#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#অন্তিম_পর্ব
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ক্ষুদ্র বার্তা দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ইভানা। তীক্ষ্ণ ফলা এসে ছুঁয়ে যায় হৃদপিণ্ড। গত চব্বিশ ঘন্টা সময় ধরে ঘনি ভূত হওয়া ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায় ঘন্টায় হাজার হাজার মাইল বেগে।
ধপ করে বসে পড়ে দরজার সম্মুখেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহিমা করিম শক্ত পোক্ত ইভানার ভঙ্গুর রূপ দেখে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর দানা বাঁধে আকাশসম ভয়। ইভানার কাঁধে হাত রেখে কাঁপা গলায় বলল,
“ইভা মা, কি হয়েছে?”
ইভানা কিছু বলে না। নির্নিমেষ চেয়ে রয় সামনে।
ফাহিমা করিম অধৈর্য্য হয়ে পড়েন। ইভানার কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে বললেন,
“ইভানা মা, আমার আবরার? আমার আবরারের কিছু হয় নি তো? কথা বলছিস না কেন তুই? আমার আবরার কোথায় ইভা?”
ইভানার উত্তর না পেয়ে ফাহিমা করিম চেঁচিয়ে ওঠেন রিফাতের নাম নিয়ে। রিফাত হুরমুর করে এসে দুজন কে মাটিতে বসে থাকতে দেখে নিজেও বসে পড়ে হাঁটু গেড়ে। ফাহিমা করিমের কান্নারত মুখ দেখে শঙ্কিত গলায় বলল,
“মা! ও মা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন মা?”
ফাহিমা করিম ইভানার দিকে দেখিয়ে কান্নারত গলায় বলল,
“আমার আবরার! আমার আবরার!”
রিফাত ইভানার দিকে তাকাল। পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে থাকতে দেখে নরম গলায় বলল,
“ইভানা বোন আমার কি হয়েছে? আবরারের খবর পেয়েছো?”
ইভানা কাঁপা হাতে ফোনটা বাড়িয়ে দিল রিফাতের দিকে।
রিফাত স্কিনে তাকাতেই মাথা ঘুরে উঠল তার। এ কি করে সম্ভব! তার হাস্যজ্বল বন্ধু এই কাজ করতে পারে না। কোনো ভাবেই না। কস্মিনকালেও না।
খুঁজে খুঁজে ভারতীয় একজন প্রফেসরের নাম্বার বের করল রিফাত। কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই কলের পুতুলের ন্যায় বলল,
“গতকাল সন্ধ্যায় ল্যাবভবনের ছাঁদ থেকে লাফিয়ে আ’ত্ম”হ’ত্যা করেছে আবরার ফাইয়াজ। হসপিটাল কতৃপক্ষ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছে।”
পরিবারের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছে ল্যাবসহকারী পেট্রিসিয়া। আবরারের সহকর্মী সে। তিনি আরও জানান -পরিবারের কাছে আবরার ফাইয়াজের মৃ’ত’দেহ হস্তান্তরের ব্যবস্থার কথা। রিফাত কথা বলে জানায় তারা চায় আবরারের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে এবং সেটা তার নিজদেশে।
অবশেষে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানান সপ্তাখানেকের মধ্যে বাংলাদেশে পাঠানো হবে আবরার ফাইয়াজের লা’শ।
সদ্য বিবাহিত রমণী ইভানার হাতের মেহেদী, গায়ের হলুদের রঙ মলিন হওয়ার আগেই জড়িয়ে নিতে হলো সাদা শাড়ি। বছর না পেরোতেই বৈধব্যদশা ঘিরে ফেলল তাকে। এই তো সেদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে, সানাই বাজিয়ে এলো সে এ বাড়ি। ওই মানুষটার হাতে হাত রেখেই। দোরগোড়া থেকে রাণীর ন্যায় ভেতরে নিয়ে এলো সে। অথচ আজ! আজ সে সব বাঁধন ছিন্ন করে একা পাড়ি জমালো দূর বহুদূরে!
ইভানা কাঁদে না। নড়ে না। কোনো অনূভুতি প্রকাশ করে না। কেবল চেয়ে রয় নির্নিমেষ, নির্বিকার। লালচে রঙের শাড়ি ছেড়ে রোবটের ন্যায় মুড়িয়ে যায় ধবধবে সাদা রঙা কাপড়ে। ইভানা একবার তাকিয়ে দেখল সাদাথান। চকিতে মনে পড়ল আবরারের বলা একটি প্রেমময় বাক্য।
“আমি মরে গেলে তুমি রোজ সাদা শাড়ি পড়বে কাঁচাগোল্লা!”
ইভানা কড়া চোখে সামনে তাকায়। ওইতো অদূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সে। মিটিমিটি হাসছে। চোখের ইশারায় বলছে- ‘তোমাকে শুভ্র পরীর মত লাগছে কাঁচাগোল্লা।’
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলে। পরক্ষণেই আরেকবার দেখার জন্য মাথা তুলে তাকায়। কিন্তু হায়! নেই তো সে। দূর বহুদূর অবধি চোখ বুলায়। নাহ! তার ছায়াটিও চোখে পড়ছে না। পুনরায় অনূভুতিহীন হয় সদ্য বৈধব্য বরণ করা মেয়েটা।
ফাহিমা করিম। একজন সাহসী মা। অকালে স্বামী হারিয়ে দুটো শিশু সন্তান আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিয়েছেন বছরের পর বছর। তাদের গড়ে তুলেছেন নিজ আদর্শে। নিজের শত কষ্ট পেছনে রেখে নরম শাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজের আধিপত্য। অতি কষ্টে বড় করা সন্তান, বেঁচে থাকার অবলম্বনের যখন এই পরিণতি তখন তার আর বাঁচার শক্তি বজায় থাকে না। থাকে না অনুভূতি ব্যক্ত করার কোনো প্রয়াস। ফাহিমা করিম ঠায় বসে আছে ইভানার সম্মুখে। ইভানা এদিক ওদিক মাথা নাড়াচ্ছে বাচ্চাদের মত। মনে হয় কিছু খুঁজছে। ফাহিমা করিম মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেয়েটার বাচ্চামো। আদৌ মনোযোগ আছে তো? নাকি তাকিয়ে থাকার জন্যই তাকিয়ে আছে সে!
নোভা কেবল কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে সে। একমাত্র তাকে দেখেই মনে হচ্ছে এই বাড়ির কেউ পরলোকগমন করেছে। গগনবিদারী চিৎকারে নিজের ভেতরের লালিত ভালবাসাকে উগরে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। চেষ্টা করছে এত বছর ধরে ম্যাজিক করা দাদাভাই কে নিজ ম্যাজিক দ্বারা ফিরিয়ে আনতে। আছে তো কোনো ম্যাজিক? আসবে তো আবরার? আরেকবার বুকে জড়িয়ে বলবে- আমার পাগলী বোনটা! দাদাভাই সব ঠিক করে দেবে! বলবে আর একটাবার?
পুনরায় হৃদয় ঘটিত যন্ত্রণা অনুভব করে সে। বুক উগলে বেরিয়ে আসে যন্ত্রণা মেশানো আর্তনাদ।
রিফাত সামলানোর চেষ্টা করে তাকে। দু’একটা কথা বলে নিজেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। দাঁতমুখ কামড়ে সামলে নেয় পরক্ষণেই। তাকে যে কাঁদতে নেই। পুনরায় ছোটে সে অন্য দিকে। মা টা যে নির্বিকার বসে আছে ওই দূরে। তাকে দেখতে হবে যে! আকাশসম দায়িত্ব দিয়ে পালিয়েছে তো কেউ একজন। স্বার্থপর, পাষাণ সে।
মাস চারেক পর।
সামান্য উঁচু পেটের ওপর হাত রেখে কবরস্থানের ফটকে দাঁড়িয়ে ইভানা। মিনিট দশেক হলো সে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। ভেতরে প্রবেশের সাহস পাচ্ছে না সে। ওই তো একটু সামনেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তার অতি আপন একজন। সবচেয়ে আপন সে। আপন থেকেও আপন। যার কাছে তার নেই কোনো সংকোচ, ভয় কিংবা অনুযোগ। আছে শুধু একরাশ অভিমানের মেঘ। অবেলায় চলে যাওয়ার অভিমান। শত শত দায়িত্বের ঝুড়ি মাথায় দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাওয়ার অভিমান। ইভানা মুখ ফুলিয়ে তাকায়। পরক্ষণেই আলতো হাতে পেট ছুঁয়ে বলে-
“তুমি শুনতে পাচ্ছো তাই না? তুমি দেখতে পাচ্ছো আমাদের। জানো তো তোমার সন্তান আসবে। একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান। ঠিক তোমার মত। তোমার মত করে হাসবে, খেলবে, ভালবাসবে। ঠিক তোমার মত জেদি হবে। স্বপ্ন দেখবে, স্বপ্ন দেখাবে আর প্রাণ উজার করে ভালবাসবে। তুমি চলে গিয়েও রয়ে গেছো আমাদের সাথেই। আমাদের মনে, প্রাণে, অন্তরে। এভাবেই থাকবে আজীবন।”
কিছুক্ষণ আবার চুপ রয় ইভানা। অনিমেষ চেয়ে রয় কিছুদূরেই দূর্বাঘাসে জড়িয়ে থাকা কবরের দিকে।
অভিমানী গলায় বলে-
”
সেদিন বসন্ত ছিল।
যেদিন,পৌষের রাত্রিতে
ঘন কুয়াশার স্পর্শও
তোমায় আমায় উষ্ণ রেখেছিল।
সেদিনও বসন্ত ছিল।
যেদিন,হিমালয়ের বরফ
গলতে গলতে নিঃশেষ হয়েছিল।
অথচ,আমাদের নাতিশীতোষ্ণতায়
এক বিন্দু ঘাম ঝরেনি।
সেদিনেও বসন্ত ছিল।
যেদিন, বর্ষার গাল ভর্তি জল
পুরো পৃথিবীকে ভাসিয়ে ছিল।
অথচ, তুমি আমি?
ঠাঁই একপায়ী ছিলাম
দুজন দুজনকে জড়িয়ে।
সেদিন গুলোতে বসন্তই ছিল।
যেদিন, কোকিলের আওয়াজ ছিল না
ছিলনা ফুলের মেলা।
অথচ, আমাদের জোড়ালো কণ্ঠ
পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছিল।
স্পর্শে সৃষ্ট কোমলতার গন্ধ
সুরভীর শুভ্রতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
সেদিন যে বসন্ত ছিল,
তুমি ভুলে গেছ প্রিয়?”
সমাপ্ত।