#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৪]
অপু সুপ্তের শেষ কথাটা ঠিক শুনতে পেল না। বলল,
“কি বললেন?”
সুপ্ত মুখে ক্ষীণ হাসি ধরে রেখেছে। অপুর জিজ্ঞাসু চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলল,
“বলতে তো চাই-ই, তুমিই শুনতে চাও না।”
উত্তরে অপুর মুখটায় আঁধার নামল। রিক্সাওয়ালা মামা তাদের কথায় দাঁত ছড়িয়ে হাসছে। অপু তা খেয়াল করে বিব্রত হলো। ভাড়া মিটিয়ে, খানাখন্দ এড়িয়ে ছুটে গেল ভার্সিটি অভিমুখে। সুপ্ত রিক্সাওয়ালা মামার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে ঠোঁট নাড়ালো,
“মানাবে?”
মামা একটি নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বোঝালো খাপেখাপ। সুপ্ত মামার উদ্দেশ্যে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে কলার ঝাকালো। চোখে সানগ্লাস গুজে ছুটে গেল অপরাজিতার পেছনে।
অপু পারলে পায়ের তলায় দুটি চাকা লাগিয়ে নেয়। জনাকীর্ণ রাস্তা বলে দৌড় দিতে পারছে না। কিন্তু মন তাই করতে চাইছে। সুপ্ত দৌড়ে এসে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। অপু বড়ো বড়ো পা ফেলেও সুপ্তের চেয়ে জোরে হাঁটতে পারছে না। রাগে ধুপধাপ পা ফেলছে। সুপ্ত তা নিরবে উপভোগ করছে। বিশেষ করে অপুর দুই ভ্রু সন্ধিক্ষণে। ঘন পাপড়ির মাঝে সঞ্চিত বিন্দু বিন্দু শ্বেত জলের মাঝে যেন তার মুখশ্রীর সকল মায়া জমে আছে। সুপ্তের মনের গহীন হতে কোনো অনবদমিত ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছে কী? ভাবনায় লাগাম টানতে সে খুক খুক করে কেশে উঠল। এক পলকের জন্য অপুর মনোযোগ রাস্তা থেকে সরে পাশের লম্বাটে গড়নের বলিষ্ঠ লোকটির দিকে গেল। সুপ্ত বলে উঠল,
“শোনো, তুমি কখনো ভ্রু প্লাগ করবে না।”
অপু এবার পূর্ণ মনোযোগে তাকালো।
“কেন?”
“বেশি কিছু বলতে গেলে পরে দেখা যাবে লজ্জায় কাঁদতে বসেছো। শুধু জেনে রাখো ওটা আমার দুর্বলতা। কাজেই ভ্রু প্লাগ করবে না।”
“হুকুম করছেন?”
“উঁহু, আবদার করছি।”
“কেন রাখব?”
“কারণ তুমি ভালো মেয়ে। আর ভালো মেয়েরা কথা শোনে।”
“ভালো মেয়েরা ভালো মানুষের কথা শোনে, বাজে ছেলেদের নয়।”
“বাজে ছেলে! থ্যাংকস ফর দিস বিউটিফুল নিকনেইম।”
অপু থেমে গেল। বিরক্তিতে চ কারান্ত শব্দ ছিটকে এলো তার মুখ থেকে। রা গে হাত মুঠ করে ফেলল। ইচ্ছে করছে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ড্রেনে ফেলে দিতে। অপু শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রু ক্ষ স্বরে বলল,
“আপনি কী জানেন আপনি ব খাটেপনা করছেন?”
“করছি না কি?”
“এখনো বুঝতে পারছেন না? একদিনের সামান্য একটা ঘটনার পর থেকে পিছু নিয়েছেন। এখন তো মনে হচ্ছে আপনাকে হেল্প করাই সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল।”
সুপ্ত বিজ্ঞের মতো মাথা দোলায়। সম্মতি দিয়ে বলে,
“আসলেই ভুল ছিল। সেদিন তুমি আহ ত দেহের আমিটাকে শুশ্রূষা করতে গিয়ে অন্তরের আমিটাকে আহ ত করে দিয়েছো। এ ক্ষ তের দায় তোমার। প্রেমানলে জ্ব লতে থাকা হৃদয়টাকে প্রশমিত করতেই বোধহয় ছুটে আসি। বিনিময়ে তুমি আরেকটু বা রুদ ছুড়ে দাও। কে জানে, একদিন হয়তো এ আ গুনের আঁচ তোমার অন্তরেও লাগবে। আমি কিন্তু তখন বা-রুদ ছুড়ে দেব না। অন্তরের অন্তঃস্থল নিংড়ে প্রণয়ের কলস উপুর করে দেব।”
কথাটা শেষ করে সুপ্ত সানগ্লাস নাকের ওপর নামিয়ে ভ্রু নাচালো। অপু জ্ব লে উঠল।
“অসহ্য!” শব্দটা বিপরীতের ব্যক্তিটির প্রতি নিক্ষেপ করে গটগটিয়ে চলে গেল। সুপ্ত ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। নিজেই নিজেকে শাসায়,
“তুই বড্ড বে হায়া হয়ে যাচ্ছিস সুপ্ত। এ কি অধঃপতন তোর?”
এ অধঃপতনের দায় সে নিজের কাঁধে নেয়নি অবশ্য। বরং সে মনে মনে শতভাগ তার অপরাজিতাকেই দায়ী করে। প্রথম দিন থেকেই। প্রাইভেট কারের সঙ্গে সংঘর্ষে সুপ্ত যখন বাইক সমেত হাইওয়েতে ছিটকে পড়েছে তখন ক্ষীণ এক জোনাকির মতো তার চোখের তারায় সেই মুখটা ভেসে উঠেছিল। যে কিনা অশেষ মায়ায় তার র ক্তমাখা দেহটা আগলে, মাথা কোলে তুলে নিয়েছিল। সমানে সাহায্য চেয়ে চ্যাচাচ্ছিল। অপরিচিত, আহ ত মানুষটার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। সুপ্ত সে মায়ামাখা কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতেই মেয়েটির কোলে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরে সেই জোনাকির মতো পিটপিট করা ক্ষীণ মুখটা এক আকাশ জ্যোৎস্না সমেত তার দৃষ্টিতে গেঁথে যায়। মেয়েটি অতি পরিচিত মানুষের মতোই জিজ্ঞেস করছিল,
“এখন কেমন লাগছে?”
মেয়েটি তখনো সুপ্তের হাত ধরে ছিল। চিনচিনে য ন্ত্র ণার সঙ্গে অদ্ভুত এক মিহি ও মোলায়েম আবেশ ছেয়ে গেছিল হৃদয়ে। চোখে ছিল কোমলতা।
“ভালো।”
সুপ্ত ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিতেই মেয়েটি একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে হাত সরিয়ে নিল। সুপ্তের মনে হলো তার হাতের মাঝে বন্দি পেলব মিষ্টিটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেল। মনের কোনো গহীনে ইচ্ছে হলো বলতে,
“আমি ভালো নেই, আরেকটু ছুঁয়ে থাকবেন প্লিজ!”
এমন ভাবনায় সুপ্ত মনে মনে নিজেকে গা লম ন্দও করেছিল বটে। ধ্যান ভাঙিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,
“আপনার বাড়িতে যোগাযোগ করার কোনো নম্বর বা ঠিকানা দিন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আপনাকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে আমি ফিরব।”
সুপ্তের তখন কি মন খারাপই না হলো। চেনা নেই, জানা নেই একটা মেয়ের কোমল স্বর, মমতা তাকে কেমন ঘোরের মাঝে নিয়ে যাচ্ছিল। যে ঘোর থেকে বেরুতে মন চাইছিল না। সেই ঘোরের নাম অপরাজিতা। অপরাজিতা ফুলের ঘ্রাণ না থাকলেও র ক্ত মাং সের অপরাজিতা তাকে অদ্ভুত সুগন্ধিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। বিষন্ন বিকেল যখন সন্ধ্যার আলিঙ্গনে বন্দি তখন মেয়েটি তাকে হাসপাতালে রেখে চলে গেল। সুপ্তকে বোধহয় অসুস্থতার থেকেও অপরাজিতার প্রস্থান বেদনা বেশি কাতর করে দিয়েছিল। কে বলেছিল অপরিচিত পুরুষের প্রতি এত কোমলতা দেখানোর? কে বলেছিল সযত্নে হাত আঁকড়ে ধরতে? ধরবেই যখন ছাড়বে কেন? বাড়ি ফিরেও শান্তি পায়নি সুপ্ত। বাবার নজরবন্দি হয়েও সে মেয়েটির খোঁজ চালিয়েছে। পেয়েছেও। এরপর… সুপ্তের নিত্যসঙ্গী হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসে গুড়ের চায়ের সঙ্গে প্রতিক্ষার স্বাদ নেওয়া। অন্যদিকে অপরাজিতার সেই কোমল, মমতাময়ী স্বর হয়েছে তী ক্ষ্ণ থেকেও ক র্কশ। সুপ্তের তা মন্দ লাগে না। তার মনে হয় মেয়েটি কণ্ঠ হতে তার জন্য যাই নিসৃত হবে তাই মধুর। আচ্ছা প্রেমে পড়ে কি তার শব্দের তারতম্য বোঝার ক্ষমতা লোপ পেল?
সুপ্ত ভাবনা থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখল। এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। সে বাইকে উঠে বসল। প্রেমযু দ্ধে আরেকধাপ এগোতে এখন তার গন্তব্য স্কুলে।
_______________
ঠিক বারোটায় শিমুলের স্কুল ছুটি হলো। সুর্যটাও তখন ঠিক মস্তকের ওপর উঠে নৃত্য করছে। গাছের পাতারা হরতাল ডেকেছে বুঝি। এক ফোঁটা বাতাসও নেই। শিমুল ধাক্কাধাক্কি করে গেইটের বাইরে এসে দাঁড়ালো। তার ইউনিফর্ম এর বুকের কাছটায় হলদেটে দাগটা সূর্যের আলোয় প্রকট হয়ে উঠেছে। সে চশমা নাকের ওপর ঠেলে এদিক-ওদিক তাকাল। কাঙ্ক্ষিত অবয়ব দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় খানিক ব্যথিতও হলো। পেটে হাত বুলিয়ে কয়েক পা এগোতেই বাইকের হর্ন বাজলো পরপর তিনবার। শিমুল লাফিয়ে পেছনে ফিরল। সুপ্ত বাইক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল ছুটে তার সামনে গিয়ে বলল,
“তোমাকেই খুঁজছিলাম।”
সুপ্ত হেসে পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরি বের করে এগিয়ে দিলো তার দিকে৷ শিমুল ছো মে রে নিল সেটা। দাঁতের সাহায্যে প্যাকেট ছিড়ে খাওয়াও শুরু করে দিলো। সুপ্ত বলল,
“কাল আসিসনি কেন?”
“ফেইল করেছি বলে বাবা চ ড় মে রে চশমা ভেঙে দিয়েছিল। তাই আসিনি।”
“কি সাংঘাতিক! চড় মে রে দিলো?”
শিমুল নিষ্পাপ মুখ করে মাথা দোলায়। চকলেট ততক্ষণে তার ঠোঁটের আশেপাশে লেগে গেছে। বলল,
“আগে একবার ভুল করে একটা কাজের ফাইলে পানি ফেলেছিলাম বলে আমাকে বেত দিয়ে পি টি য়েছিল। এবার শুধু একটা চ ড় মে রেছে। রাতে খেতেও দেয়নি। কিন্তু আপু আমাকে লুকিয়ে খাইয়ে দিয়েছে।”
সুপ্ত বিড়বিড় করল,
“আই সী! শ্বশুর ব্যাটা তো ভালোই ডে ঞ্জারাস! তার মেয়েটা না জানি কত জ্বা লায়।”
শিমুল ক্যাডবেরি খাওয়া শেষে সুপ্তের শার্ট টেনে ধরল।
“আমি বার্গার খাব।”
“চুপ শা লা, এত খাই খাই করিস কেন? শ্বশুরের মেয়েটা খাইয়ে খাইয়ে এমনিতেই তোকে মিনি হাতি বানিয়ে ফেলেছে। আগে বল কাজ করেছিস কিনা?”
“করলেও বলব না। তুমি আমাকে ব কা দিয়েছো।”
সুপ্ত নিভে গেল। শিমুলের ভারী দেহটা জাপটে বাইকের ওপর তুলে বসিয়ে হাঁফ ছেড়ে বলল,
“না না বাপ, তুই তো তুলোর চেয়েও পাতলা। আঙুলের ডগায় তুলে ঘোরানো যাবে। বার্গার, পেস্ট্রি, চাউমিন, আইসক্রিম সব খাবি। আমি খাওয়াব। আগে বল মুখস্ত করেছিস কিনা। দেখি তোর ব্রেইন কতটা শার্প। নাকি আসলেই তুই ফেলটুস।”
শিমুল ভোজনরসিক। খাবারের নাম শুনলেই মুখে পানি চলে আসে। আর তা যদি প্রিয় সব মেনু তাহলে তো কথাই নেই। সুপ্তের সঙ্গে তার ডিল হয়েছিল সে যদি বাড়ির সবার ফোন নাম্বার মুখস্ত বলতে পারে সুপ্ত তাকে যা যা পছন্দ খাওয়াবে। এমনিতেও প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর কিছু না কিছু তার জন্য এনে দেবেই। বিনিময়ে তার বাড়ির কথা শুনতে চাইবে। আপু সঙ্গে কিভাবে সে দিন কাটায়, আপু কি কি করে তা শুনবে। শিমুলও খেতে খেতে ছেলেমানুষি আলাপ নিয়ে বসে। কিন্তু সুপ্তের শেষ কথায় শিমুল রে গে গেল। সে যে ফেলটুস নয়, তার ব্রেইন শার্প তা প্রমাণ করতে হড়বড় করে সবগুলো নাম্বার জানিয়ে দিলো। সুপ্ত কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটা টুকে নিয়ে বিজয়ের হাসি হাসল।
_________________
দুপুরের পর থেকে সুপ্ত বাড়িতেই আছে। ঘুরে ঘুরে বাগানের ফুলগুলো দেখছে। ফারিহা তাকে বাগানে ঘুরঘুর করতে দেখে বলল,
“রোদের মাঝে কী করছো?”
সুপ্ত পালটা প্রশ্ন করল,
” বাগানে অপরাজিতা ফুল নেই কেন ফুপি?”
“কেউ তো বলেনি, তাই লাগানো হয়নি। হঠাৎ ফুলের খোঁজ?”
সুপ্ত গম্ভীর হয়ে বলল,
“বাগানের সব ফুলে ফেলে দাও, গেইট থেকে ছাদ অবধি শুধু অপরাজিতা ফুলের গাছ থাকবে।”
ফারিহা অবাক হয়ে বলল,
“সে কি! বাকি ফুলেরা কি দোষ করল? অপরাজিতাই কেন থাকবে?”
“আমি ঠিক করেছি এখন থেকে প্রতিদিন অপরাজিতা ফুলের চা খাব। আমার সঙ্গে তোমরা সবাই খাবে। কাজের লোকও বাদ যাবে না। এর স্বাস্থ্য উপকারীতা অনেক। গুগলে জেনে নিয়ো। এখন থেকে সিলেটের চা পাতা বাদ। সবাই অপরাজিতা ফুল দেখবে আর খাবে। ভাবছি বাড়িটার রঙটাও বদলে ফেলব। পাঞ্জাবি, শার্ট, বাইকে অপরাজিতা ফুলের লোগো বসাব।”
সুপ্ত আপন মনে বলতে বলতে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ফারিহা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ছেলের হলোটা কি?
সুপ্ত সেদিনই অপরাজিতা ফুল জোগাড় করে এনে নিজের হাতে সবার জন্য চা বানালো। কিছুটা ফ্লাস্কে ভরে নিল ফরিদ মিয়াকে দেবে বলে। বাবার রুমের বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে রঙিন চায়ে চুমুক দিতেই সুপ্ত অপরাজিতার ঘোর ছেড়ে ছিটকে মাটিতে পড়ল যেন। দ্বিতীয়বার চুমুক দেওয়ার সাধ জাগল না। সে ফোন বের করে ম্যাসেজ টাইপ করল,
“তুমি ছাড়া সকল অপরাজিতা গন্ধহীন। তুমি ছাড়া সকল অপরাজিতার স্বাদ বিদঘুটে। তোমার কাছে সকল অপরাজিতারা মলিন। এরপরেও কি সন্দেহ থাকে তুমি কতটা মূল্যবান?”
চলবে…#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৫]
ম্যাসেজটা দেখে অপু কিছুক্ষণ থম ধরে রইল। কিছুদিন আগেই তো নতুন সিমটা তুলল সে। লোকটার হাত থেকে এই নম্বরটাও রেহাই পেল না! কিভাবে যোগাড় করল? অপু উত্তর না মেলাতে পেরে অতি-ষ্ট হয়ে ওঠে। আবার সিম বদলাতে গেলে বাবা যদি স-ন্দেহ করে? মা যদি উল্টোপাল্টা ভাবে? এদিকে সুপ্তের ব্যাপারটা বলতেও তীব্র অস্বস্তি হয়।
“একেই বলে উভয়সং-কট।” বিড়বিড় করে অপু ম্যাসেজটা আবার পড়ল। যেন অক্ষরগুলোতেই এক লাগামছাড়া লোকের পা-গলামির স্পর্শ পেল। অপু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শব্দগুচ্ছের দিকে। এমন নয় সে সুপ্তকে ঘৃ-ণা করে। কিন্তু ভালোও বাসে না। বরং দিনকে দিন সুপ্তের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে যুগপৎ ভয় ও বিরক্তি ঘিরে ধরছে অন্তরে। অপু ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বেজে গেছে। দিনের বুকে রোদের আলো প্রায় ম্লান হয়ে এসেছে। অপু কৌতুহলবশত এগিয়ে গেল জানালার কাছে। তিরতির করে বয়ে চলা বাতাসে গোলাপি পর্দাটা দুলছে। সে দেয়ালের আড়াল থেকে অতি সন্তর্পণে উঁকি দিলো বাইরে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছিটকে সরে এলো। নিষি-দ্ধ জিনিসে আকর্ষণ আসছে কী? মনে মনে নিজেকে শাসালো সে,
“ছিহ! অপু ছিহ! তুই তোর কনসেন্ট্রেশন থেকে সরে যাচ্ছিস। এসবে কখনো পাত্তা দিবি না।”
বড়ো বড়ো দম ফেলে অপু রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
_____________
সুপ্ত মিটমিটিয়ে হাসছে। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে পা দোলাচ্ছে অনবরত। ফরিদ মিয়া সেই হাসিতে আজ বখশিশের গন্ধ পাচ্ছে না। প্রায় বিশ মিনিট হলো সুপ্ত তার দোকানে এসেছে। এখনো অবধি চা বা সিগারেট কোনোটাই চায়নি। বরং সঙ্গে একটি ফ্লাস্ক নিয়ে এসেছে। ফরিদ মিয়া সেদিকে আত-ঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। সুপ্ত কি তার হাতের চা খাবে না? এমন খদ্দের হাতছাড়া হওয়া আর বন্যায় শেষ সম্বল ভেসে যাওয়া ফরিদের কাছে অনেকটা একইরকম। কেঁদে ফেলবে এমন মুখভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“আমার চা কি দো-ষ করল ভাইজান? পাত্তিতে সমস্যা নাকি গুড়ে গন্ধ কয়?”
“দো-ষ করবে কেন? বলো জাদু করেছে।”
“তইলে আইজ বিড়ি-চা চাইলেন না ক্যান? আর বাড়িত্তে চা আনছেন ক্যান?”
“ওহহ এটা? তোমাকে টেস্ট করাতে এনেছি। আমার হাতে বানানো স্পেশাল এন্ড কালারফুল অপরাজিতা টি। একটা কাপ দাও দেখি।”
ফরিদের বুকের ভার নেমে গেল। সে গদগদ হয়ে একটা স্বচ্ছ কাচের কাপ এগিয়ে দিলো। বলল,
“ভাবীর নামে চা-ও আছে? কোম্পানি কি আপনে খুলছেন?”
“স্টু পিড! ভাবী ভাবী করতে করতে অপরাজিতা যে একটি ফুলের নাম হয় তাও ভুলে গেছ! এটা ফুলের তৈরি চা।”
ফরিদ লজ্জিত ভঙ্গিতে কান চুলকায়। সুপ্ত ফ্লাস্কের উষ্ণ তরলটা তাতে ঢালল। কাপ এগিয়ে দিলো ফরিদের দিকে। চায়ের নীলচে রঙটা দেখে ফরিদের মনটা নেচে ওঠে। বড়োলোকি চায়ের কত যে রঙ! সবুজ চা, নীল চা। আদুরী খেতে পেলে খুব খুশি হবে। প্রেমটা গাঢ় হবে। আদুরীর নামটা মস্তিষ্কে বেজে উঠতেই ফরিদ লজ্জা পেয়ে বলল,
“ভাইজানে কি এক কাপ চা-ই আনছেন?”
“নাহ, আরো দু-কাপ মতো আছে এতে।”
ফরিদ মাড়ি বের ক্যাবলা হাসি দিয়ে বলল,
“একটা আবদার করি ভাইজান?”
“বলেই ফেলো।”
“আমি এই রঙিন পানি আরেকজনরে খাওয়াইতে চাই।”
সুপ্ত বাকিটা শোনার আগেই সম্পূর্ণ ফ্লাস্ক এগিয়ে দিলো। যেন কুলিকে বলা হচ্ছে ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে। সে বলল,
“এই নাও, সবটা তোমার। চা পানের উপহার স্বরূপ ফ্লাস্কটা দিলাম। অনেক উপকারিতা এই চায়ে। শরীর ভালো রাখতে নিয়মিত খাওয়া উচিৎ।”
ফরিদ ফ্লাস্কটা নিল। এটাও সে আদুরীকে উপহার দেবে ভেবে নিল। নিজের কাপের চা টুকু ঢেলে রেখে দিলো আদুরীর পাশে বসে খাওয়ার জন্য। সুপ্তের ফুরফুরে মেজাজ দেখে আরেকটু উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এই পানি কেমনে বানায় ভাইজান? তইলে আমার দোকানেও বেচতাম।”
সুপ্ত ঠোঁটে কোণা চোখা করে হেসে বলল,
“একদিন খাও, অনুভব করো এর মহিমান্বিত স্বাদ। এরপরও বিক্রির চিন্তা থাকলে আমি নিজে স্পেশালি ট্রেইনড করব তোমায়।”
ফরিদ মাথা কাত করে নতুন খদ্দের নিয়ে মেতে উঠল। সুপ্ত আজ চা কিংবা সিগারেট কোনোটারই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। ওই যে পর্দার ফাঁক গলে এক পলকের জন্য কেউ তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়ে গেল। এসেই এমন কিছুর সাক্ষাত পাবে সুপ্ত কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি। একটা ম্যাসেজের এত গুণ! তাহলে তো রোজ রোজই ম্যাসেজ করবে সে।
সুপ্ত জল্পনাকল্পনায় মশগুল রইল অনেকটা সময়। হঠাৎ খেয়াল করল অপরাজিতা নিচে নেমে এসেছে। তাকে দেখে সুপ্তের হৃদপিণ্ডটা তরাক করে লাফিয়ে ওঠে। এ মেয়ের আজ হলো কী? একবার পর্দার আড়াল হতে, আবার একেবারে নিচেই নেমে এলো? সুপ্ত তাকে গেইটের সামনে দেখে নিজেও এগিয়ে গেল কয়েক পা। তখনই দেখল অপরাজিতা সিএনজি থেকে নামা একটি নারীকে জড়িয়ে ধরেছে। অপরাজিতা চোরা চোখে সুপ্তকে দেখে মেয়েটিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। সঙ্গে আসা পুরুষটা অবশ্য গেল না। লোকটা এগিয়ে গেল ফরিদ মিয়ার দোকানের দিকে।
সুপ্ত ভ্রু জোড়া একত্র করে লোকটালে পর্যবেক্ষণ করে। স্বভাবে একটা চো-র চো-র ব্যাপার আছে। মাটিতে তাকিয়ে হাঁটে। আঁড়চোখে এদিক ওদিকে তাকায়। তবে পোশাকে নিপাট ভদ্রলোক গোছের মনে হয়। লোকটি ফরিদ মিয়ার থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিল। দোকানের একপাশে সরে গিয়ে জোরে জোরে টেনে শেষ করল। এরপর একটা চকলেট মুখে পুড়ে চেক করল দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কিনা। সুপ্ত হাবভাব দেখেই বুঝে গেল লোকটি লুকিয়ে সিগারেট খায়। কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি শিমুলদের আত্মীয়?”
সুপ্ত সতর্ক হয়ে অপরাজিতার নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকল। লোকটি শিমুলের নাম শুনে যারপরনাই চমকেছে। যেন কাছের মানুষের কাছে সিগারেট খেয়ে ধরা পড়েছে। সুপ্ত যেন সবকিছু আইরিড করতে পারল। ফরিদের কাছ থেকে আরেকটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত গলায় বলল,
“ঘাবড়াবেন না। একটা টান দিন।”
লোকটি সিগারেট নিল। নাম তার আজিজ। শিমুলের বড়োবোন বেলীর স্বামী। শ্বশুর বাড়িতে ইমেজ চকচকে রাখার চেষ্টায় লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সুপ্ত প্রায় তাকে ভায়রাভাই ডেকে ফেলেছিল। জিভ সামলে কথা ঘোরালো,
“ভাই রে ভাই, এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে এমন লুকোছাপার কিছু নেই। সিগারেটের তেষ্টা পেলে আমায় ডাকবেন। এই দোকানে বিকেলের পর আমি সব সময় এভেইলেবল।”
সুপ্ত আজিজকে কিছু বলতে না দিয়ে আবার বলল,
“ফরিদ মিয়া, আজ থেকে আজিজ ভাইয়ের জন্য দোকান ফ্রি। উনার কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেবে না।”
আজিজ কথা বলার সুযোগ পেতেই প্রশ্ন করল,
“কিন্তু আপনি কে?”
সুপ্ত কৌতুক করে বলল,
“আমি সেবক। সিগারেট সেবক। যারা টাকার কারণে সিগারেট কিনে খেতে পারে না, বিড়ির জন্য হাভাতে হয়েও অভাবে আঙুলের ফাঁকে একটু আগুন ঠাঁই দিতে পারে না, যারা মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে না পেরে নিজেদের দুস্থ দাবী করে, তাদের সিগারেট দিয়ে জাতির মানবেতর প্রাণগুলোকে উজ্জীবিত করি। ভবিষ্যতে একটা ফাউন্ডেশন খোলার ইচ্ছে আছে। নাম দেব বিড়ি ফাউন্ডেশন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে আপনাকে সেই ফাউন্ডেশনের সভাপতি করে দিতেও পারি।”
আজিজ বোকার মতো সুপ্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদ মাঝখান দিয়ে বলে উঠল,
“ভাইজান, আপনের ফাউন্ডেশন এর সামনে আমারে একটা চা, পান, বিড়ির ইস্টল নিয়া দিয়েন।”
সুপ্ত ধমক দিয়ে বলল,
“তোমাকে সেক্রেটারি বানাব মিয়া। রাত হতে চলল। আজ আসি। ভালো থাকবেন আজিজ ভাই।”
সুপ্ত যাওয়ার আগে আজিজের সঙ্গে একবার কোলাকুলি করতেও ভুলল না। আজিজ হতভম্ব হয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাইকটাকে ছুটে যেতে দেখল।
______________
অপুর বড়ো বোন বেলী। বছর দুই আগে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে। আনিসুল সাহেব মেয়ের এহেন অধঃপতন মেনে নিতে না পেরে তার থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। দু’বছরেও মন গলেনি। কথাও বলেন না। বেলী কেঁদেকেটে, পায়ে ধরেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারেনি। তবে আনিসুল সাহেব তাকে এ বাড়িতে প্রবেশের ওপর কোনো নিষে-ধাজ্ঞা দেননি। বেলী স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে আসে। কয়েকদিন থেকে আবার চলে যায়। বাড়ির সকলে তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলেও আনিসুল সাহেব নিজের স্থানে অটল। বেলীর শ্বশুরবাড়ি তুলনামূলক নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আজিজ ছোটোখাটো একটা চাকরি করে। তাই দিয়ে তাদের বিলাসিতাহীন জীবন কে’টে যায়। এ নিয়ে আনিসুল সাহেবের একটা সুক্ষ্ম তা’চ্ছিল্যও আছে। যেন বলতে চান,
“আরো কর নিজের পছন্দে বিয়ে। এবার হা’ড়ে হা’ড়ে বোঝ বাবা তোদের কত সুখে রেখেছিল।”
আজিজের এ বাড়িতে আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হয় না। তিনবেলা টেবিল ভর্তি খাবার তার সামনে সাজানো হয়। যত্ন করে খাওয়ানো হয়। জাহেদা বেগম তো বড়ো মেয়ে বলতে এমনিতেই দুর্বল। আদর-যত্নের কোনো কমতি তিনি রাখেন না। বেলী মাকে পেয়ে একদফা কান্নাকাটি সেড়েছে। জাহেদা বেগমও মেয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। বাদ যায়নি শিমুলও। অপু শুধু সবাইকে সান্ত্বনা দিয়েছে। খানিক বাদেই আনিসুল সাহেব বাড়ি ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের কলরব থেমে বাড়িটা একদম সুনসান হয়ে গেল। আনিসুল সাহেব অবশ্য কিছুই বললেন না। মেয়ে এসেছে এটা যেন তেমন কোনো বিষয়ই নয়। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন,
“অপরাজিতা?”
“জি বাবা।”
“তোর পছন্দের প্লাটিনামের পেন্ডেন্টটা আজ অর্ডার করে দিয়েছি। আমার বন্ধু ডুবাই থেকে আসার সময় নিয়ে আসবে।”
অপু চুপসে গেল। আঁড়চোখে বড়ো বোনের অভিব্যক্তি বুঝে নিতে চাইল। আনিসুল সাহেব আরকিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। বেলী বলল,
“বাবা এখনো তোর কোনো আবদার ফেলে না। সেটা যতই দামী হোক।”
অপু বেলীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে আপু।”
বেলী উত্তর দেয় না। ঝাড়া মে রে অপুর হাত সরিয়ে ভেতরে চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে অপু ছোটো করে একটা নিশ্বাস ফেলে। বাবা-মেয়ের অদৃশ্য রে-ষারে-ষিতে তাকেই বারবার কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়।
রাতের খাবার শেষে অপু সবে বিছানায় গা এলিয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে অনলাইনে ঢু মা রতে যাবে এমন সময় একটা ম্যাসেজ এলো।
“ওগো পুষ্পরাণী,
নিশীথ নির্জণে, হৃদয়ের গহীনে লালিত
প্রণয়ব্যথা বলতে শুধু তোমাকেই জানি।”
চলবে…
রিচ তো কবেই ম রে গেছে। কেউ বেঁচে থাকলে সাড়া দিয়েন।