#সূর্যস্নান
#পর্ব_০৬
#Nishat_Tasnim_Nishi
উনারা বুঝতেছে না দেখে রাগ দেখিয়ে চলে আসলাম।আসার সময় বলে এসেছি আমি যদি বিয়ে করি তাহলে নিদ্রকেই করবো।
সিড়ি দিয়ে নিচে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম আরুশি উপরে উঠতেছে।আমাকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন আমি ওকে ডাক দিলাম। ও না দাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি গিয়ে ওর পথ আটকাই।
আমি ওকে বললাম,,,
—“কী হয়েছে এমন করছো কেনো?”
ও রাগ দেখিয়ে বললাম,,
—“কেমন করছি?”
—“আরে,রেগে যাচ্ছো কেনো?”
—“তো কী করবো নাচবো?আমার ভাইকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে শান্তি পাও নি?”
–“মানে,কী বলছো এসব?”
–“কী মনে করেছো?আমি জানবো না?আর কেউ জানুক আর না জানুক আমি ঠিকই জানি যে কেনো ভাইয়া এখান থেকে সবসময়ের জন্য ঢাকা চলে গিয়েছে।সব তোমার জন্য তাই না?”
আমি বিষ্ময় নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও ঝাড়ি মেরে চলে যায়। বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করতেই জানতে পারি যে, আয়ানকে ঢাকায় উনার ফুফুর বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আয়ান নাকি ওখানেই থাকবে,আর এখানে আসবে না। কারন হলো আয়ান নাকি উনার পরিবারকে বলেছে যে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না, উনার নাকি রিলেশন আছে। আর এ নিয়ে উনার বাবার সাথে তর্কাতর্কি করে চলে গিয়েছেন। কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম,উনি আমার জন্য পরিবারের সাথে ঝগড়া করেছেন। কেনো যেনো মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো,অন্তরের গভীর থেকে উনার জন্য শ্রদ্ধা চলে এসেছে।
আচ্ছা আরুশি এমন করলো কেনো? না,বিষয়টা ওকে জিজ্ঞেসস করতেই হবে। এ কথা ভেবে ওকে খুজার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম,অনেক খুঁজাখুজির পর দেখলাম ও ছাদে রেলিং এর পাশে দাড়িয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছে।
আমি ধীর পায়ে পিছনে যেতেই শুনলাম ও কাউকে চেঁচিয়ে বলছে,”
—“তুই সিগারেট খাচ্ছিস?ছিঃ,ভাইয়া শুধু মাত্র ওই একটা মেয়ের জন্য নিজের লাইফ শেষ করে দিবি?”
আমি আরো কাছে যেতেই দেখলাম,আরুশি ভিডিও কলে আয়ানের সাথে কথা বলছে। ফোনের ভেতর আয়ান সিগারেট খাচ্ছে,আর আরুশিকে বুঝাচ্ছে। এটা দেখতেই আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আয়নের নজর আমার উপর পড়তেই উনি তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টা পিছনে নিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন,,
—“নূপুর!”
তখনই আরুশি পিছনে ঘুরে আমার দিকে তাকালো,আমাকে দেখেই ও ফোন টা কেটে দিলো।আমি কোনেরকম বললাম,,
—“আয়ান!”
আমার মুখে আয়ানের নাম শুনে আরুশি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,ও আমাকে যা নয় তা বলতে লাগলো।আমি চুপচাপ সব হজম করলাম। আরুশির বকাবকির মাঝখানেই আমি বললাম,,
—-“আয়ান ভাইয়ার নাম্বার টা দিবে,আমি একটু কথা বলবো।”
আরুশি এবার আরো কড়া কথা শুনাতে লাগলো।আমার কোনো জবাব না পেয়ে ও চলে গেলো আর আমি ওখানেই বসে পড়লাম। না চাইতেও নিজের প্রতি খারাপ লাগতে লাগলো। আমার কারনেই তো সব হচ্ছে?আচ্ছা,আদৌ কি এসবের জন্য আমি দায়ী? খারাপ লাগাটা কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
বিকালে নিদ্রের ঘরে গিয়ে আমি বড়সড় ধাক্কা খেলাম। নিদ্র চেয়ারে বসে আছে,ওর মাথা ভর্তি রাশি রাশি চুলের একটা চুলও নেই,ও পুরো ন্যাড়া হয়ে আছে। আমাকে দেখেই ও দ্রুত টুপি মাথায় পরে নিলো,ও ভেবেছে আমি দেখি নি। কিন্তুু আমি ঠিকই দেখে নিয়েছি। আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম,ভালো করে উনার মুখপর দিকে তাকালাম। উনি কেমন পাংশুটে হয়ে গিয়েছেন,মুখ টা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।অনেক দিন উনাকে ভালো করে দেখিও নি,আমি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেসস করলাম,,
—-“আপনি ন্যাড়া হয়েছেন,কেনো?”
উনি থতমত খেয়ে গেলেন। আমাকে কাহিনী বানিয়ে বলতে লাগলেন যে চুলে নাকি চুইংগাম আটকে গিয়েছিলো। কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম যদি না টেবিলের উপর মেডিকেলের রিপোর্ট না দেখতাম। আমি সন্দেহ নিয়ে রুপোর্ট টা হাতে নিতেই উনি রিপোর্ট সরিয়ে নিলেন।আমি তাকাতেই বললেন এটা নাকি উনার মায়ের। আমি উনার সাথে জোরাজুরি করে রিপোর্ট হাতে নিতেই দেখলাম ওখানে স্পষ্ট লিখা নিদ্রের ব্রেইন ক্যান্সার। ছলছল নয়নে উনার দিকে তাকাতেই মাথা নিচু করে ফেললেন।
–“ওহ,আচ্ছা,তাহলে এটাই কারন ছিলো আমাকে রিজেক্ট করার পিছনে?”
–“আরে বিষয়টা,,,”
–“হ্যা বা না বলুন।”
উনি চোরের মতো মাথা নাড়ালেন।এরপর উনি সব বললেন,, আর আমি একের পর এক শক খেতে লাগলাম। উনি যে আমাকে ফাকি দিয়ে এ সপ্তাহের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন সেটাও বলেছেন। ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে উনি চলে গিয়েছেন,উনি সব বলেছেন আর কেঁদেছেন।কখন যে আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তেছিলো টেরই পেলাম না। কোনো এক অজানা কারনে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম,খুব কাঁদলাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো,এতটা কষ্ট মনে হয় এর আগে কখনও হয় নি। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছেন,,
—-” ভালোবাসা কেনো এমন হয়?যখন দরকার তখন পাই না,আর যখন দরকার নেই তখন পাই। জীবন এত সুন্দর কেনো?এর আগে এত রঙ্গিন লাগে নি, যেদিন জেনেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো সেদিন থেকে রঙ্গিন লাগছে। আমি না তোমার সাথে বাঁচতে চাই,খুব করে বাঁচতে চাই। আমার না খুব শখ ছিলো তোমার সাথে ছোট্ট একটা সংসার করবো,এত এত বাচ্চাকাচ্চা পালবো। তুমি ওদের জ্বালায় কেঁদে দিবে।আচ্ছা শুনো আমি যদি না থাকি তাহলে তুমি এত এত বাচ্চাকাচ্চা পালবা, বুঝেছো? সবসময় হাসিখুশি থাকবা।মনে রাখবা রাতের আকাশে যে তারা টা সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করবে সেটাই আমি। তুমি সে তারার দিকে তাকিয়ে আমাকে মনে করবে। আর শুনো যখন সে তারার সামনে যাবে তখন হাসিখুশি থেকো,তোমার কষ্টভরা মুখ দেখলে আমারও তো কষ্ট হবে। তাই আমার সামনে হাসবে,আর সেজেগুজে যাবা।”
উনি এমন হাজারো কথা বলতে লাগলেন,আমি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছিলাম আর সব শুনছিলাম।এ প্রথম উনাকে কাঁদতে দেখেছি,না হয় উনি তো সবসময় হাসিখুশিই থাকেন।সচরাচর উনাকে আমি কাঁদতে দেখি নি।
কোনো জবাব দেই নি,কাঁদুক না, কেঁদে মনটা হালকা করুক। আর তো কখন এমন আবদার না করতে পারে, শুনিই না সব আবদার। কেনো এত কষ্ট হচ্ছে,কেনো জীবনে এত ট্রায়াঙ্গেল,কেনো এত পরীক্ষা।
এরপর সেদিন রাতে অনেক কাহিনীর পর নিদ্রের সাথে আমার বিয়ে হয়। সে কাহিনী না হয় বাদই দিলাম। পুরো পরিবারের সাথে যে কতটা যুদ্ধ করেছি সে খবর আমিই জানি। আমার বাবা-মা তো রেগে আগুন।মা তো আমাকে থাপ্পর ও দিয়েছিলেন। আমার জেদের প্রতি আমি অটুট ছিলাম দেখে উনারা চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন আমি যাতে উনাদের বাবা-মা না বলি। কষ্ট হচ্ছিলো খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও মুখ ফুটে কিছু বলিনি। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিদ্রকে বিয়ে করেছিলাম। উনার পরিবারের মনের অবস্থা আর নাই বললাম,,বাবা-মা উনাদের এত এত কথা শুনিয়েছিলেন যে আমারই কান্না চলে এসেছিলো।
সে রাতে আমি উনাদের বাসাতেই ছিলাম,উনার পাশে বসে খুব কেঁদেছিলাম। উনি আমাকে বারবার বলেছে,,
—“এখন কাঁদতেছো ভালো কথা পরে কিন্তু কাঁদতে পারবে না।”
যত সময় যাচ্ছিলো উনি ততই দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন,,শেষ রাতে উনার অবস্থা আরো খারাপ লাগছিলো। আমি শাশুড়িআম্মুকে গিয়ে ঢেকে নিয়ে আসলাম। উনারা সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন সাথে আমিও গেলাম। ডাক্তার এসে বললেন যে উনার উপর নাকি আজ বেশিই মানসিক চাপ পড়েছে তাই উনার অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডাক্তার দ্রুত বিদেশে কন্টাক্ট করলেন। উনাকে আজকেই বিদেশে ট্রান্সফার করবেন, তখন প্রায় সকাল হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে আমাদের হাতে দু ঘন্টা সময় আছে কে যাবো আর কে থাকবো ডিসাইড করতে। কাঁন্নার কারনে আমি ঠিকমতো কথাও বলতে পারতেছিলাম না,বারবার সবগুলো কথা জড়িয়ে আসছিলো। নিদ্রের আম্মু তো কাঁদার জন্য কথাও বলতে পারতেছিলেন না,উনি এত বেশি কান্না করছিলেন যে হসপিটালের নার্স রা এসে উনাকে সামলাচ্ছিলেন।
.
.
.
.
.#সূর্যস্নান
#পর্ব_০৭
#Nishat_Tasnim_Nishi
নিদ্রের আম্মু তো কাঁদার জন্য কথাও বলতে পারতেছিলেন না,উনি এত বেশি কান্না করছিলেন যে হসপিটালের নার্স রা এসে উনাকে সামলাচ্ছিলেন। উনার প্রেশার ফল করায় উনাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়।
একের পর এক সবাই ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলো,আমি ভাবলাম এখন যদি আমিও ভেঙ্গে পড়ি তাহলে তো নিদ্রের অবস্থা আরো খারাপ হবে। আমি নিজেকে একদম শক্ত করে নিলাম, মনকে বুঝালাম এখন কোনো মতে ভেঙ্গে পড়লে হবে না।
অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি যাবো নিদ্রের সাথে। নিদ্রের আব্বু বললেন,,
—“‘আমার যাওয়ার কোনো দরকার নেই উনি আর আদ্র ভাইয়া যাবেন।'”
আমি কথাটা শুনেও শুনলাম না,জেদ ধরে বসলাম যে আমিও যাবো। আমাকে বুঝিয়েও যখন পারলেন না,তখন উনারা বাধ্য হয়ে আমার আম্মু-আব্বুকে ফোন দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরর ব্যবস্থা করলেন। হসপিটালে বাবা-মা আসলেন,আমি জানি উনারা এখন কাহিনী করবে।তাই আমি নিদ্রের কাছে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
কিছুক্ষন পর আমি উনাদের সবাইকে উপেক্ষা করে নিদ্রের সাথে রওনা দিলাম। নিদ্রের দিকে তাকাতেই বুকটা হুহু করে উঠলো,এত টা কষ্ট হচ্ছিলো বলে বুঝাতে পারবো না।
“সুখ টা হয়তো আমার জন্য মরীচিকা!
আর কান্না টা আমার নিত্য সঙ্গিনী!”
নিদ্রের চিকিৎসার জন্য বিদেশে এসেছি আজ দুইদিন। দুই দিনে দুই হাজারের মতো ঝড় বয়ে গিয়েছে আমার উপর। নিজেকেই সামলাতে পারছিলাম না বাকিদের কথা তো বাদই। নিদ্র এখন আই সি ইউ তে আছে,ওর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল, ডাক্তার বলেছে নিদ্র আর বেশি দিন বাঁচবে না। সময় থাকতে চিকিৎসা করলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেতো,কিন্তুু উনারা হেলাফেলা করায় এখন আর সময় নেই।নিদ্রের হাতে নাকি সময় আছে তিন মাস।
নিদ্র যে বাঁচবে না এটা আমি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছি,কারন উনি এখন লাস্ট স্টেজে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় নিদ্রর এ অবস্থা আমি খুব ইজিলি মেনে নিতে পেরেছি। দুইদিনে দু সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারি নি,সারাক্ষণ হসপিটালে বসে ছিলাম।
সকালেই আদ্র ভাইয়া জোর করে আমাকে হোটেলে রেখে গিয়েছেন কারন আমার অবস্থাও খারাপ হয়ে গিয়েছে। ফোনগুলো আপাতত বন্ধ রেখেছি বাড়ী থেকে হয়তো ফোন আসছে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে,সব শেষ করে দিতে মন চাইছে।
.
ডাক্তারের কথামতো নিদ্র তিন মাস ই বেঁচে ছিলো। সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত নিদ্রের জন্য ছিলো সেই তিনমাস। হসপিটালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখেছি। তিল তিল করে কষ্ট পেয়ে মরতে দেখেছি। উনাকে এমন করতে দেখে আমারও খুব খুব কষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে কখন জানেন,যখন উনি বাঁচার জন্য কাকুতিমিনতি করতেন তখন। ইচ্ছে করতো আমার হায়াত উনাকে দিয়ে বাঁচতে দেই।
তিন টা মাস বাচ্চাদের মতো উনার যত্ন করেছি,সারাক্ষণ উনার পাশেই ছিলাম। নার্সরা ক্লান্ত হলেও আমি হতাম না। সারা রাত উনার হাত ধরে পাশে বসে থাকতাম। একদিন রাত্রে হয়েছে কি উনার আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায়,চোখ মেলে দেখেছেন যে আমি উনার হাতের তালুর উপর মাথা রেখে কান্না করছি।
উনি অস্থির হয়ে জিজ্ঞাস করেছিলেন,,
—-“কী হয়েছে দোলন?কষ্ট হচ্ছে?খারাপ লাগছে?ডাক্তার ডাকবো?”
আমি শুধু স্থির দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়েছিলাম,উনি আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন, আমি কোনো সাড়াশব্দ না করে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম।আচমকা এমন হওয়ায় উনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন,কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিলো বিষয়গুলো বুঝতে।বিষয়গুলো উনি বুঝতেই পরম আবেশে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এত কষ্ট,গ্লানির মাঝে সে মুহূর্ত টাই ছিলো পরম শান্তির।
জানেন আমি না খুব কেঁদেছিলাম যেদিন উনার মৃত্যুর সংবাদ শুনেছিলাম,আমি তখন উনার পাশেই ছিলাম। সেদিন প্রথম স্বচক্ষে কাউকে মরতে দেখেছিলাম তাও নিজের সদ্য বিবাহিত হওয়া স্বামী। আমার অবস্থা কেমন ছিলো,বলে বুঝাতে পারবো না। আর বললেও হয়তো বুঝবেন না, কষ্ট টা শুধু সেই অনুভব করতে পারে যার উপর দিয়ে সে কষ্ট বয়ে যায়।
সেদিন আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।পুরো আট ঘন্টা সেন্সলেস ছিলাম। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় শায়িত অবস্থায় পেয়েছিলাম । পাশে তাকাতেই দেখলাম শশুড়বাবা বসে আছেন,আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি ডাক্তারকে ডাক দিলেন।
আমি ঠান্ডা গলায় বলেছিলাম,,
—“আঙ্কেল আমি ঠিক আছি,আপনি নিদ্রের কথা বলুন!”
উনি তখন চুপ করে গিয়েছিলেন,একটুপর মুখে হাত দিয়ে কেঁদে দিলেন, কেঁদে কেঁদেই ইশারায় বলেছিলেন যে নিদ্র আর নেই। আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম,তখনই চোখের পাশ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিলো। এক সেকেন্ডের কথা যে বুকের মধ্যে এতটা কষ্ট অনুভব করা সেটা সেদিন বুঝেছিলাম।মনে হয়েছিলো আমার কলিজটা তখন বুক থেকে সরে গিয়েছিলো।
রাতের আঁধার শেষ হয়ে দিনের শুরুতেই নিদ্রের লাশ নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। আমাদের সবার অবস্থা কেমন ছিলো সেটা আর না ই বললাম। বাড়ীতে কাউকে জানায় নি, আঙ্কেল ফোন দিয়ে শুধু এটাই বলেছিলেন দেশের বাড়ীতে চলে যেতে,আমরা ডাইরেক্ট ওখানেই যাবো।
প্লেনে আমার সিট আলাদা পড়ে,পুরো পথ নিদ্রের জামা জড়িয়ে বসেছিলাম। কান্না করতে করতে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো। মানসিকভাবে এতটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম যে আশেপাশে কী হচ্ছে হুশ ও ছিলো না। শশুর আব্বুর দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না,একে তো ছেলে হারানোর শোক আবার কাধ সমান ঋণ।
নিদ্রের আব্বুর কাধ সমান ঋণের বোঝা হয়ে গিয়েছিলো, ৩ মাসে এত এত টাকা হাসপাতালে দিতে হয়েছিলো। নিজের জমানো পুঁজি দেওয়ার পরেও উনাকে আরো কয়েক লক্ষ টাকা ধার করতে হয়েছিলো।
আর আদ্র ভাইয়া তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছেন,পরিবারের বড় সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে করতে উনি হাপিয়ে গিয়েছিলেন,নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর শোক ও ঠিক মতো পালন করতে পারে নি আমাদের কারনে।
এরপর আমি একের পর এক ধাক্কার সাথে সম্মুখীন হচ্ছিলাম,ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম এ নিয়তির সাথে লড়তে লড়তে।
এতক্ষণ এতকিছু বলার পর থামলাম,ঠোঁট দিয়ে জিহ্বা ভিজিয়ে নিলাম।তখনই সামনের ব্যক্তিটি আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,,
—“তাই তুমি এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলে?”
আমি ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানিটুকু শেষ করে নিলাম, এরপর মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হ্যা..!!”
—-” আয়ানের কী হয়েছিলো?আর তুমি ই বা এতমাস কোথায় ছিলে?এরপর কী হয়েছে,বলো না?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এত দিন পর আজ আবার পুরোনো স্মৃতি বলতে গিয়ে হৃদয় নাড়া দিয়ে উঠেছে। অতীত কখনো পিছু ছাড়ে না, যেখানেই যাই এ অতীত তাড়া করে বেড়ায়। সামনের ব্যক্তিটির আগ্রহ দেখে মৃদু হাসলাম! চোখের কোনের জমে থাকা পানি টুকু হাত দিয়ে মুছে ফেললাম। হাতের রুমাল উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,,
—“চোখের পানি মুছে ফেলুন..!!”
আমার কথা শুনে ব্যক্তিটি কিঞ্চিৎ চমকালো!হয়তো খেয়াল ই করে নি কখন যে উনার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে। উনি কিছুটা ইতস্ত হয়ে রুমাল টা নিয়ে পানি মুছে ফেললো,রুমাল টা আবার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অতি উৎসাহিত হয়ে বললেন,,
—-“বলুন না,এরপর কী হয়েছিলো?”
আমি উনার উত্তেজনা দেখে ঠোঁট বাকা করে হাসলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,,,
—-“বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই বিধবা বিষয়টা চাট্টিখানি ব্যাপার ছিলো না। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমরা উনাদের দেশের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সেখানে যাওয়ার পর হয়েছে। চিন্তাও করতে পারবে না কী কী’র সাথে সম্মুখীন হয়েছিলাম,,
.
.
.
.
.
.
চলবে!
চলবে?
(গঠনমূলক মন্তব্যেরর আশা করছি)