অচিনপুর পর্ব -০১

— তুমি আমার দেওয়া উপহারটাই দিয়ে দিলে!
সৌমিকের এমন গম্ভীর কন্ঠ আমি আগে কখনো শুনিনি! কাঁদোকাঁদো হয়ে বললাম,
— ছোটো আপা চাইল যে!
— চাইলেই তুমি তোমার সব দিয়ে দেবে তাকে?
— আমার তো লাগছিল না ওটা!
— উপহার ছিল ওটা। উপহার কারো প্রয়োজন বুঝে দেওয়া হয় না, ফুলপরী! ওটা স্নেহ, ভালোবাসা আর আন্তরিকতার নিদর্শন। সেটা অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার মানে যে উপহারটা দিয়েছে তাকে অপমান করা। তোমার না লাগলে, আমার দেওয়া উপহার আমায় ফিরিয়ে দিতে পারতে!
আমি এতটা বুঝিনি। একটা সামান্য মাউথ অরগানই তো! সেটাও ব্যবহৃত, নতুন কেনা নয়। ছোটো আপা কেন যে ওটা এত পছন্দ করল! ওকে দিতেই হবে সেটা, জোর করে চেপে ধরল আমাকে। আমি না করি কীভাবে! কাউকে অপমান করার কথা দূর, সামান্য কষ্ট দেওয়ার কথাও আমি কখনো ভাবতে পারি না। অথচ আমাকেই সবাই কাঁদায়! কান্নার তোড়ে মুখে কথা আসছিল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,
— ফিরিয়ে আনব তবে?
রেগে গেলে ও চুপ হয়ে যায়। মাথা নেড়ে বলল,
— বাড়ি যাও। কী থেকে কী বলব, কেঁদে মরে যাবে। পরে মান ভাঙাতে পায়ে সাধতে হবে। ওসব এখন ভালো লাগবে না। ব্যস্ত আছি। তুমি বাড়ি যাও।
বকুনি শুনে আমার চোখজুড়ে অশ্রুর বর্ষা নামল। বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা মুছতে মুছতে আমি ছুটে বেরিয়ে এলাম।

উত্তর দিকের দিগন্ত জুড়ে ওই যে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে, একমাথা সবুজ সবুজ টুপি মাথায় নিয়ে – তারই কোলে যে ছোট্ট গ্রামটা, সেই গ্রামটার এক কোণে আমার বাড়ি। অসমান পাথর আর কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি।
আমার নাম স্বর্ণচাঁপা। আমার বাবার দেওয়া নাম। ছোটো করে বাবা ডাকতেন স্বর্ণ৷ আমার মায়ের খুব প্রিয় ফুল ছিল স্বর্ণচাঁপা। বাবা যেদিন মাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলেন, সেদিন অঞ্জলি ভরে এই চাঁপা ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাতেই নাকি মা কাত, বাবা বলতেন! আসলে অনেক আগেই বাবাকে মন দিয়ে ফেলেছিল মা, চাঁপা ছিল শুধুই অজুহাত! বাবা আরও বলতেন,
— আমার জীবনে সমস্ত সুন্দর শুরু হয়েছে স্বর্ণচাঁপা দিয়ে!
মা ছিল বাবার সুন্দর! সেই সুন্দর খুব কম সময় স্থায়ী হয়েছিল। যেদিন আমি জন্ম নিলাম, সেদিনই নাকি মা মরে গিয়েছিল। অনেক যন্ত্রণা দিয়েছিলাম আমি, আমার মিষ্টি মা-টাকে। তাই এখন আর আমি কাউকে কষ্ট দিই না।
বাংলাদেশের নদী আর সমতলের পাট চুকিয়ে এই উঁচুনিচু পাহাড়ের দেশে আবাস গড়েছিলেন বাবা, সে বহুকাল আগের কথা। তারপর একদিন পাহাড়ি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে, বাবাও চলে গেলেন মায়ের কাছে, সেও তো অনেকদিন আগের কথা! বারো বছর হবে।
আমার জন্মদিন ছিল সেদিন। সাত বছরের আমি, বায়না করেছিলাম নতুন বারবি ডলের জন্য। এই পাহাড়ে, আশেপাশের বড়ো শহরগুলোতে ওসব পাওয়া যায় না। এখানে মাটির পুতুল আছে, কাঠের পুতুল পাওয়া যায় আর লাল, নীল কাপড়ের পুতুল। সবই পাহাড়ের আদিবাসী মেয়েদের হাতে গড়া। ও অনেক ছিল আমার। কাবার্ড ভরা ভরা।
আমার কোনো বায়নাই অপূর্ণ রাখতেন না বাবা। তখন এখানে মাসে একদিন সৌখিন জিনিসের ট্র‍্যাক আসত, রাজধানী শহর থেকে। সেদিনও এসেছিল সেটা। আমার নতুন পুতুল নিয়ে। ঝমঝম বৃষ্টি নাচছিল সেদিন সারা পাহাড়ের কোল জুড়ে। দুরন্ত জলের ধারা এত জোরে ছুটে ছুটে পড়ছিল যে মাটিতে নেমেই তারা কুয়াশা হয়ে যাচ্ছিল আর কতকটা ভেসে যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝরণার মতো করে! সে কী বৃষ্টি, থামাথামির নামই নেই! সকাল গড়িয়ে গেল, দুপুরটাও! বিকেলও নামতে বসল। ও যেন পণ করেছিল, জমানো জলের সমস্তটা দিয়েই পাহাড়গুলোকে ভাসিয়ে দেবে সেদিন! আমার চোখের জলও যেন থামছিল না!
সন্ধের আগে বাবা তাই বেরিয়ে পড়লেন জিপটা নিয়ে। জন্মদিনের উপহার, সেদিনই তো দেওয়া চাই! পুতুলটা কোলে বসিয়ে ফিরছিলেন বাবা। সহজ রাস্তাটা দিয়ে নয়। ও সহজ হলেও প্যাঁচানো বড্ড! ওই রাস্তাতে সময় লাগে বেশি। বাবার তো আগে দ্রুত আসার ছিল। সময়মতো আমাকে আমার গিফট দেওয়ার ছিল। তাই বাবা কঠিন কিন্তু কম সময়ে পাড়ি দেওয়ার রাস্তাটায় গাড়ি ছুটিয়েছিলেন। পানিতে পেছল হয়ে গিয়েছিল মেটে রাস্তা। বৃষ্টিতে সাম্নের বাঁকও দেখা যাচ্ছিল না। পথ ছেড়ে গাড়ি সোজা লাফ দিয়েছিল খাদের কিনারায়! অদ্ভুতভাবে বাবার লাশটা ছিল অক্ষত! পুলিশ আংকেলের হাত ধরে আমি যখন হাসপাতালে গেলাম বাবাকে দেখতে, মনে হচ্ছিল বাবা যেন শান্ত ছেলে হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে রাত্তিরে, আমি মা হয়ে, বাবাকে আমার ছেলে বানিয়ে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতাম, ঠিক তেমনি চুপ করে বাবা ঘুমিয়ে আছে। পাহাড়ি পাখির গানের সাথে সাথে, ভোরের মাখন আলোটা উঁকি দিতেই বাবাও চোখ মেলবে! বলবে,
— খুকী, গেট ফাস্ট! স্কুলে যেতে হবে।
আমিও দুটো এলোমেলো ঝুঁটি ঝুলিয়ে বাবার জিপে, বাবার পাশে গিয়ে বসব।
বাবাকে ভেবে আমার চোখে আবারও জলের ফোঁটা বইল।
বেলা গড়িয়ে সূর্যটা ওই নীল পাহাড়টার ওই ওপারে হারিয়ে যাওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করার আগেই ওই বেলার কান্না ভুলে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পাথুরে সরু পেঁচানো রাস্তার একদম উপরে কাঠের রেলিঙ দেওয়া বারান্দাটা ঝুলে আছে তালগাছের ঝাঁকড়া মাথায় বাবুই পাখির বাসার মতো করে। সেই বাবুইয়ের বাসা থেকে মাথা বের করে রাস্তার ওইপাড়ের ঝুপড়ি ঘরের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক ছাড়লাম,
— ও কৃষ্ণা দিদি, আজ ফুল তুলতে যাবে না?
পাহাড়ের উপজাতি মেয়ে কৃষ্ণা দিদি, কাঠের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
— একটু পরে ডাকব তোমাকে, দিদি । বাবা আজ মদ খেয়ে আঙিনায় শুয়ে আছে। ফুল তুলতে যেতে গেলেই তার সামনে পড়তে হবে। বাবার নেশা চুকে গেলে মাকে বড্ড বকবে আর মারবে!
আমার মন খারাপ করল। অজয় কাকা বড্ড পাজি। শুধু চিৎকার করে আর গালাগাল করে। কই আমার মামা তো এমন নয়। মামির বকুনির ভয়ে সকালবেলার প্রথম চা-টাও ওর মামা নিজেই করে নেয়।
মন খারাপ করে ঘরে এলাম আমি।
মামা গতকালকের বাসী পত্রিকা পড়ছিল বসে বসে। আমাকে দেখেই বলল,
— কীরে খুকী, আজকে পেপার দিলো না? কী করি বল তো সারাদিনে!
— দিন তো কেটেই গেছে, মামা। আর কী! এমন বৃষ্টির দিনে পেপার তো আসে না। ভোরে কেমন বৃষ্টি হলো বলো! হকার ছেলেটা নিজে তো ভিজে যায়ই, কাগজগুলোও ভিজে যায়। ভিজে কাগজ পেলে, তোমরাই আবার ওকে বকাবকি করো! কালকে দুটো দিনের পত্রিকা একসাথেই দিয়ে যাবে, জমিয়ে পোড়ো!
— আর উপায় কী! ইলেকট্রিসিটিও কী ঝামেলা করছে! টিভিটাও ছাড়ব সেই উপায় নেই। কী মরার দেশে বাড়ি করেছিল তোর বাবা! খালি পাহাড় আর পাহাড়! যেদিকে তাকাই, পাহারাদারের মতো একগাদা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছ! পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই এই দেশে!
মামি মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে সামনে দিতে দিতে বলল,
— ওর বাবা এই মরার দেশে বাড়িটা করেছিল বলেই, মাথার উপর ছাদ আছে। তোমার ওই রাজধানী শহরে ঝড়-বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর কিছুও তো করতে পারো নি কোনোদিন! বছর বছর বাচ্চা পয়দা করেছ শুধু, তাদের মুখে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করোনি। স্বর্ণর বাবা এই বাড়ি আর পাহাড়ের জমিগুলো রেখে গিয়েছিল বলেই খেয়ে-পরে আছি!
অক্ষমতায় খোঁটা দিলে একটু রেগে যায় মামা। অনেক বছর বাদে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, খোঁচাটাই লাগে শুধু। মিনমিন করে মামা বলল,
— আমাদের মামা-ভাগ্নীর কথার ভেতর তুমি কেন ঢোকো?
এবার মামী রেগে যাবে। তারপর ঝগড়াঝাটি আর কান্নাকাটি চলবে সারারাত।
আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম,
— আপা-রা ফিরতে এত দেরি করছে কেন আজ? আমিও বোর হচ্ছি মামা।
— গরমের ছুটি শেষ না তোদের? বাড়ি বসে আছিস কেন?
— কলেজের একাডেমিক ভবন ধসে পড়ে গেছে, মামা। তুমি পেপার মুখস্থ করেও কিছু জানো না?
— নাহ, দেখিনি তো এই খবর! এইজন্যই ঘরে বসে আছিস তুই?
মামি ফুট কাটল,
— উনি রাখবেন বড়ো বড়ো শহরের খবর। আমাদের এই ছোটো পাহাড়ি গ্রামে ওনার মতো বড়ো মানুষের কাজ কী, খুকী! আনারসের জমিগুলোতে পানি আটকে সব ফল যে পচে গেল এবার, সেই খবরে ওনার কী দরকার! চাষীরা না খেয়ে থাকবে এই বছর। আমার টাকার বাক্সেও টান পড়বে! চায়ের সাথে টা আর সপ্তাহের শেষে মাংস বন্ধ হবে বলে দিলাম আমি!
মামীর রাগ হওয়ারই কথা। দিনরাত খাটছে। বাড়ি সামলাচ্ছে আবার জমির ফসল, কৃষকের ঘর-সংসারও সামলাতে হচ্ছে তাকেই। টানাটানি করেই নিজের তিনটে মেয়েসহ আমাদের চার বোনকে ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
মামী মুখ বাঁকিয়ে যেতে যেতে বললেন,
— খুকী, ক্রচেটের নতুন যে প্যাটার্নটা শিখিয়েছি, চট করে একটা ফুল তুলে আন তো! বসে বসে অকর্মার ঢেঁকি হতে হবে না!
আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লাম। আমাদের যে কারো কাজে অসন্তুষ্ট হলেই মামী একজন মানুষকেই বকেন, সে হলো আমার মামা। মামাকে কেউ বকলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মামীর বকুনি শুনে মুখটা কেমন শুকিয়ে যায় অত বড়ো কাঁধ আর শরীরঅলা মানুষটার! আমার বুকের মাঝে ভীষণ লাগে। সবাইকেই মামীর মতো অমন কাজের মানুষ হতে হবে, এমন দিব্যি কি কেউ দিয়ে রেখেছে কোথাও? দুএকটা এমন অলস, ঢিমেতাল মানুষ না হলে পুরো পৃথিবীটাই তো একটা অটোমেটিক মেশিন হয়ে যেত – চলছে তো চলছেই, চলতেই আছে!
আমি আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মেঘের দল যেন অপেক্ষাতে ছিল, আমি এসে দাঁড়াতেই আমাকে ঘিরে ধরবে বলে। সাদা সাদা ধোঁয়ার মাঝে আমি আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। মেঘেরা বড্ড ছটফটে। এক জায়গাতে থাকতেই চায় না। যেই না ওদেরকে জড়িয়ে ধরব বলে হাত বাড়ালাম, অমনি ভেসে ভেসে পালিয়ে গেল। দূরে টিলার উপর বড়ো বাড়িটা সহজেই চোখে পড়ল। এই মেঘের শামিয়ানায় ঢেকে যাচ্ছে বাড়িটা, আবার একটু বাদেই মেঘঝাড়া দিয়ে উঁকি দিচ্ছে! মেঘের কুয়াশাগুলো চারিপাশ থেকে ঢেকে দিতে চাইছে কাঠের সাদা রঙ করা বাড়িটাকে। এখান থেকে দেখে রূপকথার কোনো অচিন রাজ্যের ঝিম ধরা রাজকীয় প্রাসাদ মনে হচ্ছে বাড়িটাকে।
আমার ছোটো বেলা থেকে এই বাড়িটা দেখছি। রাস্তার উপর কাঠের গেইট দিয়ে ঘেরা ছিমছাম তেতলা বাড়ি। সেই তখন অত বড়ো আর সুন্দর বাড়ি অচিনপুর সদরেও কোথাও ছিল না। লাল টালির ছাদ দেওয়া বাড়িটার গেইটের সামনে কুঞ্জলতার ঝাড় আর গাঢ় রঙের বাগান বিলাসের ডাল ঝুলে থাকে সারা বছর। বাবার হাত ধরে ওই বাড়ির সামনে যেতাম আমি। বাড়িটা যেন এক অপার রহস্য ছিল আমার কাছে। সবসময়ই তালা দেওয়া থাকত তো!
বছর পাঁচ হলো সৌমিক আসছে নিয়মিত। ফি বছর অন্তত দুই মাস এই বাড়িতে এসে থাকে ও।
কৃষ্ণা দিদি ফুল তুলে সদরে বেচতে নেয়, এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে, আর আমাদের গ্রামের যারা ফুল ভালোবাসে তাদের ঘরেও শোভা পায় কৃষ্ণা দিদির নার্সারির ফুল। গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, জিনিয়া, এস্টার, ডাইথাস ছাড়াও এমন কিছু ফুল আছে যেসব কৃষ্ণা দিদির নার্সারিতে চাষ হয় না। কিন্তু পাহাড়ের ধাপের গোঁড়ায় গোঁড়ায় ফুটে থাকে। শ্বেতকাঞ্চন, বুনোজুঁই, কেতকী, কাটালি, কুরুক, পলাশপদ্ম, নীলকমল – সবকিছুর স্টক থাকে ওর ঝুড়িতে। যেদিন যেদিন পাহাড়ে ফুল তুলতে যায়, ওর মস্ত ঝুড়ির সাথে একটা ছোটো ঝাঁপি নিয়ে আমিও যাই সাথে। ফুল নিয়ে আগে স্থানীয়দের চাহিদা মেটাই, তারপর জিপ গাড়ির পেছনে তুলে দিই মস্ত ঝুঁড়িগুলো। সেদিন এতগুলো শ্বেতকাঞ্চন তুলেছিলাম আমি ঝাঁপি ভরে। সাদা বাড়িটার বারান্দা থেকে সৌমিক ডেকেছিল আমাদেরকে,
— এই যে ফুলপরী, বেচবে তোমার ফুল?
আমরা ঘাড় উঁচু করে দেখলাম, ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে দুটো বলের মতো হেডফোনটা ঝুলিয়ে, মাথাটা একটু কাত করে, বারান্দার রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে একদম মেঘের মতো দেখতে একটা ছেলে হাত নেড়ে ডাকছে আমাদেরকে। কালো মেঘ না গো, এক পশলা দারুণ বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে সূর্যটা আকাশ ফরসা করে দিলে, সোনারঙ রোদের সাথে সে তুলতুলে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো তুলো তুলো মেঘ ভাসে, সেই মেঘ!
ছেলেটা আবার ডাক দিলো,
— কই ফুলপরী, দেবে আমাকে ফুল? ভেতরে এসো!
কৃষ্ণা দিদি ওই বাড়ির গেইটটা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলছিল,
— তোমাকে বলেছেরে দিদি!
— কেন এমন মনে হলো তোমার? আমার হাতেও ফুল, তোমার হাতেও ফুল!
— তুমি যে খোঁপায় ফুল গুঁজেছ দিদি! এই ঝুমকো লতার ফুলে তোমায় একদম পরীর মতোই লাগছে যে!
— বাজে বোকো না তো!
আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
সৌমিক বেছে বেছে সব ঝুমকো লতা ফুলগুলো নিতে নিতে বলেছিল,
— তোমার খোঁপার ফুলগুলো আসলেই বেশি সুন্দর নাকি তুমি পরেছ বলেই ওগুলো সুন্দর হয়ে আছে বুঝতে পারছি না। এই যে সাদা ফুলগুলো, মাঝে মাঝে হলুদের ছটা, কী নাম এদের?
কৃষ্ণা দিদি চট করে বলে দিলো,
— শ্বেত কাঞ্চন। স্বর্ণর খুব প্রিয় ফুল।
— বাহ, তোমার নাম বুঝি স্বর্ণ? চমৎকার নাম।
আমি আড়ষ্ট হয়ে জবাব দিয়েছিলাম,
— আমার নাম স্বর্ণচাঁপা!
— ওরেব্বাস, পুরো নামটা তো আরো চমৎকার! বেশ, স্বর্ণচাঁপা, তুমি কালকে খোঁপায় শ্বেতকাঞ্চন দিয়ে এসো তো। আজকে যতটা কম সুন্দর দেখাচ্ছে, কালও একে এতটাই কম রূপসী দেখায় কি না পরীক্ষা হয়ে যাবে!
তারপর থেকে প্রতি বছর সৌমিক আসছে। যখন যখন অচিনপুরের পাহাড়জুড়ে ময়ূরনাচা বর্ষা নামে, তখন দুমাস করে এই পাহাড়ের বাড়িটাতে এসে থেকে যায় ও। আর রোজ দুবেলা ওর জন্য ফুল বয়ে নিয়ে যাই আমি।
বৃষ্টির রাতগুলোতে, অবিশ্রান্ত বর্ষণ করে বর্ষারাণী একটু থামে, একটু জিরোতে শুরু করে যখন, পাতায় পাতায় জমে থাকা পানির ফোটা ঝরার টুপটাপ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও, নিশুতি সেই রাত চিরে, এই পাহাড়ে ওই পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে সৌমিকের গিটারের সুর বিরান প্রান্তর পেরিয়ে এতটা দূরের বাড়িতে এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয় আমাদের। কোনোদিন বাজে এস্রাজ! সারা পাড়া এস্রাজের সুরে ঘুমাতে যায় সেদিন।
আজও এস্রাজের সুরে ঘুম এসে পড়েছিল। ছোটো আপা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো।
— কী সুন্দর বাজায় সৌমিক, না?
— হুম।
ঘুমঘুম কন্ঠে জবাব দিলাম আমি।
— এই যে সুর তুলেছে, গানটা জানিস তুই?
— উঁহু! কার গান?
— শ্রাবণী সেন এর। রবীন্দ্রনাথের স্বরলিপি। পুরো গানটা শুনবি?
— এখন?
— অল্প একটু শোন?
— হুম। শোনাও।
ছোটো আপা এস্রাজের সাথে মিলিয়ে সুর করে গেয়ে উঠল,
“তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল
চরণপাতে।।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
আমি রাখব গেঁথে তারে
রক্তমনির হারে,
আমি রাখব গেঁথে তারে
রক্তমনির হারে,
বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে।।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার,
মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে-
তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার,
মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে-
ছিন্ন যবে হল তার
ফেলে গেলে ভূমি-পরে।
নীরব তাহারি গান
আমি তাই জানি তোমারি দান-
নীরব তাহারি গান
আমি তাই জানি তোমারি দান-
ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায়-হাওয়ায়
সুরহারা মূর্ছনাতে।।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল
চরণপাতে।।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।”

আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ছোটো আপা তুলে বসাল আমাকে। বলল,
— আমার নামটা বিন্নি না হয়ে তোর মতো সুন্দর কোনো নাম হলো না কেন? সৌমিক কী সুন্দর করে ডাকে তোকে, ‘ফুলপরী!’ আমাকে ডাকতে হলে কী ডাকবে, ‘ধানপরী!’ বলবে, ‘এই ধানপরী’ তোমার ঝুড়ির কালো বিন্নির ভাত খাইও তো আমাকে!
আমি হেসে ফেললাম।
— বড়ো আপার নাম তিন্নি, তারপর মেজ আপা মুন্নি, তোমার সাথে আর নামের মিল না পেয়ে বিন্নি রেখে দিয়েছে। এতটাও খারাপ নয় নামটা! আর ‘ধানপরী’ শব্দটাও বাজে নয় একটুও!
— সত্যি বলছিস?
— আমি মিথ্যে বলি না, ছোটো আপা।
আসলে মিথ্যে আমি বলি। সময়ে অসময়ে কাউকে খুশী করতে প্রায়ই আমি মিথ্যে কথা বলি। কারো মন ভালো করতে মিথ্যে বললে সেই পাপ লাগে না!
ছোটো আপা অধৈর্য হয়ে বলল,
— সৌমিক কখনো আমার কথা বলে?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কী বলবে?
— এই ধর, আমি কেমন আছি, কী করছি, কলেজে গেছি কি না – এসব জানতে চায় না? আমার নামে কিছুই কি জানতে চায় না? সেই যে আমি হাত পুড়িয়ে বালিহাঁস রেঁধে খাওয়ালাম আগের বছর, সেইরকম খেতে চায় না? গত বছর সে উলের সোয়েটারটা হাতে বুনলাম সেটা পরেছে? আমি নিজেই তো মাপ দিয়ে বানালাম, ফিট করার কথা তো!
— বলেছিল মনে হয়। আমি ভুলে গেছি।
আমার হাই তোলা দেখে রাগ করল আপা। রেগে গিয়ে শুয়ে পড়ার আগে আগে বলল,
— তুই সব ভুলে যাস, স্বর্ণ! দরকারের কথাগুলোই সব ভুলে যাস! সবসময়ই!
আমার ঘুমটা কাটিয়ে দিয়ে ও ভোঁসভোঁস করে ঘুমাতে শুরু করল। অনেকক্ষণ ধরে এপাশ ওপাশ করেও যখন ঘুম এলো না আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
আজ ভোরবেলাতেও ঝুমবৃষ্টি ছিল। রাত হতে হতে আকাশ একদম ঝকঝকে। বাতাস খুব তীব্র। ঠান্ডাভাবও আছে। নাক-কান জমে যাচ্ছে। উলের শালটা মাথায় আর গলায় পেঁচিয়ে বারান্দায় এসে পড়লাম। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আকাশে লক্ষ কোটি তারা। আমার বারান্দাটা থেকে হাত দশেক দূরত্বেই দুই পাহাড়ের খাদ। চাঁদের আলোয় আরো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যেন পাহাড়ের খাদের উপরেই ঝুলছে এই বাড়িটা। গায়ে কাঁটা লেগে ওঠে!
আমাদের এই অচিনপুর গ্রামটা আয়তনে বড়ো হলেও লোকালয় কম। মেখলি পাড়া আরো বেশি ছোটো। তাতে অধিবাসী আরো কম। সব মিলিয়ে আঠারো ঘর লোক আছি আমরা এই পাড়ায়।
তুলনামূলক নিচু টিলাগুলোতে বাড়িগুলো ওঠানো হয়। পাহাড়কাটা রাস্তার বাঁকে বাঁকে এক চিলতে জায়গা নিয়ে একেকটা বাড়ি। শুধু সৌমিকদের শাদা বাড়িটা এক আকাশ উঁচুতে। এই মেখলি পাড়ার সবচেয়ে উঁচু টিলার ওই বাড়িটা গ্রামের সব জায়গা থেকে দেখা যায়।
চাঁদের আলোয় ভাসতে থাকা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিলাম আমি!

চলবে …
আফসানা আশা
#অচিনপুর – ১

(অচিনপুর নিতান্তই আমার কল্পনার কোনো রাজ্য। কোনো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, অঞ্চল বা সংস্কৃতির সাথে এর কোনো মিল নেই। তাই এর নাম অচিনপুর!)

*** নিজের মনে করে কপি করবেন না প্লিজ, ওয়ালে রাখতে চাইলে শেয়ার করুন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here