অচিনপুর পর্ব -২৮

#অচিনপুর – ২৮

মামি সবগুলো চিঠি কেড়ে নিয়ে আকরামুজ্জামান সাহেবের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
— কী ভেবেছেন? স্বর্ণ বোকা বলে যাচ্ছেতাই বোঝাবেন আর আমরা শুনব দাঁড়িয়ে?
আকরামুজ্জামান চৌধুরীকে দেখে আমার খুব ভয় লাগত আগে। কিন্তু আমার কল্পনাতে সে যত ভয়ংকর রূপে আসত, আমি কখনো সামনাসামনি তার সেই চেহারা দেখিনি৷ অবশ্য আমি কখনো তার সামনেই আসতাম না। সে এসেছে জানলেই বাড়ি থেকে পালাতাম! তার সেই ভয়ংকর চেহারা আজ দেখলাম। মামির উপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন তিনি। শান্ত কিন্তু প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন,
— ওকে কখনো বোকা বলবেন না! ও বোকা নয়! দুজন অত্যন্ত মেধাবী মানুষের সন্তান ও। ওর দাদা ছিলেন তখনকার সেরা প্রকৌশলী। ওর নানা অশিক্ষিত হলেও চতুর ছিল, বুদ্ধিমান ছিল। ওর মা তানজিলা তার বাবার চাতুর্য পায়নি, হেরিডিটিসূত্রে বুদ্ধি ঠিকই ওউন করেছিল। আর তার ভাই, আপনার স্বামীপ্রবরটি সেসব কিছুই পায়নি, কেননা চাতুর্যটুকু নিয়েছিলেন আপনি। তানজিলার পরিবারের যত নেগেটিভিটি ছিল, নিচতা, স্বার্থপরতা, কুটিলতা সব আপনি নিয়েছেন! নিজের স্বার্থে একটা ট্রমাটাইজড মেয়েকে সারভাইভালের সুযোগ না দিয়ে, তার হিলিং প্রসেসে বাঁধা দিয়েছেন। তার ভয়কে খুঁচিয়ে তাজা করে রেখেছেন। একা থাকার ভয় ওর, সেই ভয় ওকে ভুলতে দেননি! বারবার, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ওকে সেই ভয় দিয়ে গিয়েছেন। কিছু হলেই, বাচ্চাসুলভ অন্যায় করলেও বলেছেন ‘ছেড়ে চলে যাব।’ মেয়েটা গুটিয়ে গেছে। ওর জীবনে ওই একা না থাকা ছাড়া অন্য কোনো চাহিদা তৈরি হয়নি! আর কিছু ভাবতেও পারে না ও। ওর চিন্তার গন্ডি একজায়গাতেই থেমে আছে। দিনের পর দিন ওকে বোকা বলে বলে ওর কনফিডেন্স লেভেল মাইনাসের ঘরে নিয়ে গিয়েছেন। ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ওকে ম্যানুপুলেট করেছেন নিজের হীন স্বার্থে – ও হয়েছে আপনার হাতের পুতুল ; যেন ও ততটুকুই নাচতে পারে, যতখানি দমের চাবি আপনি ঘুরাবেন। ও নিজেকে ভুল ভাবতে শিখেছে, নিজেকে মেধাহীন জেনেছে, নিজেকে অথর্বজ্ঞানে বড়ো হয়েছে।
আমি আকরামুজ্জামান চৌধুরীর উপর আর রাগ করে থাকতে পারছি না কিন্তু মামিকে এভাবে বকা দেওয়াতে আমার খুব মন খারাপ হলো। আমার পরিবার টেনে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। আর মামা, মামিই তো এখন আমার পরিবার। আমি ঝগড়াটা থামানোর জন্য বললাম,
— এসব কিছু সত্যি না! আপনারা ঝগড়া করবেন না, প্লিজ!
একটানা কথা বলতে বলতে আকরামুজ্জামান চৌধুরীর হাঁপ ধরে গেছে, চোখ লাল হয়ে উঠেছে। উনি দম না ফেলেই বলতে থাকলেন,
— এক তাল নরম কাঁদামাটি পেয়েছিলেন আপনি। শিব না গড়ে বাঁদর গড়তে চেয়েছিলেন। আপনি ডুগডুগি বাজাবেন আর ও হাততালি দিয়ে নাচবে! সারাদিন বোকা, বোকা, বোকা বলে বলে ওকে এমন করে ফেলেছেন, এখন ও নিজেই বিশ্বাস করে ও বোকা! আর সেই বাঁদরখেলা আমাদেরকে দেখতে হয়েছে বসে বসে। দেখেছি আর হাত কামড়েছি। কেননা আমার হাত পা বাঁধা ছিল। আমার নামে, আমাদের পরিবারের নামে এমন বিষজল মেয়েটাকে খাইয়েছেন দিনের পর দিন, স্বর্ণচাঁপা আমার কোনো কথা শোনার জন্যই প্রস্তুত ছিল না, আমার মুখও দেখতে চাইত না! কিন্তু খুব জরুরি ছিল ওকে ওর শিকড় চেনানো। ওর পরিবারকে চেনানো। নইলে তো ও নিজেকেই চিনবে না!
আকরামুজ্জামান আমার চোখে চোখ রাখলেন। আমি খেয়াল করলাম ওনার চোখ ছলছল করছে। উদ্যত হয়ে আসা চোখের জলের স্রোতটাকে কায়দা করে আটকে ফেলে তিনি বললেন,
— এইজন্যই সৌমিককে অচিনপুরে আসতে হলো, মা। আমরা চেয়েছিলাম, তোমার আর সৌমিকের আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হলেই হয়তো ওর মাধ্যমে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারব! কিন্তু এদিকে তোমার সর্বনাশের সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর আমরা ভয় পাচ্ছিলাম ইনি, তোমার মামি আর্থিক ক্ষতি বাদেও তোমার জীবনের উপর কোনো হুমকি না টানেন! আমি ওনাকে একবিন্দুও বিশ্বাস করি না!
আমি মাথা নাড়লাম। বিস্ময় গলায় নিয়ে বললাম,
— মামি? আমার ক্ষতি করবেন? কী ক্ষতি!
মামি রাগী হলেও শান্ত স্বভাবের মানুষ। আমরা ঘরের মানুষেরা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতেই পারি না, মামি রাগ করেছে। সেই আজকে ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ হারাচ্ছে! রেগে গিয়ে চিৎকার করছে। এখনো চিৎকার করে বলল,
— আমি স্বর্ণের অভিভাবক। বাপ মরা মেয়েটা অকূল সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিল। আমি ওকে টেনে তুলেছি, আদর করেছি, বাপের কষ্ট বুঝতে দিইনি! না খেয়ে খাইয়েছি ওকে। নিজে কষ্ট করেছি, ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিইনি!
আমার কাঁধ ধরে আচমকা ঝাঁকি দিলেন মামি,
— কী রে খুকী, এখন চাচা পেয়ে এই মামি খারাপ হয়ে গেল? জিজ্ঞেস করবি না, তখন কোথায় ছিল এইসব চাচারা, যখন তুই একা একা রাতের অন্ধকারকে ভয় পেয়েছিস? হ্যাঁ, তোর টাকায় খেয়েছি, পরেছি, মাথার উপর ছাদ পেয়েছি, তোর বোনেদেরকে পড়াতে পেরেছি – কিন্তু এসব কি তোর অজানা? তোর টাকার পাই পাই হিসেব কি তুই জানিস না? কত টাকা আয় হয়, সেই টাকা কোথায় কোথায় খরচ হয় – সেসব অন্য কেই না জানুক, তুই তো জানিস খুকী! তাহলে, জবাব কেন দিচ্ছিস না? কেন বলছিস না, এসব চাচার কোনো দরকার নেই তোর!
আমি উঠে গিয়ে মামিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।
আকরামুজ্জামান অদ্ভুত হাসলেন। হেসে হেসে বললেন,
— এসব কিছু আপনি স্বার্থ ছাড়াই করেছেন?
মামি আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলল,
— না। আমি কখনো তা বলিনি। আমরা খুব গরিব ছিলাম। ওর মামার কোনো আয় ছিল না। আমার শশুরের মৃত্যুর পরে আমরা আরো বিপদে পড়ে যাই। তিনটে মেয়েকে কী খাওয়াব সেটাই ব্যবস্থা করতে পারতাম না, পড়াশোনা করানো অনেক দূরের কথা! স্বর্ণের উছিলায় আমি সব পেয়েছি! আমার স্বার্থই ছিল তো! কিন্তু আমার চার মেয়েকে আমি আলাদা করে দেখিনি কখনো! আর এসব কৈফিয়ত আমি আপনাকে দেবো না। আমি স্বর্ণের অভিভাবক, ওর বাপ ও আমি, ওর মা ও আমি! ওর ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত আমিই নেবো! আপনাকে নাক গলাতে হবে না কখনোই। আমরা এতদিন সুখেদুখে ভালো ছিলাম, বাকি দিনগুলোও কেটে যাবে আমাদের!
— বাকি দিনগুলো মানে কী? একটা গড়পড়তা সাধারণ জীবন, তাই তো? ভালো পড়াশোনা শিখবে না, কোনোরকমে পাশ করে যাবে। আপনি তখন সবাইকে বলবেন, আপনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মাথামোটা মেয়ে করে উঠতে পারেনি। তারপর একদিন সেইরকম কোনো গড়পড়তা সাধারণ বাঙালি, যার কিনা অচিনপুরে কোনো শক্ত খুঁটি নেই, এমন কারো সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে সুখী গৃহবধূ বানিয়ে দেবেন, যেন কখনো আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন না ওঠাতে পারে, তাই না?
মামির চোখ বিস্ফারিত হলো। তোতলাতে তোতলাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুই আমার নামে এসব অপবাদ নিজের কানে শুনছিস, খুকী?
আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। এ কী ঝামেলা শুরু হলো! আমার কাছে পৌঁছানোর জন্য আকরামুজ্জামান চৌধুরীর প্রয়াস, অধ্যাবসায়, পরিকল্পনা আমি চাইলেও না দেখা করতে পারছি না। আর আমার অচেনা মায়ের চিঠিগুলো অতি যত্নে পৌঁছে দেওয়ার কৃতজ্ঞতাও অস্বীকার করার উপায় নেই। সবার উপরে তিনি আমার বাবার ভাই, দেখতে একদম আমার বাবার মতোই। এতদিন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে দিয়ে আমি যে মহাবোকার মতো কাজ করেছি সেটা ভেবেই নিজের উপর রাগ লাগছে।
অন্যদিকে মামি, সে তো আমার নিজের, কাছের মানুষ! তাকে অকারণ অপমানিত হতেও দেখতে পারছি না। আমার খুব বুদ্ধিমান না হতে পারি কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি, যা হচ্ছে এটা না হলেই ভালো হতো। এখন না আমি আমার বড়োচাচাকে কটু কথা বলতে পারছি, না আমি মামির পক্ষ নিতে নিতে পারছি!
বড়ো আপা আমাকে উদ্ধার করল। আমার হাতটা ধরে বলল,
— স্বর্ণের সাথে অনেক রকম অবিচার হয়েছে, আমি জানি সেটা। আমার মা যেভাবে ওকে ট্রিট করেছেন, সেটা আমার পছন্দ ছিল না, তাই আমি সবসময়ই প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু আপনি যেভাবে একিউজ করছেন সেটা হয়তো অতটাও নয়! এভাবে আপনি বলতে পারেন না!
বড়োচাচা কিছু বললেন না। নির্লিপ্ত বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নিজের হাতদুটোকে বুকের কাছে আড়াআড়ি বেঁধে রাখলেন। স্যুট, টাই, বেল্টের নিচে ঢুকিয়ে রাখা গ্রে শার্টে ভদ্রলোককে পুরো পশ্চিমা দেখা যাচ্ছে। হাইট সুন্দর, আমার বাবার মতো সুন্দর গায়ের রঙ। চুলের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। তাতে যেন আরও ঘনিয়ে উঠেছে ব্যক্তিত্ব! তিনি আস্তে কথা বললেন। বড্ড কোমল কিন্তু একইসাথে স্পষ্ট সেই কন্ঠস্বরে আমাকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,
— আজকে আমাকে সব বলতে দিতে হবে, স্বর্ণ। সবাইকে চুপচাপ শুনতেও হবে। যদি সবটা শোনার আগে আমাকে বাধা দেওয়া হয়, আমি থানায় জানিয়ে এসেছি, ওরা হয়তো কাছাকাছি এসে গিয়েছে!
মামি চুপচাপ বসে পড়ল। বড়ো চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— তোমার আসল পরিবারের যে পরিচয় তুমি পেয়েছ, সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমার বাবা তোমার মাকে মেনে নেননি যেমন সত্য, নিজের ছেলে অর্থাৎ তোমার বাবার সাথে সম্পর্কছিন্ন করেছিলেন সেটাও তেমনই সত্য! বাবা যেমন রাগ করেছিলেন, শাহাদাতও তেমনি অভিমান করেছিল, কখনো ফেলে আসা সম্পর্কে ফিরে যায়নি। তোমার মা মারা যাওয়ার পরে শাহাদাতের সেই অভিমান আরো গাঢ় হয়েছিল। সব ছেড়ে এই অচিনপুরে পালিয়ে এসেছিল ও তোমাকে বুকে করে। তারপর একদিন ও চলে গেল। ওর সমস্ত পেপারসে তানজিলার নাম ছিল। ঠিকানাও। তাই ওর মৃত্যুসংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছেনি। পৌঁছেছিল তোমার মামার বাড়ি।
তোমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার বাবা মানে তোমার দাদা অনেক চেষ্টা করেছিলেন শাহাদাতের মান ভাঙাতে। প্রপার্টিতে শাহাদাতের অংশটা বুঝিয়ে দিতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু শাহাদাত রাজি হয়নি কিছু নিতে। বাবা তখন সমান অঙ্কের অর্থমূল্য দিয়ে পাহাড়ের জমি কিনে তোমার নামে দিয়ে দেন। প্রায় কয়েক কোটি টাকা দামের জমি। তোমার আঠারো বছর না হওয়া পর্যন্ত শাহাদাতের কাছে থাকে পাওয়ার অফ এটর্নি। তোমার আঠারো না হওয়া পর্যন্ত তুমি বা অন্য কেউ এই সম্পত্তি বিক্রির অধিকার পায়নি! শাহাদাত আর বাবার ভেতর কী কথা হয়েছিল আজ আর জানার উপায় নেই, কেননা কেউই আর বেঁচে নেই। শাহাদাত এই সম্পত্তি নিতে রাজি হয়েছিল। কেন রাজি হয়েছিল, বাবা কীভাবে ওকে রাজি করিয়েছিলেন আজ আর সেটা জানা সম্ভব নয়। যদিও আমার ধারণা তোমার বাবা এই সম্পত্তি একসেপ্ট করেছিলেন, শুধুমাত্র পাহাড়ের লোকেদের জন্য ভালো কিছু করবেন বলে।
এই দেওয়া নেওয়াটা তোমার মামার বাড়ির লোকেরা জানতেন। তারা যে জানতেন সেটা আমি বাবার কিছু ব্যাংকিং ট্র‍্যানজ্যাকশন হিস্ট্রি থেকে জেনেছি। অচিনপুরে তোমার মামির একাউন্টে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন আমার বাবা। বেশ বড়ো অঙ্কের টাকা। তোমার দেখাশোনার জন্য এই টাকা পাঠানো হতো।
আমি যখন দেশে ফিরলাম তার অনেক আগেই বাবা মারা গেছেন, তাই এসব কিছুই আমার জানা ছিল না। আমি তোমার খোঁজ পেলাম। তোমার অসহায়ত্ব জানলাম। তোমার মামির উপর আমি বেশ খুশী ছিলাম। আমরা সুযোগ না পেলেও তিনি তোমার দেখাশোনা করছেন৷ হয়তো তুমি বেঁচেই রয়েছ ওনাদের বদৌলতে। আমার সাথে তোমার ফার্স্ট মিটিং সাকসেসফুল না হলেও আমি তোমার খোঁজ রাখতাম। তখনই বেশ কিছু ব্যাপার আমার নজরে পড়ল। তোমার মামির জন্য বাবা যে টাকাটা পাঠাতেন সেটা তখনো আসছে। এখনো সেটা আমাদের অফিসের বিশেষ ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে কন্টিনিউয়াস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু টাকাটা তোমার কোনো প্রয়োজনে খরচ হতো না। ওই টাকাতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া যেত তোমাকে, কিন্তু এর সিংহভাগ জমে থাকত তোমার মামির একাউন্টে এবং রাজধানীতে বেশ কিছু প্রপার্টি কিনতে বড়ো একটা এমাউন্ট ব্যবহার করা হয় পাঁচ বছর আগে। তোমার এই বাড়ির কোনো সংস্কার করা হতো না, তোমার পড়াশোনাতে এক্সট্রা এফোর্ট দেওয়া হতো না, এমনকি অভাব দেখিয়ে বাজারের খরচও কমানো হতো। শাহাদাতের নামে ইন্সুইরেন্সের টাকাটার কথা তোমাকে জানানো হয়েছিল তাই টাকার ব্যবহার সম্পর্কে ভদ্রমহিলা চালাকি করেছিলেন। তোমাকে বলা হয়েছিল এটা তোমাদের চার বোনের বিয়ের জন্য সেইভ করে রাখা আছে, কারণ তুমি তোমার বোনেদেরকে ভালোবাসতে! তাদের জন্য নিজের সবকিছু উজার করে দিতেও তুমি দুইবার ভাববে না। কিন্তু সেই টাকাও গত তিন বছর আগে রাজধানীতে একটা চার কামরার বাড়ি করতে খরচ হয়ে গিয়েছে, সেটা তোমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আচ্ছা সেসব বাদ যাক, তিনি এখনো কেন তবে অচিনপুরে অপেক্ষা করে আছেন? এর উত্তর হচ্ছে, তিনি অচিনপুরে না এসেছিলেন তোমার জন্য না ওই সামান্য ইন্সুইরেন্স এর টাকার জন্য। তার লোভ ঢের বেশি। সেটা হচ্ছে তোমার দাদার দিয়ে যাওয়া অচিনপুরের বিপুল সম্পত্তি। কয়েকশো একর রাবার বাগান, আর জুমের জমি। তোমার মামি যখন অচিনপুরে এলেন, তখন এই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির কথা জানলেও তোমার আঠারো বছর বয়স অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার শর্তের কথাটা জানতেন না। সেটা তিনি এখানে এসেই জানতে পারেন। ওই বিপুল সম্পত্তির আয় ভোগ করতে পারলেও বিক্রি করে নগদ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ তিনি পেলেন না। তাই এই পাহাড়ের কঠিন জীবনযাপনে থেকে যেতে হলো তাকে আর অপেক্ষায় থাকতে হলো, কবে তুমি আঠারো হবে। কারণ জমি বিক্রির দলিলে তো চাওয়ামাত্রই তুমি সই করে দেবে, আনডাউটেডলি!
আমি তাকালাম মামির দিকে। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। আমার কান্না পেলো তাকে দেখে। মনে হলো বড়োচাচাকে থামিয়ে দিই। কিন্তু তিনি বলেই যাচ্ছেন,
— কিন্তু প্রথম বাধাটা দিলো রাজবাড়ির বড়ো ছেলে প্রহ্লাদ। সে সেই রাবার বাগানকে সরকারি প্রজেক্টের অংশ করে দিয়ে তোমার মামির এতদিনের গোছানো ভাতে ছাই দিয়ে দিলো। যদিও সে এটা আনকনশাসলি করেছে৷ সে শুধু শাহাদাতের একটা স্বপ্নপূরণ করেছে। যেহেতু শাহাদাতের কাছে পাওয়ার অফ এটর্নি ছিল তাই প্রহ্লাদের প্রজেক্টের অংশ হতে সমস্যা হয়নি। রইল বাকি জুমের জমিগুলো। সেগুলো এতদিনে অন্য নামে হস্তান্তর হয়ে যেত, যদি না তোমার বোনেদের জীবনে একের পর এক বিপর্যয় নেমে আসত! এই সমস্ত কাজে তোমার মামিকে সাহায্য করেছে মেখলির সর্দার শেরিদ। এবং এই পরিকল্পনা যেন তুমি কখনো আঁচ করতে না পারো তাই তিনি নিজেও পাহাড়ি অভিজাতদের সাথে মিশতেন না, তোমাকেও মিশতে দেওয়া হতো না। একইভাবে শাহাদাতের বন্ধু হাসনাইনের পরিবার অর্থাৎ রাজপরিবারের সাথে সুকৌশলে তোমার যাওয়া আসা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। আর তোমার পড়াশোনা, বুদ্ধিবৃত্তিক যত্ন নেওয়া হয়নি এইজন্যই, যেন তুমি বোকাই থাকো, আর তার পরিকল্পনা কখনো আঁচ করতেও না পারো!
সেই পাঁচ বছর আগেই পুরো ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে আমি চাইছিলাম শুধু তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার একটা বেটার ফিউচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু তুমি মোটেও সুযোগ দিচ্ছিলে না। আর কিছু বলার সুযোগ পেলেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে কি না এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম আমরা। মেখলির সাধারণ পাহাড়িরাও আমাকে বিশ্বাস করত না, তারা তোমার মামিকে অন্নদাত্রী ভেবে পূজা করত। তাই আমি এই পরিকল্পনাটা করি। বড়ো বাড়িটা কিনে নিই আমরা। আমার পরিচয় গোপন করে সৌমিক নিয়মিত আসতে থাকে এখানে এবং তোমার দেখাশোনা করতে থাকে। আমরা চেয়েছিলাম তোমাদের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে ওর মাধ্যমে আমি তোমাকে সব জানাব। কিন্তু একের পর অঘটন ঘটল তোমার বোনেদের জীবনে। তোমার মামি ডেসপারেট হলেন, প্রথমে শেরিদের সাথে মিলে জুমের জমি হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছে বেচতে আর পরে সৌমিকের সাথে তোমার বোনের বিয়ে নিয়ে! জমি বেচাটা আমরা সুকৌশলে এতদিন আটকে রাখলেও তোমার আঠারো হওয়ার পরে সেটা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। এদিকে শেরিদের কাগজ প্রস্তুত – বাকি আছে শুধু তোমার কয়েকটা সিগনেচার! এ আজ অথবা কাল হয়েই যেত। তাই বাধ্য হতে হলো আমাদেরকে আগের পরিকল্পনা ত্যাগ করে সবার সামনে আসতে। তোমার মামি এই ভাঙা বাড়িটা ছাড়া তোমার জন্য আর কিছুই রাখতেন না! না তিনি তোমার কথা ভেবেছেন, না ভেবেছেন অসহায় জুমচাষীদের কথা। আরও যা যা তিনি করেছেন সেসব তো আমি আগেই বলেছি। আবার রিপিট করার কোনো মানে নেই।
আমি এখনো চাই আমার বলা একটি কথাও তুমি বিশ্বাস করবে না, স্বর্ণ। তুমি প্রতিটি ফ্যাক্ট যাচাই করবে, তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝে নেবে তোমার এখন কী করা উচিত। আমি তোমার অন্ধবিশ্বাস চাই না। বুদ্ধিকে চর্চা করেই তাকে শানিত করতে হয়। সেই সুযোগ তুমি কখনো পাওনি। এদের সাথে কী করবে তুমি সেই সিদ্ধান্ত এখন সম্পূর্ণভাবে তুমি নেবে। আর আমি চাই হৃদয় দিয়ে নয় মস্তিষ্ক দিয়ে ভাববে তুমি!
আর সৌমিক তোমাকে ভালোবাসে, মা স্বর্ণ। এই অচিনপুরে ও এসেছিল বাবার দেওয়া কাজ হিসেবে তোমার সাথে বন্ধুতা করতে। সেই বন্ধুতা ওর দুর্বলতা হয়ে গেলে আমরা ওকে তানজিলার শেষ ইচ্ছে জানাই। সানন্দে সম্মত হয় ও। তোমার বন্ধুতা ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম আমি, ভালোবাসাটা নয়! সেটা আপনা থেকেই ওর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। এটাও তুমি ভেবে দেখবে, আমরা কি তোমাদের বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেবো?
হঠাৎ করে এত এত চাপ আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। এত তথ্য একসাথে মাথাটাকে জ্যাম করে দিয়েছে। এত তথ্য একসাথে এনালাইসিস করতে গিয়ে হ্যাং না হয়। আমার শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কও অবশ হয়ে আছে। দৃষ্টিতে শুধু শূণ্যতা দেখতে পাচ্ছি!
প্রচণ্ড প্রতাপশালী মামি যেন শুকিয়ে ছোটো হয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে! বড়ো আপা ক্রমাগত কাঁদছে। ওর জন্যও এসব বড়ো আঘাত হয়ে এসেছে। ছোটো আপা একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। সৌমিকের দিকে তাকাল ও। সৌমিক মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। ছোটো আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— এত কিছু জানতাম না রে! আমাকে মাফ করিস। আমরা চলে যাচ্ছি। তুই ভালো থাকিস।
আমি ভাষাহীন তাকালাম শুধু।
বড়োচাচা হুংকার দিয়ে উঠলেন,
— অন্য কোথাও নয়, সব থানায় যাবে। সৌমিকের সাথে বিন্নিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকটা যে ষড়যন্ত্র করেছেন সেটার উপর থেকে তো পর্দাই খোলা হয়নি। শেরিদের সাথে মিলে যে একটা গোপন মিটিং হলো, তার আউটকাম কী? স্বর্ণচাঁপাকে মেরে ফেলা? সোনার ডিমপাড়া হাঁসটার পেটটা একবারেই চিরে দেওয়া?
আমি চমকে উঠে মামির দিকে তাকালাম।
মামি এবারে কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে,
— বিশ্বাস কর, খুকী, এতটা খারাপ নই। তুই আর বিন্নি যেভাবে বুদ্ধি করেছিলি আমি শুধু সেটাই শেরিদকে বলেছি। আর কিছু না। তোর জমি, টাকার উপর আমার লোভ আছে, কিন্তু তোকে আমি ভালোওবেসেছি!
আমি কাঁদলাম এবারে,
— এই যে বড়োচাচা যা যা বলে গেল এইভাবে ভালোবেসেছ তুমি আমাকে? আমার তো পৃথিবীই তোমরা, আমার পৃথিবীটাকেই মিথ্যে করে দিলে?
আমি আর শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। অচিনপুরের খরতপ্ত আকাশটা ভেঙে পড়েছে মেখলির মাথায়। সমস্ত আকাশে ঢেকে গিয়েছে গাঢ় অমানিশায়। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না স্বার্থপরতা ছাড়া!
বড়োচাচা বললেন,
— শান্ত হও, মা। এখন অনেক সাহস দরকার তোমার। তোমার সমস্তকিছু তোমাকেই বুঝে নিতে হবে তো! আমি তো এতদিন এটাই চেয়েছি, শাহাদাতের সন্তান তার সমস্ত কিছুর যোগ্য উত্তরাধিকার হোক – সম্পদেও, বুদ্ধিতেও!
সৌমিককে ডাকলেন তিনি,
— বাইরে হয়তো অচিনপুরের ওসি পৌঁছে গিয়েছেন, তুমি তাকে নিয়ে এসো। এদের জেলহাজত দরকার আছে।
আমি দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে সৌমিকের পথ আটকালাম,
— মামির মনে কী ছিল, কী আছে জানি না আমি, কিন্তু সেদিন তার আঁচলে মা মা ঘ্রাণ পেয়েছিলাম আমি, স্পর্শে মায়ের মতো আদর। তার দিকটা মিথ্যা হতে পারে, আমার অনুভূতি তো তা নয়। একটা ভয়ংকর দুঃসময়ে সে আমাকে উদ্ধার করেছিল, সেটুকুই বা কে করে কার জন্য? সেই একটা দিনের বিনিময়ে বাকি সব ভুলতে রাজি আমি! আমি বোকা চাঁপা! আমার বুদ্ধি নেই তাই আমি বুদ্ধি না খাটিয়ে হৃদয় দিয়ে ভাবি। আজও আমি হৃদয় দিয়েই ভাবব। না মামি থানায় যাবে, না এই বাড়ি ছেড়ে, না আমাকে ছেড়ে! রাজধানীতে যে বাড়ি করেছে ওরা সেখানে বড়ো আপা আর উজ্জ্বল দাদা থাকবে। আমি মাঝে মাঝে ওকে দেখতে যাব …

চলবে….
আফসানা আশা
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here