“সেই তুমি💐 পর্ব -৩৯+৪০

সেই তুমি💐
পর্ব -৩৯+৪০
Samira Afrin Samia
#Nipa

— এ কয়দিনে অনেক মিস করেছি তোমাকে। আর আমার পুচকো টা কে ও অনেক মিস করেছি। অনেক মনে পড়েছে তোমাদের কথা। আর তাই তো দুই সপ্তাহে সব কাজ শেষ করে একেবারে চলে এসেছি। তোমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাবো না।
ইশিতা হঠাৎ করে ইয়াশ কে দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ইয়াশ ইশিতা কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা দাঁড় করিয়ে ইশিতার মুখের দিকে তাকায়।
এ কয়দিনে ইশিতার মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। খাওয়ার দাওয়া ও নিজের প্রতি যত্ন না নেওয়ায় ইশিতা কে অনেক দূর্বল দেখাচ্ছে। আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে ইশিতা।
ইয়াশ ইশিতার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে
— এ কি হাল হয়েছে তোমার?
কি করে নিজের এই অবস্থা করেছো?
ইশিতা কিছু বলতে পারছে না। ইয়াশ এখনও ইশিতা কে দেখে সব কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
ইয়াশের চোখ ইশিতার পেটের উপর পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ইয়াশের মুখ কালো হয়ে যায়। ইয়াশ কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ইশিতার দিকে তাকায়।
ইশিতা সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইয়াশের বুকে মুখ লুকায়। ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো
— সব কিছু শেষ হয়ে গেছে ইয়াশ। আমাদের বাচ্চা আর নেই।
এই কথা শুনে ইয়াশ মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। মনে হচ্ছে ইয়াশের পৃথিবী এই কথা শুনার পর থেমে গেছে। ইয়াশ কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। কি থেকে কি হয়ে গেল। ইশিতা এখনও কেঁদে কেঁদে বলে যাচ্ছে।
— আমার জন্য সব কিছু হয়েছে। আমি ওর খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার ভুলের জন্য ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ইশিতার হেঁচকি উঠে গেল। আর কথা বলতে পারছে না ইশিতা। ইয়াশ কিছুক্ষণ পাথরের মত দাঁড়িয়ে থেকে ইশিতা কে সোজা করে দাঁড় করায়। ইয়াশ ইশিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে ইশিতা কে শান্ত করানোর চেষ্টা করছে।
— কেঁদো না শান্ত হও।
ইশিতার হেঁচকি উঠায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ইয়াশ ইশিতা কে বেডে বসিয়ে দিয়ে ইশিতার হাত ধরে খুব শান্ত কন্ঠে
— কি করে এসব হলো?
ইশিতা এখনও ও কেঁদেই যাচ্ছে। কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না।
— কাঁদতে বারণ করলাম তো।
এসব কিভাবে হয়েছে?
— আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় পা পিছলে গেল। আর এসব হয়ে গেল।
আমি একদম বুঝতে পারিনি। আমার ছোট একটা ভুলের জন্য এমন কিছু হয়ে যাবে।
ইশিতা আবার ও ইয়াশের বুকে মুখে গুজে কাঁদতে লাগলো। ইয়াশ ইশিতার মাথায় হাত রাখলো। ইশিতা কেঁদে কেঁদে এতদিনের লুকিয়ে রাখা কষ্ট গুলো হালকা করছে। ইশিতার চোখের পানিতে ইয়াশের শার্ট ভিজে যেতে লাগলো।
ইয়াশ কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। কি করে ইশিতা কে বুঝাবে, ওকে শান্তনা দিবে। ইয়াশের নিজের ও অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবে ইয়াশ তা প্রকাশ করতে পারছে না। বেশির ভাগ সময় ছেলেরা তাদের কষ্ট কাউকে দেখায় না। তারা চাইলে ও কাঁদতে পারে না। কারো সাথে নিজের কষ্ট গুলো শেয়ার করতে পারে না।
ইয়াশের চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ দু’টো বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে। ইশিতার এ অবস্থা দেখে ইয়াশ না পারছে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারছে এসব সহ্য করতে। এখন ইয়াশ ভেঙে পড়লে ইশিতার কি হবে?
ইশিতাকে কে দেখবে? ইয়াশ কে কষ্ট পেতে দেখে যে ইশিতা আরও বেশি কষ্ট পাবে। তখন তো কোন ভাবেই ইশিতা কে সামলানো যাবে না। ইয়াশের হাজার কষ্ট হলেও তা ইশিতা কে বুঝতে দেওয়া যাবে না। খুব কষ্টে নিজের সাথে যুদ্ধ করে ইয়াশ চোখের পানি আটকে রাখে।
তাছাড়া ছেলেদের চোখে এতো সহজে পানি আসে না। তারা মেয়েদের মত কথায় কথায় কাঁদতে পারে না। মনে মনে সব কষ্ট সহ্য করে নেয়।
ইয়াশ দুই হাতে ইশিতার মুখ সোজা করে
— দেখি কাঁদতে কাঁদতে নিজের কি অবস্থা করেছো।
শান্ত হও আর কাঁদে না। যা হবার তা হয়ে গেছে। যা হয়েছে তাতে আমাদের কোন হাত নেই। আমরা চাইলে ও সব কিছু আমাদের মত করে হবে না। উপরওয়ালা যা ঠিক করে রেখেছেন তাই হবে। আর তা আমাদের হাসি মুখে মেনে নিতে হবে।
— তুমি বলতে না তোমার একটা ছেলে বাবু চাই।
— হুম।
— ও ছেলে বাবু ই ছিল। কত ছোট ছোট হাত পা ছিল ওর। একদম তুলতুলে শরীর। একটু ছুঁলেই অন্য রকম এক সুখের অনুভূতি হয়েছিল। তুমি তো ওকে দেখো নি। আমি দেখেছি। খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখেছি।
ইশিতার এই কথা গুলো শুনে ইয়াশের বুক ফেটে যাচ্ছিল। ইয়াশের ও চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ইশিতা আর কিছু বলতে গেলে ইয়াশ ইশিতা কে চুপ করিয়ে দিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
ইশিতা ইয়াশের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতেই সেন্সলেস হয়ে গেল।
ইয়াশ বুঝতে পেরে ইশিতা কে পাচঁকোলে করে নিজের রুমে নিয়ে আসে।
ইশিতা কে দেখে ইয়াশের বুক খাঁ খাঁ করে উঠলো। এতো কিছু ইশিতা একা সহ্য করেছে। ইশিতার সবচেয়ে কষ্টের সময় ইয়াশ তার পাশে থাকতে পারেনি। যে সময় টা তে ইয়াশ কে ইশিতার সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল সে সময় ই ইয়াশ কে কাছে পায় নি। কেমন পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে ইশিতার দিন পাড় হয়েছে তা ইশিতা কে দেখেই খুব ভালো করে বুঝা যাচ্ছে।
ইয়াশ চোখ মুছে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

ইয়াশ খোলা নিরিবিলি একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে দাঁড়ায়।
রাতের অন্ধকারে কিছু তেমন ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না। আকাশের বুকে চাঁদ নেই। মেঘ গুলো চাঁদ কে আড়াল করে রেখেছে। ইয়াশ দুই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো। চোখ দিয়ে নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়ছে। কোন বাঁধ মানছে না। ইয়াশ দু’হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ এভাবে বসেই কান্না করলো।
হঠাৎ করে ইয়াশ উঠে দাঁড়িয়ে গেল। চোখ মুছে নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলো। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করে চলে আসতে লাগলো।ইশিতা ইয়াশের লাগেজ খুলে বাচ্চার জন্য আনা ড্রেস আর খেলনা গুলো দেখে আবার কান্না করতে লাগলো। পাগলের মত সব কিছু বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে। ড্রেস গুলোতে বার বার করে চুমু খেয়ে আবার শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি ফেলছে।
ইয়াশ বাসায় চলে আসে রুমে এসে ইশিতা কে এগুলো নিয়ে কাঁদতে দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না। ইয়াশ ইশিতার থেকে ওগুলো নিয়ে সোজা বাবুর জন্য যে রুম সাজিয়েছিল ওটাই চলে যায়। সব কিছু ওই রুমে রেখে ইয়াশ বাইরে থেকে রুমে তালা লাগিয়ে দেয়। যাতে ইশিতা এই রুমে না আসতে পারে। বাচ্চার খেলনা জামা কাপড় গুলো চোখের সামনে থাকলে ইশিতা কখনোই এসব ভুলতে পারবে না। বাচ্চা টা কে হারিয়ে এখন ইয়াশ ইশিতা কে হারাতে পারবে না। ইশিতা যা শুরু করেছে এতে বেশি দিন সময় লাগবে না ওর কিছু একটা হয়ে যেতে।
— কি করছো ইয়াশ?
— যা করছি তা দেখতেই পারছো। আজকের পর কেউ এই রুম খুলবে না। আর তুমিও এই রুমে আসার চেষ্টা করবে না। দুঃখের সময় টা কে আকড়ে রেখে আরও কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয় না। যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের নিজেকে শক্ত করতে হবে।
— কি করে নিজেকে শক্ত করবো?
আমি ওকে ভুলতে পারছি না। বার বার ওর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে।
— যে চলে গেছে তুমি তাকে ভুলতে পারবে না।
আমাকে ভুলতে পারবে তো?
তোমার এ অবস্থা আমি নিজের চোখে দেখতে পারবো না। তুমি এমন পাগলামি করলে আমিও তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। চোখের সামনে তোমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখবার মত শক্তি আমার নেই।
ইয়াশ চলে যেতে নিলে ইশিতা পেছন থেকে ইয়াশ কে আকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে।
— কোথায় যাচ্ছো তুমি?
তুমি ও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি বাঁচতে পারবো না। বাঁচার মত শক্তি আমার থাকবে না। তোমাকে ছাড়া আমি মরেই যাবো।
— তাহলে আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও তুমি আর বাচ্চার কথা মনে করে কাঁদবে না। আর একদম কষ্ট পাবে না।
আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারি না।
ইশিতা কিছু না বলে ইয়াশের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে। ইশিতা কে স্বাভাবিক করে তুলার জন্য এসব করা খুব জরুরি ছিল। ইয়াশ ইশিতা কে কষ্ট পেতে দিবে না। এই বাচ্চা টা কে ইয়াশ ও অনেক ভালোবাসতো।

সাত মাস পর

ইশিতা এখন প্রায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন আবার আগের মত সবার সাথে কথা বলে, হাসিখুশি থাকে। সব কিছু ভুলতে একটু সময় লেগেছে, কষ্ট ও হয়েছে। তবে শেষমেশ সব কিছু ভুলতে পেরেছে। ভুলতে পেরেছে বললে ভুল হবে। কোন মা ই তার সন্তান কে ভুলতে পারে না। তাও আবার প্রথম সন্তান। ইশিতা ও তার বেবী কে ভুলতে পারেনি। হয়ত কোন দিন পারবে ও না। তবে সত্যি টা মেনে নিতে শিখে গেছে। এখন আর বেবী টার কথা মনে করে চোখের পানি ফেলে না। শুধু চোখ বুজে তাকে অনুভব করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ইয়াশ আগের থেকে ইশিতার অনেক বেশি কেয়ার করে। ইয়াশ পাশে না থাকলে হয়ত ইশিতা কখনও স্বাভাবিক হতে পারতো না। এতদিনে হয়ত কষ্ট পেয়ে পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিতো।
ইয়াশ সব সময় ইশিতা কে চোখেচোখে রাখে। একবার ইশিতার থেকে দূরে গিয়ে বাচ্চা টা কে হারিয়েছে। তাই এখন আর ইয়াশ ইশিতার থেকে এক মুহূর্তের জন্যে ও দূরে যেতে চায় না। ইশিতা পাগলের মত ইয়াশ কে ভালোবাসে। ইয়াশ কে হারানোর কথা কল্পনা ও করতে পারে না। বলতে গেলে এখন দুজন দু’জনার নিশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।মানুষের যেমন নিশ্বাস না নিতে পারলে বেঁচে থাকা সম্ভব না,তেমনি ইয়াশ ইশিতা দু’জন কাছাকাছি না থাকলে তাদের বেঁচে থাকা সম্ভব না। এখন তো ইশিতার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ বুঝি তার কাছে এসে ধরা দিয়েছে।

এই সাত মাসে ইয়াশ আর ইশিতার মাঝে সব কিছু ঠিকঠাক চললে ও রিহা আর ইফানের মাঝে কিছুই ঠিক নেই।
ইফান নানা ভাবে রিহা কে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু চেষ্টা করেই থেমে থাকে নি। অনেক কষ্ট ও দিয়েছে। সব কিছুতেই রিহার দোষ ধরে কত ভাবেই না রিহা কে শাস্তি দিয়েছে। অন্যায় না থাকা স্বত্বেও রিহার উপর অনেক অত্যাচার করেছে ইফান।
রিহা কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য হাজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। রিহা কোন ভাবেই ইফান কে ছেড়ে এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবে না। এ কয় দিন তো ইফান রিহা কে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইফানের এক কথা সে রিহার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকবে না। যে ভাবেই হোক রিহা কে ডিভোর্স দিয়ে ছাড়বে।
এই নিয়ে ইফান রিহার বাবার সাথে ও কথা বলেছে। রিহার বাবা রিহা কে হাজার বুঝিয়ে ও পারেনি। রিহা মরে যাবে পরেও ইফান কে ছেড়ে যাবে না।

ইয়াশ স্টাডি রুমে বসে কিছু ফাইল দেখছে। ইশিতা ভেতরে এসে ইয়াশের পাশে দাঁড়িয়ে
— এই যে মি.হাজবেন্ড সারা দিন,রাত কি স্টাডি রুমেই থাকবে নিজের রুমে যাবে না?
ইয়াশ ফাইল টা রেখে উঠে গিয়ে ইশিতার কোমর পেঁচিয়ে ধরে ইশিতা কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে
— কোথায় থাকো তুমি সারা দিন?
আমার জন্য একটু ও সময় নেই তোমার?
— কে বললো সময় নেই?
কয় বার এসে দরজার সামনে থেকে তোমাকে দেখে গেছি তা কি তুমি খেয়াল করেছো?
নিজের কাজের মধ্যে এমন ভাবে ডুবে থাকো দুনিয়ার আর কোন খেয়াল থাকে না।
— ভেতরে আসলে না কেন?
— তুমি কাজ করছিলে।
— আমার কাজ কি তোমার থেকেও বেশি ইমপোরটেন্ট নাকি?
— কি জানি?
— কি জানি মানে?
তোমার কি মনে হয়?
ইশিতা ইয়াশের বুকে মাথা রেখে
— আমার মনে হয় আমার থেকে বেশি কোন কিছুই তোমার কাছে ইমপোরটেন্ট না।
ইয়াশ ইশিতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ইয়াশ এখন তেমন কোন দরকার ছাড়া অফিসে যায় না। বাসায় ই থাকে প্রায় সময়।
ইশিতা মাথা সোজা করে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে
— আচ্ছা তুমি এখন অফিসে যাও না কেন?
— যাই তো মাঝে মাঝে।
— মাঝে মাঝে গেলে তোমার কাজের হ্মতি হয়না। আগে তো রোজ যেতে।
ইয়াশ ইশিতার কপালে চুমু দিয়ে
— অফিসের কাজ গুলো যদি বাড়িতে বসেই হয়ে যায়। তাহলে শুধু শুধু অফিসে যাওয়ার দরকার কি?
কোন দরকারি মিটিং হলে যেতে হয় এছাড়া আর অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ইশিতা জানে ইয়াশ এখন কেন রোজ অফিসে যায় না। তাই আর বেশি কিছু জিঙ্গেস করলো না।
— চলো মা তোমাকে ডাকছে?
— কেন?
— তা জানি না। আমাকে কিছু বলে নি। শুধু বললো ইয়াশ কে আমার রুমে আসতে বল। তাই তোমাকে ডাকতে আসলাম।
— আচ্ছা তাহলে চলো দেখি মা কেন ডাকছে।

চলবে……..

সেই তুমি💐
পর্ব -৪০
Samira Afrin Samia
#Nipa

ইয়াশ আর ইশিতা নাজমা চৌধুরীর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে
— মা আসবো?
— কত বার বলবো আমার রুমে আসার জন্য তোদের অনুমতি নিতে হবে না।
ইয়াশ ইশিতা ভেতরে এসে। ইয়াশ বললো
— কেন ডাকছিলে মা।
নাজমা চৌধুরী চশমা টা পড়ে টেবিলের উপর থেকে একটা কার্ড নিয়ে ইয়াশের হাতে দিলো।
— দেখ তো এটা কেমন হয়েছে?
— কি এটা? কিসের কার্ড?
— খুলেই দেখ না।
ইয়াশ কার্ড খুলে দেখে এটা ইয়াশ আর ইশিতার বিয়ের কার্ড।
— এসব কি মা?
— আমি ভাবছিলাম তোদের আবার নতুন করে বিয়ে দিব। এই ইচ্ছা টা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু মাঝের সময় টা তে যা হয়ে গেল।
নাজমা চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
— আমি তোদের বিয়ে আবার দিতে চাই। সব আয়োজন শেষ করে ফেলেছি। অনেক দিন ধরেই প্লেন করছিলাম। তোদের কিছু জানানো হয়নি।
ইয়াশ কি বলবে কিছু ভেবে না পেয়ে চুপ করে আছে। ইশিতা ও মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নাজমা চৌধুরী ওদের দু’জন কে চুপ করে থাকতে দেখে
— কি হলো তোরা এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কিছু তো বলবি।
ইয়াশ মাথা নেড়ে
— তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো মা।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের কথা শুনে একটু হাসলো।
— আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বল কার্ড টা কেমন হয়েছে?
ইয়াশ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে থামিয়ে দিয়ে
— থাক তোর বলতে হবে না। ইশিতা তুই বল তোর কাছে কেমন লেগেছে। পছন্দ হয়েছে তো?
— তুমি কার্ড টা পছন্দ করেছো, আমার পছন্দ না হয়ে পারে নাকি।
— আচ্ছা তাহলে তোরা এখন যা। বিয়ের অনেক কাজ বাকি আছে। কাল থেকে সব কাজ শুরু হয়ে যাবে।
আর ইশিতা
না থাক তোর কিছু করতে হবে না। আমি নিজে গিয়ে তোর মামা মামী কে কার্ড দিয়ে আসবো।
ইয়াশ আর ইশিতা নিজের রুমে চলে গেল।
রুমে ঢুকার সাথে সাথে ইয়াশ হেঁচকা টান দিয়ে ইশিতা কে নিজের কাছে নিয়ে যায়। ইশিতা ইয়াশের বুকের উপর গিয়ে পড়ে।
— কি হচ্ছে মিস্টার?
— কই কি হচ্ছে কিছু না তো।
— তাহলে এভাবে আচমকা টান দিয়ে কেন? যদি পড়ে যেতাম।
— আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিলে তো পড়তে।
ইশিতার যেন কেনই আজ ইয়াশের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা লাগছে।
— কি ম্যাডাম এভাবে চোখ লুকাচ্ছ কেন?
আমার দিকে তাকাও।
ইশিতা ইয়াশের বুকে আরও শক্ত করে জাপটে ধরলো। ইয়াশ বুঝতে পারছে ইশিতা লজ্জা পাচ্ছে।
— আচ্ছা আমার মায়াবতীর জন্য কোন কালারের বেনারসি নিলে ভালো হবে?
কোন রঙে আমার মায়াবতী কে আরও সুন্দর লাগবে?
— জানি না।
— তুমি না জানলে কিভাবে হবে?
আমি চাই বিয়ের দিন সবাই যেন আমার মায়াবতী কে ই চেয়ে দেখে। আমাকে না দেখলে ও হবে।
আমি নিজের হাতে তোমাকে বউ সাজাবো।
ইয়াশ আর কিছু বলার আগেই ইশিতা বলে উঠলো।
— এতো সুখ আমার কপালে লিখা ছিল বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আমার কপালে এতো সুখ সইবে তো?
ইয়াশ নিজের দুই হাতে ইশিতার গাল ধরে কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে
— কেন সইবে না?
এখনও তো অনেক সুখ তোমার পাওয়ার বাকি আছে। আমি পৃথিবীর সব সুখ এনে তোমার হাতে তুলে দিব।
— তুমি শুধু সারা জীবন আমার পাশে থেকো এর থেকে বেশি আমি আর কিছু চাই না।

পরের দিন বিকেলে ইশিতা রিহার রুমে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিহা কে ডাকতে যাবে। তখনই ভেতরে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো রিহা বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। কান্নার তেমন শব্দ হচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে হেঁচকির শব্দ শুনা যাচ্ছে।
ইশিতা আর ভেতরে গেল না। বাহিরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলো। রিহা ওর পাপের জন্য যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে। তার পর ও ইফান রিহা কে মেনে নিচ্ছে না। উল্টে রিহা কে আরও কষ্ট দিচ্ছে। মেয়েটা সত্যি ই ওর ভুল বুঝতে পেরে ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।ইফান এখন বিজন্যেস সামলাতে শুরু করেছে। কাজ গুলোর সাথে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছে ইফান। দিনের বেশির ভাগ সময় অফিসে থাকে। অনেক রাত করে বাসায় ফিরে যাতে রিহার সামনে না পড়তে হয়।
আজও অনেক রাত করেছে অফিসে। ইচ্ছে করেই ইফান এতো রাত পর্যন্ত অফিসে থেকে কাজ করে।
অফিস থেকে বের হলো রাত এগারোটার দিকে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটার বেঁজে গেছে।
ইফান রুমে এসে কোর্ড টা খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে রিহা দাঁড়িয়ে আছে। ইফান রিহা কে দেখেও না দেখার ভান করে রিহার সামনে দিয়ে চলে আসলো।
— এতো রাত করে বাসায় ফিরলে কেন?
ইফান কিছু বললো না।
— তুমি প্রায় ই রাত করে বাসায় ফিরো।একদিন ও রাতের খাবার খাও না। আচ্ছা ইফান তুমি কেন এমন করো?
— আমি এখন তোর সাথে কথা বলার মোডে নেই। একা একটু একা ছাড়বি প্লিজ।
— কেন একা ছাড়বো তোমাকে?
তুমি কেন সব সময় আমাকে ইগনোর করে চলো। আমি তোমার স্ত্রী। তোমার উপর আমার যথেষ্ট অধিকার আছে।
— তুই আমার উপর অধিকার দেখাতে আসছিস?
— তুমি আমাকে বলো আমার কি ভুল হয়েছে যার জন্য তুমি আমার সাথে এমন করছো?
— তোর কয়টা ভুল ধরিয়ে দিব?
মনে নেই তুই কি কি ভুল করেছিস?
— আমি আমার ভুল গুলো শোধরে নিতে চাইছি তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো তাহলে আমি আমার সব ভুল শোধরে নিব।
— সারা দিন অফিসে অনেক কাজ করেছি। ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দে।
— আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আগে খেয়ে আসো তার পর ঘুমাও।
— আমি খাবো না।
— খাবো না বললে হবে না। একদিন ও রাতে খাও না।
রিহা ইফানের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলে ইফান এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে।
— তোকে বারণ করেছি আমার উপর অধিকার দেখাতে।
আমি বলেছি খাবো না,তো খাবো না। এতো জোর করার কি আছে।
— কেন খাবে না তুমি?
কেন প্রতি দিন এতো রাত করে বাসায় ফিরো?
অফিসে তোমার এতো কিসের কাজ? বাসায় তোমার বউ আছে মা ভাই সবাই আছে তাদের সময় না দিয়ে পুরো সময় টা অফিসে কাটাও এভাবে মানুষের জীবন চলতে পারে না।
ইফান রিহার কথা শুনে রেগে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফুলদানি টা নিয়ে জোরে ছুঁড়ে মারলো। ফুলদানি টা ছিটকে এসে রিহার কপালে লাগে। কপাল অনেক টা কেটে যায়। রক্ত বের হতে লাগলো। ইফান ভাবতে পারেনি ফুলদানি টা রিহার কপালে এসে লাগবে।
রিহা কপালে হাত ধরে অভিমানী চোখে ইফানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহা ভেবেছিল ইফান তার কাছে আসবে দেখবে কপাল টা কতটুকু কেটেছে। তবে রিহার সব ধারণা ভুল প্রমান হলো। ইফান কিছু না বলে এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো।রিহা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইফান এতটা নিষ্ঠুর হলো কিভাবে। রিহার জন্য কি ইফানের একটু ও মায়া হয় না। রিহা কি ইফানের চোখে এতটাই খারাপ।

সকালে রিহা কিচেনে রান্না করছে। ইশিতা কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে
— আরে রিহা এতো সকালে কি রান্না করছো?
আজ তো দেখি তুমি আমাকেও পেছনে ফেলে দিলে।
রিহা কাজ করতে করতে নিচের দিকে তাকিয়ে
— ইফানের জন্য খাবার বানাচ্ছি। রাতে কিছু খায়নি। না খেয়েই শুয়ে গেছে। এখন অফিসে যাওয়ার আগে কিছু বানিয়ে দিচ্ছি। অফিসে কি যেন খাওয়ায় কে জানে?
— বাব্বাহ স্বামীর দেখছি অনেক সেবা যত্ন করছো। ভালো ভালো।
রিহা ইশিতার কথা শুনে একটু হাসলো। ইশিতা রিহার দিকে তাকাতে লক্ষ্য করলো রিহার কপালে ব্যান্ডেজ করা।
— তোমার কপালে কি হয়েছে রিহা?
রিহা ইশিতার কথা এড়ানোর চেষ্টা করে
— কই কি হয়েছে। কিছু হয়নি তো।
— কিছু হয়নি কি করে দেখি। এদিকে তাকাও।
ইশিতা জোর করে রিহা কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো।
— কি হয়েছে বলো?
— একটু কেটে গেছিল।
— কিভাবে কাটলো?
— দরজার সাথে লেগে।
— আমার কাছেও মিথ্যা বলছো?
রিহা কিছু না বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।
— ইফান এখনও তোমার সাথে এরকম করে?
— ইফান একদিন ঠিক নিজের ভুল বুঝবে। আর আমাকে মেনে নিবে আমি সেই দিনের অপেক্ষা করে নাহয় ইফানের দেওয়া কষ্ট গুলো সহ্য করে নিলাম।
ইশিতা কি বলবে। বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রিহা যখন খারাপ ছিল তখন ইফান ঠিকই ওকে বিশ্বাস করতে। আজ রিহা ভালো হয়ে গেছে তার পরও ইফান এখন ওকে বিশ্বাস করতে চাইছে না।

নাজমা চৌধুরী ইয়াশ রিহা ইশিতা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ইফান সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিচ্ছিল। এমন সময় ইয়াশ পেছন থেকে ইফান কে ডেকে উঠে।
— ইফান।
ইফান ইয়াশের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে
— হ্যাঁ ভাই কিছু বলবি?
— এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস?
— অফিসে।
— ব্রেকফাস্ট করেছিস?
— না। অফিসে গিয়ে করে নিব।
ইফান চলে যেতে নিলে ইয়াশ আবার ডাকলো।
— এদিকে আয়। ব্রেকফাস্ট করে তার পর যেখানে ইচ্ছে যা।
— না ভাই আমি যাই লেট হয়ে যাচ্ছে।
— এদিকে আসতে বলছি?
কিসের এতো কাজ অফিসে, যে না খেয়ে তোকে প্রতি দিন অফিসে চলে যেতে হবে।
ইফান ইয়াশের সাথে কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে।
রিহা তাড়াতাড়ি করে ইফান কে খাবার দিলো। ইফান রিহা কে কিছু না বলে শুধু একবার রিহার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
— হুম তো এতো কি কাজ অফিসে?
— তুই তো জানিস ই ভাই অফিসে কি কি কাজ থাকে।
— জানি বলেই তো জিঙ্গেস করছি। আমি ও এতদিন অফিস সামলিয়েছি। এখনও বাসায় বসেই অফিসের সব কাজ করি। তোর মত তো এতো সকালে বের হয়ে শেষ রাতে কখনও বাসায় ফিরিনি।
দেখ ইফান এভাবে কখনও কারো জীবন চলতে পারে না।
ইফান খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। ইয়াশের কথার কোন উত্তর দিল না।
ইফান চলে গেলে ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে বলতে লাগলো
— আমাদের ইফান টা এমন কেন হয়ে গেল মা।
আগে জোর করেও অফিসে পাঠানো যেত না। আর এখন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে চায় না। কাজ থাকলেও আর না থাকলেও অফিসেই বসে থাকে। বাসায় ফিরে না। আমি খোঁজ নিয়েছি। ইফান নিজেকে অফিসের মধ্যে বন্দী করে নিয়েছে মা। ওকে কে বুঝাবে এভাবে জীবন চলে না।
নাজমা চৌধুরী আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।
— জানি না বাবা। আমার ইফান টা কবে আবার আগের মত হবে। সারাক্ষণ হেসে খেলে ছুটে বেড়ানো ছেলেটা হঠাৎ এমন ভাবে পাল্টে যাবে তা আমি কখনও ভাবিনি।
ইশিতা পাশে বসে সব কিছু শুনছে আর মনে মনে ভাবছে ও যদি ইফান কে বুঝায় তাহলে নিশ্চয়ই ইফান বুঝবে। ইফান এখন ইশিতার সাথে ও তেমন কথা বলে না। ইশিতা কে ফিরে পাবার জেদ টা ও কমে গেছে। এখন শুধু ইফানের একটাই চাওয়া ও যেকোন ভাবে রিহা কে ডিভোর্স দিবে।

বিকেলে রিহা রুমে ছিল।এমন সময় ফোন বেঁজে উঠলে রিহা ফোন রিসিভ করে কানে তুলে নেয়।
— কে রকিব?
— চিনতে পারছিস তাহলে?
— চিনবো না কেন?
বল এতদিন পর কি করে মনে পড়লো?
— তোর সাথে খুব জরুরি কিছু কথা আছে। তুই কি আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি?
— দেখা করতে হবে?
— হুম। খুব দরকারি কথা। যা তোকে বলতেই হবে।
— এখন তো আমি তেমন বাসা থেকে বের হই না। তবে দেখি। কবে কোথায় দেখা করতে হবে?
— পারলে কাল ই দেখা করিস। তোর সময় হলে আমাকে ফোন দিস আমি তোকে কোথায় আসতে হবে তা বলে দিব।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here