সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব ১১

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

২৯.
আমি কাঁদছি, প্রচুর কাঁদছি। তিনদিন হয়ে গেলো আদ্র বাসায় আসেনা। কোথায় আছে সেটাও বলছে না। মা’কে ফোন করে কথা বলে, আমি কথা বলতে চাইলেই ফোন কেটে দেয়। আমি বুঝতে পারছি না ওনি কি আমার উপর রাগ করেছেন, নাকি পালাচ্ছেন? আমাকে না দেখে এই তিনদিন ওনি থাকতে পারলেন? আমার খুব অভিমান আর রাগ হচ্ছে। ওনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, অভ্যাসটা বদ-অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে। আর আজ তিনদিন ওনি আমার থেকে দূরে আছেন, হুহ।
আমি মুখ গোমড়া করে বসে আছি। এমন সময় শ্বাশুড়ি মা আসলেন। বসলেন আমার পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন, ‘রাগ করেছো মা?’

আমি বললাম, ‘নাহ তো!’

বলে চোখের কোণা মুছে নিলাম। তাঁর ছেলের জন্য যে আমি ভেতরে ভেতরে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি, সেটা বোধহয় মা বুঝতে পারলো। বললো, ‘লুকিয়ে যাচ্ছো?’

—“কি লুকাবো…!”

—“আমি মা। আমি সব বুঝতে পারছি, আদু’র জন্য মন খারাপ হচ্ছে, তাই না?”

—“তেমনটা নয় মা…! ”

মা আমার হাতটা মুঠোয় নিলেন। একটু হেসে বললেন, ‘কি জানো তো, ছেলেটা একটু অভিমানী। একটু কিছুতেই বিরাট কান্ড করে বসে থাকে। তার উপর জেদ। নিজের জেদ বজায় রাখতে প্রিয় মানুষগুলোকেও মাঝে মাঝে কষ্ট দিয়ে ফেলে, নিজের অজান্তেই। ওর কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট ছিলোনা। ফারিন ওর এতো ভালো ফ্রেন্ড, কিন্তু কোনোদিনও ও ফারিনকে বন্ধু ছাড়া অন্য চোখে দেখেনি। সবসময় পড়াশোনা নিয়েই বিজি থাকতো, তারপর পলিটিক্সে জড়িয়ে গেলো। কতবার বলেছি বাবার সাথে ব্যবসাটা সামলাতে। কিন্তু নাহ, ওর জেদ। ব্যবসা করবে না, রাজনীতিই করবে। ওর আব্বু বললো, করুক। যা ইচ্ছে করে করুক। আমিও বাঁধা দিইনি। কতবার বললাম, আদু তোর যা ইচ্ছে হয় কর। কিন্তু আমার জন্য একটা মেয়ে নিয়ে আয়। আদু কি বললো জানো?’

আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। প্রশ্ন করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’

—“বললো ও নাকি চিরকুমার থাকবে, বিয়ে নাকি করবেনা। প্রেম করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই প্রেমও নাকি করবেনা।”

—“তারপর?”

—“ওর এই কথা শুনে ওর আব্বু আচ্ছা করে এক ধমক দিলো। বকাঝকা করলো, কিন্তু ছেলে বিয়ের জন্য কিছুতেই রাজি হলো না। তারপর ফারিনের সাথে হলো ওর বন্ধুত্ব, আমরা ভাবলাম এবার বোধহয় ছেলের মতি ফিরেছে। কিন্তু ফারিনের বিষয়ে যখন ওর সাথে কথা বলতে গেলাম, তখন ও বললো, ‘ফারিনের মতো মেয়েদের নিয়ে নাকি ফটোশুট করা যায়, ঘর সংসার নয়।”

—“তারপর।”

মা হাসলেন। বললেন, ‘এরপর আরও নানাভাবে ছেলেকে বোঝাতে লাগলাম, কিন্তু ও ওর সিদ্ধান্তে অটলই থাকলো। শত শত মেয়েদের সঙ্গে উঠাবসা করতো, কিন্তু একটা মেয়ের প্রেমে ও পড়েনি। আমি আর ওর আব্বু ভাবলাম ছেলে বোধহয় চিরকুমারই রয়ে যাবে। কিন্তু একদিন রাতে বাসায় ফিরেই ও কেমন অস্থির অস্থির বিহেভ করছিলো। কারণ জিজ্ঞেস করাতেই ও বললো, ‘ও একটা দুপুরের প্রেমে পড়েছে। আমরা মানে বুঝলাম না।”

এটুকু বলে মা থামলেন। পানি খেয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘ওর সাথে নাকি এক দুপুরে একটা মেয়ের দেখা হয়, প্রথম দেখায় ভালো লাগে মেয়েটিকে। কিন্তু দ্বিতীয় দেখায় কিছু ছিলো একটা, যাতে আমার ছেলে প্রেমেই পড়ে গেলো। সেদিন একথাটা শুনে আমি আর ওর আব্বু যা খুশি হয়েছিলাম বোঝাতেই পারবোনা। আর সেই মেয়েটা তুমিই ছিলে, ও তোমার একটা ছবি সোশ্যাল সাইট থেকে কালেক্ট করে আমাদের দেখিয়েছিলো। তারপর ভার্সিটির ঝামেলাতে আদ্রে’র আব্বু যখন তোমাকে দেখতে পায়, তখনই ভিসি স্যারের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তোমাকে পুত্রবধূ করে নিয়ে আসে। তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে নয় মা! তুমি আমাদের ব্যবহারে কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিও মা, আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিও না।’

৩০.
আমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কিসব শুনছি আমি। আমার মতো একটা মেয়েকে প্রথমবার দেখেই কেউ প্রেমে পড়তে পারে, আমি ভাবতেও পারিনা। কিন্তু ঘটেছে তো এটাই। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি ওনাকে কষ্ট দেবোনা।’

মা হেসে চলে গেলেন। বললাম তো কষ্ট দেবোনা, কিন্তু লোকটা তো আগেই কষ্ট পেয়েছেন। আমার কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়ি থেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। আমি শেফাকে ফোন লাগালাম। ম্যাস ছেড়ে দিয়েছি আমরা। কারণ আমিতো এখন এখানেই থাকি, আর শেফা একা একা থাকতে পারবেনা বলে বাসায় চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ রিং হবার পরে শেফা ফোন ধরলো। ও বোধহয় ঘুমাচ্ছিলো।

—“হ্যালো…!”

—“শেফা?”

—“হুম, আপনি কে?”

—“নাম্বার দেখস নাই, আমি আরশি!”

–“ওহহ, আরশি! কি বলবি বল। কিছু হয়েছে নাকি?”

—“হুম!”

—“কি?”

আমি বললাম, ‘আমার ঘরে রাতের বেলা যে চোরটা আসতো…!’

শেফা বললো, ‘কিছু চুরি কইরা নিয়া গেসে নাকি?’

—“আরে শোন!”

—“শোনার জন্যই তো বইসা আছি, কইয়া ফেল!”

—“যে চোরটা রাতে ঘরে আসতো সেটা তোর আদ্র ভাই ছিলো রে!”

শেফা অবাক হয়ে বললো, ‘সত্যি?’

—“হুম।”

—“তুই কিভাবে জানলি?”

—“আরে ওনি আমাকে যে ফোন থেকে কল করেছিলেন, সেই নাম্বার তো আমার কাছে ছিলো না। ওইদিন যখন ওনি ফোন বাসায় রেখে হাওয়া হয়ে গেলেন, তখন আমি ধরতে পেরেছি। আর তাছাড়া আজকে আম্মুও বলেছে আদ্র সাহেব যেদিন আমাকে প্রথম দেখেছিলো সেদিনই নাকি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা শেফা, তুই বল তো। প্রথম দেখায় আমার প্রেমে পড়ার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য কি আমার আছে?”

শেফা সব শুনে ৪৪০ ভোল্টের শক খেয়ে বসে আছে। বললো, ‘তোর মায়াবী একটা চেহারা আছে না? তোকে আমি যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই তো মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। লজ্জ্বায় বলতে পারিনি, কারণ আমি মেয়ে। নইলে আদ্র ভাইয়ের আগেই তোকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতাম, বুঝলি?’

আমি রেগে বললাম, ‘হারামখোর মাইয়া।’

—“এখন তো এসবই বলবি।”

—“তোর সাথে কথা নাই, লুচু মেয়ে।”

—“লুচু না, লিচু বল। কারণ আমি একটা মিষ্টি মেয়ে।”

—“ফোন রাখ ডাফার!”

–“জামাইয়ের সাথে প্রেম করো, হুহ!”

আমি রেগে ফোন কেটে দিলাম। শেফার কথা শুনে আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কই? আমার নিজের চেহারা তো আমার কাছে মায়াবী লাগছেনা। তাহলে বাইরের মানুষেরা আমার মায়াবী চেহারা দেখে কিভাবে?

৩১.
মায়ের সাথে ড্রইংরুমে বসে আছি। দুজন কথাবার্তা বলছি। একটু পর মা উঠে রুমে চলে গেলেন, ফোনটা টেবিলের উপর রেখেই। অনি যেতেই ফোনটা বেজে উঠলো। আমি হাতে নিলাম, দেখলাম আননোন নাম্বার। আমি রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে বললো, ‘আম্মু এত দেরি করে ফোন রিসিভ করো কেন? রাগ ওঠে আমার!’

আমার সারা শরীর দিয়ে কাঁপুনি বয়ে গেলো যেন। তিনদিন পর ওনার গলা শুনছি। আমি ওনার কথার পিঠে কোনো কথা না বলে দৌড়ে ফোনটা নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। দূরে গেলে নাকি ভালোবাসা গভীর হয়, আমিও একটু একটু টের পাচ্ছি। ওনাকে আচ্ছামতো সাইজ করার জন্যই আমার ছাদে আসা। তাই আমি গলা ঝেড়ে বলে ওঠলাম, ‘মিষ্টার আদ্র, আমি আপনার আম্মু নই। আর খবরদার ফোন কাটবেন না।’

ওপাশ থেকে ওনি বললো, ‘একশো বার কাটবো। কেটে দিচ্ছিও, তুমি কি করবা করে নাও।’

আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। আচমকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, ‘আপনি যদি ফোন কেটে দেন এবং বাসায় না ফিরেন তাহলে আমি এক্ষুনি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুসাইড করবো!’

ওপাশ থেকে ওনি জোরে বললেন, ‘কিহহহ?’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘বিশ্বাস করলেন না? তাহলে প্রুফ দিচ্ছি। ওয়েট করুন আমার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার জন্য। বাই!’

আমি রেলিংয়ের উপর দাঁড়ালাম। সাথে ফোনটাও কেটে দিলাম। চারতলার ছাদ, এখান থেকে নিচে পড়ে গেলে আমি আর আমি থাকবোনা। আমার নিজেকে উড়ন্ত পাখি মনে হচ্ছে। বদ্ধ উন্মাদ না হলে আমার মনে হঠাৎ এই চিন্তাটা আসতো না, হঠাৎ প্রেমে পাগল হওয়ার মতো। ষোলো বছর বয়সের কিশোরীদের আবেগী প্রেমের মতো! টিনএজারদের প্রেম? আমি আলতো হাসলাম। এখান থেকে পড়ে গেলে আমি মুক্ত, স্বাধীন।

👉”মহান আল্লাহ তায়ালা’র রাগের চেয়ে দয়ার পরিমাণ অনেক বেশি!”

~ আলহামদুলিল্লাহ

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here