সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব ৬

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

১৬.
ভিসি স্যার আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ভিসি স্যার শক্ত গলায় বললেন, ‘তোমরা এখানে কি করছো?’

আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।

ভিসি স্যার আদ্রে’র উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আদ্র’ আমি তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করছি। ফাঁকা ক্লাসরুমে একা কি করছো এই অসময়ে?’

আদ্র বললেন, ‘আসলে স্যার আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছু নয়।’

—“আমি যা ভাবছি সেটার কথা বলিনি, তোমরা দুজন কি করছিলে সেটা তো আমি দেখেছি। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারবো না।”

—“তেমন কিছুই নয় স্যার।”

—“তাহলে কি আমি ভুল দেখেছি?”

—“না স্যার।”

ভিসি স্যার রেগে গেলেন। বললেন, ‘ডোন্ট টক টু মাচ আদ্র! তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি।’

আদ্র স্যারকে বুঝানোর চেষ্টায় রত যে আমাদের মধ্যে এমন কিছু হয়নি। কিন্তু ভিসি স্যার কিছুতেই কথা শুনছেন না। তিনি নিজের চোখে আমার সঙ্গে আদ্রকে দেখেছেন ফাঁকা ক্লাসে, আমার এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নিরবে চোখের পানি ফেলছি। আদ্রে’র দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালাম। ওনার জন্যই সব হচ্ছে, ওনার কারণে আমার লাইফটা হেল হয়ে গিয়েছে। মান-সম্মানটুকু পর্যন্ত ধুলোয় মিশিয়ে দিলো৷ ভার্সিটির দারোয়ান, আয়া-বুয়া, এমনকি অন্যান্য প্রফেসররা পর্যন্ত এই ঘটনার শামিল। কেউ কেউ বলছে যে আদ্র এমন কিছুই করতে পারেনা, কিন্তু ভিসি স্যারের কথার জোরে সে কথাটাও টিকলো না। আমাকে দুজন আয়া সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি ওদের বললাম, ‘আন্টি আমার সাথে ওনার কোনো সম্পর্ক নেই। ওনারা ভুল বুঝছেন!’

ওনারা শুনলে বা বিশ্বাস করলেও এসবে ওরা কিছু করতে পারবে না। যেখানে ভিসি স্যার উপস্থিত সেখানে কারো কিছু বলার নেই। সবার চিন্তিত মুখ। ভিসি স্যার খুব কড়া, কারো কথা শুনতে ওনি রাজি নন। একসময় ওনি বললেন, ‘আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি!’

আদ্র জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ডিসিশন স্যার?’

ভিসি স্যার ওনাকে বললেন, ‘তুমি মেয়েদের সম্মান করো?’

আদ্র বললো, ‘অবশ্যই স্যার।’

আমি এদিকে ওনার কথা শুনে মনে মনে রেগে গেলাম। অসভ্য, ইতর একটা লোকের জন্য সবার সামনে আমি অসম্মানিত হচ্ছি আর ওনি বলে মেয়েদের নাকি ওনি সম্মান করে। মিথ্যাবাদী লোক একটা। ভিসি স্যারের কথা শুনে আমি আবারও ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম।

ভিসি স্যার আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার নাম কি?’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আরশি স্যার!’

—“তোমার প্যারেন্টস’দের মোবাইল নাম্বার দাও!”

আমি থমকে গেলাম। কি বলবো এখন? আমার প্যারেন্টস বলতে তো কেউ নেই। আমি বললাম, ‘স্যার আমার প্যারেন্টস বলতে কেউ নেই।’

স্যার অবাক হয়ে বললেন, ‘মানে?’

—“মানে স্যার আমার অভিভাবক নেই। আমার মা নেই, বাবা আমাকে ফেলে অন্যত্র বিয়ে করে চলে গিয়েছেন। আমি জানিনা ওনি এখন কোথায়। আমি অনাথ আশ্রমে থেকে বড় হয়েছি…”

বলতে বলতে কেঁদে দিলাম। আমি চাইতাম না আমার এই সিক্রেট কেউ জানুক। কিন্তু আজ শুধুমাত্র পরিস্থিতির চাপে আদ্রে’র জন্য সবার সামনে আমাকে এই কঠিন সত্যটা বলতে হলো। আবারও মনে করিয়ে দিলো আমি এতিম, অনাথ।

১৭.
ক্লাসরুমে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলো। আদ্র আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হয়তো তার খারাপ লাগছে, নাহ ওনার কেন খারাপ লাগবে? ওনি তো আমার কষ্টগুলোতে আঘাত দিতে পারলে শান্তি পাবেন।

ভিসি স্যার একটু কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর আদ্রে’র উদ্দেশ্যে বললেন, ‘স্যারকে ফোন দাও।’

আদ্র অবাক হয়ে বললো, ‘কোন স্যার?’

—“তোমার বাবা। আই মিন টু সে আমাদের সাবেক ভিসি স্যার।”

আদ্র আবারও অবাক হলো। বললো, ‘বাবাকে কি দরকার স্যার?’

—“সেটা আমি ওনাকেই বলবো। বলো এখানে আসতে। আর কোনো প্রশ্ন নয়।”

আদ্র কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ভিসি স্যারকে যথেষ্ট সম্মান করে। তাও বাবাকে ডাকাতে আদ্র বেশ কনফিউজড! করতে চেয়েছিলো একটা হয়ে গেলো আরেক ঝামেলা। ভিসি স্যার কি আরশিকে ভার্সিটি থেকে বের করে দিবেন? কিন্তু আদ্রে’র ভুলের শাস্তি আরশিকে কেন দেবে? আদ্র’ সাবেক ভিসি স্যারের পুত্র আর আরশি অনাথ বলে? এদিকে আরশিও কেমন ব্যবহার করছে আদ্রে’র সাথে, কিন্তু কেন? আদ্র আর ভাবতে পারলো না। ফোন লাগালো বাবাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে আনিস সাহেবের গলা শোনা গেলো। আদ্র বললো, ‘আব্বু!’

আনিস সাহেব বললেন, ‘বলো। কি ঝামেলা ওখানে?’

—“তুমি জানো?”

—“হুম।”

—“কে বলেছে?”

—“দারোয়ান ফোন দিয়েছিলো। একটা মেয়ের সাথে নাকি তোমাকে ফাঁকা ক্লাসরুমে দেখা গিয়েছে?”

আদ্র অপরাধী গলায় বললো, ‘হুম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি, আমার ওর সাথে কিছু কথা ছিলো… ”

—“আমি বুঝতে পারছি।”

—“স্যার তোমাকে আসতে বলছে এখানে!”

—“আমি ওখানে গিয়ে কি করবো?”

—“আমি জানিনা আব্বু। ভিসি স্যার তোমার সাথে কথা বলতে চান, বিষয়টা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন ওনি!”

আনিস সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘আমি আসছি।’

আদ্র বিষন্ন গলায় বললো, ‘আচ্ছা।’

১৮.
ভিসি সাহেবের কথা শুনে আমি হতবাক। আদ্র’ ও
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ভিসি স্যার বলেছেন, ‘ওনি এই মুহূর্তে আমার আর আদ্রে’র বিবাহ দেবেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে।’ ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আদ্রে’র বাবা। ওনিও সহমত ভিসি স্যারের সাথে। আদ্র বললো, ‘কি বলছেন স্যার? বিয়ে মানে?’

—“মানে তোমাদের দুজনের বিয়ে দেবো আমরা।”

—“কিন্তু কেন স্যার?”

আদ্রে’র বাবা ধমকে ওঠে বললেন, ‘আমরা যা ডিসাইড করেছি তা-ই হবে। তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাবার কথার অমান্য করবেনা?’

—“কিন্তু বাবা….!”

—“আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাচ্ছিনা। ভিসি স্যার নিজের চোখে তোমাদের বিভ্রান্তিকর অবস্থায় দেখেছে, তুমি কি আমার মানসম্মান নষ্ট কর‍তে চাও?”

আদ্র রেগে গেলেও চুপ করে গেলো। বাবার কথা অমান্য করার বা বাবার মুখে তর্ক করার সাহস কোনোদিনও করেনা, যতই ক্ষমতাবান পলিটিক্যাল লিড্যার হোক না কেন। বাবার সম্মানের বিষয়ে সর্বদাই সচেতন। তাও দোষটা ওর নিজেরই, এই ভর সন্ধ্যায় একটা মেয়ের সাথে এভাবে দেখলে যে কেউওই বাজে মাইন্ডে নিবে। কিন্তু আমি? আমি এখন কি করবো? সবাই সবার মতামত জানিয়ে দিলো, কিন্তু আমি এখন কি করবো? বড় বড় স্যাররা আমার সামনে, ওদের বিরুদ্ধে আমি এখন কি বলবো? আমাকে কি তাহলে ওই আদ্রে’র সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে ওরা? এই মুহূর্তে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার যদি অভিভাবক থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতো। আমি কাঁদছি! সে কান্না কেউ দেখতে পেলো না। এই কান্না দেখার কেউ নেই সৃষ্টিকর্তা ছাড়া!

কাজি এলো। একটা কাগজে দুটো সাইন করে কাগজের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলাম আমি আদ্রে’র সাথে। যাকে এই মুহূর্তে আমি সহ্য করতে পারছিনা, খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। আদ্র আমার দিকে আড়চোখে তাকালো, আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম ঘৃণায়। ওর চোখদুটোর দিকে তাকালেই ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে। ভিসি স্যার কড়া জানতাম, কিন্তু এমন কড়া হতে পারেন সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।

আদ্র সবার আড়ালে আমার হাতে হাত রাখলো, আমি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম। লোকটার স্পর্শ আমার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছে, কিন্তু খুব যেন চেনা একটা স্পর্শ! মনে হচ্ছেনা কিছুতেই এই স্পর্শটা। মনে হচ্ছে মরে যাই এক্ষুনি। এ লোকটার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাই।

হলদে রঙের সেই শাড়িটা আমার পরণে, আদ্রে’র পরণেও সেই হলুদ পাঞ্জাবি। কাগজের বিয়ে আর ওনার সেই কীর্তির কথা মনে পড়তেই আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। সবকিছু অন্ধকার, আমার কথা শোনার কেউ নেই, মাথা হেলিয়ে পরে গেলাম আদ্রে’র কাঁধে।

👉”ভেঙ্গে পড়োনা, নিরাশ হয়োনা, সাহায্য আসবেই , এটা আল্লাহর ওয়াদা । জেনে রেখো, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।”

~ [ সূরা বাকারা , আয়াত- 214 ]

চলবে…..ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here