সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব ৯

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

২৫.
আমি গুটিশুটি মেরে আদ্রে’র বুকের মাঝে শুয়ে আছি। শুয়ে আছি বললে ভুল হবে। এই অসহ্যকর, অভদ্র লোকটা আমাকে জোর করে নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়েছে।

এখন প্রায় মাঝরাত। আমি বারোটার দিকে ইতস্তত করে যখন বিছানায় শুয়ে পড়ি, তখন আদ্র বাসায় ছিলেন না। আমি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন ওনি বাসায় ফিরেন এবং রুমে ফিরে আমাকে নিজের বিছানায় ঘুমাতে দেখে ফ্রেশ হয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়েন। মাঝখানে রাখা কোলবালিশটা সরিয়ে ঘুমন্ত আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন। অতি পরিচিত স্পর্শের ছোঁয়া পেয়ে বরাবরের মতো এবারও আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখে নিলাম, যখন মনে পড়লো আমি আদ্রে’র বাসায় তখনই চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি বজ্জাত আদ্র’টা আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলবালিশ হিসেবে ইউজ করছে।

সেই যে আমার ঘুম ভাঙলো আর আমি ওনার থেকে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করছি, ততই ওনি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছেন। ওনার ঘুম নাকি আমার জন্য ভেঙে গেলো সেজন্য ওনি আমাকে ছাড়বেন না। এটা নাকি আমার শাস্তি! আমি এবার বিরক্তি নিয়ে বললাম,

—“আপনি আমাকে ছাড়বেন? ”

—“কেন?”

—“ছাড়বেন কি না বলুন।”

—“কেন?”

—“আজব!”

—“কি আজব?”

—“আপনি আজব!”

—“আপনি মানে?”

—“আপনার মুন্ডু, আমাকে ছাড়ুন। আমি এভাবে ঘুমাতে পারিনা!”

—“এভাবেই তো ঘুমাতে হবে সুইটহার্ট!”

—“এভাবে কে ঘুমায়? এমন ঘুম মানুষে ঘুমায়?”

—“মানুষে ঘুমাবে কেন? আমার আর তোমার মতো নতুন কাপলরা ঘুমায়!”

—“এই আপনি চুপ করবেন?”

—“নাহ! আজ আমাদের বাসর রাত, ফার্স্ট টাইমে তো মৃগী রোগীর মতো জ্ঞান হারিয়ে আমাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়েছো, সেকেন্ড টাইম তো তা হতে দিতে পারিনা, তাই না?”

আমি রেগে বললাম, ‘আপনি যদি আমাকে না ছাড়েন তাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করবো।’

ওনি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘করো চিৎকার, দেখি তোমার কত দম।’

আমি রেগে জোরে চেঁচিয়ে বললাম, ‘ছাড়ুন বলছি অভদ্র লোক!’

ওনি মুচকি হেসে বললেন, ‘তাই সুইটহার্ট?’

আমি আবারও যে-ই না চিল্লাতে যাবো অমনি ওনি আমার ঠোঁট দখল করে নিলেন। আমি বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছেমতো ঠেলে, ঘুসি দিতে লাগলাম। কিন্তু অভদ্র লোকটা আমাকে ছাড়ছেই না। পরম আবেশে ঠোঁটে পরশ বুলাতে লাগলেন, আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করেও ওনাকে সরাতে পারছিনা, কিছুক্ষণ পর নিজেই ছেড়ে দিলেন। কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন, ‘আরও জোরে চেঁচাও সুইটহার্ট!’

আমি কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, ‘এটা আপনি কি করলেন?’

ওনি হুট করে ওঠে বসলেন। রাগী গলায় বললেন, ‘চোখ মুছো, এক্ষুনি চোখ মুছো ড্যাম ইট!’

আমি কেঁদেই দিলাম। ওনি আবারও ধমকে বললেন, ‘কানে যাচ্ছেনা কথা?’

আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি।চাইলেও আটকাতে পারছিনা। লজ্জ্বা আর ভয়ে কিছুতেই থামতে পারছিনা। ওনি আমার কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘স্টপ ইট! বলছি না আমার সামনে কাঁদবে না?’

আমি তাও থামছিনা। এবার ওনার প্রতি রাগ হচ্ছে আমার। এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আর এখন রেগে ওনার দিকে তাকালাম লাল চোখে। ওনি বোধহয় টলারেট করতে পারছিলেন না, সেজন্য বিছানা থেকে নেমে টিস্যু বক্স আমার হাতে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন।

২৬.
আমি চুপচাপ আবারও শুয়ে পড়তেই খচ্চর লোকটা আবার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। আমার ঘাড়ে মুখ গুজে অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘চুপচাপ ঘুমাও সুইটহার্ট! নো নড়াচড়া, নো হাংকি পাংকি!’

আমার এতো রাগ হলো বলার বাইরে। যা বুঝলাম, ওনি এতক্ষণ আমার কান্না থামার অপেক্ষা করছিলেন, যেই কান্না থামলো অমনি এসে কত্বর্ত ফলাতে শুরু করলেন। আমি চুপ করে রইলাম। ওনার নিঃশ্বাসের শব্দ নীরব-নিঃস্তব্ধ ঘরটাতে গুমোট অনুভূতি সৃষ্টি করছিলো। খুব চেনা, খুব কাছের মানুষ মনে হচ্ছে ওনাকে। ওনার প্রতিটি স্পর্শ একেবারে মনের গভীর কোথাও গিয়ে জানান দিচ্ছে যে, ‘তুমি আমার, শুধুই আমার!’

ও মাগো! আমার মন কি উতলা!! কিসব ভাবছি? আই হেইট মাই মাইন্ড। জামাই বলে কি তাকে এখন প্রেমিক পুরুষ ভাবা উচিৎ এই আদ্র’টাকে? কিন্তু আমার ওই চুপিচুপি রাতের বেলার প্রেমিক চোরের কি হবে? বেচারার তো হার্ট ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে, যখন দেখবে তার দেওয়া শাড়ি পরিধান করে আমার বিয়ে হয়েছে আদ্রে’র সাথে! হায় গারমি!

কিন্তু ওই লুকিয়ে লুকিয়ে আসা আমার প্রেমিক পুরুষের স্পর্শ আর আদ্রে’র স্পর্শের এতো মিল কেন? আদ্র ছুঁলেই মনে হয়, এই ছোঁয়া পুরোনো। কেন এমন হয়? আচ্ছা, এমনটা কি হতে পারে না আদ্র’ই ওই চোর প্রেমিক?

তারপর আমি আবার এটাও ভাবলাম, ‘আদ্র সাহেবের সাথে যেদিন থেকে দেখা, ওই চোরের আগমন ও তো সেদিন থেকেই। আবার চোর প্রেমিক যে শাড়িটা রেখে গিয়েছিলো, সেই হলুদ শাড়িটা আর আদ্রে’র পরণে সেই হলুদ পাঞ্জাবীটা একদম সেইম ডিজাইনের ছিলো। পুরো শাড়ি হলুদ আর আঁচল সাদা, আর ওনার পাঞ্জাবীতেও সাদাটে ভাব ছিলো। যেটা ভার্সিটির আর কাউকে দেখা যায়নি! কিন্তু.. নাহ! একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়! ওনি চোরের মতো কেনই বা আমার ঘরে ঢুকবেন? সরাসরিই দিতে পারতো।

এসব ‘কিন্তু’ ‘কিন্তু’ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৭.
পরদিন ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ওনার বুকে আবিষ্কার করে রেগে গেলাম। একটা ধাক্কা মেরে ওনাকে সরাতে গেলেই ওনি ঘুমন্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে যান। মাথায় মনে হয় বারিও খেয়েছেন। আমি ভয়ে মুখ চেপে গুটিশুটি মেরে বিছানা থেকে নামলাম। ওপাশে এসে দেখি ওনি ফ্লোরে উঠে বসার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখেই অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ঘুমঘুম চোখে, ঘুমঘুম রাগী গলায় বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে? স্বামীর প্রতি তোমার এই-ই দরদ?’

আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, ‘উঠুন!’

ওনি উঠলেন না। রাগী গলায় বললেন, ‘স্বামীকে সম্মান না-ই দিতে পারো, তাই বলে কি আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ফ্লোরে ফেলে দিয়ে পাপের ভাগীদার হতে চাও?’

আমি আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলাম।

—“বললাম না, এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার এখানে লাগে?” (বুকে হাত দিয়ে)

তারপর আমার বাড়ানো হাতটা ধরে একটান দিয়ে নিজের কোলে ফেলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে কোমল গলায় বললেন, ‘এসব পাপ করলে আল্লাহ গুনাহ দেয়, জানো না? স্বামীদের সাথে অসভ্য ব্যবহার করা গুরুতর অপরাধ। তারপর তোমার পাপের ভাগীদার করে তুমি তো আমাকে নিজের সাথে জাহান্নামেই নিয়ে যাবে, তুমি যা নির্দয়!’

আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। তখনই একটা ফোন এলো ওনার। বেড-সাইড টেবিলে থেকে ফোনটা একহাতে নিয়ে রিসিভ করলেন, আর অন্যহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলেন। আমার রাগে গা জ্বলছে। ওনি একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, ‘কথা বলি?’

আমি বললাম, ‘আপনার ফোন, আপনি জানেন। কিন্তু আমাকে ছাড়েন।’

—“উহু…!”

বলে ফোনে মনোযোগী হলেন। কিছুক্ষণ ফাই-ফুই করে কিসব পলিটিক্স নিয়ে কথা বললেন, আমি কিছুই বুঝলাম না। একসময় ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটার কথা শোনে ওনি রেগে গেলেন। একটা রামধমক দিয়ে ফোন কেটে দিলেন। তারপর আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, ‘উঠো তো!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমি তো উঠতেই চাইছি, আপনি ধরে রেখেছেন কেন! আমাকে ছাড়ুন।’

—“নাহ, ছাড়বো না। তুমি উঠো!”

কি লোকরে বাবা! সকাল সকাল এভাবে সিরিয়ালের নায়কদের মতো ঢং শুরু করে মেজাজটাই হলো তিরিক্ষি! নিজে ধরে রেখে আমাকে কিনা বলছে উঠতে, আজব তো। এইরকম লোকদের জন্যই দেশের উন্নতি হয়না, দেশটা রসাতলে যায়। সারাদিন স্টার জলসার সিরিজ নায়কদের মতো বাড়িতে বউয়ের আঁচল ধরে কিভাবে যে এরা অফিস, পলিটিক্স সামলায় তা খোদা জানে!!

👉’আর জেনে রাখ,
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন!’

~ [সূরা আত-তাওবাহ ৯:৩৬]

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here