সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব ১১+১২

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১১
#আফিয়া_আফরিন

হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়ল।অনু পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল মিমি তার দুই হাতে দুইজনের জন্য কফি নিয়ে এসেছে। অনু নিজের চোখের পাওয়ারি চশমাটি খুলে টেবিলে রাখল। তারপর মিমির দিকে ঘুরে বসে পড়ল। মিমি অনুর হাতে কফির মগটা দিয়ে অনুর সামনে বসে পড়ল। অনু কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,

‘কালকে একটা হসপিটালে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম বুঝেছিস?’

‘হুমম, তো কি হলো?’

‘বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় নিয়ে নিয়েছে।’

‘সরকারি না বেসরকারি?’

‘এটা কেমন প্রশ্ন মিমি? অভিয়েসলি বেসরকারি।’

‘ওহ,,ভুলেই গেছিলাম যে তোর সব সার্টিফিকেট তো মেডিকেলে আছে। সরকারি চাকরি কোথা থেকে পাবি!’

‘তোর এই মাথাটা যদি একটু আগে খাটাস তাহলে খুব ভালো হয় বুঝলি?’

মিমির এতক্ষনে অর্ধেক কফি শেষ। আরেকবার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,

‘তুই বোঝ,আমার বোঝার দরকার নেই।’

অনু মিমির দিকে সরু সরু চোখে তাকালো। মিটমিট করে কিছুক্ষন হেসে উত্তর দিল,

‘এই জন্যেই আজ পর্যন্ত প্রেম করতে পারলি না।’

মিমি শ্যেন চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। মিমি অনুর থেকে এক বছরের বড়। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের দিকে ঘুরেও তাকায়নি সে। কারন তার ভালোবাসার মানুষকে আজও খুজে বেড়াচ্ছে সে। মিমির ছয় বছর বয়সে লন্ডনে চলে গেছিল সেই ছেলেটি। মিমি তখন ছোট হলেও অগাধ ভালোবাসায় বাধা পড়েছিল সে।

মিমি গলা খাকারি দিয়ে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,

‘সামলাতে পারবি দুইটা হসপিটালের কাজ।’

অনু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘আমাদের তো শ্বাস নেওয়ারও সময় নেই রে। রোগী দেখতে দেখতেই তো জীবন কাটবে আমাদের।’

অনুর কফি খাওয়া শেষ। মিমি কফির মগ নিয়ে রন্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। অনু, লারা,মিমি আর ইরা এই চারজন মিলে একই বাসায় থাকে। দুই রুম, একটা টয়লেট আর একটা রান্নাঘর নিয়ে বাসাটি গঠিত। অনুর খুব ভালো লাগে এই বাসাটি। সময় পেলেই বাড়িটাকে বিভিন্নভাবে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

__________

চার ঘন্টার জার্নি করে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রাফাত। মাথায় অসহ্য ব্যাথা করছে তার। মাথার অসহ্য ব্যাথা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রাফাত। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকতেই ঘুমের দেশে ঘুমপরী আহ্বান করতে লাগলো তাকে। কিন্তু হঠাৎ কপালে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল রাফাত। রাফাত চোখ খুলতেই ঝাপ্সা দেখতে পেল নিজের চোখে। ভালো করে চোখ মেলে দেখল একটা মেরুন কালারের টপস পড়া মেয়ে বসে আছে তার পাশে। রাফাত ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল।

মেয়েটি রাফাতের এভাবে উঠে বসায় ভ্রু কুচকে তাকালো রাফাতের দিকে। রাফাত বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফাত মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘সায়মা তুমি এখানে?’

মেয়েটি চোখ মুখ কুচকে তাকিয়ে রইল রাফাতের দিকে। তারপর মুখ বাকা করে ন্যাকা কন্ঠে বলে উঠল,

‘কেন রাফাত? তুমি আমার আসায় খুশি হওনি?’

রাফাতের রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। সায়মা নামক পেত্নিকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। নুন্যতম জ্ঞান এই মেয়েটির মধ্যে নেই। রাফাত আজ পর্যন্ত কখনো নেশাদ্রব্যের দিকে হাত বাড়ায়নি।কিন্তু এই মেয়েটি সকল নেশাদ্রব্য যেমন ড্রাগস, সিগারেট,মদ ইত্যাদি ইত্যাদি সেবন করে। সায়মা তার খালামনির ছোট মেয়ে। ছোট বেলা থেকেই আদরে আদরে বড় হয়ে ওয়ান কাইন্ড অফ জেদী এবং অহংকারী হয়েছে সে। রাফাত দাঁত কিটমিট করতে করতে বলল,

‘না তা হবে কেন?

‘তোকে দেখে আমি কেন বিশ্বের কেউ খুশি হবে না শাকচুন্নি।’

বিরবির করে কথাটা বলল রাফাত। সায়মার দিকে রাফাত তাকিয়ে দেখল সায়মা নেশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাফাত খুব ভালোভাবেই জানে যে সায়মা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু রাফাত তাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। রাফাত নিজের মাথায় হাত দিয়ে চোখ মুখ কুচকে সায়মাকে বলল,

‘সায়মা আমার না প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

‘কি বলছো তুমি রাফাত? তোমার মাথা ব্যাথা করছে আমি টিপে দেব?’

এই কথা বলে বিছানায় বসে থাকা অবস্থায় সায়মা একটু এগিয়ে আসে। রাফাত চমকে উঠে আরো পিছিয়ে যায় সায়মার থেকে। সায়মা রাফাতের মাথায় হাত বুলাতে গেলে রাফাত সায়মার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে ওঠে,

‘সায়মা আমার জন্য একটা কাজ করে দিতে পারবে?’

সায়মা তৃপ্তির হাসি দিল। যেন রাফাত তার হাত ধরায় জীবনের সব সুখ পেয়ে গেছে সে। সায়মা রাফাতের হাতের উপর তার আরেক হাত দিয়ে বলল,

‘হুমম,,বলো না? তোমার একটা কাজ কেন হাজারটা কাজ করে দিতে পারবো আমি।’

রাফাত রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,

‘আমার জন্য একটু ভেজিটেবল সুপ বানাতে পারবে। তোমাকেই বানাতে হনে কিন্তু। অন্য কারোর হাতের কিন্তু আমি খাবো না।’

সায়মার মুখ মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল।কারন খুন্তি কি করে নাড়তে হয় সেইটা পর্যন্ত সে জানে না। আর রাফাত কি না তাকে সুপ বানাতে বলছে। সায়মা মুখে জোড় পূর্বক হাসি দিয়ে সম্মতি জানালো। রাফাত ছট করে সায়মার হাত ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সায়মা বসে বসে ভাবতে লাগল কি করবে সে। রাফাত সায়মার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

‘কি হলো সায়মা?তুমি এখনো বসে আছো কেন?তুমি দেখছনা আমি কত কষ্ট পাচ্ছি।যাও তাড়াতাড়ি।’

সায়মা তাড়াতাড়ি করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। সায়মা বেরিয়ে যেতেই রাফাত অট্টহাসিতে মেতে উঠল। হাস্যজ্জল চেহারায় রাফাত বলে উঠল,

‘এবার দেখ কেমন লাগে? আজকে তো তুই নিজের হাত পড়াবিই সায়মা রানি। আর আমার থেকে প্রায় এক ঘন্টার জন্য দূরে থাকবি।’

রাফাত আবার অট্টহাসিতে মেতে উঠল। তারপর গায়ে চাঁদর পেচিয়ে শুয়ে পড়ল সে। এবার সে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়।’

_________

সকালে সূর্যের তীর্যক রশ্নি সোজা গিয়ে অনুর মুখে পড়ে। দূর থেকে অনুর কানে পাখি দের কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে। অনু পিটপিট করে নিজের চোখ খুলল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই লাফিয়ে উঠল সে। কারন তার হসপিটালে আধাঘন্টার ভেতর পৌছাতে হবে। অনু বিছানা থেকে ধপ করে নেমে পড়ল। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রেডি হয়ে নিল সে। অনুর মাথা ঢুকছে না কেউ তাকে আজকে ডেকে কেন দিল না।

মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল বাসায় কেউ নেই।সবাই গেল কোথায়?অনু বাড়ির সবজায়গায় নিজের চোখ বুলিয়ে নিল।কিন্তু কোথাও কাউকে পেল না সে। হঠাৎ পেছন থেকে হৃদয় কাপানোর মতো শব্দ ভেসে আসলো তার কানে। উপর থেকে ছোট ছোট রঙ বেরঙের কাগজের টুকরো উড়ে এসে অনু মাথায় পড়ল। অনু অবাক হয়ে পেছনে তাকাতেই সবাই চিৎকার করে বলে উঠল,

‘Happy birthday.’

অনু বিষ্ফরিত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনুর মনেই ছিল না আজকে তার জন্মদিন। কিছুক্ষন পর অনু নিজেকে স্বাভাবিক করে হেসে দিল। অনু জানতে পারল রাত বারোটার সময় অনুকে অনেক ডাকা হয়েছিল কিন্তু অনু ওঠেনি তাই তারা উইশটাও করতে পারেনি।কিন্তু অনু এতেই অনেক খুশি হয়ে গেছে। ব্যাস্ততার কারনে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে বের হয়ে যেতে হলো। অনুর জন্মদিন ইরা,লারা আর মিমি ভালো কতে সেলিব্রেট করতে পারল না যা তাদের মনটাকে খারাপ করে দিয়েছে।

রাত বারোটা বাজে। অনু যে বেসরকারি হাসপাতালে চাকরী নিয়েছিল সেখানে তাকে নাইট ডিউটি দেওয়া হয়েছে। করিডরের চেয়ারে মন খারাপ করে বসে আছে সে। কারন আজ ইরা, লারা আর মিমি তার জন্য রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করেছিল।কিন্তু রোগীদের চাপে অনু যেতে পারেনি।তাই মন বিষন্ন করে বসে আছে সে।

রাতে হাসপাতালে বেশি কেউ নেই। নিস্তবদ্ধ আর সম্পূর্ণ ফাকা রয়েছে হাসপাতালটি। বেসরকারি হাসপাতাল গুলো সরকারি হাসপাতালের চেয়ে একটু পরিষ্কার হয়। তাই এখানে বেশি একটা নোংরা হয়নি যার কারনে অনু প্রান ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। আচমকা এক নার্স অনুকে ডাকতে ডাকতে তার কাছে চলে আসল। অনু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নার্সের সামনে। নার্সটি হাপাতে হাপাতে বলল,

‘ম্যাম আপনি এখানে? আর আমি আপনাকে সারা হসপিটালে খুজে বেড়াচ্ছি। তনয় স্যার আপনাকে ডাকছেন। একটা পেশেন্ট এসেছে। খুব গুরুতর অবস্থা তাই তনয় স্যার আপনাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি চলুন।’

অনু মাহিরা নামক নার্সটির কথায় এক মুহূর্তও নিজেকে দাঁড়িয়ে রাখতে পারলো না। দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরল সে। এক কথায় জগিং করছে সে। তাড়াতাড়ি সার্জারির ড্রেস পড়ে ওই করিডরের দিকে পা বাড়ালো সে। কিন্তু করিডরের সামনে যেতেই পা থমকে গেল অনুর। অনুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মানুষগুলোকে দেখে যেন অনু আকাশ থেকে পড়েছে। এই ছোট্ট হাসপাতালে এরা কি করছে সেইটাই ভেবে পাচ্ছে না অনু।
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১২
#সুমাইয়া_আফরিন

অনু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মানুষগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই ছোট্ট হাসপাতালে এরা কি করছে এটাই ভেবে পাচ্ছে না অনু।হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের দরজা ফাক করে আরেকজন নার্স অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ম্যাম প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন।’

অনু নিজেকে আর এক মিনিটও দাঁড়িয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত গতিতে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে গেল। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢোকার আগে অনু একবার কাকলি সরকারের মুখটা খেয়াল করল। ভদ্র মহিলার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একেবারে আকাশ থেকে ধপ করে পড়েছেন। বিষ্ফোরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন অনুর দিকে।

অনু অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে দেখল তনয় স্যার সার্জারি করা শুরু করে দিয়েছে।অনু পেশেন্টের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। এবার অনু বুঝতে পারল কার জন্য এবং কেন এসেছে তারা এক হসপিটালে।

বিছানায় শুয়ে আছে একজন ২৩ বছরের মেয়ে। পেটের ব্যাথায় প্রতিনিয়ত চিৎকার করছে সে। অনু মেয়েটাকে দেখে বুঝতে পারল এই মুহুর্তেই বাচ্চা ডেলিভারী করতে হবে। এই যন্ত্রনায় কাতর মেয়েটি আর কেউ নয় রাফাতের মেজো বোন। অনু আর তনয় নামক ডক্টর নিজেদের কাজ শুরু করে দিল।

রাফাতের বোনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। দুর্বল হয়ে পড়েছে সে যা বেবির উপর আঘাত হানতে পারে। অনু অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল কারন প্রেশেন্টের অবস্থা বেগতিক খারাপ। কিন্তু শত জড়তা পেরিয়ে খুব সাবধানে বেবিকে সুস্থ অবস্থায় ডেলিভারী করল অনু ও তনয় স্যার এবং তাদের সাথে থাকা নার্সরা।

দরজার ভেতরে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না রাফাতের পরিবার। কাকলি সরকার চিন্তায় কান্না করে দিয়েছেন। তারপরে আবার অনু এখানে কি করে এলো এটাও বুঝতে পারছে না সে। হাজারো টেনশান নিয়ে পায়চারি করছে সবাই। হঠাৎ দরজার ভেতর থেকে এক নবজাতক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। কাকলি সরকার ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। চেয়ার থেকে উঠে এক পানে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন এই আশায় যে কোন সময় বেবিকে নিয়ে আসবে।

দরজা ঠেস দিয়ে একজন নার্স কোলে সাদা কাপড়ে রাখা এক নবজাতক শিশুকে নিয়ে বাইরে এলো। তারপর কাকলি সরকারের হাতে বেবি দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেলেন। কাকলি সরকার বেবিটাকে দেখে তৃপ্তির হাসি দিলেন। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। বুকের ভেতরের সব খুশি যেন এই চোখের পানির মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে।

প্রায় পনেরো মিনিট পর অনু আর তনয় স্যার বাইরে বেরিয়ে এলেন। অনু নিজের পরোনের মাস্ক খুলে প্রানভরে শ্বাস নিল। এই সার্জিকাল ড্রেস পড়ে প্রচন্ড গরম লাগছে তার। কাকলি সরকার অনুকে দেখে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছেন। তনয় স্যার বের হতেই রাফাত তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তনয় স্যার রাফাতের দিকে ক্লান্ত চক্ষুতে তাকালেন। রাফাত চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন তনয় স্যারের দিকে।

‘আমার বোন কেমন আছে?’

তনয় স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাফাত আর তার পরিবারের সবাই একবার তনয় স্যারের দিকে তাকাচ্ছে একবার অনুর দিকে। রাফাত জিজ্ঞাসু চক্ষুতে তাকিয়ে আছে তনয়ের দিকে। তনয় স্যার শান্ত গলায় বললেন,

‘আপনার বোনের অবস্থা বেশি একটা ভালো নয়। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। রক্তশুন্যতা ও পুষ্টির অভাব দেখা দিয়েছে শরীরে। মায়ের এমন অবস্থা বাচ্চার জন্য একদম ঠিক না। মায়ের এমন অবস্থার জন্য শিশুরও সঠিক বিকাশ হয়নি। মায়ের অনেক খেয়াল রাখতে হবে আপনাদের। প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।’

সবাই অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।তনয় স্যার অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘অনু, আমার ওয়াইফের শরীরটা ভীষন খারাপ। তুমি কি একটু ওনাদের প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে দিতে পারবে?’

অনুর একবার রাফাতের দিকে নজর বুলালো। রাফাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনি একটা গলা খাকারি দিয়ে বলল,

‘অবশ্যই পারবো স্যার।’

তনয় স্যার তৃপ্তির হাসি দিলেন অনুর দিকে। তনয় স্যার ও অনু একই সাথে মেডিকেলে ও এই হাসপাতালে চাকরী করে। তনয় স্যারই অনুকে এই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছিল। তনয় স্যার মধ্যবয়ষ্কের একজন মানুষ। আজকে তার স্ত্রীর অনেক জ্বর এসেছে যার জন্য তাকে আনফরচুনেটলি বাড়িতে যেতে হবে। যার জন্য তিনি অনুকে কাজটি করতে বললেন। কিন্তু এই বিষয়ের ঘোর আপত্তি করলেন কাকলি সরকার। রাগী কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন,

‘মোটেই না।এই মেয়েটা হান্ড্রেড পার্সেন জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ডক্টর পাশ করেছে। আমি চাই না আমার মেয়ের প্রেসক্রাইব এই মেয়েটা করুক।’

রাফাত ভ্রু কুচকে তার মায়ের দিকে তাকালো। তনয় স্যার বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কাকলি সরকারের দিকে। অনু বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে কাকলি সরকারের দিকে। কারন অনু আগে থেকেই জানতো যে কাকলি সরকার এমন কিছু একটাই বলবে। তনয় স্যার রাগী ভঙ্গিতে বললেন,

‘আপনার মাথা ঠিক আছে? অনু একজন বিসিএস ক্যাডার ডক্তর। ঢাকা মেডেকেলে চাকরী করে ও। আর এখানে পার্ট টাইম জব নিয়েছে। আপনি কি করে জানলেন যে নকল ডক্টর? এতই যেহেতু আপনাদের সমস্যা তাহলে এই হাসপাতালে কেন এসেছেন? আমরা আপনার টাকায় কাজ করি না যে আপনার কথা মতো চলবো। এমন তো ভাব দেখাচ্ছেন যেন আপনি একজন ডক্টরের থেকে বেডি জেনে গেছেন। আমরা আপনাদের ট্রিটমেন্ট করি৷ আপনারা আমাদের না বুঝতে পেরেছেন।’

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বললেন তনয় স্যার। বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন তিনি। কাকলি বেগম রাগে গজগজ করতে লাগলেন। অনু তনয় স্যারের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছেন। এই প্রথম তার জন্য কেউ এভাবে স্ট্যান্ড নিয়েছে। তনয় স্যার একদিন বলেছিলেন যে তাকে তার বড় ভাই ভাবতে। আজ বড় ভাইয়ের মতোই কাজ করলেন তিনি।

কথাগুলোতে কাকলি সরকারের ইগো হার্ট হয়েছে তা বুঝতে রাফাতের দেরি হলো না। তাই কাকলি সরকার কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফাত কাকলি সরকারকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলল,

‘মম প্লিজ, এখন আর ঝগড়া বাড়িও না।সবাইকে নিজের হাজবেন্টের মতো কেন মনে করো তুমি? সবাই তোমার হাজবেন্টের মতো নকল উদারতা দেখিয়ে বেড়ায় না।’

কাকলি সরকার নিজের ছেলের কথায় চুপ হয়ে গেলেন। রাফাতের কথাগুলো কাকলি সরকারের কাছে নতুন লাগছে না। যেদিন থেকে রাফাত জানতে পেরেছে তার বাবার কু কর্মের সম্মন্দ্ধে সেদিন থেকে প্রতিনিয়ত সে এইসব বলে যায়।

তনয় স্যার মাথা গরম করে বেরিয়ে গেলেন হসপিটাল থেকে। তিনি এইসব বড়লোকিয়ানা একদম পছন্দ করেন না। যার জন্য অনুর সাথে এমন ব্যাবহার করায় রুখে দাড়ান তিনি। অনু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমার কেবিনে কেউ আসুন।’

কথাটা বলেই অনু নিজের কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল। নিজের কেবিনে ঢুকে রাফাতের ফ্যামিলির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। অনু খেয়াল করল তাদের আসতে একটু দেরি হচ্ছে তাই অনু রাফাতের বোন স্নেহার প্রেসক্রিপশন লিখতে ব্যাস্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর দরজা ঠেস দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়ল। অনু তাকিয়ে দেখল রাফাত ও একটা অচেনা ছেলে ঢুকেছে। অনু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

চলবে,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here