১.
একটা ছেলেকে থাপ্পড় দেওয়ার অপরাধে আমাকে সবাই মিলে ধরে এনেছে ভার্সিটির হল রুমে। সেখানে আমাকে শাস্তি দেওয়ার বিভিন্ন পায়তারা চলছে। যেন কোনো উৎসব হবে। যে ছেলেটাকে থাপ্পড় মেরেছি সে ভার্সিটির একজন গুন্ডাটাইপ ছাত্র। আর যিনি আমার শাস্তি দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আমাদের ভার্সিটির সাবেক প্রিন্সিপাল স্যারের ছেলে আব্রাহাম আদ্র!
এই মুহূর্তে আমার ভয়ে কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আদ্র। আমাকে যখন দুটো মেয়ে ধরে ওনার সামনে নিয়ে আসলো তখন থেকেই আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। একদল মানুষের সামনে আমি ভয়ে কিছু বলতেও পারছিনা, গলা শুকিয়ে আসছে।
আদ্র নামক লোকটা আমাকে এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই বেয়াদব মেয়ে! তোমার নাম কি?’
আমি চুপ করে রইলাম। ওনি আমাকে ধমকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বলছি কানে যাচ্ছেনা?’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আরশি!’
তো মিস আরশি, ‘তুমি ছেলেটার গায়ে হাত তুলেছো কেন?’
আমি ভয়ের চোটে একনাগাড়ে বলে দিলাম, ‘এই ছেলেটা আমার সাথে বেয়াদবি করার চেষ্টা করছিলো।’
ওনি শক্ত কন্ঠে বললেন, ‘কেমন বেয়াদবি?’
আমি বললাম, ‘ওনি আমাকে জোর করে আই লাভ ইউ বলতে বলেছে। আর ওনি নাকি আমাকে বিয়ে করতে চায়।’
আদ্র রাগী চোখে তাকালো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরশি যা বলছে তা সত্যি?’
ছেলেটি ভয়েই বলে ফেললো, ‘জ্বি ভাই।’
—“তাহলে তুই আমার কাছে বিচার চাইতে আসছিস কেন?”
—“ভাই এই মাইয়া আমাকে চড় বসিয়ে দিসে আর আপনি এর বিচার করবেন না?”
—“তো তুই কি করছিস? তুই মেয়েটাকে গিয়ে এসব বলছিস কেন? বেয়াদবি করছিস কেন?”
—“আমাদের ভার্সিটিতে তো এসব হয়ই ভাই।”
আদ্র উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটার কাছে গিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে ওকে চলে যেতে বললো। রুম থেকে সবাইকে বের করে দিলো। তারপর আমার সামনে আমার চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিলো। আমাকে বললো , ‘ভবিষ্যতে তোমার নামে যাতে আর কোনো কমপ্লেইন না আসে! আজ তোমাকে হেল্প করলাম, যেটা অন্য মেয়েছেলেদের ক্ষেত্রে করিনা। মাইন্ড ইট!’
আমি চলে আসলাম। বাবা! মনে হচ্ছিলো আজ আমি শেষ। ক্লাসে চলে গেলাম। একটা ক্লাস অলরেডি মিস হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটাও ভুলে গেলাম।
২.
এই মুহূর্তে আমি আছি আব্রাহাম আদ্র’র সামনে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার সাথে এসব কি হয়ে গেলো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
ভার্সিটি ছুটি হওয়ার পরে শুনশান রাস্তা ধরে হেঁটে ফিরছিলাম আমি! দুপুরের গরম বাতাস বইছে। আমি রাস্তা বাঁক নিয়ে আরেকটু এগুতেই হঠাৎ একটা ছেলের গাড়ি প্রায় আমার উপরেই ওঠে যাচ্ছিলো। ছেলেটা গাড়িটা থামিয়ে হুড়মুড়িয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটার দিকে তাকালাম, অসম্ভব সুন্দর একটা ছেলে। কোথায় যেন দেখেছি, ঠিক মনে করতে পারছিনা আমি!
তারপর হঠাৎ মনে পড়লো আরে এটাতো ভার্সিটির সেই বড় ভাইয়াটা! আমার উপর আরেকটু হলেই গাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছিলো। এবার আর আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না, ‘বিস্ময়ের ভাব কাটিয়ে বললাম, এই যে ভাইয়া! এসব কি হচ্ছে? দেখে গাড়ি চালাতে পারেন না? কানা নাকি?’
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে রেগে ঠোঁট উল্টে বললো, ‘রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটলে গাড়ির নিচে চাপাই পড়তে। নিজের দোষ আবার আমাকে চোখ রাঙাচ্ছো!’
আমি বললাম, ‘বেশ করেছি। আমার যেখান দিয়ে ইচ্ছা সেখান দিয়ে যাবো। আপনি দেখে চললেই হলো।’ বলতেই আদ্র আমার হাত চেপে ধরলো।আমি হাত নড়াচড়া করতে লাগলাম, যার ফলে ওনার হাত ফসকে আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। প্রচন্ড ব্যথা পেলাম কোমড়ে।’
ওনি এসেই বললেন, ‘আমার সাথে বেয়াদবি করলে এমনই হবে! গট ইট?’
আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। দাঁড়িয়ে রেগে বললাম, মেয়েদের কিভাবে সম্মান দিতে হয় জানেননা? একটা অভদ্র লোক!’
ওনি রেগে বললেন, ‘তুমি ভদ্র? নিজে অভদ্রতা করে বেড়াও আবার বড় বড় কথা? তোমাকে দেখে নেবো বেয়াদব মেয়ে!’
আমি ওনার রাগ সম্পর্কে আজ ক্লাসেই শুনেছিলাম। সেজন্য ওনাকে এক অদ্ভুত কারণে আমার পছন্দ নয়। দেখতে যত সুন্দর, ততই বদমেজাজী লোক। আমি এখন কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। ওনি যদি আমার সাথে খারাপ কিছু করে বসেন!
ওনি রেগে আমাকে বললেন, ‘হ্যালো মিস! এখন কথা উবে গেলো কেন? বেশ পকপক করছিলে তো। আমি যে আজ তোমাকে হেল্প করলাম সেটা মনে নাই? এখন আমার সাথে মিসবিহেভ করেছো সো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে!’
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘জ জ্ব জ্বি ভা ভাইয়া ক কি ক্ষতিপূরণ দেব?’
ওনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এই তুমি কাকে ভাই বলছো? স্যার বলো। ক্ষমা চাও, রিডিকিউলাস!’
—“জ্বি স্যার স্যরি। কিন্তু কি ক্ষতিপূরণ দেবো স্যার?”
ওনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘এখন নিবো না ক্ষতিপূরণ। আমার যখন ইচ্ছা তখন নেবো। সো বি রেডি?’
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘জ্ব জ্বি!’
ওনি রেগে বললেন, ‘তাহলে আর আমার সাথে মতো দুঃসাহস দেখাবে?’
আমি প্রায় কেঁদে দিলাম। বললাম, ‘না স্যার!’
ওনি বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, গুড গার্ল!
কোমড় ব্যথাটা কিছু কমেছে। নিজের কাপড় ঠিক করছি আর ভাবছি এক দৌড়ে এই রাস্তাটা পার হয়ে যাবো। কিন্তু না, হঠাৎ একটা মেয়ে সম্ভবত আদ্র লোকটার বান্ধবী এসে ঠাস করে আমার গালে চড় মেরে বসলো। আর চেঁচিয়ে বললো, ‘এই ফকিন্নির মতো মেয়েটা তোমার সাথে আর তুমি তা টলারেট করলে আদ্র? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাত মুচড়ে ধরে বললো, খুব শখ না? খুব শখ আদ্র’র সাথে ঢলাঢলি করার?’
বলেই আমাকে আরেকটা চড় মারতে গেলেই আদ্র’ স্যার ওনার হাত ধরে ফেললেন। মেয়েটার গালে রেগে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘তিনঘন্টা তুমি আমার টাইম ওয়েস্ট করেছো ফারিন, তোমার জন্য আজ আমাদের সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর তুমি ফুর্তি করে এসে এখানে অন্যের গায়ে হাত তুলছো ড্যাম ইট!’
আমি চিনতে পারলাম ওনি সুপার মডেল ফারিন। বিভিন্ন কুকীর্তি রয়েছে ওনার নামে। একদম বেয়াদব একটা মেয়ে। কিন্তু এই বেয়াদব মেয়েটা আমাকে শুধু শুধু চড় মারলো ভেবে আমার প্রচন্ড রাগ হলো। আমিও গিয়ে ঠাস করে চড় মারলাম ওকে। বললাম, ‘নিজের দোষ দেখিস আগে, তারপর আমার সাথে লাগতে আসিস নোংরা মেয়ে।’
ফারিন আদ্র স্যারের হাতে মার খেয়ে ন্যাকা কান্না করছিলো। আমি থাপ্পড় দেওয়ায় জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘কি? নিজেকে খুব সুন্দরী ভাবিস? তোর ভূতের মতো চোখদুটো দিয়ে অন্যকারো দিকে তাকাইস নোংরা মেয়ে। এই আরশির সাথে লাগতে আসলে তোর চোখ উপড়ে ফেলতে আমি দু’বার ভাববো না। গট ইট?’
ফারিন আদ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আদ্র বেবি তুমি মারলে আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু এই মিডেলক্লাস ফকিন্নিটা আমার সাথে কি রুড ব্যবহার করছে তুমি দেখতে পাচ্ছোনা?’
আদ্র স্যার রাগী গলায় বললো, ‘আমি কি বলবো? তোমার দোষেই তুমি এসব কথা শুনছো। তাই আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবে না! মাইন্ড ইট।’
আমার সারা গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছে তখন। চেঁচিয়ে বললাম, ‘ও মেকআপ সুন্দরী! শুনে রাখ, আমরা কাজ করে খেটে খাই। তোর মতো নোংরা না। ছেলে দেখলেই লাফিয়ে পড়িস তোর এই কাহিনি কি আমরা জানি না ভেবেছিস! নোংরীর নোংরী!’
বলেই দেখি একজন লোক মোবাইলে এসব ভিডিও করছে। আমি আর এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়ালাম না। এক দৌড়ে ওখান থেকে চলে আসলাম। আল্লাহ বাঁচাও, কি না কি হয়ে যায়! হোস্টেলে পৌঁছেই দম নিলাম।
সন্ধ্যায় ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলাম কে যেন আমার একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। ভিডিও অন করে দেখি, দুপুরের সেই ফারিনের সাথে আমার ঝগড়া করার ভিডিও অলরেডি ভাইরাল। ক্যাপশনে লিখা, ‘সুপার মডেল ফারিনের সাথে কি দুর্ব্যবহার করলো দেখুন!’
আমি বোকার মতো বসে বসে ভিডিও দেখছি। আল্লাহ! আমি ভাইরাল। এখন কি হবে? কেন গেলাম রাগের বশে এই মেয়ের সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলতে?
অনেকক্ষণ কাঁদলাম। বান্ধবীরা সবাই ফোন দিচ্ছে। সবাই ফারিনের সাথে হওয়া ঝামেলার বিষয়ে জানতে চাচ্ছে, আমি ফোন বন্ধ করে বসে আছি। কেউ তো আর আসল সত্যিটা জানেনা। কোন পরিস্থিতিতে আমি এসব করেছি!
রাতেরবেলা ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কে যেন আমার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে রইলাম। চোখ খোলার সাহসটাও হলো না।
👉আসসালামু আলাইকুম। সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব!
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! গত পর্বে কিছু একটা ভুল ছিলো তাই ঠিক করে দিলাম। বেশি পর্ব হবে না!
#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে- ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১