সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -০৯

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#নবম_পর্ব

২৪.
আজ সারাদিনে জাফলং, বিছনাকান্দি সহ আরো টানা দু তিনটে জায়গায় ঘোরাঘুরির পর সন্ধ্যে নামার পরপরই হোটেল ‘নিরভানা‌ ইন’ এ ফিরে আসে সবাই। প্রাচীর দিনটা আজ ভীষণ ভালো কেটেছে। পছন্দের জায়গাগুলোতে ঘোরা, কিছু স্মৃতি সংগ্রহ করা বরাবরের মতোই তার প্রিয়র‌ তালিকায়।
বেশ খানিকক্ষণ রেস্ট নেয়ার পর সবাই একসাথে ডিনার করার জন্য বের হয়েছে। সিলেটের বেশ কিছু জনপ্রিয় খাদ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে লাল সাদা চালের বিরইন ভাত, চিকেন টিক্কা মাসালা, সাত রঙের চা, তুশা শিন্নি‌ ইত্যাদি।
খাবারের টেবিলে একে একে ফিহা-ইশরাক, মিসেস জেবা-আনোয়ার হোসেন, সমুদ্র আর প্রাচী মুখোমুখি হয়ে বসেছে। ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে দিতেই আনোয়ার সাহেব খেয়াল করেন প্রাচীর মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে অন্য ভাবনায় মগ্ন।
– “কি ব্যাপার প্রাচী? কোথায় হারিয়ে গেলি? নে খাওয়া শুরু কর!”
আনোয়ার সাহেবের কথায় নড়েচড়ে উঠে প্রাচী।
– “কই কিছু না তো। এইতো শুরু করছি বাবা।”
বলেই খাওয়ায় মনোযোগ দেয় প্রাচী। খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময় একজন ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লাগতেই হাতে থাকা ট্রে থেকে ওয়াইনের গ্লাস গায়ের উপর পড়তেই দু কদম পেছনে সরে যায় প্রাচী।
– “আ’ম সো সরি ম্যাম, আমি খেয়াল করি নি। আ’ম সো সরি!”
ভড়কে গিয়ে বলে উঠে ওয়েটার‌।
– “ইটস্ ওকে, আপনাকে সরি বলতে হবে না।”
– “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম, আপনি প্লিজ ওয়াশরুমে‌ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। ওয়াশরুমটা ম্যাম এদিকে।”
ওয়েটার হাত দিয়ে ইশারা করতেই প্রাচী বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের‌ দিকে।

– “এই জেবা, প্রাচী কোথায়? প্রাচীকে দেখতে পারছি না তো।”
আশপাশে তাকিয়ে বলে উঠেন আনোয়ার সাহেব।
– “হবে হয়তো আশপাশে কোথাও। হতে পারে ওয়াশরুমের দিকে গিয়েছে।”
জেবা বেগমের কথায় ছোট করে প্রত্যুত্তরে ওওহ্ বলে উঠেন আনোয়ার সাহেব।

ওয়াশরুমের‌ আয়নাতে নিজের ড্রেস পরিষ্কার করায় ব্যস্ত প্রাচী। কিন্তু পরক্ষণেই হুট করে লাইট অফ হয়ে যাওয়ায় বেশ ভড়কে যায় সে। হাতড়ে হাতড়ে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে আশপাশে তাকাবে এমন সময় কেউ মুখ চেপে ধরাতে ভয় গ্রাস করে প্রাচীকে। মুখ চেপে ধরায় ঠিকমতো মুখ দিয়ে আওয়াজ ও বের হচ্ছে না। অজানা আতঙ্ক বাসা বাঁধতেই নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রাচী কিন্তু একজন পুরুষালী দেহের শক্তির কাছে তা কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলে না।
লোকটি দু হাত দিয়ে প্রাচীকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই ভয়ে চোখ মুখ খিচে‌ নেয় প্রাচী; এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটে যাবে এই আশংকায়।
– “মেহু পাখি?”
শীতল কন্ঠে বলা কথা শুনে ঝট করে আপনাআপনিই চোখ খুলে যায় প্রাচীর। বিস্ময়তার দরুন নড়াচড়াও বন্ধ করে দিয়েছে সে ইতোমধ্যে।
ঘোর লাগানো সে কন্ঠ; যেন কোনো‌ তীব্র নেশা মেশানো‌। প্রাচীর দৃষ্টি তার সামনে থাকা ব্যক্তিটির চোখের দিকে স্থির। অন্ধকারের মাঝেও আবছা আলোয় চোখ দুটো বোঝা যাচ্ছে। লোকটি খানিকটা প্রাচীর দিকে ঝুঁকে পড়তেই টনক নড়ে ওঠে প্রাচীর।
– “ক্,কে আ,আপ্‌,আপনি?”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনোমতে জিজ্ঞেস করে প্রাচী।
– “তোমার সেই অজানা আগন্তুক যাকে দেখার জন্য এতদিন ব্যাকুল হয়ে ছিলে; যে তোমার নেশায় পুরোপুরি ভাবে আসক্ত। তোমার সাইকো লাভার!”
কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কথা কর্ণপাত হতেই চোখ দুটো আবেশে বুজে নেয় প্রাচী। এই ঘোর লাগানো কন্ঠ যেন খুব চেনা পরিচিত। মনে হচ্ছে এর আগেও কখনো শুনেছে সে কিন্তু সেটাও বহু পূর্বে। হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসতেই আশপাশের আলো জ্বেলে উঠে। সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে তাকায় প্রাচী। চারদিকে তাকাতেই খেয়াল করে ওয়াশরুমে‌ সে ছাড়া আর কেউ নেই।
– “এখানেই তো ছিল; এক মিনিটেই কোথায় গায়েব হয়ে গেল?”
খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলে উঠে প্রাচী।

২৫.
হোটেল রুমে একাধারে পায়চারি করে যাচ্ছে প্রাচী। মাথায় দুশ্চিন্তা এক আকাশ পরিমাণ।

– “না, যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটাও সহজ নয়। কে হতে পারে এই লোক; তার সাথে আমারই বা কি সম্পর্ক? আর সেই কন্ঠ? সেই কন্ঠ আমি কোথাও শুনেছি। কিন্তু কোথায়, কবে?
একবার কি ভাইয়ার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করব? না, না অযথা টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। তোকেই কিছু একটা করতে হবে প্রাচী যাতে করে লোকটা তোর সামনে একাই বের হয়ে আসে। কিন্তু করব টা কি?”
বিড়বিড় করতে করতেই রুম থেকে সোজা ব্যালকনিতে চলে যায় প্রাচী। প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে।
কিন্তু পরক্ষণেই পাশের রুম থেকে ভেসে আসা গিটারের সুর কানে পৌঁছাতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। তার পাশের রুমটা তো সমুদ্রের। তবে কি সমুদ্র এখনো ঘুমায়নি? ঘড়ির দিকে তাকায় প্রাচী। রাত ১:০০ টা বাজে। ব্যালকনির শেষ প্রান্তে গিয়ে দাড়াতেই গিটারের সুর তীব্র ও স্পষ্ট হতে থাকে প্রাচীর কাছে।

“স্বপ্নের বালুকায় কেউ কি পা লুকায়;
যদি না আসে ভেজা দিন!
ইচ্ছের হিমালয় হয় না কভু ক্ষয়;
হৃদয়ে থাকে অমলিন!
কিছু স্বপ্ন, কিছু ইচ্ছে এই আমায় টেনে নিচ্ছে
তোমার কাছে বারবার!

কেউ না জানুক, আমি তো জানি
আমি তোমার….
কেউ না জানুক, তুমি তো জানো
তুমি আমার……(২)
…………………………….
…………………………….
সব লেনাদেনা হয়না কভু শেষ
আজীবন কিছু কিছুর থেকে যায় রেশ(২)
ভালোবাসা ফুরায় না,
প্রেম কভু হারায় না;
অনুভবে থাকে যার যার!

কেউ না জানুক, আমি তো জানি
আমি তোমার……
কেউ না জানুক, তুমি তো জানো
তুমি আমার…….(২)”
( বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)

এক ধ্যানে গানের মাঝে প্রাচী ঠিক এতোটাই ডুবে ছিল যে কখন যে নিজের অজান্তেই ব্যালকনিতে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই তার‌।
গিটার টাকে ঠিক জায়গায় রেখে উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র। ব্যালকনি দিয়ে শো শো বাতাস রুমে ঢোকায় বেশ ঠান্ডা লাগছে। তাছাড়াও রাত এখন অনেক গভীর। ব্যালকনির খোলা দরজা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই অপর পাশে ব্যালকনিতে নজর পড়ে সমুদ্রের। ঘুমন্ত প্রাচীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র; যেন এই হাসির রহস্য ঠিক তার মতোই অজানা।

২৬.
ভোরের আলো ফোটার পর পরই পাখির কিচিরমিচির শব্দের রোল পড়ে গিয়েছে। তাছাড়া ভোরের সদ্য জমা শিশির ব্যালকনির গ্রিলে নিজেদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। শরীরে ঠান্ডা অনুভূত হতেই পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় প্রাচী‌। আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে বর্তমানে কোথায় আছে। ব্যালকনিতে নিজেকে আবিষ্কার করতেই গত রাতের কথা মনে পড়ে যায় তার। এমনভাবে যদি আরো কিছুক্ষণ থাকা যায় তাহলে নিশ্চিত শরীরে ঠান্ডা লেগে যাবে তাই দ্রুত বসা থেকে উঠে পড়ে প্রাচী।

ডিবির হাওর। নামটা অদ্ভুত শোনালেও জায়গাটা দারুন সুন্দর। সৌন্দর্যের লীলাভূমি মেঘালয়ের পাদদেশে ঝর্ণা বেষ্টিত ডিবির হাওর অনেকের কাছেই ‘লাল শাপলার বিল’ নামে পরিচিত। পুরোটা হাওর জুড়ে ছোট বড় লাল শাপলা দিয়ে পরিপূর্ণ। আর এর মাঝ বেয়েই নৌকায় করে ভ্রমণ করতে হয়। খুব ভোরে আসায় সেখানে অনেকগুলোই খালি নৌকা দেখতে পায় সবাই। প্রতিটি নৌকায় সারি সারি করে শাপলা বেঁধে রাখা হয়েছে। পরপর তিনটে নৌকায় গিয়ে সবাই বসে পড়তেই মাঝিও তার নৌকা ছেড়ে দেয় অদূরের উদ্দেশ্যে।

যত দূরে নৌকা যাচ্ছে ততই এই ডিবির হাওরের সৌন্দর্য আরো গভীর হচ্ছে। চারপাশে ফোঁটা লাল লাল শাপলা গুলো দেখে প্রাচী পানি থেকে সদ্য ফোঁটা দু চারটে ফুল তুলে নেয়। অপরদিকে সমুদ্র অন্যপাশে বসে সেসব মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত। এবারের বন্দি করা মুহুর্তগুলো সমুদ্রের কাছে একটু বেশিই স্পেশাল‌।

ক্যান্টিনে এক কর্ণারে মনমরা হয়ে বসে আছে হৃদিতা‌। একে তো প্রাচী নেই। তার উপর আকাশও দুটো ক্লাস করে বাঙ্ক দিয়ে চলে গিয়েছে। এতে যেন বিরক্তি তার আরো দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। একমনে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিল তখনই ফোনের স্ক্রিনে একটা আননোন নাম্বার ভেসে ওঠে। খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই অপর পাশ থেকে বলা কথা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় হৃদিতার‌। চোখে মুখে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর ভয় স্পষ্ট।…..

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here