সুপ্ত অনুরাগে পর্ব -২৮+২৯ ও শেষ

#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[২৮]

দিনটা গুমোট। রোদ, বৃষ্টি, বাতাস কোনোটার অস্তিত্ব প্রকট নয়। ভ্যাপসা গরম ছুটেছে। নিভন্ত সূর্যের ম্লান দিনে অপুদের বাড়ি মুখোরিত। বাড়িতে আজ সকলে উপস্থিত। এমনকি দুলাভাইয়ের উপস্থিতিতেও কাজু বাড়িতে আছে। অনেক দিন পর দুই শালা-দুলাভাই একসঙ্গে বাড়িতে উপস্থিত। উপলক্ষ্য শিমুলের জন্মদিন। আজ রাতে ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। শিমুলের বন্ধুবান্ধবসহ কিছু নিকটাত্মীয়ও উপস্থিত থাকবে।

আনিসুল সাহেব দুদিন ধরে চুপচাপ। কারো সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন না। যেচে পড়ে কেউও উনার সঙ্গে কথোপকথনে এগিয়ে আসছে না দরকার ব্যতীত। সাধারণত আনিসুল সাহেব রেগে থাকলে বাড়ির সকলেই কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। উনাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু পরিবারের ছোটো সদস্যের জন্মদিনের কারণেই বোধহয় আনিসুল সাহেব মেজাজ ঠান্ডা রেখেছেন।

কাজু আজ লুঙ্গি পরেছে। সঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি। বসার ঘরে আনিসুল সাহেব বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। কাজু বুক ফুলিয়ে ড্রইংরুমে আসতেই তিনি ভ্রু যুগল একত্রিত করে, বাঁকা চোখে তাকালেন। অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,
“আজ হঠাৎ লুঙ্গি পরেছিস কেন?”
কাজু ফুরফুরে মেজাজে লুঙ্গি নাচিয়ে বলল,
“যা গরম পড়েছে, তাতে লুঙিই আরাম দেয়। নিচ দিয়ে ভালো হাওয়া চলাচল করে। আপনিও পাজামা খুলে লুঙ্গি পরে নিতে পারেন, দুলাভাই। লুঙ্গি রাগী মানুষদের জন্য উপকারী। নিচ দিয়ে হাওয়া চলাচল করলে ওপর দিয়ে ঠান্ডা থাকবে। আই মিন মেজাজ ঠান্ডা থাকবে। অবশ্য লুঙ্গি সামলানোর একটা ব্যাপার আছে। আপনি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। পাজামার ফিতাতেও শুনেছি গিট লাগিয়ে ফেলেন।”
আনিসুল সাহেব চোয়াল শক্ত করে ফেললেন।চ্যাচিয়ে বললেন,
“জাহেদা, তোমার ভাইকে দুচোখের সামনে থেকে সরতে বলো। আজকের দিনে কোনো ঝামেলা চাইছি না।”
কাজু ঢোক গিলে, লুঙ্গি উঁচিয়ে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে সরে গেল।

খানিকক্ষণ বাদে আনিসুল সাহেব অপুকে ডাকলেন। অপু শিমুলের জন্য কেক ডেকোরেট করতে ব্যস্ত ছিল। ছুটে এসে ব্যস্ত গলায় বলল,
“ডেকেছিলে বাবা?”
“তন্ময়ের ফুপাতো ভাইকে তুই কীভাবে চিনিস?”
এমন সময় এহেন প্রশ্নে অপু ভড়কে গেল। বাবার অত্যাধিক শীতল কণ্ঠ শ্রবণ করে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল মুহূর্তেই। অপু ইতস্তত করে বলল,
“বলেছিলাম না একবার এক্সিডেন্ট করা এক বাইক চালককে হেল্প করেছিলাম, সুপ্ত মানে তন্ময়ের ফুপাতো ভাই-ই সেই লোক।”
“এটুকুই পরিচয়?”
অপু মৌন রইল। জাহেদা বেগম পাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে জানতে চাইলেন,
“হঠাৎ ওদের প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
আনিসুল সাহেব মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টিপাত করে বললেন,
“অপুর জন্য সম্বন্ধ এসেছিল। তন্ময়ের ফুপুর ছেলের জন্য।”

অপু রুদ্ধশ্বাসে তাকায়। সুপ্তের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে! মনের মাঝে তানপুরা বেজে ওঠে। সে উদগ্রীব হয়ে তাকায় বাবার দিকে। জাহেদা বেগম অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,
“তন্ময় মানা করেছে বলে এখন তাদের আত্মীয় সম্বন্ধ করতে চাইছে? আমার তো ওই পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখার ইচ্ছে নেই।”
আনিসুল সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
“আমারও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ওরা খুব করে বললেন। তোমার মেয়েরও নাকি ভালো খাতির ওদের ছেলের সাথে। তাই খোঁজ নিলাম।”

অপু মাথা নত করে রাখে। তার বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। জাহেদা বেগম কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলেন,
“খোঁজ নিয়ে কী জানলে?”
“জানলাম ছেলের বাবা-মা ডিভোর্সি। ছেলে ছোটো থেকেই তার বাবার কাছে বড়ো হয়েছে। হয়েছেও উশৃংখল স্বভাবের। এক্সিডেন্টের পর থেকে তোমার মেয়ের পেছনে পড়েছে। তাকে ফলো করত, ডিস্টার্ব করত। অথচ তোমার মেয়ে আমাদের কিছুই জানায়নি। উল্টে আশকারা দিয়েছে। তারচেয়েও বড়ো কথা ছেলের মা, ভদ্রমহিলা ডিভোর্সের পরও প্রাক্তন স্বামীর বাড়ি যাতায়াত করেন। এমন বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। মানা করে দিয়েছি।”
এরপর অপুর দিকে ফিরে আনিসুল সাহেব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে বললেন,
“তোর থেকে অন্তত আমি এমনটা আশা করিনি। এখন তো মনে হচ্ছে তন্ময়ের পরিবার এসব জেনেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। ছিঃ ওদের কাছে কতটা ছোটো হতে হলো!”
অপু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়। বলতে চায়,
“বাবা আমার কথাটা শোনো…”
আনিসুল সাহেব হাত উঠিয়ে অপুকে থামালেন। রুক্ষ স্বরে বললেন,
“আমাকে যেন এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলতে না হয়। ছোটো ভাইয়ের জন্মদিন। আত্মীয় স্বজন আসবে। পরিবেশ ভালো রাখার দায়িত্ব তোদের।”

অপুর চোখ ফেটে জল গড়ায়। টলতে থাকা পায়ে ছুটে যায় নিজের ঘরে। সুপ্তের বাড়ি থেকে আসার সপ্তাহখানিক পেরিয়েছে। লোকটা শেষ চেষ্টা করার আশ্বাস নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। এরপর দুজনের ফোনে কথা হয়েছিল কয়েকবার। কতটা উচ্ছ্বাস ছিল অপুর মাঝে। অথচ ভত দুদিন থেকে সুপ্ত আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অপু কিছুটা চিন্তিত হলেও বিশেষ ভাবেনি। তবে অপুর এখন তার চেয়েও বড়ো দুঃখ হলো বাবা শুধু খোঁজ নেওয়ার ওপর ভিত্তি করে মানা করে দিলো? একবার তার সঙ্গে কথা বলল না, কথা শুনলও না! অপু সুপ্তের ফোনে কল করল। গতকাল থেকে ফোন বন্ধ। প্রত্যাখান পেয়েই কী সুপ্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে? অপু আধঘন্টা পর পর সুপ্তের ফোনে কল করতে লাগল। প্রতিবারই বেসুরো শব্দ জানান দেয় ওপাশের মানুষটা মনঃকষ্ট নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

দুপুর ছাড়িয়ে বিকেল গড়ায়। বাড়িতে আত্মীয় আসতে শুরু করেছে। সময়ের সঙ্গে অপুর উদ্বিগ্নতা বৃদ্ধি পায়। যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম না পেয়ে অবশেষে তন্ময়ের কাছে ফোন করে সে। তন্ময় ফোন রিসিভ করতে বেশি সময় নিল না। স্মিত হেসে বলল,
“কী ব্যাপার? ফুলের হঠাৎ আমাকে মনে পড়ল?”
“সরি তন্ময়। আসলে গতকাল থেকে সুপ্তের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। উনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। আমার কাছে তো আর কোনো ওয়ে নেই যোগাযোগের। আপনি কী একটু…”
“বুঝেছি। তুমি চিন্তা কোরোনা। আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।”

অপু ফোন কেটে ঘরময় পায়চারী করতে থাকে। জানালার কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। একসময় সুপ্ত পথের ধারের দোকানে বসে থাকলে অপুর তা সবচেয়ে বিরক্তিকর দৃশ্য বলে মনে হতো। কে জানত সেই বিরক্তিকর দৃশ্য ও দৃশ্যের অন্তর্গত মানুষটা একসময় মনের মাঝে সন্তর্পণে জায়গা করে নেবে? অপুর চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসে। পাঁচ মিনিট বাদেই তন্ময় কল ব্যাক করল। অপু সেকেন্ড ব্যয় না করে রিসিভ করে। তন্ময় কিছুটা চিন্তিত গলায় বলল,
“ফুল, সুপ্ত তো বাড়িতে নেই। গতকাল ভোরে নাকি রাজশাহী চলে গেছে।”
“রাজশাহী! কিন্তু হঠাৎ কেন?”
“ওখানে নাকি চাকরি পেয়েছে। আঙ্কেল ওকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য নাকচ করে দেওয়ার পর ওকে আর কিছুতেই আটকানো গেল না। মামনি, আঙ্কেল সুপ্তের চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।”
অপু ফোন কানে রেখেই হু হু করে কেঁদে উঠল। সে কী এবার সুপ্তকে চিরতরে হারিয়ে ফেলল? তন্ময় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল,
“আহা! কেঁদো না। আমাকে বলো তোমাদের মাঝে সব ঠিক আছে?”
“ঠিকই তো ছিল। হুট করেই জানলাম উনারা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আর বাবাও নাকচ করে দিয়েছেন। আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। এরপর থেকে উনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
“আচ্ছা, তুমি শান্ত হও। দেখছি এদিকটা।”

অপু ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাজু দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে দৃশ্য দেখে ছুটে এলো। অপুকে টেনে তুলে জানতে চাইল,
“এই অপু? কী হয়েছে? ম’রা কান্না জুড়েছিস কেন?”
অপু মামার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ও মামা, বাবাকে মানাও না প্লিজ! আমি সুপ্তকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
কাজুর কপালে ভাজ পড়ে। চিন্তিত গলায় বলে,
“ব্যাপারটা কী? খুলে বল তো।”
_______________

জন্মদিনের আমেজে ভাটা পড়েছে। বাড়ির অবস্থা থমথমে। একমাত্র শিমুল ছাড়া বাকি সকলের চোখে-মুখে চিন্তা, হতাশা, উদ্বেগ। শিমুল ও তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব হৈ হৈ করে জন্মদিন উদযাপন করেছে। অপু শুধু কেক কাটার সময় নামমাত্র উপস্থিত ছিল। অতিথিরা চলে যাওয়ার পর সবকিছু গুছিয়ে উঠতে রাত গড়াল অনেকটা। বাড়ির সকলেই ক্লান্ত। আনিসুল সাহেব ঘর থেকে ডাকলেন,
“জাহেদা, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।”

পানি নিয়ে ঢুকল বেলী। তার পাঁচমাস চলছে। পেট খানিকটা স্ফিত হয়েছে। বেলীর ঠোঁটে এই মুহূর্তে জিতে যাওয়ার দাম্ভিক হাসি। অপুর প্রেম প্রকাশে তাকে কত কিছুই না করতে হয়েছে। এমনকি বাবার সঙ্গে ঝামেলা পর্যন্ত হয়ে গেছে। শেষমেষ তো সত্যিটা সামনে এলোই। বেলী সত্যি প্রমাণিত হলো। সে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এবার আমাকে বিশ্বাস হলো তো? বুঝলে তো তোমার আদরের অপুও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। অথচ দোষ শুধু আমাকেই দাও।”

আনিসুল সাহেবের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। অপুর প্রতি উনার বিশ্বাস ধাক্কা খেয়েছে। সন্তানদের অধঃপতনে মনঃকষ্টে ভুগছিলেন। এরই মাঝে বেলীর কথায় তিনি মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন। পানির গ্লাস ধাক্কা দিয়ে ফেলে হুংকার দিয়ে বললেন,
“অন্যের দোষ মেলে ধরে নিজের দোষ লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আসলে ব্যর্থতা আমারই, কোনো মেয়েকেই সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। একজন তো বিগড়ে গিয়েছিলই এবার পরেরটাও অর্ধেক বিগড়ে গেছে। দূর হ চোখের সামনে থেকে। তোদের কাউকে দেখতে চাই না আমি।”

আনিসুল সাহেবের চিৎকারে জাহেদা বেগম ছুটে এলেন। বেলী অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ফ্লোরে পড়ে থাকা কাচ ভাঙা পানিতে পা পিছলে উপুর হয়ে পড়ে গেল। গলা ছিটকে বেরুলো আর্তনাদ। কাচের টুকরো চামড়া ভেদ করতে সক্ষম হলো মুহূর্তেই। গলগল করে র’ক্তের স্রোত বয়ে গেল ফ্লোরে। জাহেদা বেগম গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলেন। ছুটে এলো কাজু, আজিজ, অপু ও শিমুল। বেলীর অবস্থা দেখে সকলের মাথা ঘুরে ওঠার জোগাড়। কান্নার শব্দ ছড়িয়ে গেল ঘরময়। আজিজ ও কাজু ধরাধরি করে বেলীকে তুলে নিল ফ্লোর থেকে। অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় বয়ে যাবে বলে নিজেরাই ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আনিসুল সাহেব পুরোটা সময় জড়মানব হয়ে ছিলেন। ফ্লোরে বেলীর গায়ের র’ক্ত পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আনিসুল সাহেবের দেহ কাঁপে। জাহেদা বেগম রাগে, ঘৃণায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“খুশি হয়েছো? হয়েছো না খুশি? মেয়েদের দেখতে চাইছিলে না। দেখো আল্লাহ সাথে সাথে তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করে দিলো। আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটাকে মে’রে ফেলতে চাইলে? খু’নি, খু’নি তুমি!”

জাহেদা বেগম গলা ছেড়ে কাঁদেন। আনিসুল সাহেব মূর্তির ন্যায় নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলেন। কাজু এলো খানিক বাদে। বেলীকে এডমিট করা হয়েছে। ডাক্তার প্রাথমিকভাবে মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন। আজিজ ও অপুকে রেখে টাকার ব্যবস্থা করতে কাজুকে বাড়ি আসতে হলো। আনিসুল সাহেব তাকে দেখে প্রথম কথা বললেন। জানতে চাইলেন,
“বেলী কেমন আছে?”

কাজু সে প্রশ্ন শুনেই ক্ষে’পে গেল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনার কী তা জানার আদৌ দরকার আছে, দুলাভাই? মেয়েটাকে তো মা’রতেই চাইছিলেন।”
“আমি মা’রতে চাইনি।”
“দুই বছর আগে করা এক ভুলের জন্য মেয়েটাকে আপনি সব সময় দূরছাই করে গেছেন। সন্তানের সঙ্গে ইগো দেখিয়েছেন। আরেহ সন্তানরা কী পেট থেকে ভালোমন্দের শিক্ষা নিয়ে বেরোবে? নাকি বড়োদের মতো অভিজ্ঞতা তাদের মাঝে আগেই ইনস্টল হয়ে থাকবে? মেয়েরা ভুল করে ফেলেছে বলে আপনিও ভুল করবেন? আসলে আপনি র’ক্ত’মাং’সের সন্তান জন্ম দিলেও তাদের চালাতে চেয়েছেন পুতুলের মতো। তাদের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছেন। তাদের ইচ্ছেটা পর্যন্ত জানতে চাননি। যেই না একজন আপনার নিয়মের বাইরে গেল অমনিই আঁতে ঘা লাগল। মেয়ে হয়ে গেল শত্রু। আপনার শত্রু নিধন হচ্ছে, খুশি হোন।”

আনিসুল সাহেব ফ্যাকাসে মুখে কাজুর দিকে তাকিয়ে আছেন। ভঙ্গুর গলায় বললেন,
“মুখ সামলে কথা বল, কাজু। বেলী আমার মেয়ে। তার নিধন আমি চাইনি।”
কাজু দমে গেল না। চ্যাচিয়ে উঠে বলল,
“দিনের পর দিন মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার সময় মনে ছিল না বেলী আপনার মেয়ে? এবার নিশ্চয়ই আপনার শত্রুর তালিকায় অপুর নামটাও উঠে গেল। মেয়েটা একজনকে পছন্দ করেছে। পালিয়ে যায়নি, মুখে চুনকালিও দেয়নি। বরং পরিবারের ওপর ভরসা করেছে। সেই পছন্দের মানুষ যখন সম্বন্ধ পাঠাল সেটাও আপনার পছন্দ হলো না। মেয়ের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে বাতিল করে দিলেন। অপু যদি ভুল মানুষকেই পছন্দ করত আপনি একবার তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে বোঝাতে পারতেন। কিন্তু আপনি সেসবের ধারেকাছেও যাননি। হুকুম জারি করেই শেষ। এমনকি পূর্বের বিয়েটাতেও অপুর মত আছে কিনা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অথচ আপনি এ যুগের শিক্ষিত বাবা। আরেহ যে সংসার করবে, সারাজীবন আরেকজন মানুষের সাথে কাটাবে তার সিদ্ধান্তের কোনো দাম নেই? মেয়ে কী চো’র-বা’ট’পার ধরে এনেছিল? আপনার বড়ো জামাই যখন চাকরির বাজারে লড়াই করে ভেঙে পড়ছিল আপনি সামান্য পরামর্শ দিয়েও তাকে সাহায্য করেননি। আর সুপ্ত অর্থাৎ যে ছেলের বাবা-মায়ের সম্পর্ক দিয়ে আপনি তাকে বিচার করেছেন, সেই ছেলে আপনার বড়ো জামাইয়ের যোগ্যতার ব্যবহার করে তাকে চাকরির সুযোগ দিয়েছে। ভাগ্যিস সবাই আপনার মতো বাবা-মায়ের সম্পর্ক দিয়ে সন্তানকে বিচার করে না। অবশ্য যদি বলেন মেয়ের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তার হয়ে সংসার আপনি করে দেবেন তাহলে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতেই পারেন।”

আনিসুল সাহেব স্তব্ধ মুখে বসে আছেন। কাজু তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দুলাভাই, আপনি কী কখনো খেয়াল করেছেন আপনার সন্তানেরা আপনার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। মনের কথা নিঃসংকোচে বলতে পারে না। আপনার উপস্থিতিতে তারা গুটিয়ে থাকে। তারা আপনার সঙ্গে হাসতেও পারে না, আপনার কোলে মাথা রেখে কাঁদতেও পারে না। আপনি তাদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের মতো। যার আদেশ চুড়ান্ত ও শির ধার্য। এমনকি আমার বুবু বিয়ের এত বছর পরও আপনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। প্রেশারের ঔষধ খায় দুইবেলা। আপনি সংসারকে আদর্শময় বানাতে গিয়ে আসলে এক ত্রা’সের রাজত্ব সৃষ্টি করে রেখেছেন।”

আনিসুল সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। শিমুলের মুখ ভয়ে সাদা কাগজের মতো হয়ে আছে। সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পেছনে। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা। তাকালেন জাহেদা বেগমের দিকে। বিয়ের আঠাশ বছরে এই প্রথম স্ত্রীর চোখে ঘৃণা দেখতে পেলেন তিনি। আনিসুল সাহেব দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন র’ক্তা’ক্ত মেঝেতে। আস্তে আস্তে দুচোখে আঁধার নেমে এলো।

চলবে…#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[শেষপর্ব]

সুপ্ত চলে যাওয়ার সপ্তাহ দুই পেরিয়েছে। এই ক’দিনেই রফিক সাহেবের স্বাস্থের লক্ষণীয় অবনতি ঘটেছে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। রাতের ঘুমটাও অধরা। রফিক সাহেব রাতে ঘরের দরজা আটকে দিলে কেউ আসে না ঝ’গ’ড়া করতে। যেই বারান্দা নিয়ে দুই বাবা-ছেলেতে বি’বা’দ বাধে তাও পড়ে আছে শূন্য। রফিক সাহেবের মনে হয় উনি যা যা আগলে রাখতে চান তাই হাত ফসকে যায়। যেমনটা গিয়েছিল বৈশাখী। অনেক বছর আগে যাকে এক প্রকার জোর করেই ভালো বাসিয়েছিলেন তিনি।

আশির দশকের প্রেম বর্তমান সময়ের মতো অতি সহজে ধরা দিত না। তখন ছিল না মুঠোফোন, ম্যাসেঞ্জার কিংবা ইন্টারনেট সুবিধা। টেলিফোনের অবাধ ব্যবহার ছিল না বিধায় পছন্দের মানুষের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করার সবচেয়ে পরিচিত পন্থা ছিল চিঠি। রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করার ঘটনা ছিল কদাচিৎ। রফিক সাহেব সেই সময়েই ছিলেন এক বেপরোয়া তরুণ। প্রেম প্রকাশে চিঠি কিংবা কোনো বার্তা বাহকের ধার ধারেনি। বৈশাখী তখন ইন্টারমেডিয়েটে পড়ুয়া ছাত্রী। একদিন রাস্তা আটকে সরাসরি মনের কথা জানিয়ে দিলো। ভয়ে, লজ্জায়, সংকোচে বৈশাখী পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর প্রায়ই রফিকের উত্যক্ততার শিকার হতে থাকে মেয়েটা। এলাকায় বদনাম ওঠে। বাড়িতে নালিশ দেওয়া হয়। বৈশাখীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক কেয়ারটেকার নিযুক্ত হয়। এতকিছুর পরেও রফিক নামের বেপরোয়া তরুণকে ঠেকানো যায় না। এক সময় নবযৌবনা বৈশাখীও সেই উ’ন্মাদ প্রেমিকের ফাঁ’দে পা দেয়।

বৈশাখীর পরিবার সম্রান্ত। দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের ম্যাজিস্ট্রেট। বাবা প্রভাষক। ভাইয়েরাও বড়ো বড়ো সরকারি পদে আসীন। এদিকে তরুণ রফিকের বাবা ব্যবসায়ী। নিউমার্কেটে বড়ো তিনটে দোকান। খানদানি তেজ ও সম্পত্তিতে গড়াগড়ি করে বড়ো হওয়া, বখে যাওয়া ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন বৈশাখীর পরিবার। এদিকে তরুণী অল্প কথা, স্বল্প দেখাতেই উথাল-পাতাল প্রেমে মশগুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা দিয়েই ঠিক করে ফেলল রফিককেই তার চাই। অগত্যা বিয়ে হলো শুধু রফিকের পরিবারের সদস্যদের নিয়েই।

নতুন জীবনের সুচনালগ্নে বাবা-মাকে পাশে না পেলেও শ্বশুরবাড়ির আদরে বৈশাখী ভালো ছিল। মাঝরাতে হুটহাট বেরিয়ে পড়া, শাড়ি পরে রাস্তায় হাত ধরে হাঁটা, রিক্সায় ঘোরা, একে অপরের প্রতি যত্নশীল, দায়িত্বশীল থেকে ভালোই চলছিল বৈবাহিক প্রেম। একটুকরো স্বর্গ যেন পৃথিবীতেই ছুঁয়ে দিয়েছিল তারা। একবছর, দু-বছর করে যখন তিন বছরে সংসার জীবনে পদার্পণ করল, শ্বাশুড়ি বাচ্চার জন্য দিনরাত বলতে লাগল। অধীর হয়ে উঠল রফিক-বৈশাখী দম্পতিও। কিন্তু সময় যত গড়াল সেই অপেক্ষা যেন আরো দীর্ঘতর হতে থাকল। বাড়তে থাকল অভ্যন্তরীণ কো’ন্দল। শ্বাশুড়ির ক’টুবাক্য সহ্যের মাত্রা ছাড়ালে তার আঁচ দাম্পত্যেও লাগল। রফিক সাহেব মা ও বউ দুজনকেই সামলাতে চেষ্টা করে। এক সময় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে বৈশাখীর ওভারিতে সমস্যা ধরা পড়ল। চিকিৎসার জন্য সমুদ্রও পাড়ি দেওয়া হলো। চিকিৎসা চলল। সুস্থও হলো কিন্তু গর্ভজাত সন্তানের সুসংবাদ আর এলো না। দিন দিন সম্পর্কের রঙ কেমন ফিকে হতে থাকল। রফিক সাহেবের মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার পক্ষে ভিড়লেন। বৈশাখীও অস্তিত্ব সংকটে দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠলেন। স্বভাবে সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। স্বামীর সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম বিষয়ে নজর রাখা শুরু করলেন। রফিক সাহেব অবশ্য মানুষ হিসেবে বেশ সহনশীল ছিলেন। মা ও স্ত্রী উভয়পক্ষে সমঝোতা করে সংসারটা ধরে রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে বৈশাখীর সন্দেহ, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ ও উভয়ের ঝগড়ার মিমাংসা করতে করতে দাম্পত্যের কলহ বাড়তে লাগল।

তখন রফিক সাহেবের দূর সম্পর্কের খালাতো বোন তনু গর্ভবতী অবস্থায় চরিত্রহীন স্বামীর গৃহ থেকে বিতারিত হয়। পিত্রালয় না থাকায় ঠাঁই হয় রফিক সাহেবের মায়ের ছত্রছায়ায়। খালা-বোনজির আদর ভালোবাসা বেড়ে যায়। বৈশাখী সেটা ভালোভাবে নিল না। ভাবল শ্বাশুড়ি তাকে তাড়িয়ে তনুকে পুত্রবধূ করে ফেলবেন। ঝামেলা আরেকদফা বেড়ে গেল। অতঃপর রফিক সাহেব বোনকে আলাদা বাড়িতে রাখলেন। সুপ্তের জন্মটা হলো সেখানেই। বোনের ছেলে হিসেবে রফিক সাহেবের হৃদয় উজার করা আদর পায়। তা দেখে বৈশাখী চরম আহ’ত হয়। অন্যের সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত আবেগ দেখে তার মনে হতে লাগল নিজের সন্তান হচ্ছে না বলে রফিক সাহেব হাল ছেড়ে দিয়েছেন। দিন দিন মানসিকভাবে কোণঠাসা হতে লাগলেন তিনি৷ তনুর সঙ্গে ঝামেলাও হয়ে গেল কয়েক দফা। তার এ বাড়িতে যাতায়াত একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলো। সুপ্তের বয়স যখন দশমাস তখন তনু লিভারের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মা’রা যায়। অনাথ বাচ্চাটার নিষ্পাপ মুখ চেয়ে রফিক সাহেব ওকে কোল ছাড়া করতে পারেননি। সুপ্তকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলেন। মা রাজি হলেন না। উনার নিজের র’ক্তের বংশধরই চাই। পুত্রবধূকেও তাচ্ছিল্য করতে ছাড়লেন না। নিজের সন্তান হচ্ছে না বলেই রফিক বোনের ছেলেকে সন্তানরূপে চাইছে, এ নিয়ে কথা শোনালেন। উঠতে বসতে অক্ষমতার কথা মনে করাতে থাকলেন। বৈশাখী তা আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নিজের সন্তানের জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। দত্তক পুত্র নেওয়া মানে অক্ষমতা স্বীকার করা। শ্বাশুড়ির কাছে হার মেনে নেওয়া। যা তিনি মানবেন না। ধীরে ধীরে বাচ্চাটাকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করলেন। এদিকে রফিক সাহেবও এবার গলে গেলেন না। একটা দুধের শিশুর সঙ্গে বৈশাখীর বিরোধ দেখে তিনি চরম হতাশও হলেন স্ত্রীর ওপর। তাকে নিচু মনের আখ্যা দিলেন। কলহ মাত্রা ছাড়ায়। দুজনের অহং সে যাত্রায় অটুট রইল। বৈশাখী সংসার ত্যাগ করে ভাইদের সঙ্গে দেশ ছাড়লেন। রফিক সাহেব আঁকড়ে ধরলেন ছোট্টো সুপ্তকে। যার কান্না থামাতে অহেতুক গল্প বলা, অসুস্থতায় না ঘুমিয়ে যত্ন নেওয়া এবং তুলতুলে, আদুরে স্বভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাবা।

এরপরে রফিক সাহেবের মা ছেলেকে বিয়ে দিতে অনেক তোড়জোড় করেন। কসম, কবিরাজী, হু’ম’কি-ধ’মকি কোনোটাই বাদ রাখেননি। ফলাফল শূন্য। রফিক সাহেব আর স্ত্রী গ্রহণ করলেন না। সুপ্ত দিন দিন বড়ো হতে থাকল। কথা বলতে শিখল, মুখ চিনতে লাগল। রফিক সাহেব বৈশাখীর ছবি দেখিয়ে তাকে শেখালেন বৈশাখীই তার মা। সুপ্তের বয়স যখন চার বছর রফিক সাহেবের মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা নেওয়া হয়। তিনি অবশ্য সে যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারেননি। কিন্তু উনার বদৌলতে বৈশাখীর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাত ঘটে রফিক সাহেবের। অচেনা দেশে একটি ছেলে ও অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা সেবা সমানতালে সামলাতে গিয়ে রফিক সাহেব যখন হিমশিম খান, তখনই তাদের দেখা হয়। বৈশাখীকে সুপ্ত মা বলে জানত বিধায় অনায়াসেই মাকে গ্রহণ করে। জড়িয়ে ধরে। মা বলে ডাকে। বৈশাখী অবুঝ সুপ্তের থেকে মুখ ফেরাতে পারলেও চার বছরের শিশুর মুখের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। স্বামী, সংসার ত্যাগ করে উনারও আর সংসার বাধা হয়নি। আঁকড়ে ধরলেন ভাইয়ের সংসার। একাকিত্বে খা খা করা অন্তরে অনেকদিন বাদে সুপ্তের মা ডাক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল বোধহয়। প্রাক্তন শ্বাশুড়ির অসুস্থতায় সুপ্তকে দেখভালের দায়িত্ব নিলেন কাঁধে। প্রথম প্রথম বৈশাখী সুপ্তকে কিঞ্চিৎ মায়া করেই কাছে টেনেছিলেন। কিন্তু মিশতে মিশতে কখন যে নিজেকে আসলেই ছেলেটার মা ভেবে বসলেন টেরই পেলেন না। সুপ্তের দেশে ফেরার সময় তিনি হাউমাউ করে কাঁদলেন। সদর্পে ধরে রাখলেন মায়ের স্থানটুকু।

সুপ্তের দাদি মা’রা যাওয়ার পর তার অতীত কখনো সামনে আসেনি। রফিক সাহেব আসতেও দেননি। যোগাযোগ কমিয়ে দেন আত্মীয়দের সাথে। পৃথিবীটা সীমাবদ্ধ করেন নিজের কর্মজগত ও ছেলের মাঝে। সুপ্তও তার পৃথিবী হিসেবে পায় বাবা ও দূর দেশে বাস করা মাকে। সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসি তারা একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। মাঝরাতে হরর মুভি দেখে ভয়ে সিটিয়ে যাওয়া কিংবা লম্বা কোনো ব্যাচেলর ট্যুর দেওয়া সবটাই তাদের কাছে অসীম আনন্দের। সেই আনন্দে ছন্দপতন হলো সত্যিটা সামনে এসে। সুপ্ত বুদ্ধিমান। একটু টের পেতেই বাকিটা টেনে বের করেছে। সে যে বাবার র’ক্ত নয়, তার আগমন তার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় দুটি মানুষের বিচ্ছেদের কারণ এই ধাক্কাটা সুপ্ত সামলে উঠতে পারেনি। নিজেকে তার বড্ড অযাচিত মনে হতে থাকে। এমনকি অপরাজিতা, যে ফুলের মতো মেয়েটিকে নিয়ে সে সংসার করার স্বপ্ন দেখে তাকে অবধি এই জীবনে টেনে আনতে দ্বিধাবোধ করে। অপরাজিতার আশ্বাসে ক্ষীণ এক প্রদীপ তখনো মনের কোণে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল। সেটাও দমকা হাওয়ার মতো নিভে গেল যখন অপরাজিতার বাবা প্রস্তাব নাকচ করলেন। সুপ্ত এতসব মানসিক দুঃখ থেকে বাঁচতে পালাতে চাইল। অথচ তার বিদায়ে, তাকে আঁকড়ে বাঁচা একজন মানুষ যে নিঃস্ব হয়ে গেল সেটা বোধহয় ভুলেই গেল।

রফিক সাহেব এই মুহূর্তে বসে আছেন আনিসুল সাহেবের সম্মুখে। দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। জীবনে প্রথমবার তিনি কারো সামনে মাথা নত করতে এসেছেন। একমাত্র ছেলের সুখের জন্য। আনিসুল সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। সম্মুখের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে কারো কোনো আগ্রহ নেই। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে দুজনের আলাপের মাঝে।

রান্নাঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ ছাড়া আশেপাশে আর কোনো শব্দ নেই। বাড়িতে সকলেই উপস্থিত। তবুও চারপাশ যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। বেলীকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। মিসক্যারেজ হওয়া থেকে শেষমেষ রক্ষা পেলেও প্রেগন্যান্সিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডাক্তারদের নির্দেশনায় থাকতে হবে পুরোটা সময়। সেদিনের পর থেকে আনিসুল সাহেব কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলেননি। শুধু নিরব চোখে নিজের হাতে গড়া সংসারটাকে দেখেন। দেখেন তিন সন্তানকে। বোঝেন ছন্দপতন হয়ে গেছে। যে কঠোরতা, সংযম, শাসন, নিষ্ঠা তিনি সংসারে ধরে রাখতে চেয়েছেন তা যে কখন প্রিয়দের জন্য ভীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেননি।

গতকালের কথা, অসুস্থ বাড়িতে শিমুল দমবন্ধ হয়ে উঠছিল। সকলের গম্ভীর মুখ দেখে খেলতে যাওয়ার কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। আনিসুল সাহেব কীভাবে যেন তা বুঝে গেলেন। এরপর শিমুলকে ডাকলেন। পাশে বসিয়ে কাঁধে হাত রাখতে যাবেন, তখন শিমুল কেমন সংকুচিত হয়ে গেল। আনিসুল সাহেবের খেয়াল হলো শিমুল কখনো উনার কাছে কোনো আবদার করে না। সব আবদার মা কিংবা বোনকে জানায়। তারা এসে আনিসুল সাহেবকে অবগত করে। এমনকি বাবা কখন অফিস থেকে আসবে সেই অপেক্ষাটাও কোনোদিন করেছে বলে মনে পড়ে না। ঘর্মাক্ত দেহে দরজা ঠেলে ঢুকতে কোনোদিন ছুটে এসে গায়ে ঝাপিয়ে পড়েনি। আনিসুল সাহেবের আরো অনেক কিছুই খেয়াল হলো। অনেকদিন যাবত ছেলেকে কাছে টেনে আদর করেন না। মাথায় হাত রাখেন না। দরকারের বাইরে অতিরিক্ত শব্দ বলার স্বভাব নেই বলে কোনোদিন পারিবারিক আড্ডাও জমেনি। এখন উপলব্ধি হচ্ছে মানবজীবনে দরকারী কথার পাশাপাশি খুচরো কথা অনেক বেশি মূল্যবান। দরকারী কথার আধিক্য সম্পর্কটাকে অনেকটা ধরাবাঁধা করে ফেলে, কর্পোরেট কর্মক্ষেত্রের মতো সম্পর্কও কর্পোরেট হয়ে ওঠে। অথচ সম্পর্ক হওয়া উচিৎ নির্ভার, নিঃসংকোচ। যেখানে একজন মানুষ নির্দ্বিধায় মনের আগল খুলে দেখে। অবশ্যই সহবত জ্ঞান থাকবে। ভালোবেসে ভালো-মন্দ শিক্ষা দিতে হবে। ভালোবাসাকে ছাপিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রকট হলে বিপরীত পক্ষ হয়ে পড়ে অসহায় অথবা অবাধ্য। বেলী হয়েছিল অবাধ্য এবং বাকিরা অসহায়। আনিসুল সাহেব দুই হাত একত্রে মুষ্টিবদ্ধ করে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছেন। এইসব চিন্তাভাবনা উনাকে বড্ড জ্বা’লাতন করছে। স্বকীয়তা ভেঙে পড়ছে। হৃদয়কে করে দিচ্ছে দুর্বল।

রফিক সাহেব নিরবতা খন্ডন করলেন। বললেন,
“ভাই সাহেব, আমি আপনার কাছে কিছুই গোপন রাখিনি। অবশ্যই রাখা যেত। আমার ঔরসে বা শারীরিক না হলেও সুপ্ত আমার মানসিক ঔরসের সন্তান। ওর মাধ্যমে আমার পিতৃসত্ত্বার জন্ম। মৃত্যু অবধি নিজেকে ওর বাবা বলেই মেনে যাব। কিন্তু একটি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড়ো হওয়ার অ’পরাধে আমার ছেলে আপনার কন্যার জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে তা আমার মানতে কষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই আমার ছেলের চেয়েও যোগ্য পাত্র অহরহ আছে। সে এমন কোনো বিখ্যাত মানুষ হতে পারেনি। এমন কোনো গৌরব তার ঝুলিতে নেই। কিন্তু তার মন নিষ্পাপ শিশুর মতো। সেখানে কোনো কুটিলতা, জটিলতা নেই। ওর ব্রাইট ফিউচার, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর অদম্য উচ্ছাস আছে। শুধু এইসব ঘটনায় ভেঙে পড়েছে। তার চেয়েও বড়ো কথা এখানে দুটি মানুষের বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক হৃদয়ঘটিত বন্ডিংও চলে এসেছে। যা আমি বা আপনি অস্বীকার করতে পারি না। ওরা তো আমাদেরই সন্তান। কীভাবে, কার সঙ্গে সুখী হয় সেটা আমাদের দিক থেকে বিবেচনা করার পাশাপাশি ওদের দিক থেকেও ভাবতে হবে।”

রফিক সাহেব এক নিশ্বাস থেমে আকাঙ্ক্ষিত স্বরে বললেন,
“তাছাড়া এই বয়সে এসে আমার আরেকবার বাবা হওয়ার সাধ জেগেছে। কন্যা সন্তানের বাবা। আমি আপনার কাছে পুত্রবধূ চাইতে নয়, আরেকবার বাবা হওয়ার সাধ নিয়ে এসেছি। আপনার মতো হয়তো আপনার কন্যাকে ভালোবাসতে, যত্ন করতে পারব না, কিন্তু কোনো অংশে কমও করব না এটুকু কথা দিতে পারি।”
রফিক সাহেব থামলেও আনিসুল সাহেব কোনো কথা বললেন না। ক্ষীণ স্বরে একবার ডাকলেন,
“জাহেদা?”
জাহেদা বেগম ছুটে এলেন। বললেন,
“হ্যাঁ বলো।”
“অপুকে ডেকে দাও।”

অপু ঘরবন্দী হয়েছে সুপ্ত চলে যাওয়ার পর থেকে। সে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারেনি। পালিয়েও যেতে পারেনি। কিন্তু কণ্টকের মতো একরাশ দুঃখ তার গলায় আটকে আছে। সুপ্ত চলে গেলেও তার ফেলে যাওয়া অনুরাগ অপুকে ছা’র’খার করে দিয়েছে। ফরিদ মিয়ার দোকানের এক কাপ গরম গুড়ের চায়ে সে সুপ্তকে খোঁজে। খোঁজে পথের ধারে, বাইকের হর্নে। মানুষটা না থেকেও যেন অপুর সমগ্র সত্ত্বায় রয়ে গেছে। সুপ্ত হয়ে উঠেছে ছায়ার মতো, যাকে ধরতে পারা যায় না অথচ সঙ্গে আছে সব সময়।

মায়ের ডাকে অপুর ধ্যান ভাঙল। মাথায় কাপড় দিয়ে বসার ঘরে আসতেই অপুর অস্থিরতা আরেকদফা বেড়ে গেল। বাবার কাছে পৌঁছানোর পথটুকু তার কাছে অগ্নিপথের ন্যায় মনে হয়। যত এগোয় অদ্ভুত উত্তাপ সারা দেহে য’ন্ত্রণা ছড়ায়। বিষাদের বরফ গলে ধারা বয় অক্ষিকোটর বেয়ে। অপু বাবার সামনে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মুখ চেপে ফুপিয়ে ওঠে। হাটু গেড়ে বসে পড়ে সম্মুখে। আনিসুল সাহেব নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। এই কন্যাটিই একমাত্র, যে আড়ালেও বাবার মত অমান্য করেনি। সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে কখনো আড়ালে নিন্দা করেনি। অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। এবারও করেনি। শুধু মুখ চেয়ে থেকেছে, যদি বাবার মত বদলায়। বাবা যে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। এবং সব সিদ্ধান্তই অপুর ভালোর জন্য৷ এবার কী তার ব্যত্যয় ঘটবে? আনিসুল সাহেব আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। খেয়াল করলেন একরাশ ধোঁয়া ধোঁয়া বাষ্প জেকে বসছে উনার গলায়। জেকে বসছে দুই চোখে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি।
__________________

পরিশিষ্টঃ
সাত সকালে কলিং বেলের শব্দে সুপ্তের নিদ্রা ভঙ্গ হলো। ভোরের আলো নিজের জীর্ণতা ঠেলে একটু একটু করে সবল হয়ে উঠছে তখন। ডিসেম্বরের শীতল প্রকৃতি একরাশ আলস্য নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার তিন কামড়ার ফ্ল্যাটে। সুপ্ত নিদ্রাতুর দৃষ্টিতে বিজন কামড়ায় চোখ বুলিয়ে নেয়। চারিদিক আবছা অন্ধকারে নিমজ্জিত। এমন সময় কে বিরক্ত করতে পারে? সুপ্ত আলুথালু বেশেই চোখ ডলতে ডলতে রুম ছেড়ে বের হয়। সদর দরজার ছিটকিনি খুলতেই ভূত দেখার মতো চমকে দু-পা পিছিয়ে যায়। রফিক সাহেব ভেতরে প্রবেশ করলেন অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে। সুপ্তের লাল চোখ, চোখের চারপাশে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার, রুক্ষ ত্বক, সিগারেটে পোড়া ঠোঁট ও ছন্নছাড়া অবস্থা মনোযোগের সাথে দেখে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“আজকাল গাঁ-জার পরিমান বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি?”
আসবাবহীন শূন্য ফ্ল্যাটে সেই ধীর শব্দ মেঘমন্দ্রের মতো গমগম করে উঠল। সুপ্ত ভ্রু কুচকে বলল,
“হুম হচ্ছে। আমার নয়, তোমার। নাহলে কাক ডাকা ভোরে উল্টোপাল্টা কথা বের হবে কেন মুখ দিয়ে?”

“রা’স্কে’ল! চ’ড়ি’য়ে গাল লাল করে দেব একদম। জু-য়া-ড়িদের মতো বেশভূষায় থেকে আমায় নিয়ে মশকরা হচ্ছে?”
“তুমি এই ভোরে মশকরা পেতে আসতে গেলে কেন?”
“যাচ্ছি চলে। সন্তান জন্ম দিয়ে বাবা হতে পারিনি বলে… আজ আমার উপস্থিতিও কারো সহ্য হচ্ছে না।”

রফিক সাহেব মেয়েদের মতো অভিমানী মুখ করে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিলেন। সুপ্ত খপ করে বাবার পাতলা দেহটি দুহাতের মাঝে বন্দি করে ফেলল। বাবার কাঁধে মুখ গুজে ঠোঁট ফোলানো বাচ্চার মতো আহ্লাদী সুরে বলল,
“বাবা, তুমিই আমার বাবা। তুমিই আমার সব। আমি তোমার সন্তান। বলো বাবা, আমি তোমার একমাত্র সন্তান। আমার একটাই বাবা।”

নিমগ্ন ভোর যেন একরাশ তুলো ছোঁয়া আদর নিয়ে হাজিয়ে হয়েছে বাবা-ছেলের দোরগোড়ায়। রফিক সাহেবের বুকের ভেতরটা আর্দ্রতায় ছেয়ে যায়। কতগুলো দিন পর ছেলেটা তাকে বাবা বলে ডাকছে! মনের ভার নিমিষেই হালকা হয়ে গেল। উনার ভালো থাকার সবচেয়ে বড়ো মেডিসিন যে এই ছেলেটা। তিনি ঢোক গিলে আবেগ লুকান। সুপ্তের পিঠে চাপড় মে’রে বলেন,
“যদি তাই হবে তো বাবাকে ছেড়ে আসতে তোর বাধল না?”
“কারণ তুমি একটু বেশিই ভালো মানুষ। যেটা আমার হজম হচ্ছিল না।”
“ইউ শ্যুড প্রাউড অফ মি।”
“ইউ রিগ্রেট।”
“নোপ, আই এম নট! আল্লাহ আমাকে একদিকে শূন্য করে অপরদিকে পূর্ণ করেছেন। আমার একটা দামড়া ছেলে আছে। দুদিন পর মেয়েও পেয়ে যাব। বুড়ি বউ নিয়ে এখন আমি কী করব? যৌবনে কম তো পাইনি। এখন আমার নাতি-নাতনি দরকার।”

সুপ্ত আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। এই কটা দিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বাবাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট। যাকে ছাড়া একবেলা খাবার খায়নি তাকে রেখে এই বিজন ফ্ল্যাটে গলা দিয়ে পানিটুকু নামতেও কষ্ট হতো। সে বলল,
“আই মিস ইউ বাবা!”
রফিক সাহেব ঝাড়া মে’রে সুপ্তকে নিজের থেকে ছাড়ালেন। মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
“বিশ্বাস করি না। তাহলে কেন ফিরে গেলি না?”

সুপ্ত একটু চুপ রইল। সে যে আরো একজন মানুষকে মনেপ্রাণে মিস করেছে। সেই মানুষটার শহরে গিয়ে তাকে দেখতে না পারার কষ্টটা কি সহ্য করতে পারত? নিজেকে সংযত রাখতে পারবে না বলেই তো এই বিরহের দূরত্ব, নিশ্ছিদ্র একাকিত্ব। সুপ্ত আমতা আমতা করে বলল,
“বাইক ছিল না। নাহলে ছুটে চলে যেতাম।”
“তোর বাইকে আমি আ’গুন লাগিয়ে দেব। দরকারে কাজে না লাগলে ওই বাইকের কী প্রয়োজন?”
সুপ্ত হেসে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“ডিয়ার বাডি, বাবা গেলে বাবা পাওয়া যায় না। কিন্তু বাইক গেলে অবশ্যই বাইক পাওয়া যায়। লাগাও আ’গুন। নতুন মডেল এসেছে বাজারে।”

রফিক সাহেব সে কথায় পাত্তা না দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফ্ল্যাটটা দেখলেন। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বললেন,
“তুই খেয়েছিস কী? ঘরে দেখি কিছুই নেই।”
“কিনে খেয়েছি।”
রফিক সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“হাহ! রান্নাবান্নাও তো জানিস না। এই যোগ্যতা নিয়ে নাকি তিনি আলাদা থাকবেন! এখন আমি গেস্টকে এই সাতসকালে কী খাওয়াব?”
সুপ্তের কপালে ভাজ পড়ল,
“গেস্ট?”
“হুম। আমার নয়, কারণ সে আমার আরেক সন্তান। কিন্তু তোর গেস্ট। ঢাকা থেকে তোর জন্য গেস্ট এনেছি। এন্ড গেইস হোয়াট! আমি আমার নতুন বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকা থেকে বাইক চালিয়ে এসেছি।”
বলেই রফিক সাহেব বাইকের চাবি ছুড়ে মা’রলেন। সুপ্ত ক্যাচ ধরে ফুসে উঠল,
“তোমার নতুন বাচ্চা মানে?”
“মানে তুই তো এখন লায়েক হয়ে গেছিস। মনমর্জি হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। তাই আরেক বাচ্চা এনেছি। এবার ঘুড়ি তুমি মায়ের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের দেশে চলে গেলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। লাটাইসহ সুতো আমার হাতে চলে এসেছে। ওসব কথা রাখ। শীত পড়েছে, পার্কিং করার স্পেস না পেয়ে বাচ্চাটাকে নিচে বাইক পাহাড়া দিতে রেখে এসেছি। তুই গিয়ে একটু গিয়ে বাইকটা পার্ক করে আয়। সাথে চায়ের সরঞ্জাম আনিস। গেস্টকে আপ্যায়ন করতে হবে।”
সুপ্ত তেরছা স্বরে বলল,
“চা কেন? দুধ আর ফিডার আনি? বাচ্চা বলে কথা।”
“হ্যাঁ আনিস। কদিন পরেই কাজে লাগবে।”
সুপ্ত গমগম করে উঠল,
“এত সকালে কে তোমার বাচ্চার জন্য দোকান খুলে রেখেছে যে দুধ, চায়ের সরঞ্জাম আনব?”
“সে আমি কী জানি। যেখান থেকে পারিস আনবি। আর হ্যাঁ, বাচ্চাটাকেও সঙ্গে নিয়ে যাস। দেখে কোলে তুলে নিস না আবার।”

সুপ্ত প্রবল কৌতুহল চাপতে না পেরে সিড়ি বেয়ে হনহন করে নেমে গেল। বাইক গেইটের পাশেই রাখা ছিল। কিন্তু পাহারায় কেউ নেই। সুপ্ত এদিক-ওদিক তাকায়। ভোরের কুয়াশা তখনো বেখেয়ালে ওড়াউড়ি করছে মাথার ওপর দিয়ে। কিছুটা দূরে পথের ধারে কেউ একজন ঝুকে বসে আছে। সুপ্তের বুকে যেন হুট করেই কিছু ধাক্কা দেয়। কণ্ঠনালি পানিশূন্যতা অনুভব করে। অমোঘ টানে সেদিকে ছুটে যেতেই দেখতে পায় অভিমানী এক মুখশ্রী।

অপু সুপ্তের আগমন টের পেয়েও মুখ তুলল না। একমনে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। সুপ্ত ঢোক গিলে ডাকল,
“অপরাজিতা!”
অপু চোরা চোখে তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি রাখল ঘেসো জমিনে।
“কথা বলবে না?”
“কে আপনি? আপনাকে তো চিনি না।” অভিমানে টইটম্বুর অপুর গলা। সুপ্ত হাটু মুড়ে বসল তার মুখোমুখি। উদগ্রীব হয়ে বলল,
“তুমি কেন এলে? মানে কী করে এলে?”
“কেন বলব? আমি তো আপনাকে চিনি না।”
সুপ্ত অধৈর্য হয়ে গেল,
“আহ! হেয়ালি করে না। আমায় বলো প্লিজ!”
“বাবার সাথে এসেছি। আমার নতুন বাবা।”

শব্দগুচ্ছ বোধগম্য হতেই সুপ্ত উত্তেজনায় অপুর হাত ধরে। অপু ঝারা মে’রে সরিয়ে দেয়। মাটি থেকে উঠে জামা ঝেরে বলে,
“অপরিচিত মানুষের হাত আমি ধরি না।”
সুপ্ত উঠে দাঁড়ায়। অধৈর্য হয়। বলে,
“আমি তোমার অপরিচিত কী করে হলাম?”
“অবশ্যই অপরিচিত। আমি যে সুপ্তকে চিনতাম তার শুধু বাহানা লাগত আমার কাছে ছুটে আসতে। দিন হোক বা রাত, সকাল হোক বা বিকাল। আমায় নিয়ে সে ডেস্পারেট ছিল। এক পলক দেখার আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গিলত। আমার সুপ্ত এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আর এই আপনি এক গুপ্ত কুঠুরি, যাকে আমি ভেদ করতে পারছি না। এই সুপ্ত শুধু পালাতে চায়।”
“কী করব বলো, কেউ তো আঁচলে বাধল না।”
“যখন বাধতে চাইল তখনই তো পালালেন।”

বলতে বলতে অপুর চেপে রাখা কান্না আবারো উঁকি দিলো। সুপ্ত একটানে অপুকে নিজের কাছে টানে। তার জন্য কেউ চোখের জল ফেলছে এ যে কতটা সুখের, কতটা গৌরবের তা অব্যক্ত শব্দ হয়ে মিলিয়ে যায় মনের ভেতর। ওই ছলছল চোখ, ফোলানো ঠোঁট, অভিমানী চাহনি জানান দেয় সুপ্তের আরো একজন প্রিয় মানুষ আছে পৃথিবীতে, যে তাকে ভালোবাসে। সুপ্ত অপরাজিতার দুই গালে হাত রেখে আর্দ্র স্বরে বলল,
“ভাগ্যিস পালিয়েছিলাম। নাহলে এই সুন্দর সকাল টা কী আসত আমার জীবনে?”
অপু খেয়াল করল সুপ্তের এটুকু স্নেহে তার বে’ঈ’মান মন মোমের মতো গলে যাচ্ছে। এমনটা তো কথা ছিল না। এতদিন যোগাযোগ না করায় তার এখন কঠিন রাগ করার কথা। রাগে মুখ ফিরিয়ে থাকার কথা। কিন্তু শরীর, মন সব বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। অপু বিড়বিড় করে,
“অসহ্য! অসহ্য!”

রাস্তায় প্রাতভ্রমণে বের হওয়া মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সুপ্ত মুচকি হেসে অপুকে একহাতে আগলে ধরে হাঁটতে লাগল। দূরের ঝোপালো, শুভ্র প্রহেলিকায় আঙুল দেখিয়ে বলল,
“তোমার প্রিয় কুয়াশামাখা ভোরের সকাল।”
“সে তো আপনার অনুরাগের সঙ্গেই আমার জীবনে পদার্পণ করেছে।”
“শিউলি ফুল?”
“আপনার প্রেমময় বাক্য।”
“শিশির?”
“আপনার স্পর্শ।”
“আমি?”
“প্রিয়তম অসহ্য!”

সুপ্তের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। মোহগ্রস্ত হয় অপরাজিতাও। স্নিগ্ধ ভোর তাদের মিলনের সাক্ষী হয়ে ছড়িয়ে দেয় নির্মল হাওয়া। সুপ্ত অপরাজিতার ভ্রু যুগলের সন্ধিক্ষণে একটি পূর্ণ আবেগের চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ভালোবাসি। শিশির ভেজা ঘাস, শিউলি ঝরা ভোরের চেয়েও বেশি।”
অপরাজিতা তার বুকে নিজেকে সমর্পণ করে একইরকম ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো,
“ভালোবাসি। সুপ্তের হৃদয় সিক্ত অনুরাগের চেয়েও বেশি।”

_____(সমাপ্ত)_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here