিটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তার সামনে। কাকলি সরকার হুংকার দিয়ে সিকিউরিটিকে বেরিয়ে যেতে বললেন। সিকিউরিটি মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল। অনু এসবকিছু দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতসবকিছুর মধ্যে সেও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছিলো তা স্পষ্ট তার মুখে ফুটে উঠেছে।

কাকলি সরকার কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে অনুর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালেন। অনু কাকলি সরকারের এভাবে তাকানোর অর্থ বুঝতে পারলো না। কাকলি সরকার অনু উদ্দেশ্য করে দরাজ গলায় বলে উঠলেন,

‘সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্য। এই বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই কিছু একটা অঘটন ঘটে গেল। এই মেয়েটা একটা অপয়া ছাড়া আর কিছুই না। এই………..

কাকলি সরকার আরো কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রাফাত তাকে থামিয়ে দিল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাফাত বলল,

‘মম প্লিজ, এইসব স্টার জলসার সিরিয়ালের ডায়লগ মারা বন্ধ করো। একজন মানুষ আসলেই যে তার কারনে এইসব হচ্ছে এটা পুরোই ফালতু কথা।’

কাকলি সরকার রাফাতের কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তার ছেলে যে তার হাতের থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে তা সে সে খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু তাই বলে সে তার ছেলেকে অনুর আচলে ঢুকতে দেবেন না এটা তার প্রতিজ্ঞা। বজ্রদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে।

রাফাত তার চাচিকে ফাইজাকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন এবং তার সাথে তাকে থাকতে বলল। আস্তে আস্তে সবাই যার যার মতো নিজেদের রুমে চলে গেল। অনু গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িনহ প্লেসে। রাফাত অনুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঘরে নিয়ে গেল।
__________

রাতের এমন অস্বাভাবিক ঘটনার কারনে কেউ চোখের দুই পাতা এক করতে পারেনি। ফাইজাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে কাকলি সরকার ও ইনারা বেগম।

রাফাত খুব ভোরেই ল্যাপটপ নিতে বসে পড়েছে। বাড়ির সবগুলো সুসিটিভি ফুটেজ চেক করতে লাগল সে। কিন্তু কোনো ফুটেজেই কিছু খুজে পেল না সে। বাড়ির পেছনের ফুটেজ চেক করতেই খেয়াল করল ফুটেজ দেখা যাচ্ছে না। সিসিটিভি ক্যামেরাটি কেউ কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। রাফাত রাগে সোফার পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভ্যসটি ছুড়ে ফেলে দিল মাটিতে।

আচমকা কাঁচ ভাঙার শব্দ পেয়ে চমকে উঠল অনু। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাফাত রক্তিম চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ল্যাপটপের দিকে। অনু রাফাতের এমন ব্যাবহারে প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

‘কি হয়েছে রাফাত?’

রাফাত অনুর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। ল্যাপটপ শব্দ করে বন্ধ করে ওয়াশরুমে হনহন করে ঢুকে গেল। ওয়াশরুমের দরজা ঠাসস করে লাগাতেই চমকে উঠল অনু। এই লোকটার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না অনু। বিব্রত হয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল সে।
_________

সকালের ব্রেকফাস্ট করেই অনু হসপিটালে আর রাফাত তার অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। কাকলি সরকার নিজের রুমে পা ছাড়িয়ে বসে ছিলেন। সায়মা কাকলি সরকারের রুমে নিশব্দে ঢুকে বলল,

‘খালামনি কালকে ওই লোকটা কে ছিল বলো তো? তুমি ওই লোকটাকে হায়ার করোনি তো?’

সায়মার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন কাকলি সরকার। সায়মা একটু ভয় পেয়ে শুকনো ঢক গিলল। কাকলি সরকার কঠিন গলায় বলল,

‘তোর কি মনে হয় সায়মা,আমি আমার নিজের মেয়েকে এভাবে বিপদে ফেলবো? আল্লাহ তায়ালাই জানে ওই লোকটা কে ছিল।’

সায়মা বিরক্ত হয়ে কাকলি সরকারের পাশে বসে পড়ল। উৎসাহ নিয়ে কাকলি সরকারকে বলল,

‘আচ্ছা খালামনি, তুমি অনুকে কি করবে আজকে?’

কাকলি সরকারের ঠোটের কোনায় ক্রুর হাসি। সায়মাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠল,

‘একটু অপেক্ষা কর, সময় হলেই বুঝতে পারবি।’
________

দুই হসপিটালের কাজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অনু। আজকে প্রায় রাত একটায় এসে পৌছালো বাড়িতে। প্রচুর খিদে পেয়েছে তার যার কারনে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ালো সে। অনু বাড়িতে ঢুকেই একটা বিষয়ে প্রচুর অবাক হয়েছে আর তা হলো এত রাত হয়ে গেছে কিন্তু রাফাত এখনো বাড়িতে এসে পৌছায়নি। অনু রান্নাঘরে ঘুটুমুটু করছে ঠিক ওই সময়ে একজন মেড এসে বলল,

‘ম্যাম আপনি উপরে যান আমি আপনার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

অনু মেডের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। গ্যাসের চুলার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘একটু তাড়াতাড়ি ঠিক আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে।’

অনু ঘরে অপেক্ষা করছে খাবারের জন্য। কিছুক্ষন পরেই একজন মেড এসে তাকে খাবার দিয়ে গেল। অনু খুশি হয়ে ঢাকনা ওল্টাতেই তার মুখটা মলিন হয়ে গেল। একটা বাটিতে অনেক খানি সুপ আরেকটি বাটিতে শাকপাতা দিয়ে কিছু একটা বানানো যার নাম অনুর অজানা। অনু বুক বাকা করে তাকিয়ে থস্কলো খাবারগুলোর দিকে। মুখ গোমরা করে এক চামচ সুপ মুখে পুরে নিল সে। সুপটাতে কেমন জানি একটু অদ্ভুত বিদঘুটে গন্ধ পেল সে। কিন্তু সব গন্ধকে উপেক্ষা করে সস্পূর্ন সুপটা খেয়ে নিল সে।

অনু খাওয়া শেষ করে বিছানা থেকে উঠতে গিয়েই মাথাটা এক চক্কর দিয়ে উঠল তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে আবার বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল সে। অনেকবার ওঠার চেষ্টা করে উঠে দাড়ালো সে। সবকিছু কেমন যেন ঘলাটে ঘলাটে লাগছে তার কাছে। মনে হচ্ছে আকাশে ভাসছে সে। নিজের শরীরের কোনো ভরই নেই তার। এলোমেলো পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। অকারনেই হাসি পাচ্ছে তার। দরজা খুলতেই রাফাতের সাথে ধাক্কা খেল সে। রাফাতের বুকের উপর ঢলে পড়েছে অনু। রাফাতের হাত অনুর কোমড়ে বিচরন করছে।রাফাত বুঝে উঠতে পারছে না যে অনুর হঠাৎ কি হলো। এমন কেন করছে সে।

চলবে,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here