“সেই তুমি💐 পর্ব -৩৭+৩৮

সেই তুমি💐
পর্ব -৩৭+৩৮
Samira Afrin Samia
#Nipa

রিহা কোন ভাবে ইশিতা কে একা একাই হসপিটালে নিয়ে আসে। হসপিটালে আনতে আনতে ইশিতা সেন্সলেস হয়ে যায়। ইয়াশ এই শহরের একজন সুনামধন্য বিজনেসম্যান। তাকে এক নামে সবাই নিচে। রিহা ইশিতা কে ইয়াশের ওয়াইফ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে সব ডক্টর রা ইশিতা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ইশিতা কন্ডিশন ভালো না তাই ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে। দেরি করলে আরো মারাত্মক কিছু হতে পারে।
একজন ডক্টর এসে খুব তাড়াহুড়ো করতে করতে রিহা কে জিঙ্গেস করলো
— আপনি পেশেন্ট এর কে হন?
— আমি ইয়াশ চৌধুরীর ছোট ভাই ইফান চৌধুরীর স্ত্রী। উনি আমার ভাবী হন।
— আপনাদের সাথে আর কে এসেছে?
— আসলে ডক্টর আমার শাশুড়ি নাজমা চৌধুরী বাসায় নেই। ইয়াশ চৌধুরী বিজন্যেসের কাজে দেশে বাইরে গেছে। ইফান বাসায় আছে তাকে ফোনে পাচ্ছি না।
— পেশেন্ট এর সাথে কি শুধু আপনি ই এসেছেন?
— হ্যাঁ।
— তাহলে আপনাকে কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।
মিসেস চৌধুরীর অবস্থা ভিষণ কিটিক্যাল। ইমিডিয়েটলি উনার অপারেশন করতে হবে।
— ইশিতার কিছু হবে না তো?
আর ওর বাচ্চা?
— দেখুন আমরা এখন কিছুই বলতে পারছি না। পেশেন্টের এমনিতেই অনেক ব্লিডিং হয়েছে। উপুড় হয়ে পড়ায় পেটে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। অপারেশন করতে হবে।
— ডক্টর যা করার আপনারা তাই করুন। টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। ইয়াশ চৌধুরী চাইলে মুহূর্তের মধ্যে এমন কয়েকটা হসপিটাল কিনে নিতে পারে। উনি যদি শুনেন আপনাদের অবহেলার জন্য উনার ওয়াইফ বা উনার বাচ্চার কিছু হয়েছে। তাহলে উনি আপনাদের কি হাল করবে তা বুঝতেই পারছেন।
— দেখেন ম্যাম আমাদের কাজ ই পেশেন্ট কে সুস্থ করে তুলা। হোক সে ধনী বা গরীব। ডক্টর রা কোন রোগী কে ই অবহেলা করে না। আর আমরা ইয়াশ চৌধুরী কে খুব ভালো করে চিনি। আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করবো। যাতে মিসেস চৌধুরী আর উনার বাচ্চার কিছু না হয়।
— প্লিজ ডক্টর যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
— আমরা পেশেন্ট কে অপারেশন থিয়েটারে শিফট করছি। আপনি ফর্মালিটি গুলো পূরণ করুন। আর বাড়ির কাউকে খবর দেন।

রিহা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। ইফান কে অনেক বার ফোন করেছে। প্রথমে কয়েক বার রিং হলেও কিছুক্ষণ পর ফোন সুইচ অফ বলছে। রিহা চিন্তায় মরে যাচ্ছে।
— কি করে কি হয়ে গেল। ইশিতা পড়ে গেল কি করে? কি হয়েছিল?
আমি প্রথমেই যদি ইশিতার ডাক শুনতে পেয়ে চলে যেতাম তাহলে আর এমন টা হতো না।
রিহা পায়চারি থামিয়ে স্থির দাঁড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
— মা তো আজ ফিরে আসবে। মা’কে ফোন করে জানাবো কি?
ইশিতার ব্যাপারে এসব জানতে পারলে মা তো টেনশন করেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া মা’কে সব কিছু এখন না জানিয়ে শুধু হসপিটালে আসতে বলি।রিহা নাজমা চৌধুরী কে হসপিটালে আসতে বলে তবে কি হয়েছে কারণ টা বলে না। নাজমা চৌধুরী অনেক বার জিঙ্গেস করেছে কারো কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু রিহা নাজমা চৌধুরী কে কিছু ই জানালো না।

প্রায় এক ঘন্টার মত সময় পাড় হয়ে গেল। আরো বেশিও হতে পারে। কোন ডক্টর ই এখনও অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হচ্ছে না। ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে রিহা তা কিছুই জানে না। শেষ পর্যন্ত ইশিতা আর ওর বাচ্চা ঠিক থাকবে তো। রিহা ইশিতার জন্য ও তার বাচ্চার জন্য সমানে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে যাচ্ছে।
— আল্লাহ আমি অনেক অন্যায় করেছি ইশিতার সাথে অনেক কষ্ট দিয়েছি ওকে। জীবনে এতো কষ্ট সহ্য করে মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখার আগেই কি তুমি তার সুখ কেড়ে নিবে?
তুমি তোমার বান্দার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হইয়ো না আল্লাহ। তুমি তাদের দু’জন কে ই সুস্থ রাখো।
এই বাচ্চা টার জন্য ইশিতা সমাজের সবার সাথে একা লড়াই করেছে। কত অপমান কত লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েছে। এখন এই বাচ্চা টার কিছু হয়ে গেলে ইশিতা মরে যাবে।
বলতে বলতেই নাজমা চৌধুরী এসে গেল। রিহা নাজমা চৌধুরী কে দেখে উনার কাছে যায়।
— কি হয়েছে রিহা তুমি আমাকে হসপিটালে আসতে বললে কেন?
কার কি হয়েছে?
— মা ইশিতা।
নাজমা চৌধুরী ভয়ে ভয়ে বললো
— ইশিতা?
কি হয়েছে ওর। ইশিতা ঠিক আছে তো? আর ওর বাচ্চা?
— মা আসলে আজ দুপুরে আমি রুমেই ছিলাম। ইশিতা ও ওর রুমেই ছিল। হঠাৎ আমার মনে হলো ইশিতা আমাকে ডাকছে। ইশিতা কেন আমাকে ডাকছে তা স্পষ্ট করে বুঝতে না পারলেও আমি ওর রুমে যাই ওকে দেখার জন্য। ওর রুমে গিয়ে দেখি ইশিতা ওয়াশরুমে ফ্লোরে পড়ে পেটে হাত দিয়ে চিৎকার করছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে ইশিতা শুধু আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা এইটুকু ই বললো।
বাসায় কেউ ছিল না আমি কি করবো কিছু বুঝতে না পেরে কোন ভাবে ইশিতা কে এখানে নিয়ে আসি। আর আপনাকে আসতে বলি।রিহার মুখে পুরো কথা শুনে নাজমা চৌধুরী ধপ করে নিচে বসে পড়ে। নাজমা চৌধুরী মুখে হাত দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়ে বলতে লাগলো
— সব শেষ হয়ে গেল।
রিহা নাজমা চৌধুরী কে তুলে দাঁড় করিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে
— শান্ত হন মা কিছু হবে না ইশিতার। আপনি দেখবেন ইশিতার বাচ্চার ও কিছু হবে না। ও’রা দু’জনেই ঠিক থাকবে।
— আর কিছুই ঠিক থাকবে না রিহা। মেয়েটার সব শেষ হয়ে গেল। ইয়াশ জানে ইশিতার কথা?
— না মা আমি ইয়াশ ভাইয়া কে কিছু জানাই নি।

ডক্টর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এসে রিহা কে ডাকলো।
— মিসেস রিহা।
রিহা ছুটে গেল ডক্টরের কাছে
— হ্যাক বলুন। ইশিতা কেমন আছে? আর ওর বাচ্চা?
ডক্টর চোখ থেকে চশমা খুলে মুখ গম্ভীর করে নিচের দিকে তাকিয়ে
— দেখুন আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করেছি। আমাদের হাতে যেটুকু ছিল তার বেশি তো করতে পারবো না।
— ইশিতা ঠিক আছে তো?
— হ্যাঁ উনি ঠিক আছেন তবে উনার বেবী
ডক্টর এইটুকু বলার পর ই রিহা মুখ চেপে ধরে কয়েক পা পিছনে যায়।
নাজমা চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠে এসে ডক্টরের সামনে দাঁড়ালো।
— উনার কন্ডিশন ভালো ছিল না। বাচ্চা টা কে কোন ভাবেই বাঁচানো সম্ভব হতো না।
— ইশিতা এখন কেমন আছে?
— উনি মোটামুটি ভালোই আছে। এখনও জ্ঞান ফিরে নি। আর উনি জানেন না যে উনার বাচ্চা টা আর নেই।
জ্ঞান ফিরলে উনাকে তো জানাতে হবে। আর স্বভাবতই এমন কথা জানার পর কেউ ঠিক থাকতে পারে না উনি ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না। আপনারা উনার আপন জন আপনারা একটু উনাকে সাপোর্ট করবেন। এই সিচুয়েশানে উনাকে সামলাতে না পারলে উনার ও হ্মতি হয়ে যেতে পারে।
এই বলে ডক্টর চলে গেল। নাজমা চৌধুরী মুখ চেপে কান্না করছে। আর মনে মনে নিজেকে দোষ দিচ্ছে।
— আমি বাসায় থাকলে হয়ত এসব কিছু হত না। আমি ইশিতা কে দেখে রাখতাম। এই অবস্থায় ওর খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার ছিল। আমি আমার দায়িত্ব ঠিক মত পালন করতে পারিনি। ইয়াশ কে আমি কি করে এসব জানাবো। আমার ছেলেটা তো পাগল হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন সাজিয়েছিল এই বাচ্চা টা কে নিয়ে।
রিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
— আমি ইশিতার সাথে থাকার পরও ওর এতো বড় একটা হ্মতি হয়ে গেল। আমার দরকার ছিল সব সময় ওর পাশে থাকা। ইশিতা কে একা ছাড়া আমার ঠিক হয়নি।

দুই ঘন্টার মত হয়ে গেল। ইশিতা কে ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে। কিন্ত এখনও ইশিতার জ্ঞান ফিরে নি।নাজমা চৌধুরী ইশিতার পাশে বসে ইশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রিহা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
— মা আপনি আজই এতো জার্নি করে ফিরলেন বাসায় ও যান নি। হসপিটালে চলে আসছেন। এখন তো ইশিতার জ্ঞান ফিরে নি। আপনি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন ততক্ষনে আমি ইশিতার পাশে থাকছি। বেশি সমস্যা হলে ডক্টর রা তো আছেন ই।
— আমি এখন কোথাও যাবো না রিহা। জ্ঞান ফিরে এসব শুনলে না জানি মেয়েটা কি করে। নিজেকে যদি সামলে নিতে না পারে তখন?
না না আমি ইশিতার কাছেই থাকবো।
ইশিতার জ্ঞান ফিরছে। ইশিতা মিটমিট করে তাকিয়ে মাথার উপর দাঁড়ানো রিহা কে দেখে চোখ নামিয়ে নাজমা চৌধুরী কে দেখলো। ইশিতার মনে পড়লো ওর সাথে কি হয়েছিল। সাথে সাথে পেটে হাত দিয়ে আমার বাচ্চা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে চাইলে নাজমা চৌধুরী ধরে নিলো।
— কি করছিস তুই? এভাবে উঠিস না মা।
ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে
— আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো মা?
ওর কিছু হয়নি তো?
ইশিতার মুখে প্রথমেই ওর বাচ্চার কথা শুনে নাজমা চৌধুরী ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
নাজমা চৌধুরী কে কাঁদতে দেখেই ইশিতা বুঝে গেল ওর বাচ্চা ঠিক নেই।
ইশিতা পেটে শক্ত করে চেপে ধরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে।
— তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। তোর মাম্মাম কে একা করে দিয়ে চলে গেলি। আমি কি বলবো তোর বাবা কে?
ও তো তোর দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছিল। আমি তোর খেয়াল রাখতে পারিনি।বলতে বলতে ইশিতা কান্নায় ভেঙে পড়লো।নাজমা চৌধুরী ইশিতা কে বুকে টেনে নিয়ে
— চুপ কর মা। চুপ কর। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যেই করেন। কাঁদিস না মা।
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর বুকে মুখে গুজে কাঁদছে
— কি করে চুপ হবো মা। আমার যে আর কিছুই হইলো না। যার জন্য আমি সমাজের সবার সাথে একা একা লড়াই করেছি। আজ সে ই আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
ইয়াশ কে আমি কি বলবো মা?
— তুই এভাবে কাঁদিস না। তাহলে তোর ও হ্মতি হবে। তুই নিজেকে সামলা। আমি জানি তুই ভেতর থেকে অনেক টা শক্ত। তুই একদম ভেঙে পড়বি না।
কাঁদতে কাঁদতে ইশিতা আবার জ্ঞান হারালো।

অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে ইশিতা আর কোন কথা বলে না। পাথর হয়ে বসে আছে। চোখ দু’টো শান্ত হয়ে স্থির হয়ে আছে। ইশিতা আর কাঁদছে না। আর চিৎকার চেচাঁমেচি ও করছে না। একেবারে শান্ত হয়ে গেছে। শুধু পেটে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে।
নাজমা চৌধুরী রিহা ইশিতা কে কত কিছু বলছে ইশিতা তার কোন উত্তর দিচ্ছে না।
ইশিতা কে এমন অবস্থায় দেখে নাজমা চৌধুরীর বুক ফেটে যাচ্ছে।
— ইশিতা তো কোন ভাবে সত্যি টা মেনে নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু ইয়াশ কি সত্যি টা মেনে নিতে পারবে? পারবে কি নিজেকে সামলে নিতে?

রিহা ইশিতার পাশে বসে ইশিতার হাতে হাত রেখে
— এই ইশিতা এভাবে আছো কেন?
কিছু তো বলো। কি হলো তোমার?
ইচ্ছে হলে জোরে চিৎকার করো। কান্না করো তবুও এভাবে চুপ থেকো না।তোমার এভাবে দেখে সত্যি ই আমার খুব ভয় হচ্ছে।
ইশিতা পাথরের মত বসে আছে। মনে হচ্ছে রিহার কোন কথা তার কানে যাচ্ছে না
রিহা এবার সত্যি ই ভয় পেয়ে ইশিতা কে ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে বলে উঠলো
— এই ইশিতা তোমার কষ্ট হচ্ছে না। এভাবে শান্ত হয়ে বসে আছো কি করে?
কি হলো কথা বলো।
ইশিতা এক নজর রিহার দিকে তাকিয়ে রিহা কে জড়িয়ে ধরে নিজের ভেতর চেপে রাখা কষ্ট গুলোকে চোখের জলের মাধ্যমে প্রকাশ করতে লাগলো। ইশিতা নিজের ভেতর আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না।
— কি হয়ে গেল রিহা? আমার সাথেই কেন এমন হয় বলো তো। আমি তো আগের সব কষ্ট গুলো ভুলে গিয়ে নিজেকে আবার নতুন করে তৈরি করেছিলাম। নিজের বাচ্চা কে আঁকড়ে ধরে আবার বাঁচতে চেয়েছিলাম।
এখন তো আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল টুকু ও আমার থেকে হারিয়ে গেল। আমার কপালে কেন সুখ সয়না?
রিহা ইশিতা কে বাঁধা দিচ্ছে না। কান্না করলে কষ্ট কম হবে। নিজেকে হালকা লাগবে। ইশিতার কান্না দেখে রিহা ও কাঁদছে। রিহা কখনও ভাবে নি যাকে সে এক সময় ঘৃণা করতো। যার হ্মতি করার কত চেষ্টা করেছে। আজ তার কষ্ট নিজের ও কষ্ট হবে।

চলবে…..

সেই তুমি💐
পর্ব -৩৮
Samira Afrin Samia
#Nipa

নাজমা চৌধুরী ইশিতার কাছে থেকে রিহা কে বাসায় পাঠিয়ে দিল। ইশিতা সত্যি টা মেনে নিয়েছে এখন আর কান্না করে না তবে পেটের মাঝে হাত রেখে এক নজরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে। মনে হয় কিছু বলার শক্তি টুকু ইশিতার মাঝে নেই। ইয়াশ কে এখনও কিছু জানানো হয়নি। না জানি ইয়াশ এই ঘটনা জানলে কি করবে।
নাজমা চৌধুরী ইফান কে জানিয়েছে।
ইশিতা তার বাবু কে দেখেছে। ছেলে বাবু হয়েছিল। ইশিতা খুব যত্নে মায়া ভরে তার বাবু কে দেখে নেয়। শেষ বারের মত ছুঁয়ে দেখেছে অনুভব করেছে। এতো দিন তো পিচ্চি টা শুধু পেটের ভেতর থেকে লাথি দিত। ইশিতা না দেখেই তার সাথে কত কথা বলেছে। কত গল্প করেছে, কত কথা শেয়ার করেছে। এখন ইশিতা একা থাকলে কার সাথে কথা বলবে? কার সাথে গল্প করবে? কার সাথে নিজের সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করবে?
ইশিতা তো ওর বাবু কে দেখেছে ইয়াশ তো তাও দেখতে পারলো না।
নাজমা চৌধুরী ইশিতা কে অনেক বুঝিয়ে। কিন্তু এসব কিছুতেই তো এখন ইশিতার মন শান্ত হবে না। ছোট থেকেই ইশিতা নিজের কষ্ট গুলো কে নিজের ভেতরেই চেপে রেখেছে। আজ ও তাই করলো। প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পারলেও এখন ঠিকই নিজেকে সামলে নিয়েছে।
কিছু খায় নি ইশিতা। নাজমা চৌধুরী খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে কিন্তু ইশিতা কিছুই মুখে নিচ্ছে না। পাথর হয়ে বসে আছে।
— কিছু তো খেয়ে নে মা। এভাবে না খেয়ে কত দিন থাকতে পারবি?
আর এভাবে না খেয়ে থাকলে কি তোর বাচ্চা তোর কাছে ফিরে আসবে?
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর দিকে তাকালো।
— আমি ও একজন মা। আমার ও দুই টা সন্তান আছে। আমি তোর কষ্ট টা বুঝতে পারছি। কিন্তু মা নিয়তির লেখা তো আমরা হাজার চেষ্টা করেও পাল্টাতে পারবো না।
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেললো তবুও শব্দ করে কাঁদলো না।
— তুই নিজেকে শক্ত না করলে আমার ছেলেটাকে কে সামলাবে বল তো?
ইয়াশ বাহির থেকে অনেক শক্ত। কিন্তু ভেতর থেকে ও অনেক দূর্বল। ইয়াশ কোন ভাবেই মেনে নিতে পারবে না। এই বাচ্চা টা কে ইয়াশ ও তো কম ভালোবাসে নি।
ইশিতা নিরবে চোখের পানি ফেলছে। নাজমা চৌধুরী ইশিতার মুখে খাবার তুলে দিলে এবার ইশিতা খাবার মুখে নিলো।
একদিকে খাচ্ছে আর চোখের পানি ফেলছে। চোখ বন্ধ করে বার বার নিজের সন্তানের কথা মনে করছে। তাকে অনুভব করার চেষ্টা করছে।
ইফান হসপিটালে না গিয়ে পাগলের মত বাসায় ছুটে আসে। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে গলা ফাটিয়ে রিহা কে ডাকছে। রিহা রুমে ছিল ফ্রেশ হচ্ছিল। বিকেলে রিহা হসপিটালে যাবে। রিহা ইশিতার কাছে থাকবে নাজমা চৌধুরী কে বাসায় পাঠিয়ে দিবে। তাই রিহা তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হচ্ছে। কিছু রান্না করে নিয়ে যেতে হবে ইশিতার জন্য।
এমন সময় নিচে থেকে ইফানের ডাক শুনতে পেল।
— কি হলো ইফান এমন অস্থির ভাবে আমাকে ডাকছে কেন?
রিহা রুম থেকে বের হতে হতে ইফান রিহা কে ডেকে ডেকে রুমে চলে আসে।
— কি হলো ইফান কি হয়েছে?
ইফানের চোখ লাল হয়ে আছে। ইফান কে কোন ভয়ংকর জানোয়ারের মত দেখাচ্ছে।
ইফান রিহা কে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রিহার গলা চেপে ধরে ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে নিয়ে দেওয়ার সাথে মিশিয়ে নেয়।
— তুই ইশিতার সাথে এসব করেছিস তাই না?
রিহা ইফানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আর অস্পষ্ট গলায় বলছে।
— ছাড়ো ইফান লাগছে। আমার কথা টা তো শুনো।
ইফান রিহার কথায় পাত্তা দিচ্ছে না।
— আমি জানি তুই ইশিতার সাথে এসব করেছিস। তুই কোন সময় ই ইশিতা কে পছন্দ করতি না। সব সময় ওর হ্মতি করতে চাইতি। আজ খালি বাসায় ইশিতা কে একা পেয়ে তুই তোর এতো বড় হ্মতি করে দিলি। তোর প্রতিশোধ পূর্ণ করলি।
রিহার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে কিছু বলবে তো দূর শ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে।অনেক কষ্টে ইফানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রিহা।
— তোমার মাথা ঠিক নেই ইফান। কি সব যা তা বলছো। আমি কেন ইশিতার সাথে এমন করতে যাবো?
এখন তো ইশিতার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। এখন ইশিতা আমার বোন থেকেও বেশি। আমি ওর সাথে এমন একটা কাজ করার কথা স্বপ্নে ও কল্পনা করতে পারিনা। আগে যা হয়েছে আমি ইশিতার সাথে যা যা করেছি তার জন্য আমি লজ্জিত ও অনুতপ্ত।
— চুপ তোর একটা কথা ও আমি বিশ্বাস করিনা। তুই ইশিতার বেবীর হ্মতি করেছিস।
— আমি কেন ইশিতার বেবীর হ্মতি করবো?
যা বলছো ভেবে বলো।
— আমি সেদিন তোর সামনে ইশিতা কে বলেছিলাম এই বাচ্চার জন্য হলেও ইশিতা কে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তাই তুই বাচ্চা টা কে ই পৃথিবীতে আসতে দিলি না।
— তুমি পাগল হয়ে গেছো।
— হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। তুই প্রথমেই ইশিতা আর এই বাচ্চা টা কে আমার থেকে আলাদা করে দিছিলি। এখন আমি আবার ওদের নিজের কাছে আনতে চাইছি এখন তুই বাচ্চা টা কেই মেরে ফেললি। তুই ভাবছিস এই বাচ্চা না থাকলে ইশিতা আর আমার কাছে ফিরে আসবে না।
তোর প্লেন আমি খুব ভালো করে বুঝে গেছি।
রিহা ইফানের কথা গুলো শুনে কিছুই বলতে পারছে না। ইফান ওর সম্পর্কে এমন ধারণা রাখে।
— ইফান আমি অনেক অন্যায় করেছি এটা আমি মানছি। তবে আমি এতটা খারাপ না। একটা নিষ্পাপ শিশু পৃথিবীতে আসার আগেই আমি তাকে মারতে পারবো না। এতো টা ও নিচু মনে করো না আমাকে। আমি ও মানুষ আমার ও মন আছে আত্মা আছে।
— চুপ একদম বড় বড় কথা বলবি না। আমি তোকে খুব ভালো করে চিনি। তুই নিজের জন্য সব করতে পারিস।নিজের খুশি, নিজের সুখের জন্য তুই সব কিছু করতে পারিছ।
মনে নেই আমাকে পাওয়ার জন্য তুই কি কি করেছিস?
আমি যাতে তোকে বিয়ে করার জন্য রাজি হই তার জন্য তুই নিজের হাত অবধি কেটে নিছিলি।
যে নিজের হ্মতি করে কাউকে কাছে পেতে চায়। নিজের জেদ পূরণ করার জন্য নিজের হ্মতি করতে পারে। সে খুব সহজেই অন্যের ও হ্মতি করতে পারে।
— তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না। ঠিক আছে তুমি নিজেই ইশিতা কে জিঙ্গেস করো। আমার মুখের কথায় বিশ্বাস না হলে ইশিতার কথায় তো বিশ্বাস হবে।
— ইশিতা কে জিঙ্গেস করবো!
ইফান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে
— আরে ইশিতা নিজে এতটা বোকা কে তার আপন, কে তার ভালো চায়,কে তার হ্মতি করতে চায় ও তো এটাই বুঝতে পারে না। সবার মুখের কথায় বিশ্বাস করে মুহূর্তের মধ্যেই আপন করে নেয়। আর এরজন্য শেষে কষ্ট ও পেতে হয়।তুই ইশিতার বিশ্বাস অর্জন করে তার সাথে এমন জঘন্য কাজ করলি। শেষে ইশিতার বাচ্চা টা কেই মেরে দিলি৷ তুই কি সত্যি ই মানুষ?
— আমি জানি এখন তুমি কোন ভাবেই আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তাই তোমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলে আমি সময় ব্যয় করবো না। আমাকে ইশিতার কাছে যেতে হবে।

ইয়াশ এক মাসের কাজ দুই সপ্তাহে করে শেষ করেছে। ইশিতার জন্য মন ভিষণ টানছে। এই দুই দিন ধরে কাজের চাপে ইশিতার সাথে ভালো করে কথাও হয়নি। বাবু টা না জানি কেমন আছে?
ইশিতা কে অনেক বিরক্ত করছে না তো?
ইয়াশ এখানে সব কাজ শেষ করে ফেলেছে। কাল ই সে দেশে ফিরে যাবে। নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আগে মাসের পর মাস সবাই কে ছেড়ে থাকতে পারলেও এখন পারছে না। ইশিতা কে একা রেখে আসছে মনের মাঝে অজানা এক ভয় কাজ করছে।

ইশিতা একটু সুস্থ হয়েছে। তবে মনের দিক দিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে। কারো সাথে কথা বলে না। ঠিক মত খায় না। শুধু এক নজরে তাকিয়ে কি যেন দেখে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু চিন্তা করে। কিন্তু কেউ কিছু জিঙ্গেস করলে তা বলে না। রিহা অনেক ভাবে ইশিতা কে এসব ভুলে থাকার জন্য সাহায্য করেছে,চেষ্টা করেছে ইশিতা যেন তার বাচ্চার কথা মনে না করে, কষ্ট না পায়। তবে রিহার হাজার চেষ্টা ব্যর্থ।

ইশিতা কে আজ বিকেলে রিলিজ করে দিবে। এখন হসপিটালে থাকার চেয়ে বাসায় নিয়ে গেলেই ভালো হবে। তাই নাজমা চৌধুরী ইশিতা কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় নিয়ে যেতে চায়।বিকেলে ইশিতা কে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। রিহা ইশিতা কে ধরে নিজের রুমে দিয়ে আসে। ইশিতা কে বেডে বসিয়ে
— ইশিতা তুমি থাকো আমি আসছি।
ইশিতা ক্লান্ত মুখে রিহার দিকে তাকিয়ে
— দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে যেও।
রিহা কিছু বললো না। যাবার সময় দরজা টা ভাঁজ করে দিয়ে গেল।
ইশিতা পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। সব কিছু আগের মতই আছে।
বেড সাইড টেবিলের উপর দেখে ইয়াশের ছবি টা হাতে নিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখা হঠাৎ করে ছবিটা বুকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। ইশিতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে কিন্তু এই কান্নার কোন শব্দ হচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে ইশিতা বলতে লাগলো
— আমাকে তুমি হ্মমা করে দিও। আমি আমাদের বাচ্চার খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার বেখেয়ালির জন্য ও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তুমি কত স্বপ্ন দেখেছিলে ওকে নিয়ে আমি তোমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিলাম।

পরের দিন ইয়াশ এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে লন্ডনের ফ্লাইট বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে। ইয়াশ যে আজ দেশে আসবে তা কেউ জানে না। ইয়াশ ইচ্ছে করেই জানায় নি। তাই কেউ ইয়াশ কে নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠায় নি। ইয়াশ লাগেজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোন ট্যাক্সি ও পাচ্ছে না। ড্রাইভার কে আসতে বলবে নাকি তাই ভাবছে ইয়াশ। এখন ড্রাইভার কে আসতে বললে সে বাসায় জানিয়ে আসবে। আর সবাই জেনে যাবে ইয়াশ আজ বাসায় ফিরছে। ইশিতা জেনে গেলে তাকে আর সারপ্রাইজ দেওয়া হবে না।
ইয়াশ তার বেবীর জন্য অনেক কিছু এনেছে। খেলনা ড্রেস ছোট বাচ্চাদের যা যা লাগে।
এখন শুধু ইয়াশ অপেক্ষা করছে কখন সে তার বাচ্চা আর ইশিতার কাছে যাবে। এই কয়েক দিন ইয়াশের কাছে কয়েক বছর বলে মনে হয়েছে

ইয়াশ যেই রুম টা বাচ্চার জন্য সাজিয়েছিল ইশিতা এখন প্রায় সময় ই সেই রুমে গিয়ে দরজা লক করে বসে থাকে। ড্রেস গুলো, খেলনা গুলো ছুঁয়ে দেখে। কখনও কখনও সব কিছু বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি ফেলে।

কলিং বেল বাজছে। নাজমা চৌধুরী গিয়ে মেইন ডোর খুলে দেয়। ইয়াশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে দেখার সাথে সাথে নাজমা চৌধুরীর কাছে গিয়ে
— মা তুমি কেমন আছো?
কত দিন হলো তোমাকে দেখি না। মা বলে ডাকি না। এইবার দেশের বাইরের সব কাজ গুছিয়ে এসেছি। তোমাদের ছেড়ে আর এক দিনের জন্য ও কোথাও যাবো না।
হঠাৎ ইয়াশ কে দেখে নাজমা চৌধুরী কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। ইয়াশ এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছে।
নাজমা চৌধুরী কিছু বলছে না দেখে ইয়াশ আবার বলতে লাগলো।
— কি হলো মা। আমাকে দেখে তুমি খুশি হও নি?
নাজমা চৌধুরী নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে
— তুই এতো জলদি ফিরে আসলি। তুই তো এর মাসের জন্য বাইরে গিয়েছিলি।
— সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তাই আর ওখানে না থেকে ফিরে এসেছি।
আচ্ছা মা ইশিতা কোথায়?
ইশিতার কথা জিঙ্গেস করার সাথে সাথে নাজমা চৌধুরীর বুধ কেঁপে উঠলো। ইয়াশ ইশিতা কে এভাবে দেখলে নিজেকে সামলাতে পারবে তো।
— ইশিতা কি রুমে আছে?
— হুম।
— আচ্ছা তাহলে আমি ইশিতার কাছে যাই। তুমি ড্রাইভার কে লাগেজ গুলো ভেতরে দিয়ে যেতে বলো।
ইয়াশ ছুটে উপরে চলে আসলো। রুমে এসে ইশিতা কে পেল না। এই সময় ইশিতা কোথায় থাকতে পারে তা ভেবেই বেবীর রুমে চলে গেল।
দরজা ভেতর থেকে লক করায় ইয়াশ দরজায় নক করলো। ইশিতা দরজায় শব্দ শুনে খেলনা গুলো রেখে চোখ মুছে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
ইশিতা দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে ইয়াশ ইশিতা কে জড়িয়ে ধরে নেয়।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here