অচিনপুর পর্ব -৩০ ও শেষ

#অচিনপুর – ৩০ (শেষ পর্ব)

অচিনপুরের আকাশে শীত নেমে গিয়েছে। ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালে আমার প্রিয় পাহাড়গুলোকে আর দেখতে পাওয়া যায় না, কুয়াশার মেঘে ঢাকা পড়ে ওরা একদম আড়ালে চলে গিয়েছে। ভোরের আর সন্ধের অচিনপুর দেখলে মনে হয়, কোথাও যেন কেউ মস্ত ধূপ জ্বেলে দিয়েছে, ধুনোয় ভরে আছে সমস্ত আকাশ! তবে ধূপের নাক জ্বলে যাওয়া গন্ধটার বদলে কুয়াশার সাথে ভেসে আসে বুনো পাহাড়ি ফুলের অজানা ঘ্রাণ!
আমার এই বাড়িটা আর থাকার উপযোগী নেই। শীতকাল বলে এখনো থাকা যাচ্ছে, একটু বৃষ্টি হলেই ভেসে যাব। সৌমিকদের সাদা বাড়িটাতে উঠে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি মনে মনে।
উলের চাদরটা টেনে নিয়ে আমি বরণ পাড়ার রাজবাড়িতে ঢুকলাম। এখন আমার সাথেও জিপগাড়ি থাকে। বাবারটাই। আমি এখনো ড্রাইভিং শিখিনি। মংসিক আমার গাড়ি চালিয়ে সদর ফটক দিয়ে ঢোকার সময় মস্ত রাজবাড়িটা একসাথেই চোখে পড়ে। আমি এক পলকে সমস্ত বাড়িটাকে পড়ে নিতে পারি। ফেরেনি পাহাড়ের রাজা, ফেরেনি সে! আমাকে কিছু না বলেই চলে গেছে। একদম হারিয়ে গেছে! জো-মাও বলে,
— এলো সক্কালে, আরেক সক্কালে চলে গেল! আর এলো না!
সেদিন ডুলে পাড়া থেকে আমাকে আমার বাড়িতে রেখে সে সোজা রাজধানীর পথ ধরেছে। আমি জানি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই। ওই যে বলেছিল, মিথ্যে এই বিয়ে! সেটাই সে বিশ্বাস করে। কিন্তু আমি তো পারি না, তার মতো করে ভাবতে। আমি প্রতিদিন একবার করে বরণ পাড়ায় আসি, আর বাড়ি ফিরে গিয়ে কাঁদতে বসি!
সাজেদা আন্টি উঠোনে নেমে এসেছেন। রোদ পোহাচ্ছেন। কাঁচাসোনা রোদে তাকে সোনার প্রতিমার মতো দেখাচ্ছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই ডাকলেন। আমি জিপ থেকে নেমে এসে বললাম,
— তোমাদের সমস্ত ঘরে হিটার দেওয়া আছে, তবুও তুমি বাইরে এসে ওম নিচ্ছো?
— তোদের ওসব মেশিনে আমার দমবন্ধ লাগে। কেমন সুন্দর রোদ উঠেছে, বল? তুইও বস।
— না। আমি প্রমির ঘরে যাই।
— য়েন য়েনদের বাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছে, দেখগে যা। তোর জন্যও শাড়ি এসেছে। জো মাওয়ের ঘরে সব রাখা আছে। প্রমিকে ডেকে নিয়ে এরেলা চলে যা। শাড়ির সাথে মিলিয়ে গয়না, চুড়ি কিনে নিয়ে আয়। প্রভাতকে দিয়ে কেনালে তো তোরা মেয়েরা পছন্দ করবি না আবার!
আমার পরানটা যেন ধ্বক করে উঠল! একটা নামেই যে কারো কারো পরানপাখি বন্দী থাকে, সেই কথাটা কী ভীষণ সত্যি! নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম,
— ও আসছে?
সাজেদা আন্টি হাত ঘষে গরম করে উলের হাতমোজা পরতে পরতে বলল,
— কী শীত পরেছে রে এবার? সারারাত লেপের নিচে থেকেও আমার পা গরম হয় না। মোজা না থাকলে হাতদুটোও বরফ হয়ে থাকে। কী বললি? কে আসছে?
— তুমিই তো বললে? তোমার ছোটো ছেলে, সে আসছে?
— আসবে না? তার ভাইয়ের বিয়ে, সে আসবে না? সেই তো বরকর্তা। বড়োটির কি কাজ ছাড়া মাথায় আর কিছু আছে? সখ করে যে বউটিকে আনছে, সে থাকবে? তাকে সময় না দিলে, বলি, সে কি থাকবে? তোর টাকার মুখে ঝাঁটা দিয়ে চলে যাবে না?
সাজেদা আন্টি একগাদা বকল কাজপাগল প্রহ্লাদ দাদাকে উদ্দেশ্য করে। সেসব কিছু আমার কানে ঢুকল না। আমি ভাবতে বসলাম অন্য কথাটা।
তাই তো! কী বোকা আমি! প্রহ্লাদ দাদার বিয়েতে তার ভাইকে তো আসতেই হবে!
এবার কী করবে তুমি, পাহাড়ের রাজা? আমি যখন সামনে দাঁড়িয়ে জবাব চাইব, কী করবে তুমি? উত্তর তো দিতেই হবে আমাকে। আমি তো আর সেই আগের মতো বোকা স্বর্ণ নেই। আর আমাকে বোকা বানিয়ে উড়ে যেতে তুমি পারবে না!
প্রহ্লাদ দাদা আর য়েন য়েন দিদি অবশেষে জিতেছেন নিজেদের সম্পর্কের মর্যাদায়। একটু অন্যরকম হচ্ছে বিয়েটা। দুইপক্ষই নিজেদের মতো করে বিয়ের আয়োজন করছে। কেউ কারো ধর্মীয় বিধিতে সাংঘর্ষিক কোনো আচার কেউই করবে না, আর নিষিদ্ধ খাবারে একে অন্যকে আপ্যায়ন করবে না। য়েন য়েন দিদির বাড়ি থেকে ওকে রাজবড়িতে আনার পরপরই ও পুরোপুরি এই পরিবারের হয়ে যাবে। এদের ধর্ম, সংস্কার আর পারিবারিক রীতিনীতি মেনে চলতে হবে।
সেইজন্যই পাহাড়ি পুরোহিতের বিয়ের আয়োজনের অংশ হিসেবে ওবাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছে, এই বাড়ি থেকেও যাবে। ওরা তেল, হলুদ, আদা, মশলা, আতপ চাল, মুরগি, পান, সুপারি আর নিজেদের তাঁতে কাটা কাপড় পাঠিয়েছে সবার জন্য।
রাজবাড়ি থেকেও একই তত্ত্ব যাবে। পাট পাট কাপড় এনে টাল দেওয়া হচ্ছে জো-মাওয়ের ঘরে। প্রচুর তাজা ফল আর মিষ্টি এসে নিচতলা ভরে উঠেছে। বিয়েবাড়ি আমেজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমি জো মাওয়ের ঘরে গেলাম প্রমিকে ডাকতে। ওঘরে মিটিং বসেছে। জো-মাও, প্রমি আর আরো আরো আত্মীয় স্বজনে ঘরটা ভরে আছে। গয়না নামানো হচ্ছে মাওয়ের আলমারি থেকে। মাও ততটা নড়তে চড়তে পারে না বলে প্রমি আলমারি থেকে গয়নার বাক্স নামিয়ে দিচ্ছে আর মাও পরখ করে দেখে দেখে আলাদা করে রাখছে। একটা লাল পাথরের গয়না প্রমির খুব পছন্দ হয়ে গেল। ও বলল,
— এইটা আমার জন্য রাখো, মাও।
— তুই নিবি? তোর জন্য তো আলাদা গয়না করা আছে। তোর মায়ের কাছে তোলা আছে সেসব। সে নাটক নভেল করে এখানে আসলো না। বিধবাদের বলে আনন্দ অনুষ্ঠানে থাকতে নেই। তা আমিও তো স্বামীমরা মেয়েমানুষ। আমি করছি না আনন্দ? আমার নাতিদের বিয়েতে আমি নেচে নেচে আনন্দ করব। কে আটকাবে? ওসব হচ্ছে বিধবা মেয়েটার কাজ না করার ছল। আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে রোদ পোহাচ্ছে!
— সে কী আছে না আছে তুমি আর মা বুঝবে। এটা আমি নেবো।
— আচ্ছা নি গে। তবে ওই বালা জোড়া প্রহ্লাদের বউয়ের জন্য আর মুকুটটা প্রভাতের বউয়ের জন্য রাখ।
ধাতুর পাত্রে পাথরের টুকরো পড়ে যেমন টাং করে শব্দ হয়, ‘প্রভাতের বউ’ শব্দটাও আমার মাথায় তেমন করে জুড়ে বসল। মুকুটটার উপর খুব লোভ হলো। এ নিশ্চয়ই আমার। খুব লজ্জাও পেলাম মনে মনে। প্রমি আমাকে দেখে বলল,
— তৈরি হয়েই তো আছিস। চল তাড়াতাড়ি এরেলা যাব। শপিং করতে হবে। তত্ত্ব নিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। সাদামাটা সাজে গেলে হবে? এমনভাবে যেতে হবে, সারা অচিনপুর বলবে রাজবাড়ির মেয়েরা এসেছে!
— কে কে যাবে?
— আমি, তুই, আমাদের বন্ধুরা কয়েকজন, প্রহ্লাদ দাদার বন্ধুরা আর প্রভাত দাদার বন্ধুরা।
— ওরা কখন আসবে?
খানকতক আরো গয়নার বাক্স নামাতে নামাতে ও বলল,
— ওরা কারা? সবাই চলে এসেছে।
— সবাই? কই, আমি দেখিনি তো!
— তুই তো কানি। এতদিন বোকা ছিলি। এখন হয়েছিস কানি! বাড়িতে একটা ঘরও খালি আছে? সব ভরে গেছে। ওই যে প্রভাত দাদা বন্ধুদের নিয়ে এখানেই তাদের জুড়িগাড়ি জুতেছে!
আমি বিস্ময়ে সব ভুলে গেলাম। জো মাওয়ের বিরাট পালঙ্কের একপাশে পাট করা কাপড়ের ভেতর পাহাড়ের রাজা আর চারপাশে ওর বন্ধুরা। কয়েকটা মেয়েও আছে। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম, সেই পেইন্টিংয়ের মেয়েটা কোনটা? কিন্তু ছাই চিনব কী করে? মুখ কি কখনো দেখেছি আমি ওই শাকচুন্নিটার?
আমার চোখে পানি এসে গেল। এতক্ষণ আমি এইঘরে এসেছি, ও একটি বার ডাকল না! কথা বলল না! আমার অভিমান হলো। ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ওরা হাসিঠাট্টা করে যাচ্ছে। পাহাড়ের রাজা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সেই সুন্দর হাসিটা। জো-মাও বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি! আমার ভেতরের অভিমান বালির বাঁধের মতো চুরচুর করে ভেঙে গেল! আমি লাফ দিয়ে ওইপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একগাল হেসে বললাম,
— না বলে চলে গেলে কেন? কখন এসেছে? কেমন আছ?
আমার হাসির জবাবে ও চোখদুটো আধখোলা করে দেখল আমাকে। অন্য চোখগুলোর কৌতুহল মেটাতে বলল,
— ও চাঁপা। প্রমির বন্ধু। পাহাড়েই বাড়ি।
ব্যস! এইটুকুই আমার পরিচয়? আর কিছু নেই? অন্য আর কেউ নই আমি?
আবার ঠোঁট ফুলতে থাকল আমার। আমি ওর হাত ধরে টান দিলাম,
— তোমার সাথে কথা আছে আমার। উঠে এসো এদিকে।
ও আমার হাতটাকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলল,
— আমার সাথে তোর কোনো কথা নেই, চাঁপা! ঘুমাতে দে, বিরক্ত করিস না!
— এখানে বুঝি তুমি ঘুমাচ্ছিলে? আমার চোখ নেই? আমি দেখি না?
— দেখতে কে বলেছে তোকে? নিজের কাজ কর। আমাকে বিরক্ত করিস না। কাজ কর। কাজ না করলে অন্য কোথাও যা!
বলেই চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। কী প্রচন্ড অবহেলা! কী অপমান!
এর ভেতর ওই মুখ না আঁকা মেয়েটা যে কোনটা! জানতে পারলে তার চোখ গেলে দিতাম আমি!
পাহাড়ের রাজার মুখের দিকে চোখ পড়ল আমার আর সব রাগ গলে জল হলো। সারারাতের ভ্রমণক্লান্তি চোখে নিয়েও মুখটা কেমন আলোয় উদ্ভাসিত! মুখজুড়ে খোঁচা দাঁড়ির জঙ্গল। আজকে কি শেইভ করবে না ও? কেমন লাগবে তবে? পঁচা লাগবে। কিন্তু পঁচা লাগতে থাকা ওই মুখটার দিকে তাকিয়ে আমি সারাদিন এক পায়ে তাকিয়ে থাকতে পারব! এটা আমি আগে জানিনি কেন? কী আশ্চর্য! সেই কবে থেকে, ও কথা বলে, ও ছবি আঁকে, ডনের সাথে কুস্তি করে, প্রমির সাথে ঝগড়া করে, সাজেদা আন্টির সাথে খাবার নিয়ে নখরা করে, জো-মাওয়ের আচারের বয়ম নিয়ে কাড়াকাড়ি করে – আমি হা করে ওর মুখের বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি দেখতাম। রেগে গেলে ভুরুদুটো কেমন বেঁকে যায় ওর, প্রানোচ্ছল হাসির সময় আবার সেদুটো যেন অচিনপুরের কোনো নিঝুম গাঁয়ের অব্যস্ত, অসমান দিগন্তবয়ে চলা সোজা, সরু পায়ে চলা পথ! অভিমান ভুলে আবার ডাকতে যাব, ও একটা বালিশ নিয়ে নিজের কপাল-মাথা ঢেকে ফেলতে ফেলতে বলল,
— আমি ঘুমাব। কেউ একটুও বিরক্ত করবে না আমাকে!
বলেই সত্যি সত্যি আর একটুও নড়ল না! আমি চুপ কর বেরিয়ে এলাম! কালকে তত্ত্ব নিয়ে যাব য়েন য়েন দিদিদের বাড়িতে, কালই ওকে বউ সাজিয়ে নিয়ে আসব, পরশুদিন অচিনপুরের রাজপুত্র প্রহ্লাদ দাদার বৌভাত। তিনটে দিন তো আছেই। সুযোগ করে ওর সাথে কথা বলতেই হবে আমাকে! কিন্তু এত ব্যস্ততা আর এত মানুষ চারিদিকে, সুযোগ কি পাব?

ওর ঘুম ভাঙল দুপুরের পরে। গাড়ি ভরে ভরে অতিথিরা চলে যাচ্ছে এরেলায়। লাক্সারি ট্যুরিস্ট বাংলোগুলোতে এদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজবাড়িতে আর জায়গা হচ্ছে না এত মানুষের। আমি মনে মনে বকলাম পাহাড়ের রাজাকে, এত বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসার কী দরকার ছিল? আসলে আমার ভীষণ হিংসা হচ্ছে। রাজধানীতে থাকা চটপটে ছেলেমেয়েরা সব। আঙিনাতে ব্যাডমিন্টন কোর্ট ফেলেছে এই ভরদুপুরেই। কী স্বতঃস্ফূর্ত আর হাসিখুশি সবাই। আমি আবারও সেই পেইন্টিংয়ে মুখ না আঁকা মেয়েটাকে খুঁজতে শুরু করলাম। একটা মেয়েকে খুব মনে ধরল। সালোয়ার কামিজের উপর ওড়নাটাকে বুকের একপাশ থেকে ঘুরিয়ে এনে কোমরে গিট দিয়ে বেঁধেছে, চুলগুলো ছেড়ে রাখা। শূন্যে র‍্যাকেট ছুড়ছে বারবার, একবারও কর্কে লাগাতে পারছে না। প্রতিবার মিস করছে আর হেসে গড়িয়ে পড়ছে। অনেকগুলো চেয়ার পাতা হয়েছে আঙিনা জুড়ে। আরেকটা আপু দুপুরের রোদ মুখে পেতে বসে আছে। টিপটপ সুন্দর সাজগোজ। মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না বলে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে। ওকেও ওই পেইন্টিংগুলোতে মানিয়ে দিব্যি মানিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, যতগুলো মেয়ে এই বিয়েবাড়িতে এসেছে, সবার মুখটাই ওই পেইন্টিংগুলোতে বসিয়ে দেওয়া যাবে।
প্রমি হুড়োহুড়ি করতে করতে এলো,
— স্বর্ণ, কখন থেকে খুঁজছি! এখানে হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় আয়, তাড়াতাড়ি আয়!
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
— তোর ভাইয়ের বিয়ে, তুই রাজরানী হয়ে সাজবি! আমি কে? আমাকে যেতে হবে কেন?
— ঘোড়ার ডিমের কাহিনি করবি না! এখন দেরি হলে প্রভাত দাদা আমার পিঠে কিল দিয়ে হাড় ভেঙে দেবে!
আমার চোখ চকচক করে উঠল।
— কেন? সে কেন মারবে? সে কি যাবে আমাদের সাথে?
— তো কী? ওই যে জিপ নিয়ে বসে আছে। দৌড়ে চল তো! শেষ সময়ে কেনাকাটা আমার ভালো লাগে না। বেশি কিছু কিনবও না। সব প্রভাত দাদা নিয়ে এসেছে। শুধু গয়না-চুড়ি আনেনি।
— তবে সাজেদা আন্টি যে বলল, তত্ত্ব এসেছে।
— তত্ত্বের জামা পরেই বুঝি বিয়েতে যাব? এত বুদ্ধি তোর? এইজন্যই সবাই বোকা বলে তোকে। তাড়াতাড়ি চল!
আমি ছুটে ছুটে গেলাম। সামনের সিটে লাফিয়ে উঠলাম। উঠেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
— তোমার সাথে কথা আছে আমার।
রাজামশাইয়ের কোনো হেলদোল নেই। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
— আমার নেই!
— আমার থাকলেই হবে। আমি বলবই।
ও আমাকে কিছু না বলে শিস দিয়ে ডাকল,
— ডন? আয় আয়..
সে ব্যাটা রাক্ষুসে কুকুরটা মনে হয় ওই ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল। ডাকতে দেরি হলো ওর ছুটে এসে মনিবের কোলে উঠতে দেরি হলো না। এক হাত লম্বা জিভটা বের করে আমার দিকে কুতকুতে চোখ করে তাকাতেই আমি খানিকটা ভয় পেলাম আর খানিকটা রাগ করেই পেছনে গিয়ে বসে পড়লাম!
আমার শীত শীত লাগছে। রোদ পড়তে শুরু করেছে। খোলাজিপে বাতাসটা গায়ে লাগছে। ঢং করে শাড়ি পরেছি। ব্লাউজের নিচে ফুলস্লিভ ওয়ার্মার আছে। কিন্তু এতে শীত আটকাচ্ছে না!
শীত আর রাগে কাঁপতে কাঁপতে অচিনপুর শহরে পৌঁছালাম।
মধ্যপাড়ায় মেগা মল হয়েছে নতুন। অচিনপুরের বড়োলোকেরা এখানে আসে। আমাকে আর প্রমিকে নামিয়ে দিয়ে জিপটা হুশ করে চলে গেল। পাহাড়ের রাজা একবার তাকালো না, কথা তো বললই না! আমার কি আর জানা হবে না, ওর মনের কথা!
প্রমি চটপট দুটো গয়নার সেট কিনল। দাম দেওয়ার সময় হাই তুলতে তুলতে বলল,
— তুই তো এখন বড়োলোক, তোরটার দাম তুই দিবি। আমারটাও তুই দিয়ে দে!
আমি ওর কথাতে ভয় পেয়ে গেলাম। ওকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এসে বললাম,
— তুই কি সত্যিই টাকা আনিসনি? অত দামি গয়না দাম করলি কেন তবে?
প্রমি মুখ বাঁকাল।
— তোর যখন টাকা ছিল না তখনো বোকা ছিলি, এখন অনেক টাকা হয়েও বোকা আছিস! প্রভাত দাদা আছে না, ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।
— ও তো চলে গেল!
— ওর বন্ধুদেরকে বাংলোতে নামিয়েই চলে আসার কথা। এসে গেছে মনে হয়। আমি ডেকে নিয়ে আসছি।
— নাহ, তুই আরো কী কিনবি, তাড়াতাড়ি দেখে ফেল। আমি যাচ্ছি। আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি.
মার্কেট থেকে বেরিয়ে সত্যি সত্যিই ওকে দেখলাম। জিপে হেলান দিয়ে একমনে মোবাইল গুঁতোচ্ছে। আমি দ্রুত কাছে এসে বললাম,
— অবশেষে একা পাওয়া গেল তোমাকে। দুটো কথা বলার জন্য হাপিত্যেশ করে যাচ্ছি। এবার বলো তো, এমন পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? আমার যে জরুরি কথা তোমার সাথে।
ও মুখ তুলে বলল,
— কেনাকাটা শেষ?
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
— না। প্রমি ডাকছিল তোমাকে, ওর টাকার দরকার।
আমার দিকে ফিরেও তাকালো না ও, হনহন করে হেঁটে চলে গেল মলের ভেতর।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে জিপের পেছনে গিয়ে বসলাম। সামনের সিটে এখনো জাঁকিয়ে বসে আছে খানদানি কুকুরছানাটা!
জিপ যখন এরেলা ঘাটের পারে এসেছে ফেরিতে চেম্মুডু পার হবে বলে পাহাড়ের রাজা নিজের গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ছুঁড়ে দিলো আমাদের দিকে,
— এবার ঠিকঠাক শীতও পরেনি অচিনপুরে! ঘেমে গোসল হয়ে যাচ্ছে আমার!
ওরা যেন দেখতে না পায়, এমন করে জ্যাকেটটা টেনে আমার গায়ে গলালাম। কী যে একটা পারফিউম মাখে ও, ঘ্রাণে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল! ওর শরীরের উষ্ণতা এখনো জ্যাকেটের প্রতি পরতে পরতে। সেই উষ্ণতা উপভোগ করলাম প্রাণভরে!
জিপ বরণপাড়া ছেড়ে মেখলির দিকে মোড় ঘুরলে প্রমি চিৎকার করে উঠল,
— আমাকে তো রেখে যাও!
ওর দাদা উত্তর দিলো,
— চাঁপাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। কতটুকুই বা সময় লাগবে আর! বিশ, পঁচিশ মিনিট! তুই ঘুম দে একটা!
প্রমি ঝগড়া লাগিয়ে দিলো। তাতে গাড়ির গতি দিক পাল্টাল না, আমার মাথা ব্যথা হলো শুধু!
আমি মনে মনে ঠিক করলাম এই বিয়েতে আসব না। কিন্তু সকাল হতেই প্রতিজ্ঞা ভুল হয়ে গেল। আজকের দিন আর কালকের দিনটাই শুধু পাব। এর ভেতর ঘোড়ার ডিমের নকল রাজার সাথে ফাইনাল কথা না হলে ভারী মুশকিল হবে।
বরণপাড়ায় সবাই ভীষণ ব্যস্ত আজকে। এর ভেতর নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া আর নিরিবিলিতে দুটো কথা বলা খুব মুশকিলের কাজ! তবুও ফাঁক বুঝে আমি রাজপুত্রের ঘরে ঢুকে গেলাম। কেউ এই ঘরের বিছানা তুলে দেয়নি আজকে। মশারি এক কোণা খোলা, বাকি তিনকোণা ঝুলছে। কম্বলও এলোমেলো করে রাখা। আলমারি হাট করে খুলে রাখা। বিছানা জুড়ে রাজ্যের জামাকাপড় এলোমেলো করে জাঁক দেওয়া। টেবিল উপচে পড়ছে বই আর কাগজে। আমি শাড়ির আঁচল গুটিয়ে নিয়ে সব গোছাতে লাগলাম। কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, রাজামশাই সেঁজেগুজে এলো। আমি দিব্যি করে বলতে পারি, প্রহ্লাদ দাদাও এত সাজেনি আজকে! আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা, কিন্তু সেসব ভুলে আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। কালো ধুতি স্টাইল প্যান্ট,খাটো ঝুলের কালো পাঞ্জাবির উপর লম্বা ঝুলের জ্যাকেট শেরওয়ানি। মেরুণ রঙের শেরওয়ানির উপরের বাটনটাই শুধু আটকে রাখা। ঝাঁকড়া চুলগুলোকে ব্যাকব্রাশ করে মেটাল হেডব্যান্ড দিয়ে টেনে দেওয়া। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলাম। শ্যামবর্ণা মানুষকে এত ভালো কীভাবে দেখায়? নাকি এ শুধু আমার চোখের মুগ্ধতা!
ও আমার দিকে তাকাল না। পারফিউমের বোতল খুঁজে নিজের গা আর ঘর ভরিয়ে ধমকে ধমকে বলল,
— কী হচ্ছে কী? আমার ঘরে কী?
আমার কী হলো জানি না। আমি টপ করে পেছন থেকে
জড়িয়ে ধরলাম ওকে । ও চমকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— বাড়াবাড়ি করছিস, চাঁপা।
— করব। ভালো লাগছে বাড়াবাড়ি করতে।
— আমার ভালো লাগছে না। তুই আমার চৌহদ্দির ভেতর আসবি না। তুই তো বোকা, তাই তোর মাথায় ঢুকছে না যে আমি তোকে এড়িয়ে যেতে চাইছি। সোজাসাপ্টা বলছি, তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই আর। আমার একদম কাছে আসার চেষ্টা করবি না তুই।
ও চলে যেতে চাইলে আমি ওর পাঞ্জাবির কোণা চেপে মুঠো করে ধরলে, ও থেমে গেল। বাঁদিকে একটু প্রসারিত হলো ঠোঁটটা। এটাকে বিদ্রুপের হাসি বলে, আমি জানি। ও ঠাট্টাই করল। বলল,
— নাকি ডুলেপাড়ার ইতিহাস শুনে সৌমিক গলাধাক্কা দিয়েছে, এখন আমার পায়ে ঘুরছিস! আমিই বা কেন অন্যের প্রেমিকার সাথে আমার নির্জন শোবার ঘরে একা একা কথা বলব? আমার কী দায় পড়েছে?
ঠোঁট টিপে কান্না আটকালাম আমি। মুঠো খুলে ওকে যেতে দিলাম। ও দরজার কাছে চলে গিয়েছে, আমি চিৎকার করলাম,
— এই ঘরে আগেও এসেছি আমি। একা একাই এসেছি। বারবার আসব। পারলে ঠেকিও!
তাতে কিছু হলো না। ও থামল না। চলে গেল।
ওখানেই ঠান্ডা মেঝেতে বসে পড়লাম আমি। কেঁদেকেটে সমস্ত সাজ নষ্ট করলাম। তারপর ফোলা চোখে আবার কাজল পরে বিয়েতে গেলাম।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে আর কোনো কথা বলব না আমি।
সেইমতো য়েন য়েন দিদির বাড়িতে গেলাম, বউ নিয়ে এলাম, রাজবাড়িতে এসে অচিনপুর জামে মসজিদের ইমাম সাহেব এসে প্রহ্লাদ দাদা আর য়েন য়েন দিদির বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে গেল। পরদিন হৈ হৈ করে বৌভাতও হয়ে গেল।
বিকেল হতে হতে পুরো বাড়ি খালি হতে শুরু করল। আমি চুপ করে বারান্দার রেলিং ধরে চঞ্চল ঝিরিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। না জানি কোথা থেকে নেমে আসছে এত জলের ধারা। একটা ঢেউ নেমে আসছে, আরেকটাকে পেছনে ফেলে ভেসে যাচ্ছে। কোনো ঢেউয়ে অন্য ঢেউয়ের নাম লেখা নেই। সবাই নতুন। তেমনি করে মানুষের জীবনেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ঘটনা লেখা হতে থাকে। তাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর কায়দাও নতুন। আমি স্বর্ণচাঁপা, জীবনটা একটা নতুন মোড়ে এসে থমকে আছি। এখান থেকেই নতুন শুরুটা আমাকেই পছন্দ করতে হবে। যা কিছু ঘটছে আমাকে ঘিরে, হয়তো ওই নতুন শুরুটাই ইঙ্গিত করছে। মনেপ্রাণে সেটাকেই স্বীকার করে এগিয়ে যেতে হবে আমাকে। পাহাড়ের রাজা আমাকে চায় না, তাই আমি আর ওর রাস্তা কাটব না। অন্য রাস্তাটাকেই আপন করতে আর দ্বিধা করব না!
চুপচাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম হয়তো, সন্ধ্যা হয়েছে সেটাও খেয়াল হয়নি। কাকে যেন কী বলতে বলতে পাহাড়ের রাজা ওর ঘরের দিকে আসছিল, আমাকে দেখে বলে উঠল,
— কে ওখানে? অন্ধকারে কী?
আমি আস্তে করে বললাম,
— আমি। আমি চাঁপা।
— ওহ!
চলে যাচ্ছিল ও। আমি আবার আমার প্রতিজ্ঞা ভুলে ডাকলাম ওকে,
— শোনো না! আমার একটা কথা শোনো!
আমার কান্নাভেজা গলা শুনেই হয়তো ফিরে এলো ও। কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,
— বল! কী বলবি, তাড়াতাড়ি করে বল। কুইক!
ও আমার কথা শুনবে, আশা করিনি আমি। থতমত খেয়ে গেলাম। আবার আমার কত কাছাকাছি ও! ওর গায়ের ঘ্রাণ পাওয়ার মতো কাছাকাছি। সুবাসে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। টক খেয়ে জিভ অসাড় হওয়ার মতো চিন্তাভাবনার শক্তিও থেমে গিয়েছে।
— বল তাড়াতাড়ি?
ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি করেই একটানে হড়বড় করে বললাম,
— মেখলির বাড়িটা ভেঙে যাচ্ছে! দরজা দিয়ে গুঁড়ো নামছে, টালি ফাঁক হয়ে পানি পড়ছে, জানালাতে তক্তা মারতে হয়েছে। ওখানে আর থাকা যাচ্ছে না!
— এই? এত উতলা হয়েছিস এটা বলার জন্য? তিন দিন ধরে এই বলতে চাইছিস?
— হুম! আমার মামা-মামিকে এই বাড়িতে থাকতে দেবে? বেশি না, দুটো ঘর হলেই আমাদের হয়ে যাবে। একটাতে ছোটো আপা থাকবে। আর একটাতে মামা-মামি!
— মানে কী? ওরা এই বাড়িতে এসে কেন থাকবে?
— বারে, বাড়িটা মেরামত করতে হবে না? তখন কি ওখানে থাকা যাবে?
— অচিনপুরে বাড়ির অভাব নাকি? কত বাড়ি ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে। আর চাইলেই তুই বাড়ি কিনে ফেলতে পারিস এক চুটকিতে! কত টাকা তোর এখন!
— কিন্তু আমি এই বাড়িতে থাকলে ওরা অন্য কোথাও কেমন করে থাকবে?
ও ভীষণ আশ্চর্য হয়েছে, অন্ধকারে মুখ না দেখতে পেলেও গলার স্বর শুনে সেটা বুঝলাম আমি। বলল,
— তুই কেন এই বাড়িতে থাকবি!
আমি লজ্জা পেলাম।
— তুই থাকবি? কোথায় থাকবি? তুই তো দুটো ঘর চাইলি।
আমি হাতের ইশারায় ঘরটা দেখিয়ে দিলাম। ওটা ওরই ঘর। মস্ত কাঠের পাল্লা দেওয়া বিরাট বিরাট জানালা দেওয়া ঘর। জানালা খুলে দিলেই, ঝিরঝির করে বয়ে যায় নদীর আউলা বাতাস!
ও নিজের মাথার চুল টেনে ধরল। হতাশ গলায় বলল,
— আমি বুঝিনি, চাঁপা! ঠিকঠাক বল!
— আমাকে বোকা বলো, নিজে কী?
— ঠিক করে বল, কী বলতে চাইছিস!
— বিয়ের পরে বর বউ কি আলাদা থাকে?
রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। ভাঙা গলায় বলল,
— ওই বিয়েটা সত্যি নয় আমি বলেছি তোকে। আর সত্যি হলেও বা কী? এক মন কয়জনকে দিবি তুই? ভালোবাসবি সৌমিককে, আর ডুলেপাড়ার বিয়ের নামে আমার গলায় ঝুলে যাবি, সেটা তো হবে না!
— আমি সৌমিককে ভালোবাসি না!
— তুই নিজের মুখে বলেছিলি…
— আমি বুঝতে পারিনি। তোমরাই তো বলো আমি বোকা! আমি বুঝিনি, বিশ্বাস করো।
— কী বুঝিসনি, আর এখন কী বুঝছিস সেটা আগে বুঝিয়ে বল।
— তুমি রাগ করবে না?
— অবশ্যই করব। রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। নেহায়েত তোকে ভালোবাসি বলে তোকে আঘাত করা সম্ভব না। নইলে অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আমি তার মাথা ফাটিয়ে দিলাম।
— কী বললে, আবার বলো?
— কী বললাম? তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো? ভালো হবে সেটা?
— না, ওই যে বললে, তুমিও আমাকে ভালোবাসো!
ও কোমরে হাত দিয়ে মারমুখো ভঙ্গিতে বলল,
— কী বলতে চাইছিস, পরিস্কার করে বল?
— তুমিও তো আমার মতোই। তুমিও আগে অন্য কাউকে ভালোবাসতে। এখন আমাকে ভালোবাসো। ওই বিয়েটার জন্যই তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ।
— এসব তোর মগজে কে ঢোকাচ্ছে? আমি বলেছি এই কথা? নাকি তোর উর্বর মস্তিষ্কে চাষ হয় এইসব? ওই বিয়ের কোনো দাম নেই আমার কাছে!
— কোনো দাম নেই?
— না। নেই! বিরক্ত করিস না, চাঁপা। মারব কিন্তু।
— তুমি মারলে আমিও মারব। স্বামী-স্ত্রী সমান সমান হতে হয়। ভালোবাসলে সমান সমান বাসতে হয়। আর ঝগড়া করলে সমান সমান করতে হয়। আমাকে ভালোবাসলে আমিও ভালোবাসব। আদর করলে আদর করব। আর আমাকে মারলে আমিও মারব!
পাহাড়ের রাজা হেসে ফেলল,
— যা তো আমার সামনে থেকে। তোর সাথে এই আজব ঝগড়া করার ইচ্ছে আমার নেই। বোকা বোকা কথা বলে ঝগড়ার মুডও নষ্ট করে দিস!
— কোনটা বোকা কথা? ওই বিয়ের দাম নেই তোমার কাছে? এটা বোকা কথা?
— হ্যাঁ ওইটেই। না নেই। ওই বিয়ের দাম নেই এক পয়সাও!
— তবে এটা কী?
ডুলে সর্দারের বউয়ের দেওয়া সেই চুলের গয়নাটা ওর চোখের সামনে নাচালাম আমি। সেটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার অভিনয় করেছিল ও। ওর আলমারির ড্রয়ারে বড়ো যত্নে রাখা ছিল এই গয়নাটাকে। আমি আজ খুঁজে পেয়েছি!
ওর গলায় হতাশা প্রকাশ পেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— শুধু ওটাই চুরি করেছিস? আর কিছু দেখিসনি?
— আর কী?
— চল দেখাচ্ছি!
ওর ঘরে একটা বড়ো কাগজের কার্টন রাখা ছিল দেখেছিলাম। আমাকে সাথে নিয়ে ওটার মোড়ক খুলে ফেলল ও। একে একে অসংখ্য ছবি বের হলো সেটা থেকে। কত কত ছবি! সবগুলো ক্যানভাসে আমাকে আঁকা। মুখ না আঁকা পেইন্টিংও অনেকগুলো। ও সেগুলো দেখিয়ে বলল,
— অনেক আগে থেকেই এই বোকা ফুলটাকে ভালোবাসি আমি। ভালোবেসে রঙ তুলিতে আঁকি। ওই ডুলে পাড়ার বিয়েরও অনেক আগে থেকেও! শুধু বলতে পারিনি। তুই আমার মনের কথা কবে বুঝে যাবি ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আরেকটু সময় নিই। তুই নিজেই যেন সব বুঝে যাস ততদিন অপেক্ষা করেছিলাম! আর ওই বিয়েটা – ওটা আমার সবকিছু, চাঁপা। পৃথিবীর বুকে নেমে আসা ওই একটা রাত – আমার জীবনের সেরা সময়! ওই অল্প কয়েকটা জংলি মানুষ জানে, তুই আমার বউ – এইটুকুই মনে হয় আমার জীবনের সব পাওয়া! ওই কিছু সময়ের জন্য আমি স্বর্গে ছিলাম, সেই একেকটি মুহূর্তকে এখনকার প্রতিটি দিনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি আমি। কিন্তু তবুও তোর কাছ থেকে জোর করে নিতে পারব না, চাঁপা। ভালোবাসবি অন্য একজনকে – আর আমার সামনে ঘুরঘুর করবি, তার চাইতে দূরে গিয়ে মর! তাও আমার সহ্য হবে।
পাহাড়ের রাজা চলে যাচ্ছিল, আমি টেনে ধরলাম ওকে।
বললাম,
— আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি না। সৌমিক আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি বোকা, ভেবেছিলাম ওকে ভালোবাসি। ওকে মিস করি এটা ঠিক, কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট হয়। মনে হয়, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই কোথাও। কী ভীষণ ভয় পেয়েছি আমি!
ও সন্দেহ প্রকাশ করে বলল,
—- অন্য একজনকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে আমাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করল, হঠাৎ করে? এ কেমন ভালোবাসা তোর, যা তুই টেরই পাসনি?
—- কেমন করে টের পাব বলো? বুকের মাঝে হৃদয়টা তো দিন নেই, রাত নেই – ধুকপুক করেই যাচ্ছে, ওকে কি আলাদা করে টের পাও? কই, আমি পাই না তো! তুমিও যে আমার অত কাছেরই, চিরদিনের অত কাছের। আলাদা করে তোমাকে বুঝিইনি কোনোসময়! হৃদয়ের ধুকপুকানি কখনো থেমে গেলে তবেই তো বোঝা যায় সে কতখানি থাকে! সে থেমে গেলেই তবে লোকে টের পায়, সে ছাড়া তার আর সব ফাঁকি! তেমনি করে আমার সব শূন্য করে চলে গেলে যখন, তখনই তো অনুভব করলাম, তুমি আমার সবটুকু জুড়ে আছ! চিরদিনই সবটুকুতে শুধু তুমিই ছিলে, আমি শুধু বুঝতে পারিনি!
ওর কন্ঠে তরলতা,
—- তাই? তবে ডাকিসনি কেন বোকাফুল? একটা ফোন করতে পারতি।
– আমি ভেবেছিলাম ওই পেইন্টিংয়ের মেয়েটা অন্য কেউ! সেটা ভেবেই কখনো তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। আর তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও যদি সেই ভয়ে তোমাকে ডাকিনি। সামনাসামনি কথা বলতে চেয়েছি।
আমার ঠোঁট ফুলতে শুরু করল আবার। অভিমান ফেনিয়ে উঠল গলায়,
—- আমি তো বোকা। আমি যে বোকা, তা তো তুমি জানতেই। আমি না হয় আমাকে বুঝিনি, তোমাকেও বুঝিনি, তবে তুমি কেন আমাকে বুঝলে না! আমাকে বুঝে, আমাকে কেন বুঝিয়ে দিলে না?
ও কিছু বলার আগেই বড়ো অসময়ে বিদ্যুৎ চলে গেল!
টুপ করে রাত নেমে এলো অচিনপুরে। চোখের পানি মুছে বললাম,
— একটা মোমবাতি দিয়ে গেল না কেউ? যাই, আলো নিয়ে আসি।
পাহাড়ের রাজা আমার হাত চেপে ধরল,
— কোথাও যাবি না। অন্ধকারে আছাড় খেয়ে নাক ফাটাবি নইলে পা ভাঙবি!
— না, আমি অন্ধকারে চলতে পারি!
— পারবিই তো! তুই তো বোকা ফুল। তোর কাজই তো উলটো হবে। সবাই অন্ধকার এড়িয়ে চলে, তুই অন্ধকারে হাঁটিস!
— এত বোকা বোকা করবে না! রেজাল্ট আসলে দেখো, কেমন তাক লেগে যাবে সবাই। কেউ আর কখনো বোকা বলতে পারবে না আমাকে। এত এত পড়াশোনা করেছি।
— চুপ একদম চুপ। একটাও কথা বলবি না।
— কেন? কথা বলব না কেন?
ও আমার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। আমার মাথা ঘুরে উঠল চট করে। সেই মাথা খারাপ করা সুবাস আমার চারপাশজুড়ে মেলে দিয়ে ও ফিসফিস করে বলল,
— চুপ করে থাকবি, কারণ এখন আমি তোকে আদর করব!
আমিও ফিসফিস করে বললাম,
— কথা বললে কী হবে?
— আমি বিরক্ত হব। আদরের সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করবে এটা আমার পছন্দ নয়।
পাহাড়ের রাজার ঠোঁটদুটো আমার ঠোঁটে চেপে বসল। হাতদুটো কোমরে ছুঁয়ে দিতেই আমি ছটফট করে উঠলাম।
— কী হলো? ব্যথা পেয়েছিস?
— না, কাতুকুতু লাগছে!
ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে খাটের উপর বসতে বসতে গলায় চ্য শব্দ করে বলল,
— তোর খুব বাজে টাইমিং। ভুল সময়ে ভুলভাল কথা বলে তব্দা খাইয়ে দিস! প্রভাতের জন্য মায়া হচ্ছে আমার! সবকিছু ওর একাই করতে হবে। একার এফোর্টেই সন্ধ্যামালতী ফোটাতে হবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি!
বোকা হলেও এই কথার অর্থ আমি ঠিক বুঝে ফেললাম, আর লজ্জায় গুটিয়ে গেলাম।
ও বলল,
— অন্ধকারে তোর মুখ দেখতে পাচ্ছি না, চাঁপা। কাছে আয়।
আমি মুখ চেপে হাসলাম,
— এখন না পাহাড়ের রাজা। ওই বিয়েটা তুমি মানো না বলেছ। বলেছ, আইনে বিয়ে হয়নি, ধর্মে হয়নি, সমাজের নিয়মেও বিয়ে হয়নি। তবে সত্যিকারের বিয়ে হোক আগে, তারপর তোমার কাছে আসব।
— তুই তো আর বোকা ফুল নোস, চালাক ফুল হয়ে গেলি তো!
ও হাসলো জোরে জোরে।
আমি ধমক দিলাম,
— পুরো অচিনপুরকে শোনাবে নাকি?
— হুম। তুইও বোকা, আমিও বোকা। দুই বোকা মিলে এতদিন কত অকারণ কষ্ট পেলাম সেটা সবাইকে জানাতে হবে না? অচিনপুরের সবাইকে বলতে হবে তো!
আমারও হাসি পেলো। আসলেই তো, কী বোকা আমরা!
অচিনপুরের রাজবাড়ির বিরাট বিরাট জানালার গ্রীল গলে এক টুকরো বাঁক চাঁদ ঢুকে গেল আমাদের ঘরের ভেতর। আমরা দুজনে মুগ্ধ হয়ে সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এক ফালি জোৎস্নাও কেমন করে বহুদিনের জমাট হওয়া আঁধার সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!
আহা! ওই টুকরো চাঁদের আলোর সাথে অচিনপুরে আজকে কেমন চমৎকার একটা রাত নেমে এসেছে, দেখতে পাচ্ছ তো সবাই!

সমাপ্ত

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here