সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব ১০

#সেদিনও_ছিলে_তুমি ❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

২৬.
‘অবাক’! আমি চরম ‘অবাক’! ঠিক কতটা ‘অবাক’ হলে একটা মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আমি জানিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অতিরিক্ত ‘অবাকের’ চোটে হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছি। আদ্রে’র সাথে আমার দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমার বিয়ে হয়েছে আজ একমাস। আর এই একমাসে আদ্রে’র প্রতি আমার অনুভূতি অনেকখানি পাল্টে গিয়েছে। দায়িত্ববোধের তাড়নায় বিয়েটা মেনে নিতে হয়েছিলো, কিন্তু এখন আমার দুনিয়া এই সংসারটাই! ছোট্ট একটা সংসার, অথচ সবার প্রতি সবার ভালোবাসাটা অসীম। ভিসি স্যার মানে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর তার গুণধর ছেলের ভালোবাসা দেখে আমিও অনেকটাই ওদের প্রতি কোমল হয়ে গিয়েছি।

‘এতিম’ বলে ওনারা আমার প্রতি দয়া দেখাননি, যেটা দেখিয়েছে সেটা আমার প্রতি একরাশ ‘সম্মান’ আর একবুক ‘ভালোবাসা’! চোখের আড়াল হলেও যে তিনটা মানুষ আমার চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যায়, তাঁদের প্রতি সম্মানটা তো এমনিতেই এসে পড়ে, তাই না?

কিন্তু আমার অবাক হওয়ার কারণ আমি যখন এই একমাসে একটু একটু করে এই আদ্র’টার প্রেমে পড়ছি, ওনার উল্টাপাল্টা কাজগুলোকে অভ্যাস হিসেবে মেনে নিয়েছি তখনই এটা ঘটলো।

আমি দুপুরের খাবার শেষ করে রুমে এসে বসতেই আদ্র বললো, ‘এই মেয়ে, এখানে আসো!’

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘কেন?’

চোখ রাঙিয়ে আদ্র বললো, ‘আসতে বলেছি আসো!’

—“আসবো না।”

—“কিহহহ?”

—“শুনতে পাননি?”

—“আসবে কি আসবে না?”

—“বললাম তো, আসবো না!”

আদ্র বাঁকা হেসে বললেন, ‘এসো না। তাতে আমার কিছু যায় আসবে না!’

আমি ভেংচি কেটে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে গেলেই আদ্রটা আমার ওড়না টেনে ধরে বললো, ‘দাও না একটু মাথা’টা টিপে! আমার খুব মাথা ধরেছে মেয়ে!’

আহা! ওনার মুখে আজকাল ‘মেয়ে’ শব্দটা শুনতে কতই না মধুর লাগে! আর আগে যখন বলতো তখন আমি রেগে একাকার হয়ে যেতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে ওনার কিউট করে বলা কথাটা শুনে আমি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘আপনার মাথা ধরেছে, আমাকে না বলে দেওয়ালের সাথে বারি দিন। ফটাফট ঠিক হয়ে যাবে!’

আদ্র আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুজে বললো, ‘তুমি আজও সেদিনের মতো নির্দয়ই রয়ে গিয়েছো মেয়ে!’

—“এমনই থাকবো…!”

—“এমন থাকলে কিভাবে চলবে মেয়ে?”

—“এই আপনি যান তো। এসব ন্যাকামি ভালো লাগে না।”

—“আমি ন্যাকা?”

—“জ্বি। ইভেন আপনি একটা খারাপ মানুষ। আপনি কি ভেবেছেন আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছি? না, আমি আপনার কর্মকাণ্ড কিছুই ভুলিনি।”

আদ্র রেগে গেলো। আমাকে ওনার মুখোমুখি দাড় করিয়ে বললো, ‘এই মেয়ে, তুমি মাঝেমাঝে এটা কেন বলো? এমন ভাবে বলো যেন আমি ভয়ংকর কিছু করে ফেলেছি তোমার সাথে। বিষয়টা কি বলো তো!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?’

—“আরে কোন বিষয় সেটা না বললে আমি জানবো কি করে?”

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘বড়লোক নেতাদের এসব কুকীর্তি মনে থাকেনা।’

ওনি রেগে বললেন, ‘কুকীর্তি মানে? আমি কি কুকীর্তি করেছি?’

আমি বললাম, ‘ভুলে গেলেন? এত তাড়াতাড়ি?’

আদ্র রেগে বললো, ‘তুমি বলবে কি কুকীর্তি করেছি আমি?’

আমি একটা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু আমাকে তো জানতেই হবে সেদিন ওনি কেন আমার সাথে এরকম করেছিলেন। সেজন্য আমি বললাম, ‘আপনি যেদিন আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় আপনার বাসায় নিয়ে যান, তারপরের দিন যখন আমি ম্যাসে ফিরে যাই তখনই ঘটনাটা আমি দেখি!’

—“কি ঘটনা?”

—“এই যে, আমার গলায়, গালে আপনিই তো কামড় দিয়েছিলেন। আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছিলেন, তাই না মিস্টার আদ্র?”

আদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অকপটে বললো, ‘হ্যাঁ আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু সরলতার সুযোগ বলতে তুমি কি বুঝাচ্ছো?’

—“ওহহ, এটাও এখন আমাকে বলে দিতে হবে? ওয়েট বলছি, আমার না নিজেকে মাঝেমধ্যে প্রস্টিটিউট মনে হয়, সেদিন রাতে আপনি কি করেছিলেন সেটা ভেবে।”

আদ্র এবার ভয়ংকর রেগে গেলো। ঠাস করে একটা চড় মেরে বললো, ‘শুনে রাখো মেয়ে! আমি সেদিন তোমার মায়াবী চেহারার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে কন্ট্রোল না কর‍তে পেরে জাস্ট এটুকুই করেছি। এর বাইরে বেশিকিছুর কথা আমি ভাবতেও পারিনা, ভাবিনিও! এতদিন যে আমাদের বিয়ে হলো আমি কি তোমার সাথে সেইধরনের কোনো খারাপ বিহেভ করেছি মেয়ে? আর তুমি কিনা আমাকে বাজে লোকের সাথে মেলাচ্ছো আর নিজেকে প্রস্টিটিউটদের সাথে তুলনা করছো!’

আমি গালে হাত দিয়ে কান্না করছি। সত্যি ওনাকে কতটা ভুল বুঝলাম আমি, এতদিন একসাথে থেকেও ওনার প্রতি এতোটা ভুল ধারণা পুষতাম আমি? ছিহ!

২৭.
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে চিল্লিয়ে বললেন, ‘চোখ মুছো মেয়ে, তোমার এসব আকাশপাতাল উল্টাপাল্টা চিন্তা মুছে কাউকে ভালোবাসতে চেষ্টা করো। আর না পারলে দ্যাটস এনাফ, ভালো। সেদিন ভার্সিটিতে যা হয়েছিলো সেটাও এক্সিডেন্টলি। তুমি ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলে তাই আমি আটকাতে চেয়েছিলাম। আর বিয়ের বিষয়টা নিতান্তই স্যার আর আব্বুর মতামতের উপর ভিত্তি করে হয়েছে। সেজন্য তুমি আমাকে হাজব্যান্ড হিসেবে মেনে নিতে না পারলে বা আমার কাছে আসতে না চাইলে আমি কিছু মনে করবোনা বা জোর করবো না। আদ্র কখনোই নিজের অপমান মেনে নেয় না, মাইন্ড ইট!’

বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। কয়েক মিনিটের মাঝে রুমে একটা টর্নেডো বয়ে গেলো যেন। সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কাপড়চোপড় পরে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলেন। একবারও আমার দিকে তাকালেন না। হুহ, যত্তসব ঢং।

২৮.
বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো, কিন্তু আদ্র এখনো বাসায় ফিরেনি। শ্বাশুড়ি মা দু’বার ফোন করলেন কিন্তু ফোন সুইচড অফ। রাতের খাবার খেয়ে ওয়েট করতে লাগলাম ওনার জন্য, কিন্তু নাহ! বেচারা আদ্র বাসায় ফিরলোই না। শ্বশুর মশাই কিছুক্ষণ রাগে গজগজ করতে করতে বকাঝকা করলেন। ওনি নাকি আগেও কয়েকবার এমন করেছেন, তবে ফোন করে জানিয়ে দিতো। কিন্তু আজ, ফোন না করায় সবাই দুশ্চিন্তা করছে।

ওনি যে আমার সাথে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছেন সেটা বলার সাহস পেলাম না। ওনাদেরকে অনেক কষ্টে সামলে নিলাম। বললাম, ‘ওনার ফিরতে রাত হবে, আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন!’

ওনারাও কিছুক্ষণ গাই-গুই করে শুয়ে পড়লেন। আমি রুমে এলাম। ফোন করবো কিনা ভাবছি, কিন্তু কিভাবে দিবো? আমার কাছে তো ওনার সেলফোনের নাম্বার নেই। মানে, কোনোদিন ফোনে কথা হয়নি। সেজন্য প্রয়োজন পড়েনি ওনার নাম্বার। ড্রইংরুমে গেলাম, মায়ের ফোনটা টেবিলের উপর রাখা ছিলো। লিস্ট থেকে ওনার নাম্বারটা কালেক্ট করলাম। মা ওনার নাম্বারটা ‘আদু’ দিয়ে সেইভ করে রেখেছেন, ফলে আমি সহজেই পেয়ে গেলাম। মা সবসময় ওনাকে ‘আদু’ বলেই ডাকেন।

আমি রুমে এসে নাম্বারটা ডায়াল করতেই আমার চক্ষুচড়ক গাছ! এই নাম্বার থেকেই তো এক সকালে আমার গোপন প্রেমিক ফোন করে বলেছিল, ‘তুমি ঘুমিয়ে থাকলে এতো মায়াবী লাগে কেন? আর বেশিক্ষণ ঘুমিও না, তাহলে হার্টের পেশেন্ট হয়ে বিয়ের আগেই মরে যাবো!’

তারমানে এটা আদ্র’ই? ওহ মাই গড! আই কান্ট বিলিভ দিস। এটা কি করে হতে পারে? আদ্রে’র মতো একটা ম্যাচিউরড ছেলে, সে নাকি আমার ঘুমন্ত চেহারা দেখার জন্য রাতের বেলা চুপিচুপি আসতো। চুপিচুপি একটা ফাগুনী শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো! আর আমি চোরটাকে সারাক্ষণ আশেপাশে রেখে, একমাস সংসার করার পর চিনতে পারলাম? লোকটা এতদিন ধরাও দেয়নি আমাকে? এমন একটা ভাব করতো যেন ওনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ, গম্ভীর, রাগী, ফাজিল, অসভ্য একটা মানুষ। আসলে ওনি যে প্রথম থেকেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন সেটা অতি সন্তপর্ণে গোপন করে গেলেন।

সেদিন শাড়ির সাথে ছোট্ট একটা চিরকুটও ছিলো। প্যাঁচানো কথাবার্তা। লিখা ছিলো,

“মায়ারাণী,

‘তোমার সাথে আমার দেখা সেদিন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যুগযুগ ধরে তোমার সাথে আমার পরিচয়। কেন এমন মনে হচ্ছে জানিনা। তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, তখনই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তুমি হয়তো আমার গভীর সেই চাহনি লক্ষ্য করোনি, করলে ঠিকই বুঝতে পারতে ওই চোখ তোমার প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই ‘যুগ’ ‘যুগ’ ধরে আমার অতি কাল্পনিক একটা স্বত্ত্বার সাথে তোমার মিল পেয়ে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি। তোমার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে আমার রাতের ঘুমটা ভালো হয়, ম্যাজিকের মতো। আচ্ছা! যাইহোক, কাব্যিক কথাবার্তা আমার ততোটা আসেনা। ফাগুন রঙের শাড়িটা তোমার জন্য। ভালোবাসা এক আকাশ সমান,
ভালোবাসা একটা পৃথিবীর সমান!’

তোমার অচেনা পুরুষ!”

সেই চিঠি পড়ে আমি যে সেইরাতে কত হেসেছি, বুঝাতে পারবোনা। কিন্তু এখন যখন জেনে গেলাম এটা আদ্র সাহেব, তখনই আমার হাত-পা তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি চাইলেই এই ফোন নাম্বার দিয়ে আরও আগেই এই ব্যাটাকে ধরতে পারতাম। শিট,,লোকটা তলে তলে এতকিছু করে ফেললো আর আমি সেই আদিকালের নারীর মতো পিছিয়েই আছি? নাহ, আমাকেও জ্বলে উঠতে হবে। আমার সাথে লুকোচুরি খেলবে আর আমি সারাজীবন বোকা বউ হয়ে সব মানবো তা তো হতে পারেনা, তাই না?

👉”মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত!”

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here